ঋভু চট্টোপাধ্যায়

Romance Tragedy

4  

ঋভু চট্টোপাধ্যায়

Romance Tragedy

পরিচয়

পরিচয়

9 mins
224


              



নিমাই দাস আর আমি একই দপ্তরের পাশাপাশি দুটো টেবিলে কাজ করি।আমি অবশ্য বয়স এবং জয়েনিং তারিখের বিচারে নিমাইএর থেকে সিনিয়ার।আমরা দুজন প্রতিদিন স্টেশন থেকে অফিস পর্যন্ত একই বাইকে যাতায়াত করি।স্টেশন থেকে অবশ্য দুজন দুটো আলাদা ট্রেনে চাপি।নিমাই খুবই ভদ্র, শিক্ষিত ও মার্জিত রুচির মানুষ।তবে নিমাইএর একটাই অসুবিধা, উত্তর দেওয়া ছাড়া নিজে পাল্টা কোন প্রশ্ন করে না, কথা বলে না।আমি সহ অফিসের অন্যান্যরা যে সময় রাজনীতি, অর্থনীতি থেকে শিক্ষানীতির আলোচনার বন্যা বইয়ে দি সেখানে নিমাই থাকে নিরুত্তর, নিরুত্তাপ।ইউনিয়নের নেতা থেকে আরম্ভ করে দপ্তরের আধিকারিক প্রত্যেকেই নিমাইএর এই ব্যবহারের কথা জানে।প্রথম প্রথম নিমাইএর এই আচরণে আমারও অস্বত্বি হত,এক্কেবারে পাশের টেবিলের লোক, ঘাড় ঘোরাতে গেলেও যার মুখ দেখতে হয়, সে কিনা কলিগদের সাথে কোন কথা বলে না, এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি।নিমাই জয়েন করবার কয়েকমাস পরে একদিন জিজ্ঞেস করি,‘ভাই এই যে আমরা একই জায়গায় মাসের পর মাস কাজ করছি, তোমার কি মনে হয় না, এতে আমাদের মধ্যে একটা ভালো সম্পর্ক তৈরী হয়েছে?’ আমার কথা শুনে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিমাই বলে,‘হ্যাঁ হয় তো, খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়, আবার খুব খারাপ সম্পর্কও হয়।’

 –তুমি যদি এতই সব বোঝ তাহলে এরকম ভাবে এত চুপচাপ থাকো কেন?

–কে জানে?

কিছু সময় চুপ থেকে বলল,‘আপনাদের তো কথা বলবার অনেক লোক তাদের মধ্যে আমি যদি কথা না বলি কারোর কি অসুবিধা হয় ? আমি আমার মত থাকি না।’

এই উত্তরের পর আমি পাল্টা প্রশ্ন করবার আর ধৈর্য দেখাতে পারিনি, শুধু নিজেকে বোঝালাম, তুমি বাবু তোমার মতই থাকো, আমরা আমাদের মত।এরপর নিমাই এর মৌনব্রত মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেলেও আমি নিমাইকে কোন প্রশ্ন করিনি, এমনকি অফিস থেকে বেরিয়ে একই বাইকে যাবার সময়েও না।যেহেতু নিমাই আমার সাথে একই বাইকে স্টেশন থেকে অফিস পর্যন্ত আসা যাওয়া করে স্বভাবতই নিমাইকে কিছু বলতে হলে আমার ডাক পড়ে। আমি সব সময় নিমাইকে বলি আর নিমাই ঘাড় নাড়ে।নিমাই অফিসের কোন অনুষ্ঠান, কলিগদের কারো বিয়ে, পৈতে, শ্রাদ্ধ অন্নপ্রাশণ সহ কোন নিমন্ত্রণ রক্ষা করে না।এই রকম ব্যবহারের জন্যে অফিসের কয়েকজন নিমন্ত্রণ পত্রে ওর নাম লিখে আবার কেটে দেয়, পরে অবশ্য আলোচনা হয়, ব্যাপারটা অনেকের কাছে দৃষ্টিকটু লাগে। অনেকে আবার ওর শেয়ারের টাকাটা হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার কথাও বলে।তবে নিমন্ত্রণ করা বা না করা কোন কিছুতেই নিমাইএর খুব একটা অসুবিধা হয় বলে আমাদের মনে হয় না।প্রশ্ন করলে শুধু হেসে ফর্মালিটি পালন করে, তবে কোন দিনও উপহার কেনার চাঁদা দিতে ইতস্তত করে নি এবং টাকাটা প্রতিবারেই আমার হাতেই দিয়ে দেয়।এই রকম ভাবেই নিমাইএর সাথে কয়েক বছর কাটিয়ে দিলাম।এই কয়েক বছরে নিমাই এর অবস্থার খুব সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে।আমার সাথে আগের থেকে দুই শতাংশ কথা বলা বাড়িয়েছে।একদিন অফিসের ছুটির পর আমাকে বলে,‘বর্মনদা আজ আমি আপনার দিকে যাব, বাঁকুড়া যেতে হবে।’


নিমাইএর মুখে এককালীন এতগুলো কথা শুনে প্রথমে একটু অবাক হয়ে যাই।এই এতগুলো বছর আমার বাইকের পিছনে বসে যাতায়াত করে শুধু মাত্র মাসের প্রথমে গাড়ির তেল খরচ বাবদ আমাকে কিছু টাকা দেওয়ার সময়, ‘এই নিন’, আর বাইক থেকে নেমে ‘ আসছি।’ এই কথা দুটো ছাড়া নিমাই কোন দিন কোন রকম দ্বিতীয় কথা বলে নি।স্বভাবতই এত গুলো কথা শুনে আমি উত্তরে জিজ্ঞেস করি,‘বাঁকুড়াতে যাবে মেয়ে দেখতে?’

নিমাই এক্কেবারে কাঠের মত মুখ করে বলে, ‘না, অন্য কাজ আছে।’

 আমার মান্থলি টিকিট থাকায়, ও টিকিট কেটে ট্রেনে চাপে।ট্রেনটা ওখান থেকে ছাড়বার জন্য একটু আগে এলে মনের মত জায়গা পাওয়া যায়।আমি, নিমাই দুজনে জানলার ধারে দুটো সিট নিয়ে বসি।নিমাই চা খাওয়ায়। লোকাল ট্রেনে এক ঘন্টার যাত্রাপথ, নিজের থেকেই আমার বাড়ির ব্যাপারে বেশ কিছু প্রশ্ন করে।আমার উত্তর মন দিয়ে শুনে নিজেই উত্তর দেয়,‘আমি একদিন আপনার বাড়ি যাব।’ আমি ভরসা পেয়ে জিজ্ঞেস করি,‘আচ্ছা নিমাই তুমি এমনি ভাবে কেন থাকো?’

–এমনি মানে কেমনি?

-এই কারোর সাথে কথা না বলা, না মেশা।

ট্রেন সেই মাত্র ছাড়ল, নিমাই জানলার দিকে তাকিয়ে কিছু সময় বসে থাকবার পর বলে ‘এই সব কথার কি জবাব দেব, তার থেকে আপনাকে একটা গল্প বলছি, মন দিয়ে শুনুন।আপনি অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন, রাস্তার এক ঘেঁয়েমিটাও কেটে যাবে।এমনিতেই আমার মত লোকের সাথে কোথাও যাওয়াটা একটা দুঃস্বপ্ন।’

নিমাইএর এই কথাটা আমাকে নাড়িয়ে দেয়।তবে আমি কিছু বলবার আগেই নিমাই তার গল্প বলা আরম্ভ করে।


-এক গ্রামের শেষ প্রান্তে বেশ কয়েক ঘর রুইদাস ফ্যামিলি থাকত।গ্রামের অন্য সবার কাছে পাড়াটার নাম ছিল মুচিপাড়া।মুচি পাড়াতে থাকত সুবল রুইদাস, গ্রামে পরিচিত ছিল সুবলা মুচি নামে।সুবল ঘরামীর কাজ করত, না হলে টুকটাক ফাই ফরমাস খেটে সংসার চালাত।সুবলের বউ সাপের কামড়ে মারা যাবার পর মেয়ে রীনা স্কুল যাওয়া ছেড়ে ঘরের সব কাজ কর্মের দায়িত্বের সাথে ভাইটাকে মানুষ করবার দায়িত্বটাও নিজের কাঁধে তুলে নেয়।রীনার সাথে তার ভাইয়ের বয়সের পার্থক্যও ছিল, এমনি ভাবেই বেশ চলছিল।কিন্তু রীনার বয়স পনেরো হতেই পাড়ার সবাই রীনার বিয়ে দেওয়ানোর জন্য সুবলকে চাপ দিতে আরম্ভ করে।পাড়ার সব মাতব্বররা বলতে থাকে,‘এত বড় বিটি আমাদের পাড়াতে তো নাই, তুই উয়ার বিয়ার কথা ভাব।’ওদের সামনে মাথা নেড়ে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ’ বলে এলেও আসলে সুবলের, রীনার বিয়ে দেওয়ার কোন ইচ্ছেই ছিল না।রীনাও ঠিক পাকা গিন্নীর মত বাবা কাজ থেকে ফিরলে এক থালা ভাত এগিয়ে দিত।সেই সঙ্গে মায়ের মতই রাত্রে বাবার নেশার সাথে যুদ্ধ করে বাড়ির ভিতর নিয়ে যেত, এই পরিতৃপ্তি একমাত্র সুবলই বুঝতে পারত।স্বভাবতই রীনার শূন্য ঘরের হাহাকার কি হতে পারে সেটা ভেবেই সুবল ভয়ে শিউড়ে উঠত।কিন্তু অনেক চেষ্টা করলেও পাড়ার সব লোকের চাপে কিছুটা বাধ্য হয়েই সুবল রীনার বিয়ের ব্যবস্থা করে পাশের গ্রামের কালু দাসের সাথে।কালু দাস ভ্যান চালায়, বয়সে রীনার থেকে কিছুটা বড় হলেও আপত্তি করে নি।পাড়ার সবাইকে সুবল সামর্থ্য মত একটা ছোটখাটো ভোজ দেয়। ঘর ও মন শূন্য করে রীনা চলে যায় কালুদাসের বাড়ি।সুবলের ছেলে স্কুল ছেড়ে সুবলের সাথে ঘরের কাজে হাত লাগাতে আরম্ভ করল।তবে সুবলের বাড়ি রীনার জন্যে খুব বেশি দিন ফাঁকা থাকেনি।বিয়ের মাত্র এক মাসের মধ্যেই রীনা কালুর বাড়ি ছেড়ে আবার নিজের বাবার বাড়িতে একরকম পাকাপাকি ভাবেই ফিরে এল, এই ফিরে আসার নেপথ্যে কোন আজানা কারণ ছিল কিনা তা একমাত্র রীনাই জানত।বাপের বাড়ি এসে রীনা আরো পাকা গিন্নী হয়ে উঠল।পাড়ার সূত্র মেনে কারণে অকারণে ঝগড়া করতে বের হওয়া রীনার মুখের কাছে কেউই দাঁড়াতে পারত না।প্রথম কয়েকটা দিন বিয়ের চিহ্ন হিসাবে শাঁখা সিঁদুর পড়লেও খুব অল্প দিনের মধ্যে সমস্ত জঞ্জালকেই টা টা করে রীনা পুরোপুরি আবার সেই সুবলের ঘরেরই হয়ে উঠল।এদিকে পাড়ার লোকেও সুবলের নিজের আচরণের মধ্যেও অনেক পরিবর্তন লক্ষ করল।সুবল কাজ থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে লাগল, নেশা করাও আগের থেকে অনেক কমালো।’

নিমাই এর মুখে গল্প শুনতে শুনতে কিভাবে যে সময় পেরিয়ে যেতে লাগল তা নিজেই বুঝতে পারলাম না। অন্যদিন বাড়ি ফেরবার সময় টুকটাক কিছু না কিছু খেতাম, কিন্তু সেদিন নিমাই এর গল্পের জোয়ার আমার সব ক্ষিধে চেষ্টাকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল।প্রথমে সেই এক কাপ চা, যা দুজনে পান করে ছিলাম, ব্যাস ঐ টুকুই। নিমাইও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিজের গল্পের গতির সাথে আপোস করেনি।আমি একবার নিমাইএর গল্প থামিয়ে জল পান করে আবার ঢুকে গেলাম, রীনা আর সুবলের ঘরে।নিমাই আবার আরম্ভ করল।

এদিকে রীনা বাড়ির কাজ করবার পাশাপাশি বাবু পাড়ার বেশ কয়েকটা বাড়ির কাজ আরম্ভ করল।পাড়ার লোকে খবর পেল এক বিশেষ বাবুর বাড়িতে রীনা কাজ আরম্ভ করতেই বাবুর সাথে নাকি একটু বেশি দহরম মহরমও আরম্ভ হয়েছে।তবে পাড়ার লোকে সব শুনে আড়ালে আলোচনা করলেও সামনা সামনি তখনও কেউ কিছু বলেনি।এমনি ভাবেই সব কিছু চলতে লাগল।মাস চার এমনি করে কেটেও গেল।পাড়ার কয়েকটা মেয়ে রীনার শরীর এবং হাঁটাচলার পরিবর্তন মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করে রীনাকে কাজ থেকে ফেরবার সময় দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘তুর কি খবর বলত, আমরা কয়েকদিন ধরেই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি।’ রীনা একটু থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কেনে? আমার আবার কি ব্যাপার হবেক, আমি তো ঠিক আছি।’

–তুই তো পোয়াতি, তুর তো গতরটো দেখেই বুঝি গেছি।

 প্রথমে রীনা অবশ্য কিছুতেই স্বীকার করে না।পাড়ার সবাই মিলে চেপে ধরে বলতে আরম্ভ করে, ‘ তুই সব ঠিক করে বল, না হলে এই পাড়াতে তুকে থাকতে দিব নাই,মোড়লের কাছে লিয়ে যাব, সবাই মিলে….’

তার পরে সবাই সবার মত করে যে যা শুনেছে তার হিসাব দিতে আরম্ভ করে। কিছুটা বাড়িয়ে বলা থাকলেও অনেক কথা সত্যিও ছিল।রীনা তাদের কোন কথার কোন জবাব না দিয়ে এক রকম ছুটে তাদের কাছ থেকে পালিয়ে বাড়ি গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।পাড়ার মেয়েরাও রীনার পিছন পিছন এসে সুবলের বাড়ির সামনে চিৎকার আরম্ভ করে দিল।দেখতে দেখতে সুবলের বাড়ির সামনে লোকজনের সংখ্যা বাড়তে লাগল।

-সুবল তখন অন্য গ্রামে কাজে গেছিল, কিন্তু গোলমালের কথা শুনতে পেয়ে তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে এসে সেই জমায়েতের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল, ‘কি হনছে, এত ভিড় কেনে?’

–তোমার বিটি তো মুখ পুড়ানছে, বর তো অনেক দিন আগেই খ্যাদারে দিনছে, তা সত্ত্বে ও এখন প্যাটে বাচ্চাটো আসে কি করে? তুমি কি খবর কিছু জান, না আমরা যে খবর জেনিছি সেটই ধরে পুধানের কাছকে লিয়ে যাব। ভিড়ের মধ্যে থেকেই একজন আবার বলে উঠল, ‘সব কথাই শুনতে পেছি, একট বাবুর সাথে লাকি এখন ভারি পিড়িত হনছে, দিন রেতে তো বাবুর ঘরকেই পড়ে থাকা হচে, বলি পেটের ট বাবুর বটে নাকি?’ সুবল এতক্ষণ একটা কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে সবার কথা শুনছিল, মুখ দিয়ে একটা শব্দও বেরোচ্ছিল না।ভিড়ের ভিতর থেকে কয়েকজন আবার মাঝে মাঝে ধমকের সুরে বলছিল, ‘তোমার বিটির লগে তো পাড়ার অন্য বিটি ছিলাদের কারোর বিয়ে দেওয়া পর্যন্ত মুশকিল হয়ি যাবেক, গোটা গেরামের মুখ পুড়িছে. ইয়ার পর কি কারোর বিটির বিয়া হবেক?’ সুবল ঠিক কি জবাব দেবে ভেবে পাচ্ছিল না।কিছু সময় পরে ভিড়ের সামনে এসে হাত জোড় করে সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠল, ‘আমার বিটির হয়ি আমি মাফ চেয়ি লিছি, আমরা কাল সকালেই এই গ্রাম ছেড়ি চলি যাব, তখন তুমাদের আর কুনু কিছু বলবার থাকবেক নাই।’ সুবলের কথা শুনে উপস্থিত দের কয়েকজন বলে উঠল, ‘সে না হয় তুমি চলি যাবে, কিন্তু আমাদের তো জানতে হবেক তোমার বিটিটর এই রকম করলেকটা কে?’

-তবে তুমরা যুনট ভালো বুঝ কর, ইয়ার বেশি আর বলতি লারব।

পরের দিন ভোর হবার আগেই সুবল আর রীনা সেই গ্রাম ছেড়ে নতুন জায়গায় চলে গেল।এবার অবশ্য গ্রাম নয় শহর, সেই শহরের একটা বস্তিতে সুবল আর রীনা থাকতে আরম্ভ করে।সুবল ঘরামী, রাজমিস্ত্রি, জোগাড়ের কাজ ও জুটিয়ে নেয়।সময় এগিয়ে চেলে, রীনার গর্ভের জনও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে।সুবল এক হাতুড়ে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগও করে, যাতে পেটেরটাকে নষ্ট করে দিতে পারে,কিন্তু রীনা রাজি হয় না।শহরের সরকারি হাসপাতালে সন্তানের জন্ম হয়, এক নতুন জীবন আরম্ভ হয়, নতুন স্বপ্ন দেখাও শুরু হয়।

আমি নিমাইকে একটু থামিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘সুবলের ছেলের কি খবর, ও কোথায় গেল?’

–যেদিন সুবলের বাড়িতে লোকজন এসে ঝামেলা করছিল, সেদিন ছেলেটা মাঠে খেলছিল।কিন্তু মাঠ থেকে আর বাড়ি ফিরে আসেনি।সুবল বা রীনা সেই রাতে খোঁজ করলেও কোন খোঁজ পায় না।অবশ্য সুবল আর রীনা গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে গ্রামের লোক নদীর জলে ছেলেটার লাশ ভাসতে দেখে।

সুবলের মুখে গল্পটা শুনে তৃপ্তি পেলাম না।সেই এক ঘেঁয়েমি বাংলা সিরিয়াল মার্কা বস্তা পচা গল্প।নতুন কিছু শোনবার প্রত্যাশা থাকলেও মাঠে মারা গেল।এরকম ঘটনাতো আকছার হয়।এখন এই সব ধরা ছোঁয়ার মধ্যে থাকে না।কাজের লোকের সাথে সম্পর্ক তো এখন প্রায় শুনতে পাই।তবে আমি এসব কথা নিমাইকে কিছু বলিনি, একেই তো ছেলেটা কথা বলে না, তার ওপর আমি কিছু বললে হয় তো অভিমানে আমার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দেবে, সেটা আরো সমস্যার হয়ে যাবে।এদিকে আমার গন্তব্যস্থলে চলে আসার জন্য নিমাই এর কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় তার দিকে তাকাতেই ওর চোখের কোণে জল চোখে পড়ল।আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘কি ভাই, তোমার চোখে জল?’ নিমাই চোখ মুছতে মুছতে বলে, ‘দাদা, বুকে অনেক কষ্ট জমে আছে, একটু কাঁদি, তাতে যদি বুকটা একটু হাল্কা হয়।’

‘কাঁদলে কি বুক হাল্কা হয়, নাকি আরো ভারি হয়ে যায়?’

একথা নিমাইকে জিজ্ঞেস করতে না পারলেও বুঝলাম নিমাই এর সাথে এই গল্পের একটা দারুন সম্পর্ক রয়েছে। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাঁকুড়ার কোথায় যাবে?’

–মাকে দেখতে, শরীর ভালো নয়।

-তোমার বাবা কি মারা গেছেন?

 নিমাই সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘বাবার কথাটা থাক, এটা আমি বলতে চাই না’


আমি আর কোন প্রশ্ন না করে নিমাইকে আমার বাড়িতে আসতে বলে আমি আমার জায়গায় নেমে গেলাম।পরের দিন থেকে আবার আগের মত অফিস চলতে থাকল। আমি নিমাই যেমন ছিলাম তেমনি থাকতে লাগলাম, আমি অবশ্য নিমাই এর গল্পের কথাটা কাউকে বলিনি।ঠিক মাস দুই পরে অফিসের সব কর্মীদের একটা ডেটা বেস তৈরির জন্য কর্মীদের নাম, বাবার নাম সহ যা কিছু লাগে সব অফিসের কম্পিউটারে এন্ট্রি করছিলাম।আমাদের সবার নাম, ধাম সব লোড হচ্ছিল, কিন্তু নিমাই এর বাবার নাম কম্পিউটারে লোড করবার সময় চমকে উঠলাম। নিমাই দাস, বাবা সুবল দাস, পি.এফের নমিনি রীনা দাস, শেয়ার একশ শতাংশ, রেলেশেনশিপ মাদার।

কম্পিউটারে সব কিছু এন্ট্রি করবার পর কিছু ক্ষণ চুপ করে বসে থাকলাম।মাথায় কিলবিল করা অনেক প্রশ্নের উত্তর পেলেও নিমাইকে কোন প্রশ্ন করতে পারলাম না, বুঝলাম মৌনতা কত শান্তির। 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance