সাজঘর থেকে স্টেজে (ধারাবাহিক)৪
সাজঘর থেকে স্টেজে (ধারাবাহিক)৪
৪
তাহলে দাঁড়ালো গিয়ে যে, সুগন্ধাবাসীদের রীতিমতো এলেম আছে। "লক্ষ্মণের শক্তিশেলে"র মতো অমন একখানা কঠিন নাটকের পালা কেবলমাত্র গ্রামের কচিকাঁচা ছেলে ছোকরারা মিলেই নামিয়ে দিলো একেবারে ঠিকঠাক করে। দর্শকদের মধ্যে ধন্য ধন্য। বিশেষ করে অমলের কমিক সেন্স এবং সাবলীল অভিনয়ের গল্প তো আশেপাশের গ্রামের লোকেদের মুখে মুখে ঘুরছে। ডিরেক্টর খগেনদার প্রশংসায় তো সবাই পঞ্চমুখ। কী সাংঘাতিক ডিরেক্টর! কুঁচো কুঁচো ছেলেপুলেদের দিয়েই এমন একখানা নাটকে এমন অভিনয় করিয়ে নিলো। তাহলে পরদিন বড়দের অভিনীত যাত্রাপালা না জানি কোন পর্যায়ের উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছবে! এই আলোচনায় মশগুল দর্শককুল। উৎসাহ উদ্দীপনায় মানুষ একেবারে ফুটছে সুগন্ধা দোল উৎসবের দ্বিতীয় সন্ধ্যার যাত্রাভিনয় মঞ্চস্থ হতে দেখার অপেক্ষায়। যত বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যের দিকে যাচ্ছে, ততই উত্তেজনার পারদও চচ্চড় করে চড়ছে। অবশেষে সন্ধ্যে নামতে না নামতেই আলোয় আলোয় আলোকিত চারধার। ভেঙে পড়ছে মানুষের ঢল। বসার জায়গা পুরো ভর্তি। দর্শকদের বসার জায়গা নেই আর। চারদিকের বাঁশের ঘেরা ভেঙে পড়ার জোগাড়। শেষপর্যন্ত ভলান্টিয়াররা ঘেরা খুলে দিতে বাধ্য হলো। পড়ে গেলো ফার্স্ট বেল। তারপর সেকেন্ড বেল। তারপর থার্ড বেল পড়ার সাথে সাথেই তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে শুরু হলো যাত্রার মিউজিক কনসার্ট, সঙ্গে বিবেকের গলায় গান। বাহ্, বাহ্, চমৎকার। শুরুতেই এই, তবে না জানি কি মারাত্মক যাত্রাপালা অভিনয় হবে আজ। সত্যিই ভারী সুন্দর এগোচ্ছে সব। একদম মসৃণ গতিতে। লঙ্কারাজ রাবণের সীতাহরণ এবং জটায়ুর সাথে রাবণ রাজার যুদ্ধ পর্যন্ত সব নির্বিঘ্নে।
যাত্রায় প্রত্যেক অঙ্ক দৃশ্য পরিবর্তনের সময় ডিরেক্টর খগেনদা বিবেকের গান রেখেছে। চমৎকার গায় ছোকরা, বেড়ে গলাখানা। এবারে পালা এগোচ্ছে রাবণ রাজের লঙ্কাপুরী থেকে বন্দিনী সীতা উদ্ধারের দৃশ্যের দিকে। "রাবণ বধ" পালায় রামের চরিত্রে অভিনয় করছে সুগন্ধার পুবপাড়ার নবীন। আর লক্ষ্মণের চরিত্রে অভিনয় করছে পুবপাড়ারই গণেশ, ওরফে গণশা। সীতার শোকে বিলাপ করতে করতে রামরূপী নবীন সাজঘর থেকে বেরিয়ে সোজা বুক চাপড়াতে চাপড়াতে স্টেজে উঠলো প্রায় ছুটতে ছুটতে। তাকে অনুসরণ করে লক্ষ্মণরূপী গণশাও এসে উঠলো স্টেজে। ডিরেক্টর খগেনদার তেমনই নির্দেশ। তারপর এসে রামরূপী নবীন স্টেজের একধারে এক্সপ্রেশন দিয়ে দাঁড়াবে। তার থেকে সামান্য দূরে রামের দিকে পেছন করে লক্ষ্মণরূপী গণশা দাঁড়াবে অন্যপাশের দর্শকদের দিকে মুখ করে এক্সপ্রেশন দিয়ে। সব ঠিকঠাক। ডিরেক্টর পাখিপড়া করে সবাইকে রোল বুঝিয়েছে কী আর এমনি এমনি? কোথাও যাতে কারো কোনো ভুলচুক যাতে না হয়ে যায়। তারপরও প্রম্পটার পটলদার হাতে একখানা লম্বা সরু লিকলিকে কঞ্চি। যার যখন পার্ট তখনই ঠিক আগের মুহূর্তে তার পায়ের পাতায় কঞ্চির খোঁচা দিয়ে তাকে পটলদা সতর্ক করে দিচ্ছে। যাতে কেউ কোনো ডায়ালগ মিস্ করে না যায়, বা ভুলভাল করে অন্যের পার্টের সাথে নিজের পার্ট গুলিয়ে না ফেলে। সুন্দর ব্যবস্থা। কোনো ঝামেলা গণ্ডগোল পাকানোর কোনো সম্ভাবনাই নেই।
এবার রামের পার্ট, রামরূপী নবীন লক্ষ্মণরূপী গণশার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে, দু'হাতের জেশ্চার দিয়ে, আবেগঘন গলায় পার্ট শুরু করলো। রুদ্ধশ্বাস জনতা। চোখ ছলছল। রামরূপী নবীনের ডায়ালগ, "চলো, চলো ভাই লক্ষ্মণ, চলো যাই ত্বরা করি সীতা উদ্ধারিবারে। বধ করি ঐ নরাধম পাষণ্ড রাবণেরে, অশোককানন হতে সীতারে ফিরায়ে আনিবারে, চলো ভাই লক্ষ্মণ, চলো যাই ত্বরা করে।" রামের ডায়ালগ শেষ হবার মুহূর্তেই যথারীতি প্রম্পটার পটলদা লক্ষ্মণরূপী গণশার পায়ের পাতায় খোঁচা দিয়ে সতর্ক করেছে। গণশাও লক্ষ্মণের ডায়ালগ শুরু করেছে রামের দিকে ফিরে, "যাবো না? যাবোই তো সীতা উদ্ধারিবারে! সেদিন যে ধান রুইতে রুইতে আধখানা বিড়ি চেয়েছিনু, দিয়াছিলে কি মোরে? ভুলিয়া গিয়াছিলে কি যাইবে কেমনে লঙ্কায় একেলা, সীতা উদ্ধারিবারে?" পটলদার কঞ্চির ঘনঘন খোঁচা খেয়েও কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই গণশার। গণশার ডায়ালগ শেষ হতেই দর্শকাসনে প্রবল হাসির রোল আর তুমুল হাততালি। এদিকে ডিরেক্টর খগেনদা তখন সাজঘরে বসে নিজের মাথার চুল ছিঁড়ছে। হায় হায়, একী কাণ্ড! কোনোরকমে বিবেককে পাঠিয়ে একটা বাড়তি গান ঢুকিয়ে খগেনদা কোনোরকমে পরিস্থিতি সামাল দিলো। সাজঘরে ফিরে আসতে খগেনদা গণশাকে এই মারে তো, সেই মারে। কোনোরকমে রামরূপী নবীন খগেনদাকে সামলায়। জানা যায় রহস্য। যাত্রার স্টেজ রিহার্সালের দিন দুপুরে ক্ষেতে ধানের বীজতলায় রোয়ার কাজের সময় গণশা ফোকটে নবীনের কাছে আধ খাওয়া বিড়িতে ক'টা সুখটান দিতে চেয়েছিলো। নবীন দেয় নি বিড়ি। এবং তখনই প্রতিজ্ঞা করে ফেলেছিলো গণশা, এর শোধ ও তুলবে ঠিক পালার দিনে। আর ব্যাস্, যেমন ভাবা তেমন কাজ! গণশা লক্ষ্মণের ডায়ালগটি বানিয়ে বানিয়ে বলে যাত্রাপালা প্রায় পণ্ড করে ফেলে আর কী। তারপর অবশ্য ডিরেক্টরের বিস্তর গালাগালি খেয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে কোনোরকমে পরের অংশে নিজের পার্টটুকু ঠিকঠাক করেই বলে যাত্রাপালার শেষ দৃশ্য পর্যন্ত।
গণশার ব্যাপারটা সামলে নিয়ে পালা আবার গতি পেলো। শেষ অঙ্কে পৌঁছে গেছে পালা। টিনের তলোয়ার, বাঁশের কঞ্চির তীরধনুক আর এক বিরাট আকারের থার্মোকলের গদা নিয়ে ভয়ানক যুদ্ধ হলো রাম রাবণের। অর্থাৎ রামরূপী নবীন আর রাবণরূপী শ্রীদামের মধ্যে। গদার হাতল ভেঙে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিঘ্ন হয় নি। রামের হাতের তলোয়ারের আঘাতে রাবণ বধ হলো। রাবণ বুক চেপে ধরে বড়সড় ডায়ালগ দিয়ে বিভীষণকে দোষারোপ করে, বিষ্ণু অবতার রামের বন্দনা করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। ঢলে পড়ার ঠিক আগে জোড়হাতে রামের দিকে মুখ করে রাবণের এক অট্টহাসি। এই ছিলো ডিরেক্টর খগেনদার নির্দেশ। কিন্তু এইখানটায় এসে রাবণ ডায়ালগ শেষের সুরের সাথে মিলিয়ে বলতে থাকলো প্রম্পটার পটলদার দিকে তাকিয়ে, "পড়ে যাবো, না পালাবো? পড়ে যাবো, না পালাবো?" পটলদার ইশারায় বুঝলো রাবণরূপী শ্রীদাম, তাকে স্টেজ থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। যাত্রাপালা শেষ। তুমুল হাততালি। স্টেজ থেকে বেরোচ্ছে একদম প্রথমে রাবণ অর্থাৎ শ্রীদাম, তার পেছনে পেছনে রাম লক্ষ্মণ, হনুমান, জাম্বুবান, সুগ্রীব, অঙ্গদ, বানর সেনার ক'জন এবং বিভীষণ। মিউজিক মাস্টারের কনসার্ট প্রবলবেগে বাজছে। হাততালিতে ফেটে পড়ছে দর্শকাসন।
হঠাৎই এবারে রাবণ মানে শ্রীদাম উল্টোপথে ছোটা শুরু করলো। সাজঘরের দিকে না গিয়ে সবাইকে ঠেলেঠুলে প্রায় ফেলে দিয়ে আবার বুক চেপে ধরে গিয়ে স্টেজে উঠলো শ্রীদাম একলা। সবাই হতভম্ব। খগেনদা দু'হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লো। আর স্টেজে উঠে রাবণরূপী শ্রীদাম বুকে হাত দিয়ে সে কি অট্টহাসি... হা হা হা হা হা! আসলে পড়ে যাবো, না পালাবোর চক্করে আর প্রম্পটার পটলদার ইশারায় শ্রীদাম মানে যাত্রাপালার রাবণ ভুলে গিয়েছিলো স্টেজে এই অট্টহাসিখানা হেসে আসতে। তাই ভুলটি মালুম হতেই নিবেদিতপ্রাণ অভিনেতা শ্রীদাম ছুটেছে স্টেজে, সেই অনিচ্ছাকৃত ভুলের মেকাপ দিতে। হাসি চলছে... হা হা হা হা হা হা। ওদিকে দর্শকদের মধ্যে চলছে হাততালির ঝড়। ততক্ষণে পালার ডিরেক্টর খগেনদার মাথায় আর ক'গাছি চুল বেঁচে রইলো, তার হিসেব করবার আগেই প্রম্পটার পটলদার ঘোষণা। তারপর আলুর আড়ৎদার জগন্নাথবাবুর গদগদ ঘোষণা। "লক্ষ্মণের শক্তিশেল" পালা নাটকের হনুমানের ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকদের অভিভূত করেছে সুগন্ধা গ্রামের সেরা কিশোর অভিনেতা অমল। আর "রাবণ বধ" পালায় লক্ষ্মণের ভূমিকায় অভূতপূর্ব নিজস্ব ডায়ালগের জন্য বিশেষ পুরস্কার পাচ্ছে গণেশ মানে গণশা। এবং সবশেষে সমবেত দর্শকদের উল্লাসধ্বনির মাঝে ঘোষিত হলো এই দুই পালা মিলিয়ে সেরার সেরা অভিনেতার পুরস্কার পাচ্ছে রাবণের ভূমিকায় অভিনয় করে শ্রীদাম। হনুমানের ভূমিকায় অমল পাচ্ছে নগদ পাঁচশো টাকা, লক্ষ্মণের ভূমিকায় গণেশ পাচ্ছে নগদ একহাজার টাকা, আর রাবণের ভূমিকায় শ্রীদাম পাচ্ছে নগদ দু'হাজার টাকা।
দর্শকদের বিপুল হাততালিতে অমল, গণেশ আর শ্রীদামের পোশাকে সেফটিপিন দিয়ে পুরস্কারের টাকা আটকে দিলেন জগন্নাথবাবু। আর মাইকের ঘোষণা আর হৈচৈ হাততালিতে একটা আওয়াজ চাপা পড়ে গেলো। সেটা হলো দুই পালার ডিরেক্টর খগেনদার ভেউভেউ করে কান্না। সে কী কান্না! দুঃখের বা আনন্দের... দুটোই হবার প্রবল সম্ভাবনা। তবে খগেনদার হাততালি দেওয়া দেখে এবার মনে হচ্ছে, এ কান্না সাফল্য, জয় ও স্বীকৃতির। জয় লঙ্কেশ রাবণের জয়।