ঋভু চট্টোপাধ্যায়

Romance Others

3  

ঋভু চট্টোপাধ্যায়

Romance Others

মাঝের মানুষ

মাঝের মানুষ

7 mins
11.7K




গৌতমের অফিস থেকে এসে আবার ফোনটা নিয়ে বাইরে চলে যাওয়াটা ইতুর খুব একটা ভালো লাগেনি।যতবারই ফোনটা আসে ততবারই গৌতম মুখ চেপে ফোনটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়।ব্যাপারটা যে ভালো নয় সেটা আন্দাজ করা হলেও হুট করে তো কিছু বলা যায় না।এমনিতেই গৌতমের কথা মত অফিসের বিরাট চাপ।টিফিন খেতে পর্যন্ত সময় পায় না।বাড়িতে আসার পরেও ফোনের কামাই নেই।কিছু জিজ্ঞেস করলে রেগে যাচ্ছে।চোখ মুখ গম্ভীর হয়ে উঠছে।মাঝে মাঝেই বলছে,‘এই ঘরের সব কিছু এমনি এমনি হয় না।অফিসে মুখে রক্ত তুলে, টাকা ইনকাম করি, আর তাতেই তোমাদের পোদ্দারি।’ সেই বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই কাজের চাপের কথা শুনে আসছে।তখন অবশ্য সমস্ত কাজ করত, বাবুকে স্কুলে দিয়ে আসত।সানডেটে সবাইকে নিয়ে ঘুরতে বেরোত।কোথা থেকে কি হয়ে গেল।

তোমাদের বলতে ইতু আর তাদের একমাত্র মেয়ে রীমা।এবছর ক্লাস ইলেভেনে পড়ে, ইংলিশ মিডিয়াম।ফোনের ব্যাপারটা সেই প্রথম শট আউট করে ইতুশ্রীকে বলতেই ইতু বেশ গম্ভীর ভাবে উত্তর দেয়,‘বাবার কাজের খুব চাপ, সেই সবের ফোন হয়ত।তুই ওসবে মাথা ঘামাস না।’

সেদিনকার মত রীমা চুপ করে গেলেও কয়েকদিন পর আবার মাকে বলে,‘মাগো কিছু একটা ব্যাপার আছে।বাবা অনেক রাতে ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোন করে, তুমি একটু খোঁজ নাও।’

-রাতে ফোন!কত রাতে?

-তাও ধর দুটো, আমি তখন পড়ছিলাম।

ইতু মেয়েকে কিছু না বললেও সে রাতেই গৌতম শুতে যাওয়ার পরে খুব শান্ত ভাবেই জিজ্ঞেস করে,‘তোমার অফিসের খুব চাপ?’

-হ্যাঁ চাপ তো আছেই।

-রাতেও ফোন করতে হচ্ছে?

গৌতম কোন উত্তর না দিয়ে ইতুর দিকে তাকিয়ে বলে,‘কি বলতে চাও?’

-না মানে কাল অনেকরাতে আমার ঘুম ভেঙে গেছিল, ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে কাকে যেন ফোন করছিলে।গৌতম কোন উত্তর না দিয়ে ইতুর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে একটু ইতস্তত করেই জবাব দেয়,‘ঐ একজন কলিগ ফোন করছিল, তুমি অন্য কিছু ভেবো না?’

-না না এতে অন্যকিছু ভাববার কি আছে?

সে’রাতে ইতুশ্রীর অনেক দেরিতে ঘুম আসে।করপরেট সেক্টরে চাকরি।প্রায়ই চাকরির জন্য বিভিন্ন জায়গায় গৌতমকে ট্যুরে যেতে হয়।ফেশবুকে ছবিও দেয়।অনুভা বলে একটি মেয়ের সাথে গৌতম ক্যাবিনেট শেয়ার করে।অনেকবার বাড়িতেও এসেছে।ওভারর্স্মাট, তবে কোন সম্পর্ক তৈরী হবার মত মানুষ নয়।অন্তত ইতুর তাই মনে হয়েছে।এরা হুটহাট শরীর দিয়ে দেবে কিন্তে মন দেবে না।আর মন না দিলে কি ফোন হয়?কে জানে অন্যকিছুও হতে পারে। সমস্যা হল সত্যি যদি কিছু হয় তবে তো যাবার আর কোন রাস্তা থাকবে না।রীমার এই মাঝ রাস্তায় পড়া, আর ভাবতে পারা যাচ্ছে না।পাশে শুয়ে থাকা গৌতমের দিকে তাকায়।এখন কত নিশ্চিন্ত এই লোকটা, যেন এই পৃথিবীতে কারোর কোন সমস্যা নেই।সবাই শান্তিতে ঘুমাচ্ছে এখন।ইতু শুয়ে থাকতে পারে না।বিছানা ছেড়ে ব্যালকোনিতে দাঁড়ায়।ঘরটা যখনই বদ্ধ লাগে তখনই এই ব্যালকোনিটাই শ্বাস নেওয়ার জায়গা।তাও বেশিক্ষণ দাঁড়াতেও ভালো লাগে না। রীমার ঘরে আলো জ্বলছে।ইতু ড্রয়িংরুমে এসে রীমার ঘরে হাল্কা টোকা মেরে বলে,‘বাবু অনেকরাত হল ঘুমিয়ে পড়, কাল স্কুল আছে।’

ওপাশ থেকে উত্তর আসে তুমি ঘুমাও নি?

ইতু বলতে যায়, ‘ঘুম আসছে না।’বলতে পারে না।বদলে বলে,‘এই যে ঘুম ভেঙে গেল,তুই এবার ঘুমিয়ে পড়, আর দরজা খুলতে হবে না।’

রীমাকে দরজা খুলতে নিষেধ করলেও নিজের দরজাটা কারকাছে খুলবে।বাড়িতে বাবা-মা’কে এই সব কথা বলা যায় না। একমাত্র বোন বাইরে থাকে।পাড়ার যে’কজনের সাথে কথাবার্তা হয় তারা তাদের নিজেদের স্বামীর সম্পর্কে বললেও ইতু নিজে কোনদিন গৌতমের ব্যাপারে একটা কথাও বলে নি।কিন্তু কাউকে কিছু বলতে না পারলে তো ভিতরে ভিতরে গুমড়ে মরতে হবে।গৌতম নিয়ম করে অফিস থেকে দেরি করে ফেরে।এক একদিন অনেক রাত হয়ে যায়। এমনকি ছুটির দিনেও বেরিয়ে যায়।কিছু জিজ্ঞেস করলেই রেগে যায়।ঝগড়া হয়, এক দিন তো বলে ওঠে,‘সব সময় কানের কাছে এমন ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ কোরো না তো, ইচ্ছে হলে থাকো না হলে যাও।’

-যাও মানে?

-পথ দেখো।

পথ!সত্যিই কি কোন পথ আছে?রীমার পড়াতো এখন মাঝপথে, আর ইতু নিজেও তো শুধু মাত্র একজন গ্র্যাজুয়েট।না জানে কম্পিউটার, না জানে অন্য কিছু।ঘরের চারটে দেওযাল জীবনের সব রস এক রকম শুষে নিচ্ছে।দোকান বাজার ইলেকট্রিক রীমার স্কুল, টিউসন সব এক হাতে সামলেও ইতুর নিজেকেই ঘৃণা লাগে, তাহলে কি কিছু কমতি আছে, শরীর কি আগের মত নেই, না তা তো হবে না, কয়েকদিন আগেও রীমার এক ক্লাসমেটের মা বলে উঠলেন,‘আপনাদের দুজনকে দু’বোন মনে হচ্ছে।’

সব ভুল হয়ে যাচ্ছে।যদি সত্যি সত্যিই গৌতম একটা সম্পর্কে জড়িয়ে যায় তবে তো খুব মুশকিল।মাথাটাও ঠিক থাকছে না কয়েকদিন আগেই সব্জি বজারে হিসাবে ভুল করে বেশি টাকা দিয়ে ছিল।চেনা লোক তাই ফিরিয়ে দিয়েছে।মুদিখানার দোকানেও টুকটাক ভুল হয়ে যাচ্ছে।এক ভারী দম বদ্ধ করা অবস্থা।রীমা মাঝে মাঝেই এসে জিজ্ঞেস করে,‘মা, কিছু বুঝতে পারলে?’

-না রে বাবু, সব কেমন যেন ধোঁযাশার মধ্যে।

কয়েকদিন পর রীমা স্কুল থেকে বাড়ি এসেই বলে,‘মা,হাসপাতালে কে ভর্তি আছে গো? অনুশ্রীর বাবার সাথে বাইপাশের একটা হাসপাতালে দেখা হয়ে ছিল, বাবা নাকি কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয় নি।এমন একটা ভাব করেছিল যেন চেনেই না।’ আমাকে বলে,‘আমি তো ভাবলাম কাকিমার খুব শরীর খারাপ।’

ইতু কোন উত্তর দেয় না।বুকের ভিতর সেই হাতুড়িটা আবার দমদম করে বাজতে আরম্ভ করে।রীমাকে খেতে দিয়েই গৌতমের অফিসের সন্তোষদাকে ফোনে ব্যাপারটা বলে।অফিসের কেউ হাসপাতালে ভর্তি আছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই উত্তর শোনে,‘না গো আমাদের তো কেউ হাসপাতালে নেই।এখন তোমাদের আত্মীয়দের মধ্যে কেউ আছে কিনা সেটাতো জানি না।’ এবার ইতু আর নিজেকে সামলাতে না পেরে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে।সন্তোষকে ফোনে সব কিছু বলে।সন্তোষ সব শুনে উত্তর দেয়,‘কথাগুলো বলা ঠিক না ভুল জানিনা তবে গৌতম বেশ কয়েকমাস ধরে অফিসে বেশ ইরেগুলার।দেরি করে ঢুকছে, তাড়াতাড়ি বেরোচ্ছে।আমরা তো ভাবছি তোমাদের কারোর কোন শরীর খারাপ।এদিকে প্রচুর পেণ্ডিং কাজ,কয়েকদিন আগে একটা প্রবলেমও হয়েছে।এখন তুমি যা বললে তাতে তো ব্যাপারটা খুব একটা সুবিধাজনক জায়গায় নেই।’

ইতু ফোনেই কাঁদতে কাঁদতে বলে তুমি একটু দেখো দাদা সংসারটা ভেসে যাবে।

-দেখছি কি করা যায়?কিছু খবর পেলেই বলব।

ফোনটা রেখে ইতু একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয় অফিসের কারোর সাথে কিছু হয় নি।তাহলে ঘটনাটা বাইরের্ আত্মীয়দের মধ্যে কারোর কিছু হলেও হতে পারে বিশেষ করে গৌতমের কাকা জ্যাঠাদের।তা হলেও তো বলত।কিন্তু সত্যিই যদি আরেকজনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তখন কি করা যাবে?এখন কত কিছু হচ্ছে চারদিকে।ব্ল্যাকমেল, মার্ডার পর্যন্ত।সর্বনাশ মার্ডার হয়ে গেলে?সতীনের সাথে ঘরটা না হয় করে নেবে, কিন্তু মার্ডার হয়ে গেলে?গৌতমকে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করবার কথা ভাবে।কিন্তু ওরও শরীর ভালো নেই, চোখ মুখে চাপা কষ্ট। বোঝা যাচ্ছে চূড়ান্ত একটা মানসিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।ইতুদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

কয়েক সপ্তাহ পরেই সন্তোষদা ফোন করে বলে,‘শোনো, গৌতম এখন প্রতিদিন বাইপাশের ধারে একটা নাসিংহোমে যাচ্ছে।এইটা একটু খোঁজ নাও।’

রীমাও কয়েকদিন আগে বলল।তারমানে কেউ একজন ভর্তি আছে। কিন্তু কিভাবে খোঁজ পাওয়া যাবে?নিশ্চয় কিছু একটা কাগজ পাওয়া যাবে।পরেরদিন থেকে গৌতম আর রীমা বেরিয়ে যাবার পরেই ইতু গৌতমের সব ব্যাগ বের করে খুঁজতে আরম্ভ করে।রীমাকে কিছু বলে না, গৌতমকেও না।শুধু একের পর এক ব্যাগ বের করে খোঁজা।কিছু পাওয়া যায় না।শুধু পুরানো কিছু হাবিজাবি ছাড়া।

এদিকে গৌতম যথারীতি রাত করেই বাড়ি ফেরে, কারোর সাথে সেরকম কথা বলে না। জিজ্ঞেস করলে শুধু জবাবটুকু দেয়।একদিন ইতু রীমার সামনেই বলে,‘হাসপাতালে যাচ্ছ, কেউ কি ভর্তি আছে?’

গৌতম দপ করে জ্বলে ওঠে,‘সব ব্যাপারে এত প্রশ্ন ভালো লাগে না।আমারও কিছু নিজস্বতা থাকতে পারে।’ ইতুও রেগে যায়।সারা সন্ধে চেল্লাতে থাকে।রাত হয, গৌতম আগেই শুয়ে পড়ে, ইতুও কিছু প্রশ্ন করতে পারে না।’

পরের দিন দুজন বাইরে বেরিয়ে গেলে আবার সারাটা ঘর এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে।একে এক দুটো ঘর বারান্দা শেষ করে হাত পরে ডিভানে।খুঁজতে খুঁজতে একটা ছোট্ট ব্যাগের মধ্যে কয়েকটা পুরানো দলা পাকানো কাগজ পায়।খুলে একটু পড়েই বুঝতে পারে গৌতমকে লেখা বহু পুরানো দিনের প্রেমপত্র।গৌতমের এঞ্জিনিয়ারিং জীবনের লিপি।এতদিন দেখতে পায় নি?অদ্ভুত তো।ইতু সব চিঠিগুলোই যত্ন নিয়ে পড়ে।পরমা নামের কেউ একজন লিখেছে।ডেট না থাকলেও ইতু মোটামুটি একটা টাইম সিকোয়েন্স পায়।শেষটাতে পরমার সরে যাবার কথাও বোঝে।কিছু একটা কারণে বিয়ে হয় নি।গৌতম ব্যাপারটা ইতুকে বলেও নি।

ইতু সব চিঠিগুলো আলাদা করে রাখে।রীমাকে কিছু না বললেও সেদিনই রাতে গৌতমকে জিজ্ঞেস করতেই চমকে ওঠে গৌতম্।‘তুমি কি ভাবে জানলে?’

-সেটা পরের প্রশ্ন, তুমি এডিয়ে যেও না।

একটা লম্বা শ্বাস ফেলে গৌতম্।‘পরে সব বলব।এখন একটু চাপে আছি।’

-ইতু আবার গজগজ করতে আরম্ভ করে।গৌতম কোন উত্তর না দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে থাকে।

পরের দিন ঘুম ভাঙতেই দেখে গৌতম এক্কেবারে রেডি।ইতুর ঘুম ভাঙা দেখেই বলে,‘উঠে গেছ। আমি বেরোচ্ছি।’

-কোথায়?

-তাড়া আছে, পরে বলব।শেষের কথা গুলো বলেই গৌতম বেরিয়ে যায়।

মাথার আকাশ ভেঙে পড়ে।ইতু সঙ্গে সঙ্গে গৌতমকে ফোন করলেও ফোন ধরে না।রীমা স্কুল যায না।মাঝে ইতু একবার অফিসে ফোন করে জেনে নেয় গৌতম অফিসেও যায় নি।সকালের দিকে মা মেয়েতে গৌতমকে পালা করে ফোন করে গেলেও একটু বেলাতে ফোনটা সুইচ্ট অফ পায়।দুজনার কেউই দুপুরে ভাত খেতে পারে নি।মাঝে মাঝে সন্তোষদা ফোন করে জিজ্ঞেস করে কোন ফোন বা অন্য কিছু খবর পেয়েছে কিনা।ঘরের ভিতর মা মেয়ে অধীর অপেক্ষায় বসে থাকে।সকাল থেকে বিকাল, বিকাল থেকে সন্ধ্যা।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত ঢুকব ঢুকব এমন সময় গৌতম বাড়ি ঢুকতেই ইতু চিত্কার করে ওঠে,‘কোথায় ছিলে গো?সারাটা দিন একটা ফোনও নেই।’গৌতম কোন উত্তর না দিয়ে সোফার ওপর বসে কিছুসময় কোন কথা না বলে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ইতুর হাতে দিয়ে বলে,‘আজ সকালে পরমা মারা গেল।আমি তো তোমাকে পেলাম, বাবুকে পেলাম, কিন্তু ও সারাটা জীবন এক্কেবারে একাই থেকে গেল।কয়েকমাস আগে আমাকে দেখতে চেয়েছিল, লাস্ট স্টেজ ছিল।না করতে পারিনি, কয়েকটা মাস সময় দিলাম।’

শেষের কথাগুলো বলতে বলতেই ব্যাগ থেকে একটা প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট বের করে ইতুর হাতে তুলে দিয়ে বলে,‘এগুলোও দেখো।’তারপরেই নিজের ঘরে চলে যায়।

ড্রয়িংরুমের ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকে রীমা আর ইতু।ইতুর হাতে তখনও প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটটা ঝুলছে, বুঝতে পারেনা ঠিক কি করা যাবে?





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance