রুম নাম্বার ৯ ( প্রথম ভাগ )
রুম নাম্বার ৯ ( প্রথম ভাগ )
অদ্রিকা ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা তাই ধীরে ধীরে তৈরী হয়ে খুব সাবধানে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় । আজ অফিসে যাওয়ার সময় গতকালের "লাইফ ওয়েলনেস সেমিনার" এর কথা ভাবছিল । এটি একটি বিষয়ের উপরেই বারবার জোর দিয়েছে -
"আপনার বস, সহকর্মী, অধস্তনদের ভাল জিনিসের প্রশংসা করতে ভুলবেন না সেইসাথে অপরিচিতদের সাথে আপনি আপনার সম্পর্ক বুদ্ধি ও উদারতার সাথে গড়ে তুলুন । আপনি যদি পারেন তবে কোনো অসহায় মানুষদের একটু সাহায্য করুন । আপনার সকল প্রকার কর্মের দ্বারা নিজেকে সন্তুষ্ট রাখুন এবং এই জন্য ভগবানের কাছে কৃতজ্ঞ থাকুন । "
অদ্রিকা আরও কয়েক দিন কাজ করে তারপরে maternity leave নেবে । যখনই সম্ভব হয় ওর স্বামী ওকে অফিসে পৌঁছে দেয় আর নয়তো ক্যাব ভাড়া নিয়ে যেতো । কিন্তু আজ সে নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছে, নতুন গাড়ি কিনেছে সে নিজের জন্য । যদিও অন্তঃসত্ত্বা হওয়ায় স্বয়ং ড্রাইভ করাটাকে একটু এড়িয়ে চলে সে ।
অদ্রিকা হেসে ধন্যবাদ জানালো নিরাপত্তারক্ষীকে যিনি গেট খুলেছিলেন যখন নিজের গাড়ি নিয়ে আজ প্রথমবার প্রধান গেটে প্রবেশ করেছিল । মনে মনে বেশ উৎফুল্ল অনুভব করছিল সে, এভাবে বায়ুমণ্ডলে একটি ইতিবাচক শক্তিরও সৃষ্টি হয়। বেশ কিছু জমে থাকা কাজ শেষ করার আনন্দ তার মুখে ফুটে উঠল, তবে অবশ্য রাতে অফিস থেকে বের হতে অনেক দেরী হোলো । তখন রাত দশটা : দশ মিনিট । অফিসের কাজে আজ খুব চাপ ছিল । আজকের বৈঠকে, অদ্রিকা এবং তার গ্রুপ খুব দ্রুত পণ্য সরবরাহ করার জন্য গ্রাহকদের অতিরিক্ত চাপে পড়েছিলেন । তার মাথায় ক্রমাগত একই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল । তারপর হঠাৎ গতকালের সেমিনারের কথা মনে পড়ল। সে আজ নিরাপত্তারক্ষীকে যে প্রশংসা করেছিল তার কথা মনে পড়ল এবং সকল ভালো ভালো কথাগুলো মনে পড়তেই মন ভালো হয়ে গেল এবং তার মনের থেকে অফিসের চাপ কিছুটা কম হোলো ।
অদ্রিকা কম যানজট দেখে একটি রাস্তা ধরলো । গাড়ি চালাতে চালাতে জানালা দিয়ে ডানদিকে তাকাল অদ্রিকা তখন হঠাৎ একজন মহিলার চিৎকার শুনতে পায়, তড়িঘড়ি গাড়ি থামিয়ে দেখলো একটা অটোরিকশা দাঁড়িয়ে আছে । ঐ অটোরিকশা থেকেই একজন মহিলার চিৎকার ভেসে আসছিল । অটোরিকশার সামনে গিয়ে আওয়াজ দিতেই একজন লোক উঁকি দিল যাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল । " মনে হচ্ছে গতকালের সেমিনারে ব্যবহৃত কথাগুলো এখন কাজে লাগানোর সময় !" এই ভেবে অদ্রিকা অটোরিকশাওয়ালা আর লোকটিকে জিজ্ঞেস করল, "কি হয়েছে ভাই , উনি চীৎকার করছেন কেনো ? কিছু হয়েছে কী ? " ঠিক সেই সময় অটোরিকশার ভিতরে থাকা মহিলাটি আবার চীৎকার করে ওঠে ।
তখন তিনি রিকশায় একজন গর্ভবতী মহিলা ও তার স্বামীকে দেখতে পান ।
রিকশাচালক বললেন, "রিক্সাটা হঠাৎ breakdown হয়ে গেছে ম্যাম । আমরা যাই করি না কেন, এটা এখন চলবে না এদিকে এই ভদ্রমহিলার প্রসব বেদনা অনেক বেড়ে গেছে । ওনাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে । "
এক মুহূর্তও চিন্তা না করে অদ্রিকা অটোরিকশায় বসা দম্পতিকে বলল, " চলুন, আপনারা দুজন, আমার গাড়িতে আসুন । "
অদ্রিকা অটোরিকশাচালককে ছেড়ে দেয় এবং ঐ গর্ভবতী মহিলা এবং তার স্বামীকে গাড়িতে করে সেই হাসপাতালে নিয়ে যায় যেখানে তাদের যাওয়ার কথা ছিল । পুরো যাত্রার সময় ভদ্রমহিলা অনেক চিৎকার করছিল অসহ্য প্রসববেদানায় । মহিলাটির নাম ছিল মিতালী এবং কাকতালীয়ভাবে এটি একই হাসপাতাল ছিল যেখানে অদ্রিকাও চেক-আপের জন্য আসতো ।
ডাক্তার বললেন, " আপনি ওনাকে ঠিক সময়ে নিয়ে এসেছিলেন কারণ ওনার কেস খুব জটিল হওয়ার সম্ভাবনা ছিল কিন্তু এখন ঝুঁকি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম ।"
" আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ম্যাডাম " এই বলে ঐ দম্পতি অদ্রিকাকে বিদায় জানায় । দুজনেরই ওই শহরে কেউ ছিল না এবং সময়ের আগেই ব্যথা শুরু হওয়ায় হঠাৎ কাউকে ডাকতে না পারায় তারা একটা অটোরিকশায় করে তাড়াহুড়ো করে যাচ্ছিল । কিন্তু অটোরিকশা মাঝপথে breakdown হয়ে যায়, তবে অদ্রিকা তখন সাক্ষাৎ ভগবানের মতো তাদের সাহায্য করে ।
হাসপাতালে, কমলা অস্থির হয়ে উঠছিল, সে জানত না এরপর কি হবে, তার স্বামী তাকে আশ্বস্ত করছিল, তাকে বলছিল যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে ..............
অদ্রিকা বাড়ি ফেরার পথে অফিসের কাজের চাপ ভুলে গিয়েছিল এবং একটি আত্মবিশ্বাসী চিন্তা তার মনে এসেছিল যে সে আগামীকাল গ্রাহকের মুখোমুখি হতে পারবে । যখন সে বাড়িতে ফিরে আসে , আলোচনা থেকে শেখার পরে তিনি তার স্বামী এবং চার বছর বয়সী মেয়েকে তাদের দিনের ভাল জিনিসগুলির জন্য ধন্যবাদ জানাতে ভোলেনি ।
পরের দিন সময় পেলে অদ্রিকা আবার হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ খবর নেয় । দ্যাখে গতকালের মহিলার স্বামী কাঁদছে । তাকে জিজ্ঞাসা করার পরে সে জানতে পারে যে মহিলাটি মারা গেছে তবে শিশুটিকে বাঁচানো গেছে । সেখানে চিকিৎসকরা জানান, দেরি হলে শিশু ও শিশুটির মা দুজনেই মারা যেত ।
ঘটনাটি শুনে অদ্রিকা দুঃখ পেলেও তার সাহায্যে অন্তত শিশুটিকে রক্ষা করায় তিনি খুব খুশি ।
মিতালীকে যে কক্ষে ভর্তি করা হয়েছিল সেটি হাসপাতালের তৃতীয় তলায়, রুম নম্বর
নাইন । সেই ঘরটার অন্য ঘরগুলোর থেকে একটু পার্থক্য ছিল । ওই ঘরের বাইরে করিডোরের দেয়ালে দুই পাশে বিভিন্ন রাশির চিহ্ন আঁকা ছিল , বারোটি রাশির মোট বারো রাউন্ড এবং সেই রাশির চিহ্ন ।
মিতালীর খোঁজখবর নেওয়ার পর ঘর থেকে বেরিয়ে আসার পথে, অদ্রিকা অনুভব করলো মীন রাশির মাছ প্রাচীরের উপর দিয়ে পুলে সাঁতার কাটতে লাফিয়ে উঠছে, অন্যদিকে সিংহ করিডোরে আগত লোকেদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে । সে নিজের কাল্পনিক ধারণা দেখে মনে মনে হেসে সেখান থেকে চলে
গেল ।
কিন্তু কেউ জানত না যে মিতালী যখন মারা যাচ্ছিল, সে তীব্র আবেগে ভরা একটি শপথ করেছিল.......... দেওয়ালে রাশির চিহ্নগুলি সেই শপথের পরেই শান্ত হয়ে গেছে .........
কয়েকদিন কাজের ব্যস্ততার মধ্যে থাকায় অদ্রিকা এই ঘটনাটি ভুলে যায় ।
এদিকে ওই হাসপাতালে আরেকটি ঘটনা ঘটে গেছে ইতিমধ্যেই...........
হাসপাতালের সামনে একটা গাড়ি এসে থামলো.........
