Sourya Chatterjee

Tragedy Fantasy Others

4.5  

Sourya Chatterjee

Tragedy Fantasy Others

স্বার্থপর

স্বার্থপর

6 mins
250


আজ অটোগ্রাফ নেবার জন্যও তেমন ভিড় নেই। বড্ড অসন্তুষ্ট হল রূপ। শো-তেও অডিটরিয়াম অর্ধেকের বেশি ফাঁকা, হঠাৎ করে হলো টা কি! রকস্টার রূপের শো-তে যেখানে ভিড় উপচে পড়ে, তিলধারণের জায়গা থাকে না সেখানে দর্শকদের এরকম কম উপস্থিতি কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছে না রূপ। ঠিকঠাক প্রচার করতে না পারার দায় কর্তৃপক্ষের ঘাড়ে চাপিয়ে নিজের গাড়ি নিয়ে সশব্দে অডিটরিয়াম ছাড়ল রূপ। কিন্তু মেইন-গেটের কাছে এত মিডিয়া! যাকগে! তাও মিডিয়া কভারেজ ভালো পাওয়া যাচ্ছে। কিছুটা আস্বস্ত হলো রূপ। জানলার কাঁচ নামাতেই সাংবাদিকরা এমন প্রশ্ন করল তার জন্য সত্যিই প্রস্তুত ছিল না ও।

-   রূপ, একাধিক সূত্র থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছে মৃন্ময় অধিকারী আপনার বাবা। তথ্যটি কি সঠিক!

মানে! এরা কি করে জানলো? এত বছর ধরে একটা লুকিয়ে রাখা সত্যকে কি করে জানলো সংবাদমাধ্যম! এ তো বিনা মেঘে বজ্রপাত! এতদিন ধরে যতটুকু সুখ্যাতি অর্জন করেছে রূপ, এই একটা খবরই সেই সুখ্যাতিকে ভেঙেচুরে চুরমার করে দেবার জন্য যথেষ্ট। নিজেকে সামলে নিয়ে রূপ উত্তর দিল

-   হোয়াট! হোয়াট আ ননসেন্স কোয়েশ্চেন! আস্ক সাম ভ্যালিড কোয়েশ্চেন।

-   আমাদের কাছে নিশ্চিত খবর আছে মৃন্ময় অধিকারী আপনার বাবা। কিছু বলুন এ ব্যাপারে।

-   সরি।

জানলার কাঁচ তুলে নিয়ে সাংবাদিকদের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে গেল রূপ।

-   মম, মিডিয়া কি করে আঁচ করল যে মৃন্ময় অধিকারী আমার বাবা! 

ঘরে ঢুকেই মায়ের কাছে কৈফিয়ত চাইল রূপ। রূপের মা কৃষ্ণা দেবী তখন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। 

-   তোর বাবার শরীরটা খুব খারাপ। হাসপাতালে ভর্তি। কিছু দরকারে আমার ফোন নম্বরটা হাসপাতাল থেকে চায়। আমি দিয়ে ফেলেছি রে। সেখান থেকেই ওরা কিছু লিংক পেয়ে গেছে।

-   তুমি আমার ক্যারিয়ার টা পুরো শেষ করে দিলে মা ওই বেইমান লোকটার জন্য। ডু ইউ নো দ্যাট! 


রূপের গলা থেকে হতাশা ঠিকরে বেরোচ্ছে। কৃষ্ণাদেবীর চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে। দরজার পাশের পর্দাটাকে শক্ত করে বুকের মধ্যে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন উনি। অসুস্থ স্বামীর প্রতি নিজের ভালোবাসা আর নিজের ছেলের ক্যারিয়ার, এই দুইয়ের দ্বন্দ্বের মধ্যে পরে আজ সত্যি ওনার মত অসহায় আর কেউ নয়।

রূপ সদ্য নাম করেছে, ভালোই প্রোগ্রাম পায়। এই রূপকে নিজের শখ-আলহাদ সব বিসর্জন দিয়ে নিজের হাতে একা মানুষ করেছেন কৃষ্ণাদেবী। রূপের প্রাথমিক সংগীত শিক্ষাও মায়ের হাত ধরেই। রূপও মায়ের এই আত্মবলিদানের যথেষ্ট মর্যাদা রাখার চেষ্টা করেছে। সম্পূর্ণ রোজগারটাই মায়ের হাতে ভক্তি ভরে, সস্নেহে তুলে দেয় রূপ।

নিজের ঘরে ঢুকে দরজাটা ছিটকিনি দিয়ে বন্ধ করল রূপ। রাগে অপমানে অসহায়তায় তার চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। গিটারটার উপর সেই রাগের বহিঃপ্রকাশ দেখিয়ে মেঝেতে আছাড় মেরে ফেলে বাইরের জামাকাপড় পরেই নিজে বিছানায় শুয়ে পড়ল ও। বাড়ির প্রত্যেকটা কোণায় কোণায় তখন যেন সময়ের কাঁটা স্তব্ধ হয়ে আছে। পাশের বাড়ি থেকে টিভির শব্দ ভেসে আসছে। খবর চলছে তাতে। "ভীরু, কাপুরুষ, স্টোওয়ে মৃন্ময় অধিকারী আবারও খবরের শিরোনামে। গুরুতর অসুস্থ হয়ে মৃন্ময় অধিকারী ভর্তি শহরের এক বেসরকারি হাসপাতালে। তার থেকেও বড় খবর পরিবারসূত্রে খবর পাওয়া গেছে রাইসিং রকস্টার রূপ মৃন্ময় অধিকারীর পুত্র। সেই খবর পাবার পর রূপের শো-ও বয়কটের ডাক দিয়েছে দর্শকবৃন্দ"।


-   মা, বাবাকে কেন সবাই কাপুরুষ বলে?

অনেক বছর আগে মায়ের কোলে বসে মাকে প্রশ্ন করেছিল ছোট্ট রূপ। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে কৃষ্ণাদেবী উত্তর দিয়েছিলেন

-   বাবা অন্যায় করেছিল সোনা। তাই। 


তারপর থেকে আস্তে আস্তে বিভিন্ন জায়গায় নানান কায়দায় বাবার সম্মন্ধে জানতে চেয়েছে রূপ। দেখেছে বাবার নাম নিতেই লোকজনের চোখেমুখে একরাশ ঘৃণা, ক্রোধ দানা বেঁধেছে। তবে মায়ের কথা মতন ছোট থেকেই কারোর কাছে নিজেকে মৃন্ময় অধিকারীর ছেলে বলে পরিচয় দেয়নি রূপ। যখন আরেকটু বড় হল একটা পত্রিকা থেকে সত্যিটা জেনেছিল সে। তারপর থেকে মায়ের কথা মতন নয়, স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানেই পিতৃপরিচয় গোপন করে গেছে রূপ। 


মৃন্ময় অধিকারী, রূপের বাবা ছিলেন দেশের এক উচ্চপদস্থ মিলিটারি-ম্যান। কিছু ট্রেনিংয়ের জন্য বছর পঁচিশ আগে তাকে রাশিয়া যেতে হয়েছিল। ছয় মাসের ট্রেনিং শেষ হবার পর 'সোফানিয়া' নামক জাহাজে চড়ে আবারও দেশে ফেরার জন্য রওনা হয়েছিলেন মৃন্ময়বাবু। মাঝসমুদ্রে হটাৎই একটা ডুবো পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে জাহাজ ফুটো হয়ে জল ঢুকতে আরম্ভ করে। জাহাজ ডুবে যাবে নিশ্চিতরূপে। লাইফবোট এনে শুরু হয় উদ্ধারকাজ। মৃন্ময়বাবু বাকি যাত্রীদের মতোই খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। গোটা জাহাজ জুড়ে তখন "গেল গেল" রব। উপরের ডেকের ইকোনোমিক ক্লাস থেকে তখন যাত্রীদের উদ্ধার কাজ চলছে। সেকেন্ড ক্লাসের যাত্রী হয়েও জাহাজের কর্মকর্তাদের আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে সোজা ইকোনোমিক ক্লাসের ডেকে চলে আসেন মৃণ্ময়বাবু। তখনও মহিলা এবং শিশুদের উদ্ধার কাজ চলছে। অন্ধকারে কে মহিলা, কে পুরুষ তাও বোঝা যাচ্ছে না তখন। সেই সুযোগটাই কাজে লাগালেন মৃন্ময়বাবু। "দশ নম্বর বোটে আরো দুজন মহিলা যাত্রী আসুন" ঘোষণার সাথে সাথেই বোটে সাতপাঁচ না ভেবেই বোটে ঝাঁপ দিয়েছিলেন মৃন্ময়বাবু। দেড় হাজারেরও বেশি লোক প্রাণ হারিয়েছিলেন সেই দুর্ঘটনায়।

যখন দেশে ফিরলেন মৃন্ময়বাবু, খবরের কাগজের পাতায় তার এই কীর্তির কথা ছাপা হয়েছে। দেশের এক উচ্চপদস্থ সৈনিক যার কিনা বিপদের মুখে ঝাপিয়ে পড়ে লোকের প্রাণ বাঁচানোর কথা, সে কিনা নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য এরকম কাপুরুষতার পরিচয় দিল! ছি! চারিদিকে ছড়িয়ে গেল কাপুরুষ আর্মি-ম্যান মৃন্ময়বাবুর নাম। চাকরি তো খোয়ালেনই মৃন্ময়বাবু, তার সাথে সমাজও তাকে বিচ্যুত, একঘরে করে দিল। আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি মৃন্ময়বাবু। বাঁচার তাগিদে মৃন্ময়বাবুকে পরিত্যাগ করল পরিবারও। কৃষ্ণদেবী লুকিয়ে যেটুকু যোগাযোগ রেখেছেন সেটুকুই এখন মৃন্ময়বাবুর বেঁচে থাকার সম্বল।


বিছানা থেকে উঠে জানলার পর্দাটা সরিয়ে আকাশটাকে দেখল রূপ। আজ অমাবস্যা বোধহয়। আকাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার ঠিক তার এখনকার জীবনের মত। সোশ্যাল মিডিয়ার বন্ধুবান্ধবও রূপের পিতৃপরিচয় পেয়ে তাকে ব্লক করে দিয়েছে। কর্মকর্তারা রূপের পরবর্তী সব অনুষ্ঠানও বাতিল করে দিয়েছে এতক্ষণে। কিছু ভালো লাগছে না রূপের। বাবার করা একটা অন্যায়ের বোঝা কেন রূপকে বয়ে বেড়াতে হবে। ও তো কিছু অন্যায় করেনি! কেন এই সমাজ এত অবুঝ! চোখ বন্ধ করল রূপ। ঘরের দেওয়ালগুলো যেন ক্রমশ একটু একটু করে ওকে ঘিরে ফেলছে। কিছু ইচ্ছে করছে না রূপের, বেঁচে থাকতেও না। গোটা ঘর জুড়ে ব্যর্থ স্বরলিপিরা পোড়া সিগারেটের ছাইয়ের মধ্যে নিজেকে ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে।


একটু ঘুম দরকার! অন্ধকারের মধ্যে হাতড়িয়ে স্লিপিং পিল খুঁজতে গিয়ে রূপের পায়ের উপর কি যেন একটা পড়ল। আলো জ্বালালো রূপ। বহু পুরোনো একটা ডায়রি মনে হচ্ছে। কোথা থেকে পড়ল ঠাওর করতে পারল না রূপ। ডায়রিটা হাতে নিয়ে দেখল পাতাগুলো জরাজীর্ণ। মৃন্ময়বাবুর হাতে লেখা ডায়রি। পাতা উল্টাতে উল্টাতে রূপের চোখ গিয়ে পড়ল যে পাতায় সেখানে জ্বলজ্বল করছে তারিখ ৭ই এপ্রিল, ১৯৯০। এই দিন-ই তো সোফানিয়া জাহাজের দুর্ঘটনাটা ঘটে।


কিছু না ভেবে পাতা উল্টিয়ে ডায়রিটা পড়তে শুরু করল রূপ। তার আগের দিন অর্থাৎ ৬ই এপ্রিল, ১৯৯০। মৃন্ময়বাবু লিখছেন "এখন রাত দশটা। ট্রেনিংটা বেশ ভালোই হল। অনেক কিছু শিখলাম ছয় মাসে। বুঝলাম, আমাদের দেশ বেশ কিছু প্রযুক্তিগত দিকে উন্নত দেশগুলোর থেকে পিছিয়ে আছে। যা শিখলাম তা আমাদের সৈনিকদের মধ্যে এবার তাড়াতাড়ি বিতরণ করে দিতে পারলেই আমি আপাতত এক বিরাট দায়ভার থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পাব। তবে যে দায়িত্ব আমি পেয়েছি তাতে আমি খুব খুশি"।

চোখটা ছলছল করছে রূপের। বাবা দেশের প্রতি এতটা দায়িত্ব-পরায়ণ ছিল! আবার পড়তে শুরু করল রূপ।

"আজ জাহাজে চড়লাম। দেশে ফিরছি। পরশুর মধ্যে পৌঁছে যাবে। বাড়ির সব খবরই পেয়েছি। একটু বিচলিত আছি। আশা করি সব ভালো হবে"। 

সোজা হয়ে বসল রূপ। পরের পাতা উল্টালো। এই তো সেই অভিশপ্ত তারিখ ৭ই এপ্রিল, ১৯৯০।

"এখন বিকেল পাঁচটা। সকালে আবহাওয়া ভালোই ছিল। কিন্তু বেলা বাড়ার সাথে সামুদ্রিক ঝড়ের মুখে জাহাজ পড়ে। আমি খুব ভালো অনুধাবণ করতে পারছি কৃষ্ণা গত সপ্তাহে তোমরা কিরকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলে। আমি খবর পেয়েছি গত সপ্তাহের ঠিক এরকমই এক ঝড়ে আমাদের বাড়ির ছাদের একটা অংশ ভেঙে পড়েছে। আমি যে এন.জি.ও টা চালাই সেখানেও একাধিক অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানকার বাচ্ছারা তো আমার আরেকটা পরিবার, ওরাও খুব কষ্টে আছে। আর আমার নিজের বাড়িতে বাবা, মা শয্যাশায়ী। কৃষ্ণা সন্তানসম্ভবা, সপ্তাহ তিন চারেকের মধ্যে আমাদের সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখবে। তোমার কাছে, তোমাদের কাছে আমার পৌঁছানোটা খুব জরুরী। তোমাকে বাঁচাতে, বাবা মা কে বাঁচাতে, এন.জি.ওর বাচ্ছাগুলোকে বাঁচাতে, আমাদের সন্তানকে বাঁচাতে এখন খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছানোটা খুব জরুরী। আসছি কৃষ্ণা। আর একদিন ধৈর্য ধর। ঝড় ঠিক থামবে, দেখো"।


এক নিশ্বাসে লেখাটা পড়ে থামল রূপ। তার চোখ দিয়ে তখন টপটপ করে জল পড়ছে। ডায়রিটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আছে রূপ। বাবাকে কোনোদিনও জড়িয়ে ধরা হয়নি রূপের। এই মুহূর্তে ডায়রিটাকে জড়িয়ে ধরে সেই স্বাদ কিছুটা হলেও মেটাচ্ছে ও। পড়া শেষ হয়নি। আবারও ডায়রিটা খুলল ও।

"এখন রাত সাড়ে এগারোটা। একটা অজানা দ্বীপে রয়েছি। বড্ড অন্যায় করেছি। বড্ড স্বার্থপরের মত কাজ করেছি আমার দুটো পরিবারকে বাঁচানোর জন্য। কোনোদিনও ক্ষমা কোরো না। সব জাহাজে ফেলে এলেও ট্রেনিং মেটেরিয়ালগুলো নিয়েই ঝাঁপ দিয়েছি নৌকায়। জানিনা, সুযোগ পাব কিনা ওগুলো সবার মধ্যে পৌঁছে দিতে। বড্ড অন্যায় করে ফেললাম কৃষ্ণা"।


ডায়রির পরের পাতাগুলো ফাঁকা, ঠিক যেমন এক দমকা হাওয়া এসে মৃন্ময় বাবুর বাকি জীবনটা একদম ফাঁকা করে দিয়েছে। তখন ভোর হচ্ছে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে জানলার গ্রিল ধরে দাঁড়ালো রূপ। গান লিখতে হবে নতুন ভোরের। গান লিখতে হবে অজানা, অচেনা স্বার্থপরতার।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy