সার্টিফিকেট
সার্টিফিকেট
- কি ব্যাপার ভবেশ? কিছু লাগবে?
- না স্যার। ইয়ে মানে একটা কথা ছিল।
- বল, বল।
- না মানে স্যার দু দিনের ছুটি যদি
- বল কি গো? মেয়ের বিয়ে নাকি?
- কি যে বলেন?
জিভ কাটলেন ভবেশ বাবু।
- বেশ, ছুটি মঞ্জুর।
হেসে ভবেশ বাবুর কাঁধে একবার হাত রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন সনৎ স্যার। পাল্লা দেওয়া দরজাটা নড়ে চলেছে তখনও। সনৎবাবু একটি সরকারী স্কুলের হেডস্যার। ভবেশবাবু ওই স্কুলের-ই অফিসঘর সামলান। পরীক্ষার খাতা, মার্কশিট যত্ন করে রাখা, হেডস্যারের স্ট্যাম্প মেরে দেওয়া ইত্যাদি কাজকর্ম ভবেশবাবুই সামলান আর কি!
চেহারায় জীর্ণতার ছাপ, খোঁচা খোঁচা সাদা পাকা দাড়ি, ঢলঢলে জামা প্যান্ট – ভবেশবাবুর পরিচয় দেবার জন্য এইটুকু বর্ণণাই যথেষ্ট। গাঢ় নীল রঙের একটা প্যান্ট যেটা কিনা মাঝে মধ্যে ছাত্রদের স্কুল-ড্রেসের সাথে গুলিয়ে যায় আর সাদার উপর নীল চেকের একটা বহুদিনের পুরোনো শার্ট। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত – ভবেশবাবুর এই একটাই পোশাক। না, তা বলে ভাববেন না যেন ভবেশবাবু একটা জামাই রোজ পরেন! একদমই না। একটা একই থান থেকে দু খানা জামা বানানোর মত কাপড় কিনেছিলেন একবার। সেই দু খানা জামাই অদলবদল করে পরেন আর কি!
ভবেশবাবুকে নিয়ে সারাদিন স্কুলে স্টাফদের মধ্যে হাসি ঠাট্টা চলে। ভবেশবাবু তাতে অবশ্য আপত্তি জানান না কোনোদিনও। বাম গালে টোল ফেলে ভবেশবাবুও হেসে ওঠেন। ইচ্ছে করে ভবেশবাবুর ব্যাগ লুকিয়ে রাখা, চেয়ার লুকিয়ে রাখা, এসব তো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।। ব্যাগ লুকিয়ে রেখে সঞ্জুরা জিজ্ঞেস করে “ভবেশদা, ব্যাগ কই তোমার?” ভবেশবাবু হেসে উত্তর দেন “রেখে দাও। ওই তো একটা ছেড়া রংওঠা পুরোনো ব্যাগ। ভেতরেও কিস্যু নেই। তোমরা রেখে দাও”। অবশ্য রোজই যে হাসি ঠাট্টার ছলে ভবেশদা উত্তর দেন এমনটাও নয়। এই তো সেদিন সঞ্জু ব্যাগ লুকিয়ে রেখেছে।
- ভবেশদা, ব্যাগ কই তোমার?
ভবেশবাবু স্মিত হেসে উত্তর দেন
- সঞ্জু, আজ দিয়ে দাও।
- খুঁজেই তো পাওয়া যাচ্ছে না।
মুখের হাসিটা ক্রমে মেলাতে থাকে ভবেশবাবুর।
- ভাই, আজ দিয়ে দাও। আজ একটু তাড়া আছে।
- কেন গো? আবার বিয়ে সাধি করছ নাকি? তোমার ক্যালি আছে কিন্তু
- তোমার বৌদিকে নিয়ে একটু ডাক্তারখানা যাবার আছে।
- কেন? আবার ছেলেপুলে হবে নাকি?
বারবার হাতের ঘড়ি দেখে ভবেশবাবু। চোখমুখ ক্রমশ লাল হতে থাকে, চিৎকার করতে পারে না, নিজের মনের ভিতর ক্রমশ রাগটা জমতে থাকে। হয়তো সেই রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটে একাকী কোনো অন্ধকার রাস্তায় কিংবা বাথরুমে চির খাওয়া আয়নার সামনে।
আরেক প্রস্থ মজা চলে টিফিন-টাইমে। সবাই যখন সুসজ্জিত ব্যাগ থেকে টিফিন ক্যারিয়ার খুলে রুটি, পরোটা, লুচি, ডালপুরী বের করে তখন ভবেশবাবু একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে গার্ডার দিয়ে বাঁধা দুটো ছোট ছোট টিফিন বাক্স বার করে। একটাতে মুড়ি, আর আরেকটাতে তরকারি।
- আমাদের কটা টিফিন বাক্স? একটা! ভবেশদার দ্যাখ, দুটো! এত বড়লোক, কি বলবো!
- তোমাদের তো টিফিনবাক্সে একতলা, দোতলা,তিনতলা সব ভাগ আছে।
- তুমি কি এনেছ ভবেশদা?
- মুড়ি।
- মুড়ি দিয়ে মাংস খাবে নাকি?
- না, না।
- খেও না। খেলে মুরগি বা পাঠা যাই খাও না কেন ওই মুরগি বা পাঠাটার অপমান হবে।
- নিমন্তন্ন ছাড়া মাংস কোথায় পাব বল!
সুস্থ, স্বাভাবিক কথা বলা উদ্দেশ্যই থাকে না সঞ্জুদের। কিভাবে ভবেশবাবুকে একটু ছোট করবে, কিভাবে ভবেশবাবুকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবে, এগুলোই উদ্দেশ্য। তাই তো “তোমাদের তো একতলা, দোতলা, তিনতলা টিফিনবাক্স” কিংবা “নিমন্তন্ন ছাড়া মাংস পাব কই” এইসব কথাগুলোর উত্তর দেবারও প্রয়োজন মনে করে না কেউ।
শুধু স্টাফ বলে নয়, সবাইই টুকটাক মজা করেন ভবেশবাবুকে নিয়ে। এই যেমন সনৎবাবু কি একটা কাজে অফিসরুমে এসেছিলেন, যাওয়ার সময় সঞ্জুকে হেসে বলে গেলেন “সঞ্জু! ভবেশ দুদিনের ছুটি নিচ্ছে। খোঁজখবর নাও তো কি ব্যাপার!”
ব্যাস, আর সঞ্জুদের পায় কে!
- ভবেশদা, ও ভবেশদা। তুমি ছুটি নিচ্ছ?
- হ্যাঁ। ওই আর কি!
- তুমি ছুটি নিচ্ছ, খবরটা আমাদের হেডস্যারের থেকে শুনতে হবে। এটা একটা কথা হল ভবেশদা!
- না, না বলতাম তোমাদের। তোমাদের তো বলবই।
- কেন ছুটি নিচ্ছ ভবেশদা? হুমম হুমম?
- কোনোদিনও বউ ছেলে মেয়েকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি তো। অনেকদিন ধরেই বলছে সবাই। ভাবলাম একটু পুরী ঘুরে আসি।
- বলো কি গো ভবেশদা? তুমি পুরী যাচ্ছ?
- হ্যাঁ, ওই আর কি?
- পুরীতে কিন্তু বিশাল সমুদ্র। হারিয়ে যেও না যেন।
- হ্যাঁ শুনেছি। সবাই বলে। এই প্রথম সামনাসামনি দেখব আর কি!
- তুমি প্রথমবার পুরী যাচ্ছ ভবেশদা?
- হ্যাঁ।
- জগন্নাথ দেব ধন্য হয়ে যাবেন তো।
- ধ্যাৎ, কি যে বলো না।
দেখতে দেখতে পুরী যাবার দিন চলে এল। রাত দশটায় ট্রেন। ভবেশবাবুর মুখে একগাল হাসি খেলে বেড়াচ্ছে। আজ ভবেশবাবু একদম ফ্রেস। কাঁচা পাকা সাদা দাঁড়ির গালখানা সুন্দর ভাবে ক্লিনশেভড। অফিস রুমে ঢুকতেই সঞ্জু বলল
- আরে ভবেশদা! চেনাই যাচ্ছে না যে।
- হে হে! কি যে বল না তোমরা!
- ও ভবেশদা, খাওয়াবে না?
- কেন?
- এই, প্রথমবার পুরী যাচ্ছ, খাওয়াও।
ভবেশদার মুখের হাসিটা কেমন যেন মলিন হল।
- কি খাবে?
- বিরিয়ানি খাওয়াও।
চুপ করে গেলেন ভবেশবাবু। মুখের চাকচিক্য, হাসি মুহূর্তে মিলিয়ে গেল। কোনো এক রঙিন দুনিয়া থেকে ভবেশবাবু ধূসর বাস্তবের মাটিতে পদার্পণ করলেন হঠাৎই। ভাগ্যিস পাশ থেকে কোনো এক শুভানুধ্যায়ী বললেন
- এই না গো, রোল খাওয়াও।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ভবেশবাবু।
- চারটে রোল কিনে নিয়ে এস তবে।
- থ্যাংক ইউ ভবেশদা। পয়সা দাও।
- কত করে গো? কুড়ি না পঁচিশ?
- ভবেশদা, তুমি কোন যুগে পড়ে আছ! চল্লিশ টাকা করে।
আবারও একটা দমকা হাওয়া বয় ভবেশবাবুর মনে। ঢোক গিলে নিজেকে সামলে নেন ভবেশবাবু।
- শোনো না, আজ রাতে তো ট্রেন। আমি খেলে যদি পেট খারাপ হয় কি দরকার! তুমি বরং তিনটেই নিয়ে এস সঞ্জু।
ব্যাগ থেকে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট বের করে তার থেকে দুটো পুরোনো পঞ্চাশ টাকার নোট বার করেন ভবেশবাবু। তারপর পকেট হাতড়িয়ে কুড়ি টাকার খুচরো জোগাড় করে সঞ্জুর হাতে তুলে দেন। আবার ভবেশবাবুর মুখে ফুটে ওঠে হাসির ঝিলিক। বাড়িতেও এরকম কতবার যে পেট খারাপের দোহাই দিয়ে চারটে সিঙ্গাড়ার বদলে তিনটে সিঙ্গাড়া, চার পিস মাছের বদলে তিন পিস মাছ নিয়ে এসেছেন তার ইয়ত্তা নেই।
নানান কাজে ব্যস্ততার পর টিফিন টাইমে ভবেশবাবু অফিসঘরে ফিরে এলেন। আলমারিতে দরকারি কাগজপত্র গুছিয়ে রেখে পেছন ঘুরতেই দেখলেন সনৎবাবুও কোনো এক কারণে হাজির হয়েছেন সেখানে।
- কি গো ভবেশ, কাল থেকে ছুটি তো তোমার।
- হ্যাঁ স্যার।
সঞ্জু বলল
- একবার দেখুন স্যার।
ভবেশবাবু যেখানে বসেন, সেই চেয়ারের পিছনের অংশের দিকে সঞ্জু দেখতে বলল। দেওয়ালে কাগজ আটকানো। তাতে লেখা রয়েছে “ আমি ভবেশ দাস, জীবনে প্রথম বারের জন্য সমূদ্র দেখতে পুরী যাচ্ছি”। নীচে আজকের তারিখ লেখা।
- এই সঞ্জু, যা! এসব করে না। ভবেশ, তুমিও এদের কিছু বলো না বলে কিসব করছে দেখ!
ভবেশবাবু মুখ নিচু করে হেসে বললেন
- ওরা একটু আনন্দ করে, করুক! কি আর বলব!
- তুমি এত ভালো মানুষ! কি বলব! সত্যি আগে সমুদ্র দেখো নি তুমি? প্রথমবার দেখবে?
- হ্যাঁ স্যার। প্রথমবারই দেখব।
- বলো কি গো ভবেশ?
- আর স্যার কি করব বলুন! ইচ্ছে তো কতবার হয়েছে। প্ল্যানও হয়েছে। হয়ে ওঠেনি স্যার। ছোটবেলা বাবা কোনোরকমে দিন এনে দিন খেয়ে সংসার চালালো। একটু বড় হয়ে চাকরি পেলাম যখন, তখন মা বাবার চিকিৎসা, ভাই বোনদের দায়িত্ব। তারপর বিয়ের পর বউ, ছেলে মেয়েকে বড় করা। সময়, সাধ্যি কিছুই হয়ে ওঠেনি স্যার।
গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে আসে ভবেশবাবুর। সঞ্জু এমনিতে খুব ছটফট করে। বাকিদের মত সেও চুপ করে যায় এখন। ভবেশবাবুর কাঁধে হাত রেখে সনৎবাবু বলেন
- সঞ্জু, ওখান থেকে কাগজটা ছিঁড়ে ফেল।
- হুমম স্যার। সরি ভবেশদা।
কাগজটা ছিঁড়ে ফেলতে যায় সঞ্জু। ভবেশবাবু চোখের জল মুছে বলেন
- ওটা থাক সঞ্জু। স্যার, ওটা থাকুক না!
- ভবেশ, এরম করে না। সঞ্জুরা না বুঝে করেছে। রাগ কোরো না।
- না স্যার, রাগ না। একটা কথা বলব স্যার।
- হুমম বল, বল।
- আপনার রুমে বা অন্যান্য রুমে সার্টিফিকেট থাকে না! ওগুলো তো আপনারা অর্জন করেছেন, বলুন! তাই ওগুলো ওরম সাজানো থাকে। আমিও তো বহুদিন ধরে বহু চেষ্টা করে আজ পুরী যাওয়ার সাধ্যি অর্জন করেছি। থাক স্যার ওটা।
ভবেশবাবুর কাঁধে হাত রাখতে গিয়েও রাখেন না সনৎবাবু। গলার স্বর নিচু করে একবার বলেন শুধু
- ভালো করে ঘুরে এস ভবেশ। খুব ভালো করে ঘুরো।