প্রসবকালীন এক মহিলা গাড়ি থেকে হাসপাতালে এসে নামে, তার নাম তৃণা ।
তার সাথে একজন বয়স্ক মহিলা ও দুজন পুরুষ ছিলেন । মহিলাটিকে একটি কক্ষে ভর্তি করা হয়েছিল, যে ঘরে মিতালীকে আগে ভর্তি করা হয়েছিল.........৩য় তলায় সেই ৯ নম্বর
কক্ষ ।
ওই ঘর থেকে একটু এগিয়েই ছিল লেবার রুম । দুজনের একজন আগে থেকেই গিয়ে সন্দেহজনক কিছু নিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলছিল । এদিকে তৃণাকে লেবার রুমে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ডাক্তারও কিছুক্ষণ পর লেবার রুমে যান ।
এদিকে ঐ বয়স্কা মহিলাটি এবং লোকটি ইতিমধ্যে এসে তৃণার ৯ নম্বর রুমে বসেছিল, তারা অনেকক্ষণ কথা বলছিল আর একে অপরের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিল । তারপর বয়স্কা মহিলাটি লেবার রুমের দিকে চলে যায় । এরপর ডাক্তার নার্সকে কিছু বলে করে লেবার রুমে চলে যান ।
ওনারা ৯ নম্বর কক্ষের বাইরের দেয়ালে আঁকা বিভিন্ন রাশিচক্রের চিহ্নগুলি ঘোরাঘুরি করে দেখছিল । লেবার রুমে থাকাকালীন তৃণা নামের ওই মহিলার স্পষ্ট মনে পড়ে যে কয়েকদিন আগেই তার শাশুড়ি এবং তার স্বামী একবার তার অজান্তেই তাকে গর্ভপাতের চেষ্টা করেছিল যখন তারা জানতে পেরেছিল যে সে লিঙ্গের ভিত্তিতে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিতে চলেছে । তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিন্তু সে সময়মতো তা বুঝতে পেরেছিল এবং দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ করেছিল । এসব কথা আগে থাকতেই নিজের ভাইকে বলে
রেখেছিল । ফলে বাপের বাড়ির লোক তার শ্বাশুড়ি এবং স্বামীর উপর চাপ সৃষ্টি করে তাতে শাশুড়ি আর স্বামী প্রথমে খুব ঝামেলা করে পড়ে অবশ্য অনুতপ্ত হওয়ার ভান করে । তবুও তৃণা যথেষ্ট সতর্ক ছিল এবং অবশেষে আজ বাচ্চা প্রসবের সময় এসেছে, যা অবশ্যই তার ইচ্ছা অনুযায়ী ঘটতে চলেছে । সে একটি কন্যা সন্তানের মা হতে চলেছে ।
নার্স কি একটা ইনজেকশন দিতেই সে প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করতে লাগল । কিছুক্ষণ পরেই অসহ্য প্রসববেদনায় সে কাতর হয়ে পড়ে । তারপরেই কেমন যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যায় । ঘোরের মধ্যেই সে দ্যাখে তার বাচ্চাটি ভূমিষ্ঠ হোলো , আনন্দে চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা জল । তারপর যখন সে তার সামনে ডাক্তারের বাহুতে শিশুটিকে দ্যাখে মোটেও কাঁদছে না । তখন নার্স বললো , " আসলে শিশুটি সবেমাত্র জন্মেছে তো তাই কাঁদছে না । তুমি ভয় পেয়ো না । " এই বলেই নার্সটি শাশুড়ির দিকে আড়চোখে তাকায় তা পরিস্কার চোখে পড়ে তৃণার । অন্যদিকে তার স্বামী ডাক্তারের সাথে কি যেন ষড়যন্ত্র করে সেটাও বুঝতে পারে তৃণা , কিন্তু সে এতোটাই দূর্বল যে প্রতিবাদ করার মতো শক্তি ছিল না তার শরীরে । তারপরেই তার স্বামী প্রথমে অনুতপ্ত হওয়ার ভান খুব কাঁদতে
শুরু করে এবং অবশেষে তিনি যা করার তা করলেন । তৃণা নিজের চোখের সামনে দেখলো তার স্বামী নিজেরই সদ্যোজাত সন্তানের গলা টিপে ধরেছে আর শিশুটি সামান্য একটু নড়েই স্থির হয়ে গেল । তৃণা সেই আঘাত সহ্য করতে না পেরে প্রাণ
হারায় ।
তৃণা শেষ নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় মনে মনে এক ভয়ানক শপথ নেয় যা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি । কিন্তু সেই শপথের তীব্রতায় দেওয়ালে আঁকা রাশিচক্রের কিছু চিহ্নের মধ্যে সবার অলক্ষ্যেই আমূল পরিবর্তন ঘটে যায় ।
******* to be continued
