স্বপ্ন সমাধি
স্বপ্ন সমাধি


লাবনী আজ সকাল সকাল বিছানায় ছেড়েছে, রোজ দিনের অলস রাজকন্যা আজ সকালে সেজেছে কদম সাজে! হলুদ শাড়ীতে নিজেকে মেঘের অনন্যা করে পথে দাঁড়িয়েছে ট্যাক্সি ধরবে বলে! আজকাল শহরের মানুষের আয় বেড়েছে, আগে যেখানে ট্যাক্সিচালকগুলো অপেক্ষায় দাড়িয়ে থাকতো, আজকাল তাদের মিনতি করতে হয়!
মেঘ, অনেক দিনের চেনা মেঘকে আজ অন্যভাবে জানবে লাবনী! এতোদিন ভালোবাসা থেকে সঙ্গম সব ছিলো মুঠোফোনের খাঁচায় বন্দি, আজ সেটা মুক্ত আকাশে পাল উড়াবে! সময়ে বদলেছে সব কিছুই, মেয়েবেলার সেই পিতৃশুন্য ঘরে যুবতী মাকে দেখে দেখে লাবনী শিখেছে কি করে বাঁচতে হয় এই হায়েনার সমাজ জঙ্গলে! নিজের চোখের সামনে মাকে অনেকবার আপন জেঠুর কাছে ধর্ষিতা হতে দেখে দেখে, সেই সয়ে যাওয়া মায়ের চোখে চোখ রেখে লাবনী বুঝেছে পেটের ক্ষুধা হচ্ছে স্রষ্টার চেয়েও শক্তিশালী! তারপরও লাবনী যখন মাকে দুহাত তুলে দেবতার কাছে কাঁদতে দেখে, তখন মায়ের জন্য নয়, বরং মায়া হয় সেই দেবতার জন্য! বিচিত্র জীবন বটে! মনের এলোমেলোর ভাবনাটায় ছেদ দিয়ে একটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়িয়ে সামনে হাঁক দিলো, কিছুটা অবাক হলেও লাবনী আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ঝটপট উঠে গেলো! দুইবার ইতিমধ্যে মেঘ ফোন দিয়ে দিয়েছে, সম্ভবত ও এসে গেছে ।
মেঘ, লাবনীর মেঘ, খুব যত্ন করে লাবনী তার মেঘকে নিজের মতো তৈরি করেছে! রাতের পর রাত কি মুগ্ধতায় না কেটেছে দুজনের কত শত কথামালায়! মনের অনেক আকুতি যখন শরীরে গিয়ে আছড়েছে, তখনও মেঘকে লাবনী অদৃশ্য থেকে প্রেম দিয়েছে, কিন্তু কখনো দৃশ্যপটের সামনে আসেনি! অবশ্য শত অভিমানে মেঘও কখনো অভিযোগ করেনি, শুধু প্রত্যাশী হয়ে প্রেমিক বনেছে লাবনীর, আর এজন্যই লাবনী সব ভুলে আজ মেঘের কাছে যাচ্ছে, নতুন করে একটা পৃথিবী শুরু করবে বলে!
ভাবতে ভাবতে প্রচন্ড শীতেও লাবনী হঠাৎ ঘেমে উঠলো! এক অজানা আশংকায় মনের কাঁপন শরীরে ছড়ালো! তবুও স্বপ্ন সবসময় সুন্দর হয়, তার চেয়ে বেশী সুখ হয় যখন সেই স্বপ্ন বাস্তবের হাসি হাসতে চলে! শহরের ট্রাফিক ঠেলে আর অপেক্ষার ইচ্ছে হয় না লাবনীর, বারবার তাড়া দিতে থাকে ট্যাক্সিচালককে!
প্রায়ই দুপুর বেলার এই পথটাতে ভীষণ ট্রাফিক থাকে, মনে হচ্ছে রুপকথার পাখাটা আজ সত্যি হলে খুব ভালো হতো, এক উড়ে যাওয়া যেতো মেঘের কোলে! সব ফেলে আবার ডুবতে ইচ্ছে করছে মেঘের ভাবনায়! ভালোবাসায় ভাবনাতেও কতো সুখি হওয়া যায়! এই জীবনকে অনেক ছাড় দেয়া হয়েছে, এবার নিজেকে একটু সুখী করার সময় এসেছে! নিঃসঙ্গ মাঝরাতে মাকে অনেক দেখেছে কাঁদতে, আর নয়, এবার মাকে একটু হাসতে দেখতে চায় লাবনী! সময় যখন ডানা মেলে সামনে আসে তখন তাকে ধরতে জানতে হয়! এই বাজারে মেঘ ছেলে ভালো, ধনী বাবার ছোট ছেলে, আদর সোহাগে বড় হলেও আজকাল বাবার ব্যবসায় মন দিয়েছে লাবনীকে ভালোবেসে! লাবনী ও দেখতে নেহাৎ খারাপ নয়, পাড়ায় ছেলে বুড়োরা বেশ কামনায় তাকায়, মন্দিরের কাকু তো শ্যামা সুন্দরী বলে ডাকেন, বলেন "নারে, তোর চোখে যে দেবী আছেন" ! লাবনী শুনে হাসে, খুব জানা হয়েছে এই পূজারীকে, আশির্বাদ করতে গিয়ে বুকে হাত বুলাতে উনি খুব ভালোবাসেন, লাবনীও কিছু বলে না, মৃদু হেসে আস্কারা দেয়, তাতে সেই পুরোহিতের কি সুখ! হাহাহা, বাঁদরের দুনিয়াতে মানুষ কই আর? তবে মেঘের বুকে নিজেকে আদরে ঢাকতে লাবনীর খুব সাধ, মুঠো ফোনের মাঝে যে আদর, তাতেই যে মাদকতা, আসল প্রেম ছাড়া যে শরীর জাগে তাতে মৃত আত্মা বাস করে! ভালোবাসা অনুভবে বাঁচে! আজ মেঘের সাথে কথা বলে সংসারী হওয়ার আর্জি জানাবে লাবনী! লাবনীও জানে, মেঘও তাই খুব চায়!
ভাবতে ভাবতে কখন যে চলে এসেছে সুখের ঘরে, খেয়ালই হয়নি, মন ফিরলো চালকের ডাকে, "দিদিমনি নামুন", ও হ্যা, বাস্তবে ফিরে লাবনী ঝটপট ভাড়া মিটিয়ে নেমে গেলো। তাড়াতাড়ি মেট্রোর সামনে ছুটে যেতে চাইলো লাবনী, হাজার মানুষের চলার ভিড়ে নিজেকে তুলোর মতো ওজনহীন করে ছুটে চললো মেঘের লাবনী!
ঠিক ঠিক হলুদ টিশার্ট পরে মেঘ দাড়িয়ে, এক গুচ্ছ কদম হাতে! মুগ্ধ হয়ে থমকে তাকিয়ে রইলো লাবনী, এই শীতেও কদম পেলো কোথায় এই যুবরাজ? ভালোবাসা বুঝি একেই বলে! চোখ ছল ছল করে লাবনীর খুব ইচ্ছে করলো এই জন অরণ্যে চিৎকারে মেঘকে ডাকতে! ঘেমে, কেঁপে লাবনী হলুদ পরী হয়ে মেঘের সামনে দাঁড়ালো অবশেষে!
মেঘ যেন শুন্যে মেলালো, আচমকা একটা ধাক্কায় দুজনেই পাথর হয়ে গেলো যেন! শুধু অস্ফুট শব্দে মেঘ একবার বলে উঠলো, "তুমি?" লাবনীর চোখ ভেজা মুখে শুধু তাকিয়ে রইলো মেঘের লাল চোখে! অনেকটা সময় পেড়িয়ে গেলে, লাবনী নিজেই ভাঙলো শব্দের দেয়াল! কাঁপা গলায় অস্ফুট শব্দে বলে উঠলো "মেঘ, তুমি যদি না চাও, আমি তোমায় জোর করবো না"। উত্তরে লাবনীর মেঘ ভয়ংকর অভিমানে সজোরে আঘাত করলো লাবনীর অশ্রু অধরে! চিৎকার করে বলে উঠলো, "রাতের মেয়ে হয়ে তুই কি করে ভাবলি এটা"?
লাবনী আর পারলো না, এক ছুটে পালিয়ে মিশে গেলো জন স্রোতে! এলোমেলো মনে, চোখ ভর্তি এক মেঘ বর্ষা নিয়ে দ্রুত মিশে যেতে চাইলো মানুষের মাঝে! ছুটতে ছুটতে শুধু মনে মনে বললো, "শোন মেঘ, তোমাকে আমি ক্ষমা করলাম, আমি জানতাম না শতজনের মাঝে তুমিও আমার এই নোনা শরীরের একজন ধনী খরিদ্দার ! টাকায় কেনা শরীরে কখনো ভালোবাসার আদর ছোঁয়া পরে না, এটা আমি জানি, মেঘ! তুমি ভালো থেকো শুধু"! ছুটতে গিয়ে হুট করে পথচলা মানুষের ধাক্কায় লাবনী পরে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিলো! আজ যে লাবনীকে থামলে চলবে না,সামনে অনেকটা পথ যেতে হবে, অন্তত মা যতদিন বেঁচে আছেন, ততোদিন তো বাঁচতেই হবে! এক জীবনে হাজার বার ধর্ষিতা মাকে আর মনে ধর্ষিতা হতে দিতে চায় না লাবনী! এই ইট কাঠের শহরের এক টুকরো মেঘের স্বপ্নে হারিয়ে যাওয়া নারী, রাতের রাজকন্যা হয়ে আবার শুরু করলো তার জীবনের শেষ সময়ের যাত্রা, যার সাক্ষী হয়ে রইলো শুধু শহরের পথে ধুলো উড়ানো জন অরণ্যে এক খণ্ড জড় মানব স্রোত! পেছনে পরে রইলো শুধু এক স্বেচ্ছা ধর্ষিতার অশ্রু সুখের আকুতি !