Sangita Duary

Classics

4  

Sangita Duary

Classics

স্ব-আমি

স্ব-আমি

6 mins
519


ভজাকে সঙ্গে নিয়ে সোনাপল্লীর গোলাপি বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ালেন ষাটোর্ধ্ব সৌদামিনী।

চারপাশটা ভালো করে দেখে চব্বিশ বছরের পুরোনো ভৃত্যকে বললেন, "ঠিক জানিস তো? এই বাড়িটাই?"

এদিক ওদিক উঁকি মেরে খানিকটা আত্মপ্রত্যয়ী ভঙ্গিতে ভজা বলে, "হ্যা, মা, মুকুন্দ দাদা তো সেরকমই বলেছিল।"

- "হ্যা, সেই, এই সময়েই তাকে দেশে ছুটতে হলো।"

মাথা নিচু করে ভজা বলে, "প্রত্যেক বছর মুকুন্দ দাদাই তো কাজটা করে মা, নেহাত মুকুন্দ দাদার মায়ের অসুখ, তাই না সব কাজ ফেলে দেশে ছুটতে হলো!"

- "ঠিক আছে, শুড়ির সাক্ষ্মী মাতাল, যা, দেখ বাড়িতে কেউ আছে কিনা..."

মাথা নিচু করে এগিয়ে যায় ভজা, মনে মনে হাসে, সেই আট বছর বয়স থেকে মুখার্জি বাড়িতে বাপের সাথে এসেছিল ভজা, গিন্নিমা একরকম কোলে পিঠে করেই বড়ো করেছেন তাকে। গিন্নিমা বরাবর এরকম। বাইরে থেকে কঠিন মানুষ, আর ভিতরে এক্কেবারে মা দুর্গা। নাহলে কাজের লোকের সঙ্গে এই বেশ্যা পাড়ায় দুগ্গা পুজোর মাটি আনতে আসেন! প্রতি বছর মুখার্জি বাড়ির মালি মুকুন্দই এই কাজ করে দেয়, এবছর মায়ের অসুখের খবর পেয়ে হঠাৎ দেশে ফেরার জন্য কাজটা বাকিই ফেলে গেছে সে। ভজা বলেছিল, সে একাই কাজটা সামলে নেবে, কিন্তু গিন্নিমা ভজাকে একা ছাড়লেননা, যদি সে হারিয়ে যায়! পথ ভুল করে আর বাড়ি ফিরতে না পারে, গিন্নিমা ভজাকে এখনও সেই ছোট্টটিই ভাবেন। ভাববেন নাইবা কেন, সে ছাড়া গিন্নিমার আছে টা কে?

চার শক্তপোক্ত ছেলে, সবাই বিদেশে, ওই এক পুজো ছাড়া কেউ মুখার্জি বাড়ি মাড়ায় না।

আর এক মেয়ে, সে তো বর মেয়ে সংসার সামলে মাকে ফোন করে খোঁজ নিতেই ভুলে যায়। ছেলেরা মাকে বিদেশ নিয়ে যেতে চাইলেও গিন্নিমা রাজি হননি। এত বড় বাড়ি, এত বছরের ঐতিহ্য সব ছেড়ে গিন্নিমা কিছুতেই ছেলেদের গলগ্রহ হতে রাজি হননি। এই ভজাই গিন্নিমার শেষ বয়সের একমাত্র ভরসা। চব্বিশ ঘন্টা সৌদামিনীর সেবা ছাড়াও, বাড়ি বাগান সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ সবই ভজাই করে। বেশ কিছুক্ষণ কড়া নাড়তে এক মহিলা এসে দরজা খোলে। পরনে লালপাড় সাদা শাড়ি, খোলা ভিজে চুল, বোধহয় পুজো সেরে উঠেছে সবে। সৌদামিনী এগিয়ে আসেন, "এটা কি গোলাপির বাড়ি... মানে, গোলাপি...."

মেয়েটি ঘোমটা টেনে মাথা নিচু করে, "আপনারা...."

এবার ভজা কথা বলে, "আমরা মুখার্জি বাড়ি থেকে এসেছি, ইনি গিন্নিমা, প্রতিবছর মুকুন্দ দাদা এখান থেকে দুর্গাপুজোর মাটি নিয়ে যায়!"

মেয়েটি এবার সম্ভ্রম চোখে তাকায়, "গিন্নিমা! মা'র শরীরটা ভালো নেই, আপনারা ভিতরে আসবেন?"

এতক্ষন রোদে দাঁড়িয়ে সৌদামিনী একটু কাহিলই হয়েছেন, পা আর কোমর একটু বসতে চাইছে। খানিক ইতস্তত করে ভিতরে ঢোকেন সৌদামিনী। পিছনে ভজা।

সস্তার ভাঙা চোরা কয়েকটা চেয়ার। দেওয়ালে অর্ধনগ্ন মেয়েদের ছবি। কোনায় একটা টেবিল। বোঝাই যায় এটাই গোলাপির বুকিং অফিস।

নাক সিঁটকে মেয়েটির পিছু নেন সৌদামিনী। ভিতরে একটা বড় ঘর, মেয়েটি সেখানে বসতে দেয় সৌদামিনীকে।

"আপনারা একটু বসুন, আমি মাকে ডেকে আনছি.." বলেই মেয়েটি বেরিয়ে যায়।

চারপাশটা ঘুরে দেখেন সৌদামিনী। এই ঘরটা যে এই বাড়িরই অংশ এটা বিশ্বাস করা যায় না। বেশ বড় এই ঘরটা, লম্বা একটা গদি বসানো ডিভান। ফুলের নকশা কাটা বালিশও রয়েছে কয়েকটা। ডিভানের চাদর ধবধবে সাদা। জানলার পাশে একটা মা কালির ছবি আঁকা বাংলা ক্যালেন্ডার। মেঝেতে পরিষ্কার লাল রঙের কার্পেট বিছানো। দেওয়ালের গায়ে মনীষীদের ছবি, কোনায় তেপায়া টুলের ওপর মিনাকারী ফুলদানিতে রজনীগন্ধা। সুন্দর একটা ধূপের গন্ধ, মনটা ঠান্ডা হচ্ছে সৌদামিনীর।

একটু পরে গোলাপি আসে। উস্কখুস্কো চুল, অবিন্যস্ত শাড়ি, ঘরে ঢুকে হাতজোড় করে বলে, "কি সৌভাগ্য আমার, গিন্নিমার পায়ের ধুলো পড়েছে আমার ঘরে!"

এমনিতে সৌদামিনী খুব একটা প্রাচীনপন্থী নন, তবে গণিকা কিংবা দেহব্যবসা ইত্যাদির নাম শুনলে মনে খানিক ঘেন্নার উদ্বেগ হয় বৈকি!

তবে এখানে এসে, বিশেষ করে এই ঘরে ঢুকে, সৌদামিনীর মনে কোনো খারাপ লাগা আসছেনা।

"প্রতি বছর, মুকুন্দই মাটি নিয়ে যায়, এবছর ওর মায়ের শরীর খারাপ, দেশে গেছে, তাই আমাকেই..."

গোলাপি করজোড়ে বলে, "মুকুন্দ বাবুর মুখে আপনার নাম অনেক শুনেছি, আজ যেন সাক্ষাৎ দেবী দর্শন করলাম মা!"

'দেবী' শব্দ শুনেই ওই মেয়েটির মুখটা মনে পড়লো সৌদামিনীর, "আচ্ছা, যে মেয়েটি দরজা খুলল, ও কে?"

গোলাপি ততক্ষনে মেঝেতে সৌদামিনীর পায়ের কাছে বসে পড়েছে, "কে, জয়া?"

- "জয়া? তোমার মেয়ে বুঝি?"

বিদ্রুপ হেসে গোলাপি বলে, "মেয়েই বটে মা। নাহলে এই বয়সের এই বেশ্যার কি এত সেবা তোলা ছিল, তাও ওর হাতে?"

সৌদামিনীর কৌতূহলী দৃষ্টি লক্ষ্য করে গোলাপি বলে, "নিজের ইচ্ছেয় কোনো মেয়ে এই ধান্দায় আসেনা মা, আমিও আসিনি। গরিব বাপ সাত সাতটা ছেলে মেয়ের পেটে ভাত জোটাতে না পেরে, আমাকে বিক্রি করে দিলো। সেই কোন সাতবছর বয়সে। ছেলেবেলার পুতুল সংসার ভেঙে খদ্দের খুশি করতাম। খুব ইচ্ছে করতো আপনাদের মত স্বামী নিয়ে সংসার করবো, নুন ভাত খেয়ে বরের পা টিপবো। স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল।

প্রতিরাতে কুকুর শিয়াল শরীরটাকে ছিঁড়ে খেত।

খুব ঘেন্না হত নিজের ওপর। রোজ কাকভোরে গঙ্গাস্নানে যেতাম, যেন কেউ না দেখে, কেউ না আঙ্গুল তোলে। বেশ্যাদের রাতে সোহাগ করলেও দিনের আলোয় ওই ভদ্দরলোকেরাই গায়ে থুতু দেয়।

দিনটা ছিল মহালয়া। ঘাটে নামছি, দেখি, একটি মেয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে, কেমন যেন ঘোরে রয়েছে, দৌড়ে গিয়ে ধরলাম। বাড়ি নিয়ে এলাম, জানলাম, ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিল হতভাগী। বদলে জানোয়ারটা ওকে লুটে পুটে চলে গেছে। ওর পেটে তখন ছ মাসের বাচ্চা। সেই থেকে ও আমার কাছে, আমার জয়া মা। কিন্তু বিশ্বাস করুন মা, একদিনের জন্যও ওকে ধান্দায় নামাইনি। ও যদি আমার পেটের মেয়ে হত, আমি পারতাম ওকে দিয়ে ব্যবসা করাতে?"

সৌদামিনী অস্ফুটে বললেন, "আর ওর সন্তান?"

-" রাজাকে এই নরকে রাখিনি মা, ও হোস্টেলে থাকে। পাঁক না ঘাঁটলেও পাঁকের মাঝেই তো ওর মা ফুটে থাকা পদ্মফুল, ও যদি সেটা না বোঝে, যদি ঘেন্না করে মাকে, তাই ছোট থেকেই ও বাইরে, প্রতিমাসে জয়া মা-ই গিয়ে ওকে দেখে আসে।"

সৌদামিনী করুন চোখে জিজ্ঞেস করেন, "কিন্তু এত খরচ, তোমারও তো বয়স হচ্ছে!"

-" হ্যা, মা, আগের মত আর রোজগার নেই, তার ওপর গেল মাস থেকে শরীরটা টানতে পারিনা।"

কেঁদে ফেলে গোলাপি, " জয়ামাকে কত বারণ করলুম, শুনলোনা, অবশ্য শুনলে কি ছেলের খরচ টানতে পারতো? পেটে বিদ্যে ছিল, অনেকের হাতে পায়ে ধরেছিল একটা কাজ দেওয়ার।

জন্তুগুলো নজর দিয়ে গিলে খেত ওকে।

এক কাপড়ের কলে কাজও পেলো। আমাকে ধান্দা বন্ধ করে দিতে বললো। একদিন অভারটাইমের নাম করে মালিক ওর ইজ্জত লুটলো।

তারপর থেকে আর বাইরে বেরোয়নি জয়ামা।

বাড়িতেই....

খুব কষ্ট হয় আমার গিন্নিমা, ভোর রাতে মেয়েটা যখন শরীরে আঁচড়ের দাগ নিয়ে ঘরে ঢোকে, মনে হয়, মা মেয়েতে বিষ খাই, কিন্তু দাদুভাই, আমরা ছাড়া ওর যে কেউ নেই....!" হাঁটুর ভিতর মুখ গুঁজে কাঁদছে গোলাপি।

সৌদামিনীর চশমার কাঁচ ঝাপসা।

হাতের আঙ্গুল দিয়ে গোলাপির চিবুক তুলে বলেন, "জয়া মা'র হাতের একগ্লাস জল খাওয়াবে গোলাপি? গলাটা শুকিয়ে গেল গো!"

গোলাপির চোখে খুশির ঝিলিক, " আপনি আমার ঘরে জলস্পর্শ করবেন মা? সত্যি? আমি এক্ষুনি বলছি। জয়া মা... মাগো..."

বলে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যায় গোলাপি।

**********

বিসর্জনের বাজনা বেজেছে মুখার্জি বাড়িতে। ছেলে বৌমা, মেয়ে জামাই নাতি নাতনি, প্রতিবেশী মিলিয়ে মুখার্জি বাড়ি সরগরম।

বরণ চলছে মায়ের। একটু পরেই সিঁদুর খেলা শুরু হবে। দাওয়ায় বসে চাতক চোখে কাউকে খুঁজছেন সৌদামিনী।

সদর দরজা খুলে ভজা ঢুকলো। তার পিছনে ঘোমটা মাথায় আরও দুজন স্ত্রীলোক। সৌদামিনী প্রায় দৌড়ে গেলেন, প্রথমজনের হাত ধরে বললেন, "এত করে বলে এলাম, পুজোয় এলেনা কেন? শেষে ভজাকে বললাম তোমাদের ধরে আনতে। এসো, মাকে বরণ করবে।"

ইতস্তত মেয়েদুটোর হাত ধরে টানতেই ঘোমটা খুলে যায়। প্রতিবেশীদের বিস্ময় চোখ, এ কাদের ধরে এনেছেন মুখার্জি গিন্নি!

সবার দৃষ্টি উপেক্ষা করে গোলাপি আর জয়াকে নিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়ান সৌদামিনী, "এই যে মাকে দেখছো, ইনি জাত ধর্ম বোঝেননা, বোঝেন শুধু ভক্তি। আর আমরা পুজো করি দেবীর রূপে শক্তিকে। সেই শক্তির মূর্তি গড়তে তোমাদের ভিটের মাটি ছাড়া চলেনা। যাও মায়ের বরণ সম্পূর্ণ করো।"

থালা হাতে মায়ের সামনে দাঁড়ায় জয়া, মায়ের সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে, জল মিষ্টি মায়ের মুখে লাগিয়ে, নিচে নামে। সামনে সৌদামিনী এবং গোলাপি ,আঙুলে লেগে থাকা মায়ের সিঁদুর লাগিয়ে দিল দুজনকে, প্রণাম করে বললো, "ঠিক বলেছেন গিন্নিমা, আমরা শক্তির পুজো করি, প্রতিমা তো প্রতীক মাত্র, আর সেই শক্তি ছড়িয়ে আছে আপনার মধ্যে, গোলাপি মায়ের মধ্যে। গণিকা বাড়ির মাটির ঋণ শোধ করার শক্তি এবং সাহস একমাত্র দেবীমাই রাখেন, মাটির মায়ের দুইপাশে তাই তোমরাই আমার শক্তি, আমার চিন্ময়ী দেবীমা। পাঁচদিনের অতিথি থেকে মা চলে যান, তাঁর ছোঁয়া সিঁদুর ছুঁয়ে বাকি দিনগুলো আমরা জেগে উঠবো, দুর্গা হয়ে!!"

ছলছল চোখে সৌদামিনী জয়ার দিকে তাকান, "কিন্তু আমি যে বিধবা রে মা, সিঁদুর আমায় শোভা পায়না!"

জয়া নিজের ঘোমটা খুলে ফেলে, "যাকে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিলাম, স্বামী মেনেছিলাম, আমার সর্বনাশ করে সে নিরুদ্দেশ, জীবিত কিনা জানিনা।

মারা গেলে মানুষ শরীর ত্যাগ করেন, কিন্তু প্রিয়জনদের কাছে, তাদের অনুভূতি দিয়ে স্মৃতি দিয়ে সেই মৃত মানুষকে অমর করে রাখেন। সত্যি বলুন তো গিন্নিমা, শরতের প্রথম শিউলিতে কর্তা মশাই এর দেখা পাননা?

বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে তাঁর সঙ্গে কথা বলেননা? তিনি তো বেঁচে আছেন আপনার মধ্যেই! বাইরের বেশে আপনি বিধবা, সমাজের চোখে, হিন্দু ধর্মমতে আপনি এয়ো নন, কিন্তু এখনও আপনি কর্তা মশাইয়ের স্ত্রী, তাঁর সহধর্মিনী!"

কৌটো থেকে সিঁদুর নিয়ে জয়ার গালে লাগিয়ে দিলেন সৌদামিনী, "ঠিক বলেছিস মা, স্ব-আমি(স্বামী)র মধ্যেই 'আমি' মিশে থাকে, তাই আমি বেঁচে থাকলে ,ভালো থাকলে আমার মধ্যে তিনিও বেঁচে থাকবেন বই কি!"

অভ্যাগত সবাই দেখলো তেজস্বিনী এক বিধবা ছেলে মেয়ে বৌমা জামাই নাতি নাতনি ভুলে সিঁদুর খেলছে সমাজের প্রত্যাখ্যাতা দুই রমণীর সঙ্গে।

পিছনে জ্বলজ্বল করছে মা দুর্গার সহাস্য মৃন্ময়ী মূর্তি।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics