ঋভু চট্টোপাধ্যায়

Tragedy Fantasy Others

3  

ঋভু চট্টোপাধ্যায়

Tragedy Fantasy Others

সাপ লুডো

সাপ লুডো

10 mins
111



                       ১


-ম্যাডাম, ও ম্যাডাম, ঘুমিয়ে গেছেন যে, কোথায় নামবেন ?

 সামনে বসে থাকা ভদ্রলোকটির কথা গুলো শুনে ম্যাডাম চোখ দুটো তাড়াতাড়ি খুলে চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কোন স্টপেজ?’

-চোপান, আপনি কোথায় নামবেন ?

- সরাইগ্রাম, দেরি আছে ?

-অনেক।সেই সকাল নটার আগে ঢুকছে না, লেটে রান করছে।

‘ও’ বলে ভদ্রমহিলা আবার কিছু সময় চুপ করে শুয়ে হঠাৎ উঠে বসে পড়লেন। তারপর হঠাৎই নিজের মনে চলে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন।রাত দুটো, কামরার আলো নেভানো থাকলেও মেয়েটির উল্টো দিকে বসে থাকা ভদ্রলোক এতক্ষণ শুয়ে শুয়েই ভদ্রমহিলাকে দেখছিলেন।বেশ কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল।একবার উঠে বসছেন, একবার শুচ্ছেন, শুয়ে শুয়ে কেঁদে উঠছেন।উল্টো দিকে বসে থাকা ভদ্রলোকের কেমন যেন সন্দেহ হল। তারপর দরজার কাছে ভদ্রমহিলা এসে দাঁড়াতেই পিছন থেকে তাকে চেপে ধরে ভিতরে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন।ভদ্রমহিলা ছটফট করলেও আর কোন উপায় নেই।এমনিতেই ধস্তাধস্তির আওয়াজ শুনে কয়েকজন ঘুমন্ত প্যাসেঞ্জার ঘুম থেকে উঠেও পড়েছেন।ভদ্রলোক সব কিছু বলবার পরে সবাই শুনে অনেক কিছু জানবার চেষ্টা করে গেলেও কোন লাভ হল না।কোলকাতার আপ ট্রেন বাঙালি যাত্রীর সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়। কিন্তু ভদ্রমহিলা সমান চিৎকার করে যেতে লাগলেন, ‘আমাকে ছেড়ে দাও, আমার বেঁচে থাকবার কোন অধিকার নেই।’ ভদ্রলোক অনেক বুঝিয়ে শেষে হার মেনে পরের স্টপেজে এক রকম জোর করেই তার সাথে নামালেন।         


                          ২


আজ কাল দীক্ষাকে অপর্ণার কেমন যেন অচেনা মনে হয়। যত বয়স বাড়ছে মেয়েটার আদিখ্যেতা বেড়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন আগেই মেয়েকে একবার বলে, ‘দেখ বড় হচ্ছিস এখন এমন ভাবে হাফ প্যান্ট গেঞ্জি পরে থাকিস না।’ কে কার কথা শোনে কথাগুলো এক্কেবারে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বলে ওঠে, ‘তুমি সেই গাঁয়য়াই রইলে, আমার বন্ধুগুলোকে দেখো, সুইম করে, হট প্যান্ট পরে পড়তেও আসে।’

সেদিন কথাগুলো শুনেই মাথা ঘুরছিল অপর্ণার। ওদের মা’দেরকেও বলিহারি, হাফ প্যান্ট পরে কেউ বাইরে ছেড়ে দেয়।এই জন্যেই চারদিকে এত সব ঘটনা ঘটছে। আরে বাবা তুমি যদি তৈরী করা খাবার কারোর মুখের সামনে তুলে দাও কে আর না খেয়ে থাকতে পারে? আমরাও তো পড়াশোনা করেছি নাকি। ছেলেদের সাথে মিশেওছি। সুপ্রকাশ নামের একটা ছেলে তো প্রায়ই বাড়ি আসত। ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করত, কই কোনদিন তো নির্লজ্জ হতে পারে নি।বরং মা যেদিন সুপ্রকাশের সাথে নিজের পিরিওডস নিয়ে আলোচনা করে সেদিন খারাপ লেগেছিল। সুপ্রকাশ চলে যেতেই মায়ের ওপর রেগে গিয়ে বলেছিল, ‘এসব কথা কেউ ওর সাথে আলোচনা করে?’ মা অবাক হয়ে উত্তর দিয়েছিল, ‘কেন ও’তো আমার ছেলের মত,ওর কাছে আবার কিসের লজ্জা ?’ দীক্ষারা অবশ্য খোলাখুলি এসব নিয়ে আলোচনা করে।একদিন অপর্ণার কানেও কিছু কথা আসে।তবে তন্ময় বাড়ি ফিরে আসার পরেই দিক্ষার সাহস একটু বেড়ে যায়। আগে ও যখন বাইরে পোস্টিং ছিল, অপর্ণাকেই সব কিছু করতে হত। সে টিউসনের স্যারের সাথে যোগাযোগ হোক অথবা স্কুলের কোন সমস্যা।ক্লাস এইটে পড়তে তো একটা ছেলে কয়েকদিন খুব পিছনে লেগেছিল, অপর্ণা একাই ছেলেটার বাড়ি খুঁজে সেখানে গিয়ে ছেলেটার বাবা মায়ের সাথে কথা বলে, ছেলেটার সাথে কথা বলে, তার জন্য অবশ্য দীক্ষা খুব একটা খুশি হয় নি।বরংঅপর্ণার ওপর রেগেই যায়।ক্লাস নাইনে আবার দীক্ষার সাথে একটি ছেলের একটা সম্পর্কও তৈরী হয়।সেখানেও অপর্ণাকে বলতে হয়।তখন তন্ময় শুধু মাসে মাসে টাকা পাঠিয়েই দায়িত্ব পালন করে।এমনকি ফোনে এই প্রেমটেম কথা গুলো শুনে খুব সাধারণ ভাবেই উত্তর দেয়, ‘এই বয়সে এরকম একটু অধটু হয়,এডোলেশন পিরিয়ড, অপোসিট সেক্সের প্রতি একটু ভাব ভালোবাসা জন্মাবেই, তোমারও জন্মেছিল, এখন তুমি অস্বীকার করতেই পার।’

এরপর আর কিই বা বলা যায়, শুধু রেগে উঠে বলেছিল, ‘বেশ, কিছু সমস্যা হলে আমাকে কিছু বলতে এসো না।’ 

-সমস্যা আর কিই বা হতে পারে, একটু প্রেম করবে, ফূর্তি করবে, এটাই তো বয়স।

-বেশ, তুমিও তাহলে যেখানে আছো সেখানকার মেয়েদের সাথে ফূর্তি করগে। এখানে আমি সন্যাসিনীর মত থাকি।

 আগে দীক্ষাকে বকে মেরেও কিছু কাজ হত, কিন্তু তন্ময়ের আসার পরেই কিরকম সব যেন গণ্ডগোল হয়ে যেতে আরম্ভ করল।এমনি তো ফোর্সে কাজ, রিটার্য়াডমেন্ট নিয়ে বাড়ি এসে মাস ছয়ের মধ্যেই আবার একটা সরকারি চাকরিও জুটিয়ে নেয়।এই কয়েকমাস রিটায়ার্ডমেন্টের কিছু কাগজ পত্র তৈরীর জন্য এদিক ওদিক ঘোরে, সেসময় মেয়ের সাথে আগের মতই যোগাযোগ ছিল, কিন্তু অপর্ণা কয়েকদিন বাড়িতে না থাকবার জন্য তন্ময়ের মেয়ের সাথে একটা অন্য রকমের বণ্ডিং তৈরী হল।পাকাপাকি ভাবে এখানে আসার পরে প্রতিদিন সকালে উঠেই মেয়ের সাথে মাঠে ছুটতে বের হত, দুজনেই হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি পরত।প্রথম কয়েকদিন কোন কিছু মনে না হলেও কয়েকদিন পরেই সামনের দোকানে একটা জিনিস কিনতে গিয়ে পাড়ার এক বৌদির সাথে দেখা হয়, কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করবার পরেই বলে, ‘ দীক্ষাকে সকালে দেখি, হাফ প্যান্ট দৌড়ায়, সঙ্গে কে কর্তা, দেখে মনে হয় ওরাই যেন স্বামী স্ত্রী, কে বলবে তুমি মা, এখন তো তোমাকে কর্তার থেকেও বড় লাগে।’

কথাগুলো অপর্ণার খুব কানে লেগেছিল। বাড়ি ফিরেই বাথরুমের দরজা বন্ধ করে নিজেকে আয়নার সামনে নগ্ন করে দেখার চেষ্টা করেছিল।শরীরে সত্যি সত্যিই অযাচিত বার্ধক্য বাসা বাঁধতে আরম্ভ করেছে কিনা, অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করে। শরীর ঝুলছে? সেদিনই দীক্ষার ওপর রাগ দেখিয়ে বলে ওঠে, ‘সকাল সকাল এমন ভাবে হাফ প্যান্ট পরে বাইরে যাস না, পাড়ায় কথা উঠছে।’


-কথা! হাউ সেভেজ ইউ আর অপর্ণা! ভেরি ব্যাড, আমি দীক্ষাকে মর্ডান করে মানুষ করবার চেষ্টা করছি, আর তুমি ওকে সেই পুরানো মানসিকতার তৈরী করছ। কে কি বলছে তাতে মাই ফুট। তুমিও সব শোন, যদি তোমার ভালো না লাগে বলবে। আমি দীক্ষাকে অন্য জায়গায় নিয়ে চলে যাব, অন্য কোথাও ভর্তি করে দেব। তুমি একা থাকো।


মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে অপর্ণার।এত বড় কথা, মেয়েকে নিয়ে আলাদা থাকবে!শরীরটা কেঁপে ওঠে। এভাবেও কেও বলতে পারে এই ভাবনাটা মাথায় আসছে না অপর্ণার।খুব বাজে অবস্থা।তারপর থেকে দীক্ষাকে কথায় কথায় বকা বন্ধ করে। কিছুটা উদাসিন থাকবার চেষ্টাও করে। কিন্তু কতক্ষণ এভাবে উদাসিন থাকা যায়? সতেরো বছরের মেয়ে কথায় কথায় বাবাকে জাপটে ধরছে। বাবার সামনে একটা ভেস্ট পরে বেরিয়ে যাচ্ছে, এটা তো মেনে নেওয়া যায় না। অপর্ণার নিজের ছোট বেলার কথা মনে পড়ে। যেদিন থেকে বুকের দুদিকে দুটো মাংসপিণ্ড বড় হয় সেদিনই মা বলে দেয়,‘মাম্পি, এবার থেকে পোষাকে একটু যত্ন নিবি, আর খালি গায়ে বাইরে বেরোবি না, বাবা কাকাদের সামনেও দুমদাম করে চলে যাবি না, জামার নিচে এবার থেকে একটা টেপ বা গেঞ্জি পরবি।’

অপর্ণা কিন্তু কোনদিন মাকে কি কেন প্রশ্ন করেনি।বরং মা সময়ের সাথে একটু পরিবর্তিত হলেও অপর্ণা নিজেকে পরিবর্তন করতে পারে নি। কিছু কিছু বিষয়ে মায়ের ওপর রেগেও যেত।এখন অবশ্য মেয়ের ওপর রাগতে পারছে না।কয়েকদিন পরে তন্ময় অফিস থেকে ফিরেই অপর্ণাকে বলে, ‘কাল থেকে একটু ছোলা বাদাম, পেস্তা ভেজাবে, আজ কিনে এনেছি, দীক্ষাকে জিমে ভর্তি করছি, শরীরে ফিটনেস আসবে, তারপর দেখি টেনিসে ভর্তি করবার ইচ্ছেও আছে।’

 –কিন্তু এখন তো পড়ার খুব চাপ, আর এক বছর অপেক্ষা করলে হত না?


-জানতাম তুমি বাধা দেবে।

কথাগুলো শেষ করবার সময়েই দীক্ষা ঘরে আসতেই আর তন্ময় দীক্ষাকে জাপটে ধরে নিজের কোলে তুলে নেয়।পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অপর্ণার শরীরে কারেন্ট লাগে। এমন ভাবে তো কেউ কোনদিন ওকে কোলে তোলে নি।দীক্ষা আবার তন্ময়ের কোলে উঠেই তন্ময়ের গালে কপালে চুমু খেতে আরম্ভ করে, মুখে বলে, ‘ও সুইট ড্যাডি আই লাভ ইউ।’


অপর্ণা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, কে জানে চুমুটা কখন ঠোঁটে পড়ে যায়।

রান্না ঘরে সব্জি কাটার সময় আঙুল কেটে ফেলে, হাতে ভাতের ফ্যান পড়ে যায়।ভগবান এ’তুমি কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছ।শেষ কালে কিনা মেয়ে তার বাবার সাথে এমন সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে, আর মা হয়ে সেটা ড্যাব ড্যাব করে দেখতে হচ্ছে।এক রাতে অপর্ণার হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়।বিছানায় পাশে তন্ময়কে না পেয়ে একপা একপা করে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই দীক্ষার ঘরের ভেতর থেকে একটা চাপা গলার আওয়াজ শুনতে পায়।কোন কিছু না বলে তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলতেই নিজের চোখ দুটো লজ্জায় বন্ধ হয়ে আসে।তন্ময় বিছানার ওপর একটা ছোট প্যান্ট পরে শুয়ে আছে। আর তার শরীরে শরীর লাগিয়ে একটা ভেস্ট পরে শুয়ে আছে দীক্ষা। নিচে প্যান্টিটাও নেই।অপর্ণা আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, চিৎকার করে ওঠে, ‘এসব কি হচ্ছে, তুমি তো বাবা, ও তো তোমার মেয়ে, তোমার লজ্জা করছে না।’


তন্ময় প্রথম দিকটাতে ভ্যাবাচ্যাকা মেরে গেলেও পরে ক্ষণেই নিজেকে ঠিক করে চেল্লাতে আরম্ভ করে, ‘তুমি পারভাটেড হয়ে গেছ, ও আমার মেয়ে, ওর সাথে কোন সর্ম্পকই খারাপ সম্পর্ক নয়, সেটা না দেখে তুমি এই সব ভাবছ, তোমার লজ্জা করছে না, যাও নিজের ঘরে যাও।’


–পারভাটেড! তাহলে কি সত্যি সত্যিই দীক্ষা আর তন্ময়কে আকারণ সন্দেশ করছে।বাবা মায়ের অপত্য স্নেহ! তার মধ্যে কি সত্যিই শরীর এলেও আসেনা। ছোট বেলাতে অপর্ণা একবার বাবার সাথে ডাক্তার দেখাতে গেছিল। মায়ের কি একটা কাজ ছিল। কিন্তু সেই ডাক্তার তো কিছুতেই দেখবেন না।বাবাকে কড়া করে শুনিয়ে দিয়ে ছিলেন, ‘মায়ের সাথে পাঠাবেন, আপনার সামনে ওর সব সমস্যা আলোচনা করা ঠিক নয়। মেয়ে বড় হলে প্রত্যেক বাবার উচিৎ তাকে স্নেহের সাথেও একজন মেয়ে হিসাবে মর্যাদা দেওয়া। যেমন ধরুন এই যে আপনার মেয়ে আপনার সাথে এসেছে এখন মেয়ের যদি কিছু প্রাইভেট দেখার প্রয়োজন হয় আপনার সামনে মেয়ে কি সাবলিল হতে পারবে?’ সেদিন ডাক্তারের চেম্বার থেকে বাবা বাইরে বেরিয়ে আসে। তারপর থেকে আর কোন দিন অপর্ণাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যায় নি, সমস্যা হলেই তার মাকে পাঠিয়েছে।এটাই তো স্বাভাবিক, বাবা কাকা যতই নিজের হোক তারাও তো পুরুষ।এক বিখ্যাত উপন্যাসে ঘরের মামাতো পিসতুতো দাদাদের জোর করে তার সাথে যৌন সর্ম্পক করার বর্ণনা পড়ে চমকে উঠেছিল অপর্ণা।এমনটা কি সত্যি সত্যিই হতে পারে?তবে ওটা তো তুতো দাদা।কিন্তু তা বলে বাবা ?


পরের দিন সকালেই কাজের মেয়ে টুম্পা ময়লার বালতিটা একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে ফেলবার সময় মুচকি হেসে ওঠে।অপর্ণা ওর হাসি দেখে একটু জোর করেই,‘কি হল রে?’ জিজ্ঞেস করতেই টুম্পা বলে, ‘বৌদি তোমাদের মেয়ের তো বয়স হয়ে গেছে, এখন আরেকটা ছেলে মেয়ে কিছু নিতেই পারো।’ অপর্ণার মাথাতে আবার বিদ্যুৎ খেলে যায়, রেগে ওঠে। এরকম বলবার কারণ জিজ্ঞেস করতেই টুম্পা প্যাকেটটা একটু ফাঁক করে আঙুল দিয়ে দেখায়।চমকে ওঠে অপর্ণা, দু’চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।কিছু ক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া এই কেনর কোন উত্তর নেই।তন্ময় এখানে ফিরে আসার পর এখনো পর্যন্ত তাদের মধ্যে কোন শারীরিক সম্পর্ক হয় নি। কনডমের কোন প্রশ্নই ওঠে না। তার ওপর আবার ডাস্টবিনে ফেলা।ওরা শেষকালে এতটা নিচে নেমে গেল? হায় ভগবান এর থেকে মরে যাওয়াটাই ভালো।কয়েকদিন তন্ময়দের সাথে কথা বলা এক্কেবারে বন্ধ করে দিল।একই ঘর, এক ছাদের নিচ, শুধু কথা বলা বন্ধ। এমনি ভাবেও তো বেশি দিন থাকা যায় না।বাপের বাড়িতে গিয়েও যে কয়েক দিন থাকবে তারও কোন উপায় নেই।এদিকে যে কি হবে তা বলা মুশকিল।তাছাড়া বাপের বাড়িতে মা ছাড়া এখন কেউ নেইও। মা’কে তো এই সব অনাসৃষ্টির কথা বলা যায় না। কিন্তু বলবার জন্যেও একজন বন্ধুরও প্রয়োজন। একদিন সকালের দিকে পেপার পড়তে পড়তে এক মনোবিদের ফোন নম্বরে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়। ওখানে গিয়ে সব কিছু বলতে ডাক্তার ম্যাডাম ক্লাইটেমনেস্ট্রা, এজিস্টাস, ইলেকট্রা, ওরিস্ট্রেস সব নাম একের পর এক বলে বিভিন্ন ধরনের যৌন বিকৃতির কথা বলতে আরম্ভ করেন।উল্টো দিকে বসে থাকা অপর্ণা অপেক্ষা করে বসে থাকে এই বুঝি কোন উপায় বলবেন। বললেনও তবে অনেক শেষে। নিজেকে হাসব্যাণ্ডের কাছে আরো ভালো ভাবে নিয়ে যাবার সাথে মেয়েকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।বাড়ি ফিরে মাথাটা আবার গরম হয়ে যায়।দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে দেখে তন্ময় দীক্ষার ঘরের বিছানাতে শুয়ে আছে। দুজনের শরীরে কোন সুতো নেই।


                       ৩


জীবনে এক ভাবা ছিল, এক হল। কয়েক বছর ধরে আয়নার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, অথচ এই আয়নাটাই এখন নিত্য সঙ্গি হয়ে গেল।মাসে একবার করে মাকে দেখতে যাওয়াটাই কাল হল, অবশ্য এর আগেও বহুবার মাকে দেখতে গেছে কিন্তু কোন বার এমনি ভাবে কোন মহিলার সাথে দেখা হয় নি। তাও যদি শুধু দেখা হত তাহলে না হয় ঠিক হত, কিন্তু এমনি ভাবে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাবে কে জানতে? ভদ্রমহিলা অবশ্য বেশ ভালো, কোন রকম ঝামেলা নেই। বহুবার জিজ্ঞেস করবার পরেও নিজের সম্পর্কে কিছুই বলে নি।প্রথম দিন শুধু নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিল,” আমার নাম অপর্ণা, আপনার।’

–কুশল।


এরপর থেকে আর কিছু না বললেও কুশল প্রতিদিন অফিস বের হবার সময় ভাবে, ‘নিশ্চয় ফিরে দেখব উনি নেই।’ কিন্তু উনি থাকেন। বাসায় ফিরে প্রতিদিন কুশল অপর্ণার হাতে তৈরী নতুন নতুন খাবার খায়, তখনই চোখের সামনে অ্যাসাইলামের ভিতর থেকে মা উঠে আসে, পাশে বাবা।বাবা ডাকে, কুশল ছুটে পালায়। পাড়ার লোক বাবাকে অপমান করে। মা বাবা পাড়া ছাড়ে, বাবা চাকরি ছেড়ে নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। তারপরেও অবশ্য নিস্তার নেই কুশলের বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে বাবা মায়ের ঝগড়া আরম্ভ হয়। বাবা, মায়ের গায়ে হাত তুলতে আরম্ভ করে।তারপর একদিন রেল লাইনে মাথা দেয়।কুশল কিছুই জানতে পারে না।একা মা তাকে বড় করতে থাকে।একদিন একটা ফাইলের ভিতরে একটা কাগজ দেখে চমকে ওঠে কুশল। মাকে জিজ্ঞেস করে, ঝগড়া হয়, মাকে অপমান করে, মা আর সহ্য করতে পারে না।


                      ৪

-একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

- নিশ্চয়।

-এই যে আমি আপনার বাড়িতে আছি আপনাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে নি? মানে আপনার অফিসে, পাড়ায়?

কুশল একটা শ্বাস টানে, ‘এক্কেবারে যে করে নি এটা বলব না, তবে বলেছি আমার দিদি। জামাইবাবু মারা যাওয়াতে আমার কাছে থাকছে।’

অপর্ণা কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দেয়, ‘এটা কিন্তু আপনি ঠিকই বলেছেন, আমার স্বামী সত্যি সত্যিই মারা গেছেন।’ তারপরেই ব্যাগ থেকে একটা খবরের কাগজ বের করে একটা খবর দেখিয়ে বলে, ‘আত্মহত্যা, আমার মেয়ে ও উনি, দুজন একসঙ্গে।’ 

কুশল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘হঠাৎ!’

-হঠাৎ না।


–মানে? আপনার মেয়ে আর স্বামী দুজন একসাথে সুইসাইড করে দিয়েছে, আপনি কিছু করতে পারেন নি।

–আমি ঘটনার দু’মাস আগেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে একটা হোমে থাকতে আরম্ভ করেছিলাম। চাকরির চেষ্টা করছিলাম।

–কি এমন ঝামেলা করলেন?

 –আমার মেয়ে প্রেগনেন্ট হয়ে গেছিল। অ্যাণ্ড বাই হার ফাদার।


কুশল শেষের কথাগুলো শুনে চমকে উঠল। একপা একপা করে একটা জানলার ধারে অন্ধকারের দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকে।রাত্রি অন্ধকার হলেও দিনের আলোর মত জটিল নয়।শহরটাতে মানুষ খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, না হলে কুশলের দু’চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল দেখতে পেত।না হলে পড়তে পারত দুটো বার্থ সার্টিফিকেট।অনেক চেষ্টা করেও যে’দুটো থেকে বাবার নামটা মোছা যায় নি।পাশাপাশি রাখলে পড়া যায় কুশলের দাদুই তার বাবা।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy