STORYMIRROR

Sourya Chatterjee

Tragedy Classics

4  

Sourya Chatterjee

Tragedy Classics

স্বপ্নপূরণ

স্বপ্নপূরণ

5 mins
257

-   সোফাটায় গিয়ে বসে পড়, যা।

ডাইনিং চেয়ারগুলো ডিঙিয়ে সোফাটায় গিয়ে কোনোরকমে বসলাম। তাও, জায়গার বড্ড অভাব। সেই অর্থে বলতে গেলে লোকাল ট্রেনের সিটে চতুর্থ জন যেরকম বসে অনেকটা সেরকম ভাবেই বসলাম।

-   চিন্তা করিস না। সব বাঁধা আছে ঠিকঠাক। তুই শুধু সাইকেলটা ধরে বোস।

-   আচ্ছা বাবা!

-   বন্ধ করে দিলাম।

ম্যাটাডোরটার পেছনের হুডটা বন্ধ করে দিল বাবা।

বাবার মুখে একটা হাসি লেগে আছে। স্মিত কিন্তু গাঢ়! স্বপ্নপূরণের হাসি। অনেকদিন পর বাবাকে কেমন যেন চিন্তামুক্ত লাগছে। 

রথতলার এই মোড়টায় সাদা সাদা রঙের যে বাড়িটা, ওটাতে আমরা থাকি। ওহ! না মানে থাকতাম। ভাড়া থাকতাম। আজ তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যাচ্ছি ওখান থেকে। বাবা নতুন ফ্ল্যাট কিনেছে সল্টলেকে। আজ থেকে নতুন ফ্ল্যাটের বাসিন্দা আমরা। মা আর বোন আগেই চলে গিয়েছে। এখন এই ম্যাটাডোরটা করে বিছানাপত্র আর আরো কিছু টুকটাক জিনিসপত্র নিয়ে আমরা রওনা হলাম।

সৃজনকাকু সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি পরে হাত দুটো জড়ো করে দাঁড়িয়ে আছেন। বাবা ওনার কাছে গিয়ে ওনার হাত দুটোকে ধরে হেসে ঘাড় নাড়ল।

-   সৃজনদা, আসি তবে?

-   আসুন। আসবেন কিন্তু আবার। 

-   অবশ্যই অবশ্যই। আর টাকা পয়সা কিছু বাকি নেই তো?

-   দাদা, আপনিও না! আপনার মত ভাড়াটে পাওয়া চাট্টিখানি কথা নাকি! কখনো মাসের দু তারিখে ভাড়া দেননি। সবসময় এক তারিখেই মিটিয়ে দিয়েছেন।

-   আসি সৃজনদা। ওদিকে আবার গোছগাছ করতে হবে। গৃহপ্রবেশে বৌদিকে নিয়ে না আসলে খুব দুঃখ পাব কিন্তু।

-   আসুন। অবশ্যই যাব। 

ম্যাটাডোরে ড্রাইভারের পাশের সিটটায় উঠে বসল বাবা। 

আমার সমস্ত বন্ধুবান্ধবদের দেখি নিজস্ব ফ্ল্যাট। কত সুন্দর সাজানো গোছানো! আর সেখানে আমাদের এই ভাড়া বাড়িটা একদমই বেমানান। বন্ধুদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করতেও লজ্জা লাগে।কি ভাববে ওরা! আমি, মা, বোন অনেকদিন ধরেই বাবাকে বলছিলাম ফ্ল্যাট নেবার কথা। শেষমেষ নেওয়া হল। এবার আমরা আমাদের মত করে ফ্ল্যাটটাকে সাজাবো। কাল অবধি খুব আনন্দে ছিলাম, কিন্তু এখন কি হল কি জানে! খুব খারাপ লাগছে। কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে বাঁ চোখের কোণে জলও আবিষ্কার করলাম। চোখের জল কি আর হবে! মনে হয় না। ঘামই হবে হয়তো।

যখন বাড়িটায় এসছি, তখন আমি সবে পাঁচ আর বোনের বয়স দুই। তারপর তেরোটা বছর এই রথতলার ভাড়া বাড়িতে থেকেছি। কত স্মৃতি হুড়মুড়িয়ে মনের ভিতর এসে হানা দিচ্ছে কি বলব! সৃজন কাকু আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো। আমি হাত নাড়ার জন্য হাতটা তুললাম, কিন্তু নাড়তে পারলাম না। হাসলাম, কিন্তু নিজে থেকে হাসিটাও মিলিয়ে গেল মুহূর্তমধ্যে। 

ম্যাটাডোরটাকে স্টার্ট দিল ড্রাইভার। বাবা জানলা দিয়ে মুখ বার করে পেছনে আমার দিকে তাকিয়ে বলল

-   হা! হা! বাবু, নতুন ফ্ল্যাট!!

নতুন ফ্ল্যাটের স্বপ্নটা বাবার ছিল না। ছিল আমাদের – মায়ের, বোনের আর আমার। আমাদের স্বপ্নটা অবশেষে পূরণ করতে পারছে বলেই বাবা আজ এত খুশি বোধহয়। 

তপন কাকু গলির মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মুখটা গম্ভীর। বাবা ম্যাটাডোরটা থামাতে বলল।

-   ত—পন, চললাম রে।

-   আসুন। জানিনা এবার থেকে আর পাড়ায় কালীপূজোটা করতে পারব কিনা! আপনি একা হাতেই তো সব সামলাতেন।জানিনা! ভালো থাকবেন ।

-   আরে হবে হবে, সব হবে। কালীপুজোর ভোগ খেতে ঠিক চলে আসব। আমাদের গৃহপ্রবেশে এসো কিন্তু। আসি।

আবার স্টার্ট দিল ম্যাটাডোরটা। গলি থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠতে আরো কিছুটা পথ যেতে হবে। তপন কাকুকে টাটা করে এগিয়ে গেলাম। বিদায়বেলায় তপনকাকুর ও চোখদুটো ঝাপসা মনে হল। 

গলিটার মুখে টমি শুয়ে আছে, নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। প্রতি রাত্রে ওকে খেতে দিতাম। আজ রাতেও আমাদের বাড়িটার সামনে গিয়ে কুইকুঁই করে খাবার চাইবে হয়ত। আমাকে না দেখতে পেয়ে প্রচুর অভিমানও করবে। জানি আমি। যদিও সৃজনকাকু কথা দিয়েছেন রোজ খেতে দেবেন, তবুও খুব কষ্ট হচ্ছে। ভাগ্যিস ঘুমাচ্ছে, তা না হলে ওকে বিদায় জানাতে আরো কষ্ট পেতাম হয়তো! উপরে খোলা আকাশের দিকে তাকালাম। সবকিছু যেন ধূসর হয়ে যাচ্ছে। 

এই গলির মোড়, এই পাড়া! কোনো কিছু আর আমার নিজের থাকবে না! এতটা কষ্ট হবে সত্যিই ভাবিনি। বুকের ভেতরটায় কান্নারা কেমন যেন দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। বাবা কি করে এত নির্বিকার কে জানে! আমার থেকে আরো কত বেশি বাবা পাড়ার সাথে যুক্ত ছিল! হিসেব মিলছে না কিছু। নির্বিকার কণ্ঠেই বাবা জিজ্ঞেস করল

-   বাবু!

-   হুমম বাবা?

-   মা রা ঠিকঠাক পৌঁছে গেছে তো?

-   হুমম ! ফোন করেছিল। 

-   বেশ বেশ! আজ দুপুরে অনলাইনে খাবার অর্ডার করিস কিন্তু। বিরিয়ানি খাব। ছোট করে সেলিব্রেট না করলে হয়!

আমি ঢোক গিলে উত্তর দিলাম 

-   আচ্ছা।

“আছে নিগো লোহা ভাঙা টিন ভাঙা” করতে করতে টিন ভাঙা লোহা ভাঙা কাকু পাশ দিয়ে যাবার সময় বাবাকে দেখে ভাঙাচোরা দাঁত নিয়ে প্রাণ খুলে এক গাল হাসি হাসল। বাবাও মুখের সেই হাসিটা ধরে রেখে দু হাত জড়ো করে নমস্কার করল। 

ছোটবেলা তখন বাবা খুব একটা রোজগার করত না। মা তখন একটা সেলাই মেশিন কিনেছিল, ব্লাউজ বিক্রি করে কিছু রোজগারের জন্য। সেই মেশিনটা নতুন ফ্ল্যাটের সাথে ঠিক মানানসই হবে না বলে এই লোহা ভাঙা টিন ভাঙা কাকুকে আমরা বিক্রি করে দিয়েছি। আমার ছোটবেলার সাইকেলটাও বা নতুন ফ্ল্যাটে কোথায় রাখবো! ওটাও কাকুকে বেঁচে দিয়েছি কাল। তাই হয়তো আজ বাবাকে দেখে এরকম প্রাণ খোলা হাসি হাসল। বিক্রি করে দেবার সিদ্ধান্তটা বাবার ছিল না। আমরা সবাই মিলে প্ল্যান করেই বিক্রি করেছিলাম। কিন্তু যখন সব হিসেব মিটিয়ে ওই সব জিনিসপত্র নিয়ে চলে যাচ্ছিল কাকু তখন খুব খারাপ লাগছিল। জিনিসগুলোকে অতটা আপন হয়ত ওই প্রথমবারের জন্য মনে হয়েছিল। ঠিক যেমন আমাদের বাড়িটা, পাড়াটা, সৃজন কাকু, তপন কাকু, টমি এমনকি গাছগুলোকে পর্যন্ত এতটা আপন এই মুহূর্তে প্রথমবারের জন্য মনে হছে।

-   বাবু? এই বাবু?

বাবার গলার স্বর পেয়ে একবার গলা খাকারি দিয়ে বললাম

-   হ্যাঁ গো বাবা!

-   এই, ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলি না “শিফটিং টু আওয়ার নিউ ফ্ল্যাট” লিখে? একটা সেলফি তুলে দে দেখিনি। ও, তুই তো ওভাবে সাইকেলটা ধরে বসে আছিস। আচ্ছা! ফ্ল্যাটে পৌঁছে ছবি তুলব। কেমন!

আমার বাবা ছবি তোলা, ফেসবুক - এসব থেকে শত হস্ত দূরে থাকে। সেই বাবা নিজে ছবি তুলতে বলছে, ফেসবুকে দিতে বলছে, এমন ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে, যেখানে আমার চোখে বারবার জল চলে আসছে। কি করে পারছে বাবা! কিছু হিসেব সত্যিই হয়তো মেলে না এভাবে। 

গলি পেরিয়ে পাড়া পেরিয়ে বড় রাস্তার মোড়ে সিগন্যালে ম্যাটাডোরটা থামল। পেছনটা ঠিক যেন একটা সিনেমার পর্দার মত লাগছে! যেখানে যেন আমার ছোটবেলাটা সিনেমারূপে চিত্রায়িত হচ্ছিল। এখন শেষ দৃশ্য চলছে। আর কিছু সেকেন্ডের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে সিনেমাটা।

একটা স্কুটার এসে ম্যাটাডোরটার পাশে এসে থামল। একজন অল্প বয়সী লোক, বাবার থেকে বছর তেরো চোদ্দ ছোট হবে। বাবাকে জিজ্ঞেস করল

-   দাদা, রথতলার মোড়টা কোনদিকে বলতে পারবেন?

-   ওই দিকে আরেকটু গেলেই পাবেন।

-   ধন্যবাদ। চিনিনা তো! ওখানে সৃজন দত্ত বলে একজন ভদ্রলোকের কাছে যাব। ওনার বাড়ির একতলাটা ভাড়া দেবে বলে শুনলাম। তাই আর কি কথা বলতে যাব।

হকচকিয়ে উঠে ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। লোকটা আমার ছোটবেলাটাকে কিনে নিতে এসেছে। তাই না?


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy