STORYMIRROR

Partha Pratim Guha Neogy

Abstract Fantasy Others

3  

Partha Pratim Guha Neogy

Abstract Fantasy Others

স্বাগত বৈশাখ

স্বাগত বৈশাখ

4 mins
167

বৈশাখ এই শব্দটি আমাদের বাঙালিদের অত্যন্ত পরিচিত ও সমাদৃত। মূলত আভিধানিক অর্থে এ শব্দটি এসেছে বিশাখা শব্দ থেকে, বিশাখা থেকে বোশেখ। বিশাখা এক বিশেষ নক্ষত্র ও রাধার অন্যতমা সখী৷ এই বিশাখার মাঝে রয়েছে নক্ষত্রযুক্ত পূর্ণিমা। হিন্দু সম্প্রদায়ের নিকট এটি বিশেষরূপে আকর্ষণীয় ও সমাদৃত।


বাংলা মাসের প্রথম ঋতুর ফসলই হলো বৈশাখ৷ প্রকৃতির ঋতু রঙ্গমঞ্চে অগ্নিমূর্তি ধারণ করেই আসে বৈশাখ। সূর্যের দু'চোখের বহ্নিজ্বালা নিয়ে আর্বিভাব ঘটে রুদ্র বোশেখের। সূর্য কঠিন হারে ছুঁড়ে মারে তার খরতপ্ত অগ্নিবাণ। কবিগুরুর ভাষায়—

"এসো ,এসো,এসো হে বৈশাখ৷

তাপসনিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,

বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক৷"

নিদারুণ এই দহন কালে স্তব্ধ হয়ে যায় পাখ-পাখালি৷দানবরূপী হিংস্র কাল বৈশাখীর রূপও আমরা দেখি। বৈশাখের প্রথম প্রহরে আবার নবোদয় সূর্যের রক্তিম আভার সাথেসাথে চারিদিকে বর্ষ বরণের আহ্বান৷ কিশলয়ের সাথে কোলাকুলি করে নতুন জীবন ও কল্যাণের প্রতীকের রূপেই আসে নববর্ষ। আকাশে-বাতাসে,গ্রামে - গঞ্জে ,প্রকৃতিতে নতুনের বরণ!এ এক আনন্দঘন পরিবেশ! কোথাও বা বর্ষ বিদায় ও বর্ষ বরণের ধূম৷সেই সূত্রে বৈশাখী মেলা নববর্ষ কে উৎসব মুখী করে তোলে৷বাঙালি জাতীয় সত্তার সঙ্গে পয়লা বৈশাখের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়।


পৃথিবীর সবুজ চত্বরে বারটি মাস চক্রাবর্ত্তে ঘুরে ঘুরে চৈতী হাওয়ায় বিদায়ের করুণ সুর বাজিয়ে আসে পয়লা বৈশাখ। ফেলে আসা দিনের কথা ,আজও মনে আঁকিবুকি কাটে৷ আসে বৈশাখ তার ম ম করা নতুন সুবাস ছড়িয়ে৷প্রকৃতি ও মানবের মাঝে নবীন বরণের কত নব নব চেতনা৷ অন্তরের গভীর অনুরাগের বার্তাবাহক বাংলা নববর্ষকে আবাল বৃদ্ধবণিতা ও প্রকৃতি সকলেই সাদরে বরণ করে নেয়। এই দিনটি জাতিসত্তার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে এবং সংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবেও এটি গৃৃহীত। 


মনে পড়ে যায় ছেলেবেলায় আমাদের গ্রামাঞ্চলের পয়লা বৈশাখ বা নব বর্ষ উৎসব কেমন ছিল৷মনে পড়ে সকালে উঠেই ঠাকুমার সাথে আমরা ভাই বোনেরা গঙ্গা নদীতে স্নান করে এসে নতুন কিছু একটা পরে হয়তো বা বেশীর ভাগ সময়েই মেয়েরা মায়ের হাতের ফুল কাটা টেপজামা আর দাদারা নতুন গেন্জি প্যান্ট গায়ে একটু সাজুগুজু করে কুলদেবতা ধর্মরাজ ও গ্রাম দত্যি থানে প্রণাম সেরে নাচতে নাচতে বাড়ী ফেরা ও তুলসী তলায় প্রণাম সেরে দাদু-দিদিমণি ও বাবা -মাকে ও বড়দের প্রণাম করে রোজকার দুধমুড়ি,ছানা মুড়ির পরিবর্ত্তে সুস্বাদু লুচি আলুর দম ও পায়েস-রাজভোগ,দানাদার ইত্যাদি বিভিন্ন মিস্টি সহযোগে জবরদস্ত জলখাবার খেয়ে আবার দিদিমণির সাথে গোপাল বাড়ী ও শিব-বাড়ী,গোঁসাই ঠাকুর ও গোসাঁই প্রণাম ও মঙ্গল প্রার্থনা করে কলকল করতে করতে বাড়ী ফেরা৷


রহিম চাচার দোকানে বিশালকায় খাঁসি কাটা ও লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে বাবার অপেক্ষায় থাকতাম ও বাবা পাওনা গন্ডা চুকোলে আবার বাবার সাথে বাড়ী ফেরা৷এবার সে সকালবেলা থেকে সন্ধ্যেবেলা যেন সম্পূর্ণ আমাদের নিজস্ব৷সাংস্কৃৃৃতিক দিকটা বজায় রাখবে গ্রামের কচি-কাঁচা ও যুবা সম্প্রদায়৷তাই বড়দের নির্দেশে প্রায় প্রত্যেকেই আমরা ছুটতাম বাড়ী বাড়ী ভাল কাপড় ও চাদর,শতরঞ্চি সংগ্রহে৷বরাবরই আমার দাদুর বৈঠকখানা ঘরের বিশাল চৌকিটা আমাদের স্টেজ হতো৷


সে কি উচ্ছ্বাস আমাদের৷ কাগজের ফুল বানাতো সব দাদারা , দিদিরা , পিসি, সব আল্পনা আঁকা স্টেজ সাজানো ইত্যাদির কাজ করতো। আমরা এরই ফাঁকে ফাঁকে মিস্টি খাবার লোভে বাড়ী বাড়ী গিয়ে ঢুপঢাপ বড়দের প্রণাম সেরে কোথাও মুড়কি মিঠাই খেয়ে বেড়াতাম। মনে পড়ে আমাদের রির্হাসাল দেওয়াতো আমাদের জ্যাঠার বাড়ীতে জেঠীমা, দিদিরা ও দাদারা। নাটক, গান, আবৃৃৃত্তি, প্রতিযোগিতা মূলক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মহড়া দিয়ে দুপুরে যে যার ঘরে ফেরা ও খাঁসির মাংস দিয়ে ভাত খাওয়া ও মায়ের নির্দেশানুযায়ী ঘুম দেওয়া যাতে রাত্রে ভাল করে অংশগ্রহণ করতে পারি।


বিকেলে ঘুমিয়ে ওঠার পর বাবার সাথে মুদি দোকান, মিষ্টির দোকানে নববর্ষের হালখাতা উদ্বোধন উপলক্ষে যাওয়া, সেখানেও শরবত, বালুসায়, জিলিপি প্রভৃতি খেয়ে ভাইবোনেরা ধেই ধেই করতে করতে বাড়ী ফেরা। হাত পা ধুয়ে সন্ধ্যে বাতি দিয়ে ও" ভবসাগরতারণ " গুরুবন্দনা করে মায়ের কাছে সাজুগুজু সেরে ভাল জামাকাপড় পরে ,চুলে লাল ফিতে বেঁধে দে ছুট পাড়ার মাঝখানের বেল তলায়। গ্রাম আলোকিত করতো সেই বিখ্যাত হ্যাজাক লাইট, তার পাশে আমরা কেমন মাছির মত ভনভন করে ঘুরে বেড়াতাম ! কখন এসো হে বৈশাখ কোরাস গান গাইবো এই ছটফটানি!


গ্রামের মানুষ গুলোর একঘেয়ে জীবনে আসে আনন্দের বন্যা। ভিন্ন সাজে সাজিয়ে সবাই নিজেকে সাজায় ও নিজের নিজের ঘরের দরজায় আমপল্লব দিয়ে লক্ষীদেবীর আগমন হেতু ঘর সুসজ্জিত করতেও ভুলতোনা। সাথে রাত্রে মেয়েরা নিজেদের হাতে গাঁথা বেলফুল ও রজনীগন্ধার মালা খোঁপায় জড়িয়ে সুসজ্জিত করতেও ভুলতোনা। নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে সহজ,সরল জীবনের অনাবিল আনন্দধারার পরিপূর্ণতায় উপচে উঠতো গ্রাম্য সরল মানুষের হৃদয়। সেদিন ছিলনা আভিজাত্যের অহমিকা, ছিল না কৃৃত্রিমতার বিলাসিতা, না ছিল অনুকরণ্যের চান্চল্য।


এভাবেই নববর্ষের নব রবির বিকিরণে পুণ্যস্নান করে সকলে বিগত দিনের ব্যর্থতা,দীনতাও হতাশাকে বিসর্জন দিয়ে দীপ্ত শপথে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞার বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। বাঙালি জাতি যেন তাদের নববর্ষ পালনের এই সুসংহত ঐতিহ্যকে আনন্দ,উৎসাহ ও উদ্দীপনার মাধ্যমে পালন করে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে পারে।


আমাদের রঙ্গমঞ্চের শেষ সমবেত গানটিও ছিল .....

"আলোকের এই ঝর্ণা ধারায় ধুইয়ে দাও —

আপনাকে এই লুকিয়ে রাখা ধুলায় ঢাকা ধুইয়ে দাও৷"


 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract