ঋভু চট্টোপাধ্যায়

Romance Inspirational

3  

ঋভু চট্টোপাধ্যায়

Romance Inspirational

লতা পাতার মা ঋভু চট্টোপাধ্যায়

লতা পাতার মা ঋভু চট্টোপাধ্যায়

7 mins
122



রাতে কয়েকদিন ধরেই ফুলমণির ভালো করে ঘুম হচ্ছে না।শুলে বুকের কাছ খানটা কেমন যেন ধড়াক করে উঠছে।তখনই পাশে শুয়ে থাকা দশ বছরের ব্যাটা পদির নাকের নিচে হাত রেখে বেরিয়ে যাওয়া বাতাসের খোঁজ নিচ্ছে।চারপাঁচ দিন এমনি করেই কেটে গেল।নিজের মরদ বিশুও এখন অন্য জায়গায় আটকে গেছে। কি এক লক না কি ডাউন হয়েছে তার জন্য সব কিছু বন্ধ।টেরেন বাস তো লড়ছেই নাই, এমনকি কার মুখে যেন শুনল, বাইরে এমনি বেরোলেও পুলিশে লাঠি উচায়ে তাড়ছে।কয়েকদিন আগেই ই’গাঁয়ের দুটা মরদ পিটানি খেইছে।সেদিন গাঁয়ের ঠাকুরথানে মোড়ল সবাইকে হেঁকে বললেক,‘সবাই শুন, এখন একট রোগ এইছে তার লগে লক ডাউন।সব কিছু বন্ধ বটে।ইখন তুরা কেউ বাজার দোকান করতি শহরের দিকা যাবি নাই।গেলি কিন্তু পুলিশের ডাঙ খাবি।’ তারপর ওদের দু’জনের পিঠের জামা তুলে সবাইকে দেখিয়ে বলে,‘ ইদ্যাখ, কেমন দাগ করি দিনছে।’ 

ইগাঁয়ে পার্টির কুনু ঝামেলা নাই, পুলিশও আসে না।ভোটের সময় ছাড়া শেষ কবে পুলিশের গাড়ি ঢুকিছিল, কেউরই মনে পড়ে না।তাই পুলিশের হাতে মার খাওয়ার কথা শুনে বেশ ভয়ই পেয়ে যায়।সবাই হাঁ করে পিঠের দাগগুলোর দিকেই তাকিয়ে থাকে।ফুলমণিও সব দেখে ভয়ে শিউড়ে উঠে জিজ্ঞেস করে,‘কিন্তু আমাকে যে একবার ঐ বড় হাসপাতালে যেতে হবেক, ব্যাটাটকে রক্ত দিতে হবেক যে।’ 

-সব কিছু মিটুক, তারপর যাবি।বিশে ফিরুক, বিটিছিলা তুই একা সব পারবি কেনে?

কথা গুলান তো সত্যি বটে।ব্যাটাটকে তো কুনুবার একা লিয়ে যায় নাই।উয়ার বাবা সেই কুন দূর থেইকা এসে আবার সবাইকে লিয়ে গেইছে।ফুলমণি শুধু ছিলাটাকে সাথে লিয়ে বসি থেকিছে।বিশু একে উকে শুধায়ে সেই টিকিট করা থেকে শুরু করে বাকি কাজ গুলান করিছে।কিন্তু লোকটাও এখন নাই, কবে ফিরবেক বলতে লারে। এই ছিলাটর লেগেই তো ঘর ছেইড়ে বাইরে থাকা।হোক কেনে সরকারি হাসপাতাল তাও খরচ তো হয়। ফুলমণি সব কিছু ভেবে মাস্টারবাবুর কাছে যায়।লোকটা ভালো বটে।পাশের গাঁয়ের প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার ছিল। কাজ শেষ হয়ি গেলেও ইগ্রাম ছাড়ে নাই।লুকটার ছিলা বউ সব উয়াকে ছেড়ে পলায়ছে।ফুলমণির কুনু ফের হলেই তার কাছে যেয়ে শুধায়।

সেদিনও মোড়লের কথা শুনে মাস্টারের কাছে গিয়ে সব কিছু বললেই মাস্টার বলে,‘কবে যেতে হবে আগে ফোন করে দেখো, তারপর গাঁয়ের কাউকে বল।খরচ একটু বেশি হবে।সেরকম হলে আমি না হয় গাড়ি ভাড়াটা দিয়ে দেবো।’

–সে না হয় তুমি দিলে কিন্তু গাঁয়ে গাড়ি একটই।আজকেই শুনলম উকে নাকি সরকার লিয়ে লিনছে।কুথাকার কোন আপিসের লুকজনকে লিয়ে যেছে।তাও আমি কথা বইলব।তুমি শুধু একবার ডাক্তারের সাথে কথা বলি দিবে।

পরের দিনেই ফুলমণি সব কাগজ নিয়ে মাস্টারের বাড়ি গেলে মাস্টার কাগজ দেখে ডাক্তারের সাথে কথা বলেন। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারবাবু, তবে ফুলমণিদের খুব ভালোবাসেন।কয়েকবার ব্যাটাটকে রক্ত দেবার পরেই নিজে থেকেই ফোন নম্বরটা দিয়ে বলেন,‘এখানে আসার আগে আমাকে ফোন করে নেবে।’

ফুলমণির নিজের ফোন নেই।প্রতিবার ছিলাটকে রক্ত দেবার আগে কেউরকে দিয়ে ডাক্তার বাবুকে ফোন করায়। ডাক্তার বাবু যখন জিজ্ঞেস করতেন,‘তুমার ব্যাটা বেশি ঘুমাচ্ছে? খেলতে খেলতে বসে যাচ্ছে, চামড়াগুলো সাদা হচ্ছে?’

ফুলমণি উত্তরে হ্যাঁ বললেই ওপাশ থেকে ডাক্তার বাবু বলতেন,‘এবার নিয়ে আসবে।’ অথবা বলতেন,‘ঠিক আছে যেগুলো বললাম সেগুলো যেদিন থেকে শুরু হবে এখানে নিয়ে আসবে।’

একবার অবশ্য ডাক্তারবাবু ফুলমণিকে খুব বকেছিলেন।ফুলমণি শুধু বলেছিল,‘ব্যাটাট কেমন যেন কালো পারা মুতছে।’

–তুমি মারবে তোমার ছেলেটাকে।আজকেই যেমন করে পারো নিয়ে এসো।

সেদিন ব্যাটর বাবা বিশুটাও ঘরে ছিল। বাসও চলছিল।তাড়াতাড়ি নিয়ে চলেও গেছিল।

মাস্টারের মুখে শোনার পর ডাক্তারবাবু আগের বারের রক্ত দেওয়ার দিনটা বলতে বলেন।আগের মতই জিজ্ঞেস করেন।সব কিছু শুনে ডাক্তার বাবু আবার রেগে উঠে বলেন,‘যেমন করে হোক কাল বা পরশুর মধ্যে ছেলেটাকে নিয়ে এসো।না হলে কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।’

–হাসপাতাল!

মোড়ল আবার এখন গাঁয়ের কেউরে হাসপাতালে যেতে না করে বলেছে,‘ইখন কেউ হাসপাতালে যাবি নাই, রোগট ধরি যাবেক।কুনু রোগ হলেই গাঁয়ের ধবল ডাক্তারকে দেখাই লিবি।’

ফুলমণির আবার গাঁয়ের ডাক্তারটকে ভালো লাগে না।ব্যাটা খুব বদ।সবাই বলে ব্যাটার কাছে কুনু বিটি ছিলা পায়ের ব্যথা দেখাতে গেলেও আজে বাজে জায়গায় হাত দেয়।পদির প্রথম প্রথম যখন জ্বর আসত, ব্যাটাট ছুটতে লাড়ত, ঘুম থেকে উঠেও আবার শুয়ে যেত।তখন ধবল ডাক্তারের কাছে বিশু লিয়ে যেতেই বলে,‘তুই এক কাম কর, বউকে বল বেশি করে বুকের দুধ খাওয়াতে।’

-ছয় বছরের ছিলা, বুকের দুধ কি খাওয়াবে কি গো? তুমার মাথাট গেছে।

ফুলমণিরা আর যায় নাই।

মোড়ল আবার সব কিছু শুনে জান বুড়োর কাছে দেখাতে বলে।জানবুড়ো শিকড় বাকড়, মাদুলি সব কিছু দিলেও পদি ঠিক হয় না।গাঁয়ের লোক ফুলমণিকে দেখা হলেই বলে,‘গাঁয়ের আর কুনু কেউ তো এমন নাই গো, তুমার ছিলাট এমন হল কেনে? তুর গেদে গরম, ঠাকুর দেবতাকে কুনু ভয় ডর নাই।উর লগেই তো এমন সব হচে রে।’

তখন এই মাস্টারই একদিন ফুলমণিকে বলে,‘শুন, ওসব বাজে কথা, ঠাকুর দেবতা সব বাজে কথা।এটা একটা রোগ।তুই পদিকে লিয়ে হাসপাতালে চলে যা।আমার খুব একটা ভালো লাগছে না।তাড়াতাড়ি নিয়ে গেলে ভালো করে ট্রিটমেন্টে হবে।না হলো সব তো চারদিকে শুনছিস। দিন কাল এক্কেবারে ভালো নয়।’

মাস্টারের কথাতে ফুলমণি আরো ভয় পায়।এই একটা মাত্র ছেলে।হবার সময় ডাক্তারে বলেছিল,‘শুনোগো তুমার কিন্তু আর ব্যাটা বেটি হবেক নাই।অনেক গলদ আছে।’

ফুলমণি সব কিছু জানতে চেয়েছিল।ডাক্তারবাবু কোন উত্তর না দিয়ে বলেছিলেন,‘অতো সব বললে তুমি বুঝবে না। যেটা বললাম শুধু সেটুকুই শুনবে।’ ঠিক যেমন পদির কি শরীর খারাপ তা ফুরমণি জানে না।জানেনা বিশুও।শুধু ডাক্তার বাবু বলেছেন,‘তোমার ব্যাটার রোগটা ভালো রোগ নয়।খুব যত্ন করে রাখতে হবে ভালো করে খাওয়াবে। যখন দেখবে খেলতে পারছে না, বেশি সময় ঘুমাচ্ছে, শুয়ে শুয়ে বেড়াচ্ছে, বা গা সাদা হয়ে যাচ্ছে তখনই হাসপাতালে নিয়ে আসবে। রক্ত লাগবে। দেরি করলেই কিন্তু মুশকিলে পড়বে।’

ফুলমণি ডাক্তার বাবুর কথা সব শোনে।এমনিতে টাকা পয়সার জোর নেই।তারপর সরকারি হাসপাতাল হলেও কিছু তো খরচ লাগে।লোকের জমিতে মজুরের কাজ করে সেরকম রোজগার না হওয়ার জন্যেই বিশুকে অন্য রাজ্যে কাজ নিয়ে চলে যেতে হয়।ব্যাটাটাকে তো বাঁচাতে হবে।তারমধ্যেও একখানা ঘর করেছে, ছেলেটার জন্যেও খরচ হয়।তাও গতবারই যাবার ফুলমণির জন্য একটা ফোন কিনে দেবার কথা বলে গেছে।

মাসে দু’মাসে বা পদির ডাক্তার দেখানোর দিন থাকলে গ্রামে চলে আসে।

ফুলমণির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। মানুষটা এবার আসবে কিভাবে?

ডাক্তারবাবুকে ফোন করাবার সময় কথাগুলো বলতেই উনি বলেন ‘তোমার ছেলের রোগ কি এই লকডাউনের জন্য অপেক্ষা করবে? যদি বাঁচাতে চাও যেভাবে হোক হাসপাতালে এস।’

ফুলমণি গাঁয়ের সবার কাছে যায়।গাড়ির খোঁজ করে, না পেয়ে মোটর সাইকেলের খোঁজ করে।তেল ভাড়ার সাথে আরো বেশি টাকা দেওয়ার কথা বলে।বিশু কারোর কাছে থেকে কিছু টাকা ধার নেওয়ার জন্য বলেওছে।অবশ্য কেউ বলতে তো সেই মাস্টার বাবু।গাঁয়ের আর কারোর অত টাকা দেওয়ার মুরদ কই? চাইবেই বা কিভাবে। সবাই তো দিন আনা দিন খাওয়ার রাস্তায়, তার উপর এই লক ডাউনে লোকের রোজগার এক্কেবারে বন্ধ। ফুলমণির কথাতে সবাই মোটরসাইকেলে চাপাতে রাজি হলেও হাসপাতাল শুনে পিছিয়ে আসে।এমনকি সব খবর পেয়ে সেদিনই মোড়ল ফুলমণিকে নিজের বাড়িতে ডেকে পাঠিয়ে বলে,‘হাসপাতাল গেলে কিন্তু গাঁয়ে ঢুকতে পারবিনি।তুর শরীরে রোগ ঢুকল কিনা কে বলবে?শেষে গাঁয়ের সবাই তুর লগে মরবেক।’

ভয় পেয়ে যায় ফুলমণি।জিজ্ঞেস করে,‘থাকব কোথায়? ছিলাটকে রক্ত না দিলেও যে বাঁচবেক নাই মোড়ল মশাই।’ –তুই ভাব।তুকে যেমন তুর ব্যাটাকে দেখতি হবেক আমাকেও তেমনি এই গাঁ’টকে তো দেখতি হবেক।

 আর কিছু বলেনা ফুলমণি।গলায় শুকনো কান্না আটকে আসে।

মাস্টারের বাড়ি গিয়ে বিশুকে ফোন করে সব বলতে ওপাশ থেকে বিশু বলে,‘শুন আমাদের ইখান থেইকে অনেকেই হেঁইটেই ফিরছে গা। তু যদি বলিস আমিও হাঁটা লাগাই।’

চমকে ওঠে ফুলমণি।এমনিতেই ট্রেনে চেপে ফিরতেই গোটা একদিন সময় লাগে।তারপর বাস, সব কিছু মিলে অনেক দেরি।এখন আবার তো সব বন্ধ।হেঁটে কি আর এতোটা পথ আসা যায়।

বিশুকে বলে‘থাকগো, আমি দেখছি।যদি গাঁয়ের লোক ঢুকতে না দেয়, শ্মশানে থাকবো। মা’কালি তো আর তাড়াবেক নাই।’

ফুলমণি মাস্টারের কাছে গিয়ে সব কিছু বলতে মাস্টার তার ঘরের দেওয়ালে দাঁড় করানো সাইকেল দেখিয়ে বলে,‘আমার বয়স একটু কম হলে এই সাইকেলে চাপিয়েই নিয়ে চলে যেতাম।এখন আর বেশি দূর চালাতে পারিনা। হাঁপিয়ে যাই।তাছাড়া পয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ কিমি রাস্তা, মুখের কথা নয়। দুপাশে জঙ্গল, এই সময় তো লোকজনও বেশি থাকছে না। তারপর হাতির উৎপাত।একা মেয়ে মানুষ রাত থাকতে যাবেই বা কিভাবে? কয়েকদিন দাঁড়াও দেখছি।’ 

–সাইকেল!

ফুলমণি ঘরে ফিরেই ভাবতে থাকে।সত্যি তো সাইকেল নিয়ে যাওয়া যায়। ওতো নিজে ভালোই সাইকেল চালাতো। বিশুর একটা সাইকেল ছিল।এখন খারাপ হয়ে পড়ে আছে।বাগাতে বিস্তর খরচ। মাস্টার বাবুকে বললে সাইকেলটা একদিনের জন্য দেবে না?

ফুলমণির মাথার মধ্যে মাস্টারের কথাগুলো ঘুরতে আরম্ভ করে।মোড়লের কথাও কানে বাজে।গাঁয়ে ফিরলেও ঢুকতে দেবে না।তখন কি হবে? এই নুনু ছিলা লিয়ে কুথাকে থাকবেক কুথাকে খাবেক? 

চারদিকে নিকষ অন্ধকার।কিন্তু হাসপাতালে যেতে হলে রাত থাকতেই বেরোতে হবে।পাশে শুয়ে আছে পদি।চোখ মুখটা সাদা হয়ে আসছে।ফুলমণি ঘড়ি দেখে রাত দুটো। দুটো শাড়ি, আর ব্যাটার কয়েকটা জামাকাপড় নিয়ে রাতের অন্ধকারেই মাস্টার বাবুর ঘরে গিয়ে দরজা ঠোকে।মাস্টারবাবু ফুলমণিকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,‘এত অন্ধকারে কোথায় যাবে? তারপর এত বড় ব্যাগ নিয়ে।’

ফুলমণি মাস্টারের সাইকেলটা দেখিয়ে বলে,‘একদিনের লগে ইটো দাও, আমি চালাতে পারি।’

-সে পারলেও এই অন্ধকারে কেউ যায় নাকি? দুপাশে জঙ্গল, হাতি বেরোয়। তুমি যাবে কিভাবে?

–ফুলমণি ব্যাটাকে দেখিয়ে বলে,‘আমার একটই ব্যাটা গো।ইয়ার যদি কিছু হয় তুমিই বল কেমনে বাঁইচবো আমি? গাঁয়ের লোক ঢুকতে না দিলে তুমি শুধু এই ব্যাগট একটু দিয়ে আসবে। আমি ঐ শ্মশানেই থাকবো। আর যদি হয় একটু চাল আলু দিবে। 

মাস্টারবাবু আর কথা না বাড়িয়ে সাইকেলটা এগিয়ে দেয়।

অন্ধকার ঠেলে তারপরেই এগিয়ে যায় ফুলমণির সাইকেল, পিছনে বসে থাকে তার ছেলে।

মাস্টার বাবু বেশি ক্ষণ দেখতে পারে না।চোখ দুটো ভিজে গেলেও ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে।এটা অবশ্য ফুলমণি দেখতে পায় না।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance