রোজগারের সহজ পথ!
রোজগারের সহজ পথ!
বিপদের ধর্মই এই সে কখনও একা আসে না।দোসর ছাড়া সে যেন চলতেই পারেনা।২০২০ সালে করোনার ক্ষত যখন ২০২১এ দগদগে হয়ে উঠে কেড়ে নিচ্ছে একের পর এক প্রাণ তখনই তার দোসর হলো 'ইয়াস' ঘূর্ণিঝড়।বাংলায় ততটা প্রভাব না ফেললেও উপকূলবর্তী এলাকায় বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কথায় আছে না,-"নদীর পারে বাস ভাবনা চিরমাস"। আমফানের ক্ষতে মানুষ যখন সামান্য প্রলেপ লাগিয়েছে তখনই এল 'ইয়াস'।পরিস্থিতির শিকার হয়ে 'কানা চোখো' ভগবানের মুণ্ডপাতকরা ছাড়া আর কী করার আছে সাধারণ মানুষের। আর এই যন্ত্রণার সঙ্গে রাজনীতি যুক্ত হয়ে নাভিশ্বাস ওঠে ওদের। স্থায়ী সমাধান কেউ করে না,শুধুই আশ্বাসের ফুলঝুরি আর অন্যকে দোষারোপ--এই চলতে থাকে।কিন্তু যাদের মাথা ফাটে চুন লাগানোর ব্যবস্থা তো তাদেরকেই করতে হয়।
আমাদের গ্রামের ভুবন কাকা একটা কোম্পানিতে চাকরি করতো।প্রথম করোনার সময় কাজটা হারাল। ছেলেটা বাইরে একটা কারখানাতে কাজ করত। প্রথমবার লকডাউনের কারণে কোম্পানির ব্যবসায় ভাটা পড়ায় কারখানা বন্ধ হলো।কোম্পানি বা কারখানার গেটে তালা ঝোলার অর্থ এদের পেটেও তালা ঝোলা।কিন্তু পেট তো তালা মানবে না। বাপ-বেটার রোজগার আর মেয়ে টুনির দু-একটা টিউশনি করে যে টুকু হয় তাতে ভুবন কাকুদের চারজন সদস্যের পরিবারে কোনো রকমে দিন কাটতো--এই দ্রব্যমূল্যের বাজারে। কিন্তু এখন কী করে চলবে? আগে তাদের অবস্থা এরকম ছিল না।ভুবন কাকু কোম্পানিতে তখন ভালো মাইনে পেত।ছেলেটাও বেশ ভালো রোজগার করত।ভুবন কাকুর বৌ মানে শোভা কাকিমা একটা স্কুলের মিড-ডে মিলে রান্নার কাজ করত।এই নিয়ে বেশ স্বচ্ছল ভাবেই দিন কাটত তাদের।খাওয়া-পড়ার অভাব ছিল না।ছেলেটা মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ে পড়া ছেড়ে দিল। ভুবন কাকু যদিও ওর পড়া চালিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু ছেলে রাজি না হলে কী আর করবে!মেয়ে টুনি অবশ্য বাবার কথা রেখেছে।অষ্টাদশী টুনি কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে কলাবিভাগের সাধারণ পাঠক্রমের ছাত্রী।এইভাবে খেয়ে-না খেয়ে, সুখে -দুঃখে কোনো রকমে দিন গুলো বেশ কেটে যাচ্ছিল ভুবনকাকুদের মতো মানুষ গুলোর।কিন্তু ওই 'কানা চোখো' ভগবান মানুষের সুখ সহ্য করতে পারে না যে। মোহিতলাল মজুমদারের "দুঃখের কবি" কবিতার সেই বিখ্যাত লাইন যে মানুষের আসল জীবন--"একটু বেহুঁশ হয়েছে যেমনি, ওমনি লাগায় চাঁটি।"
২০২০সালে জানুয়ারির শেষ দিক করে শোভা কাকিমার স্টোক হল।মারা না গেলেও শরীরের ডানপাশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেল।সংসারের খরচ বাঁচিয়ে মুখের আহার কেটে মেয়ের বিয়ের জন্য যেটুকু তুলে রাখছিল সেটুকুও চলে গেল চিকিৎসায়।সঙ্গে হারাল শোভা কাকিমার কাজ ও রোজগার।এই অবস্থা থেকে উঠে একটু যেই পিঠটা টান করতে যাবে অমনি পিঠের উপর পরল 'কোরানা' চাবুকের বাড়ি। বাপ-ছেলে কাজ হারিয়ে ঘরে ঢুকে বসল। একদিকে সংসার খরচ অন্য দিকে চিকিৎসার খরচ --কীভাবে জোগাড় করবে তা ভেবে কুল-কিনারা করতে পারে না ভুবন কাকু। চিন্তায় চিন্তায় সেও অসুস্থ হয়ে পড়ল।সরকারের দেওয়া রেশন থেকে যেটুকু পায় আর দু-একটা ক্লাব বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে যেটুকু চাল-ডাল সাহায্য পায় তা দিয়ে এক বেলা খেয়ে আর একবেলা উপোস করে কোনো ক্রমে কাটতে লাগল।আসতে আসতে শুরু হলো অনলকের পালা।খুলতে লাগল দোকান-বাজার।কিন্তু ভুবন কাকুদের কোম্পানি আর খুলল না।আর খুললেও আর কাজ করার মতো শারীরিক অবস্থা তার নেই।ছেলেটা যা হোক একটা স্থানীয় দোকানে কাজে ঢুকল।
এভাবে আবার কোনোক্রমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে সামিল হলো সবাই।পুরোনো দিন মানুষ ফিরে পেল না ঠিকই কিন্তু সেই অ-সুস্থ পরিস্থিতি থেকে কিছুটা সুস্থ পরিস্থিতি ফিরে পেল।কিন্তু সুখ তো বেশি দিন টিকে না।তাই বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আছড়ে পড়ল কোরানার দ্বিতীয় ঢেউ।এই ঢেউ প্রথম বারের থেকে অনেক বেশি ভয়ানক।
মারণ রোগ প্রথম থাবা বসাল টুনির শরীরে।টুনিকে কোভিড হাসপাতালে ভর্তি করা হল।টুনি কোভিড মুক্ত হয়ে সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরতে না ফিরতেই একসঙ্গে অসুস্থ হয়ে পড়ল টুনির বাবা-দাদা।দুজনকেই হাসপাতালে ভর্তি করা হল।তাদের শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালো না।পেট ভরা খাবার নেই শরীর আগে থেকেই দুর্বল।তার উপরে নেশার পরিমাণটা আগের থেকে অনেকটা বেড়েছে।তাই শরীরের ফুসফুসের অবস্থাটা কেমন তা সহজেই অনুমান করা যায়। প্রথমে বাবা তার দু'দিনের মাথায় দাদা-- দু'জনকেই হারাল টুনি।এখন কী করে সংসার চলবে?খাবে কী?মায়ের চিকিৎসা করাবে কী করে ?--এই প্রশ্ন গুলো আরও প্রবল হয়ে উঠল। হাজারো প্রশ্ন-- হাজারো সমস্যা কিন্তু তার সমাধান নাই!
রেশন থেকে যেটুকু চাল পায় তা তো আর জলে গুলে খাওয়া যায় না। তা সিদ্ধ করতে আগুনের দরকার। তাই রেশন থেকে পাওয়া চাল-আটার কিছুটা বিক্রি করে সেই টাকায় একটু ডাল-আলু কিনে জ্বালানির ব্যবস্থা করে।এভাবে দিন কয়েক দু-বেলাতো দূরের কথা একবেলাও পেট ভরে খাওয়া জোটে না।মাঝে মাঝে পুকুর পাড়ের শাক,কারো ঘর থেকে সজনে শাক ভেঙে এনে সিদ্ধ করে পেটটা ভরানোর চেষ্টা করে।কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে? পাড়ার লোকের কাছে ধার-দেনা করে আর কতদিন চলবে। সবার অবস্থায় তো এক--এই পরিস্থিতিতে কে হবে কার "অন্ধের যষ্টী"।তাই একটা কিছু ব্যবস্থা তো করতে হবে।করোনা আর লকডাউনের কারণে টিউশনি আগেই বন্ধ হয়েছে।এখন রোজগারের কোনো রাস্তা সে খুঁজে পায় না।বাবার পরিচিত একজন কে যে-কোনো কাজের একটা ব্যবস্থা করে দিতে বলতেই সে বলে,"মেয়েদের টাকা রোজগার করা তো সব থেকে সোজা রে--আচ্ছা দেখছি। তা যে কোনো কাজ করবি তো?" লোকটার মুখে একথা শুনে টুনি মাথা নেড়ে বলে "হ্যাঁ,যে কোনো কাজ করতে পারব।দাও না কাকু, একটা কাজের ব্যবস্থা করে।আমাদের অবস্থা তো সবই জানো। এখন একটা কাজ না হলে না খেয়ে মরতে হবে মা-মেয়েকে।" টুনির কথা শুনে লোকটা বলল,"বেশ, আজ সন্ধ্যায় আমার সাথে বাড়িতে এসে দেখা করিস।"
সন্ধ্যায় টুনি লোকটির বাড়িতে উপস্থিত হল। বাইরের মেন গেট খুলে ভিতরে ঢুকে দরজায় টোকা দিতেই লোকটি মদের গ্লাস হাতে দরজা খুলে দিয়ে টুনিকে ভিতরে আসতে বলে। ভিতরে ঢুকেই বড়ো ডাইনিং। ডাইনিং -এ মদের বোতল,বাটিতে চাট।ঘরের ভিতরের দরজার ছিটকিনিটা ভালো করে লাগিয়ে লোকটা একটা চেয়ারে বসে টুনিকেও একটা চেয়ারে বসতে বলে।লোকটি টুনিদের পূর্ব পরিচিত তাই টুনি জিজ্ঞাসা করল ,"কাকু,কাকিমা বা ভাই কাউকে দেখছি না।" টুনির এই প্রশ্নে বেশ বিরক্ত হলো লোকটি ;মেজাজের সুরে বলল,"তুই কি কাকিমা, আর ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছিস,না নিজের কাজের জন্য?"টুনি চুপ করে থাকল।লোকটি হাতে থাকা গ্লাসের মদটি একঢোকে খেয়ে নতুন প্যাক বানাতে বানাতে বলল,"তোকে কাজ দেখে দিয়ে আমার কী লাভ হবে?আমি কী পাব?" লোকটার কথা শুনে টুনি।বলল,"আমাকে থেকে কী চাও বলো?আমার কী আছে যে তোমাকে দেব।"টুনির একথা শুনে লোকটি চেয়ারে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে প্রায় অর্ধেক শুয়ে পেট থেকে জামাটি তুলে ভুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বলে,"আমাকে খুশি করতে পারবি?" লোকটার কথাটা ঠিক মতো বুঝতে পারলা না টুনি। তাই মুখ নীচু করে জিজ্ঞাসা করল,''কী করতে হবে?"একথা শুনে লোকটা নতুন প্যাক বানানো বন্ধ রেখে টুনির চেয়ারের পিছনে উঠে গিয়ে তার দু'কাঁধে হাত বুলাতে বুলাতে টুনির ঘাড়ের উপর মুখটা রেখে বলে "নিশি পরী" হতে হবে। লোকটার এরকম আচরণে অস্বস্তি বোধ করছিল টুনির ।তাই কাঁধ থেকে হাতটা সরিয়ে সে উঠে দাঁড়াল।আর বলল,"আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না,কাকু।"লোকটি টুনির হাতটা ধরে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে "আমার সঙ্গে শুতে হবে।সেজন্য আমি তোকে টাকা দেব। " এবার টুনি পুরো বিষয়টা বুঝতে পারে ।জোর করে লোকটার হাতটা ছাড়িয়ে টুনি জানিয়ে দেয় "আমার পক্ষে একাজ করা সম্ভব নয়। না খেতে পেয়ে মরে গেলেও আমি এ কাজ করতে পারবে না।" টুনির কথায় লোকটা বেশ বিরক্তির সঙ্গে মেজাজের সুরে বলে," যা তাহলে সতী হয়ে না খেতে পেয়ে মা-মেয়ে তে মর গা।পুরো মুডটা নষ্ট করে দিল!যা বেরো এখান থেকে।" টুনিও দরজার ছিটকিনিটা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেল চোখের জল মুছতে মুছতে।
সারারাত টুনি দু-চোখের পাতা এক করতে পারল না। একদিকে পেটে খিদের জ্বালা অন্যদিকে তার সাথে ঘটে যাওয়া পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে তার ঘুম আসে না।ভাবতে থাকে মানুষের স্বভাব সম্পর্কে।টুনির গায়ের রংটা চাপা বলে এই লোকটিই একদিন এর এক আত্মীয়র সাথে টুনির বিয়ে হতে দেয়নি--আর আজ--এই লোকটি বাবার পরিচিত ও বাবার সমবয়সী হওয়ায় 'কাকু' বলে ডাকত আর সে কিনা...এই চিন্তা ভাবনার মাঝেই টুনি 'ধপ্' করে একটা আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে মায়ের ঘরে ছুটে গিয়ে দেখে মা বিছানা থেকে পড়ে গেছে আর নাক মুখ থেকে রক্ত বেরচ্ছে। টুনি দৌড়ে গিয়ে পাশাপাশি দু-একটা বাড়িতে ডাকল কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে কেউ আসতে চাইল না।শেষ পর্যন্ত একজন তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলো।কোনো ক্রমে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে মা কে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করল টুনি।কিন্তু ডাক্তার জানিয়ে দিল "এখানে আর কিছু করা যাবে না।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোগীকে বাইরে নিয়ে যেতে হবে।"
''বা..ই..রে... '' কাঁপা গলায় নিজের মনেই টুনি বলে উঠল কথাটা।তাহলে তো অনেক টাকার দরকার।চোখে অন্ধকার দেখে টুনি।কী করবে?কোথা থেকে জোগাড় করবে এতো টাকা।তার পা আর চলে না।কোনো রকমে হাসপাতালের বেঞ্চে বসে পড়ে টুনি।মা ছাড়া যে তার আর কেউ নেই।সারা রাত ভেবে টুনি কোনো পথ খুঁজে পেল না।সে দেখলো তার চোখের সামনে একটাই পথ খোলা মাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানোর--নিশিপরী।
পরদিন সকাল হতেই টুনি ছুটলো পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে যেখানে ওই লোকটা প্রতিদিন চা খেতে আসে।লোকটার পায়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল টুনি,"আমার মাকে বাঁচাও কাকু,আমি তোমার সব কথা শুনব।তুমি যেমন বলবে,যা করতে বলবে আমি সব করব।তুমি শুধু আমার মাকে বাঁচাও।" আসে পাশের সকলে তাকাচ্ছে দেখে লোকটা টুনিকে একটু পাশে ডেকে বলে , ধমকের সুরে বলে,"দেখ এবার কথার নড়চড় করবি না তো?"টুনি মাথা নেড়ে বলে "না " বলে। " তোর তো এখন অনেক টাকা দরকার।কিন্তু আমি তো এতো দিতে পারব না। আমার সাথে আরও দু'জন থাকবে।ওদের থেকে বেশি পাইয়ে দেব ভাবিস না।"টুনি চুপ করে লোকটার কথা গুলো শুনে কিন্তু কোনো উত্তর করে না।টুনিকে চুপ থাকতে দেখে লোকটা জিজ্ঞাসা করে "কিরে রাজি তো?" টুনি মাথা নেড়ে "হ্যাঁ" বললে লোকটি টুনিকে সন্ধ্যায় তার বাড়ি গিয়ে টাকা নিয়ে আসতে বলে।
পরদিন সকালে টুনি মাকে অ্যাম্বুলেন্স করে বাইরে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায়।মাকে শহরের বেশ বড়ো নামকরা নার্সিং হোমে ভর্তি করে।তার সারা শরীর ব্যথা করছে।ভালোভাবে চলতে পারছে না টুনি। সারারাত কেঁদেছে। এখন টুনি বুঝতে পেরেছে মেয়েদের টাকা রোজগারের সহজ রাস্তাটা।
----------------* ---------------