একটি রাতের অভিজ্ঞতা
একটি রাতের অভিজ্ঞতা
দিনটা ভারী বিশ্রী। শীতের দিনে বৃষ্টির মতো বিরক্তিকর কিছু হয় না।তার মধ্যে আমি আবার শীত কাতুরে।দুপুরের পরে বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। ঠান্ডাটাও আগে থেকে বেশ বেড়েছে। দুপুরে অন্ধকার ঘরে মাথা পর্যন্ত লেপ ঢাকা নিয়ে কানে হেড ফোন লাগিয়ে চোখ বন্ধ করে সানডে সাসপেন্স শুনছি। এরকম ওয়েদার ভূতের গল্প শোনার জন্য বেস্ট।
হঠাৎ যেন খুব বেশি ঠান্ডা লাগতে লাগল মনে হলো আমার গা থেকে ঢাকাটা কেউ টানছে। চোখ খুলে দেখি আমার মুখের সামনে কে একটা দাঁড়িয়ে। ভয়ে "কে?" বলে চিৎকার করে উঠি।
–আমি রে আমি,আমি রতন। ওরকম ভূত দেখার মতো করে চিৎকার করছিস কেন?
–শালা,লাইট ধরাতে পারিস না। আমি কানে হেডফোন লাগিয়ে সানডে সাসপেন্স শুনছিলাম। চরম ভয়ের মুহুর্তে দেখি আমার গায়ের ঢাকা সরছে চোখ খুলতেই অন্ধকারে দেখি মাথার পাশে কে দাঁড়িয়ে, ভয় লাগবে না!
আমার কথা শুনে রতন একটা বিদঘুটে হাসি হেসে বলে,–নে এবার ওঠ। চল ঠেকে গিয়ে আড্ডা মেরে আসি। শুভ ফোন করেছিল ওরা চলে এসেছে।
–লাইট টা ধরা।বাইরে বৃষ্টি পড়ছে না?এই ওয়েদারে আমি কোথাও যাব না। ঘরেই বস। এখানেই আড্ডা দে।আমি মা কে বলছি কফি দিয়ে যেতে।
–না এখন আর বৃষ্টি পড়ছে না। বেশ তুই যখন যাবি না বলছিস তখন এখানেই আড্ডা দিই।
রতন আমার বাল্যকালের বন্ধু।চাকরি সূত্রে বাইরে থাকে।এখন ছুটিতে এসেছে।
মা কে কফি করতে বলে এসে রতনের সঙ্গে গল্প করতে বসলাম। স্বভাবতই আজকের গল্পের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়াল ভূত।
–তুই ভূতে বিশ্বাস করিস?–রতন আমাকে জিজ্ঞাসা করল।
"হ্যাঁ তা করি।তবে ভূতে নয়।অতৃপ্ত আত্মাতে বিশ্বাস করি।"
ভূত প্রেত নিয়ে আলোচনা যখন জমে উঠেছে তখন রতন কে জিজ্ঞাসা করলাম–আচ্ছা রতন,তুই তো পড়াশোনার জন্য বাইরে থেকেছিস এখন কাজের জন্য বাইরে থাকিস বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিস তোর কখনও ভূতের বা ওই রকম কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। তুই ভূতে বিশ্বাস করিস?
–দেখ ভূতে আমি বিশ্বাস করি না। তুই জানিস আমি ভূতটুতে ভয়ও পায় না। তবে একটা এরকম অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে।
–মানে ভূত দেখার অভিজ্ঞতা?বলিস কী রে!বল বল।
–ঠিক ভূত দেখার না ,অনুভবের। তবে সেটা ভূত কিনা তা জানি । তবে সেদিন গা টা ছমছম করে উঠেছিল ভয়ও পেয়েছিলাম ভীষণ।
এই সময় মা কফি তৈরি হয়ে গেছে বলে ডাক দিল।কফি নিয়ে এসে রতন কে দিয়ে ও আমি নিজে নিলাম।তারপর কফির কাপে এক চুমুক দিয়ে রতন কে বললাম,–নে শুরু কর তোর ভূত অনুভবের গল্পটা।
–গল্প নয় রে,আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা।
–আচ্ছা, সেই বাস্তব অভিজ্ঞতাটাই বল।
রতন কফির কাপে আর এক চুমুক দিয়ে শুরু করল – তুই জানিস নিশ্চয় দাদুর ক্যানসার হয়েছিল।সময়টা ফাল্গুন মাস।আমি তখন 11এ পড়ি।দাদুর ক্যানসারের শেষ ধাপ চলছে।খুব বাড়াবাড়ি।একবারে এখন তখন অবস্থা। যেদিন মারা যাবে ঠিক তার আগের দিন খুব বাড়াবাড়ি হল। একবারে চোখটোখ জিভটিভ উলটে দিয়েছিল।খবর পেয়েই আমরা সব গেলাম। গিয়ে দেখি ঘরে মরাকান্না শুরু হয়ে গেছে।য়মামা ডাক্তার নিয়ে এসেছে। ডাক্তার একটা ইঞ্জেকশন দিতেই কিছুক্ষণের মধ্যে দাদু একবারে সুস্থ হয়ে উঠে বসল। গল্প করল আমাদের সঙ্গে। সব নাতি নাতনিদের মধ্যে আমি দাদুর খুব আদরের ও প্রিয়।আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করল গালে কপালে চুমুটুমু খেল। যাইহোক দাদু ঠিক আছে দেখে আমরা বাড়ি ফিরলাম।
রতনকে থামিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম–তোর দাদুর বাড়ি কোথায়?
–এই তো কড়িধ্যা। আধঘন্টার রাস্তা।
–ও আচ্ছা।তারপর বল।
–হ্যাঁ।বলি–বলে রতন শুরু করল। পরদিন রাত্রে এই 10-10.30 সময় আবার ফোন এল দাদুর আবার খুব বাড়াবাড়ি। খবরটা শুনে মা কান্নাকাটি শুরু করল। মায়ের কান্নায় পাশের বাড়ির সবাই ছুটে এল কী হয়েছে জানতে। আমি আর বাবা দুজনে গাড়িতে করে গেলাম।মা আর ভাই ঘরে থাকল। ওখানে গিয়ে দেখলাম ডাক্তার দাদুকে দেখছেন। দাদুকে দেখার পর ডাক্তার জানিয়েদেন আর বেশিক্ষণ নেই। মামাদের মুখ থেকে শুনলাম দাদু নাকি সন্ধ্যা থেকে আমাকে দেখতে চেয়েছে।
বাড়িতে মা ভাই একা থাকায় বাবা আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। বলল,–কোনো খবর হলে তখন মা কে নিয়ে আসবি।এখন চলে যা।কারণ বাড়িতে মা ভাই একা আছে। পাড়ার পরিবেশ ভালো নয়।চোরের উৎপাত আছে।
খাওয়া আগেই হয়ে গিয়েছিল তাই ওখান থেকে বাড়ি ফিরে এসে শুলাম। রাত তখন ঠিক 12টা।ল্যান্ড ফোনে খবর এলো দাদু আর নেই। বাবা জানাল মামাতো বোনের জামাই গাড়ি নিয়ে আমাদের বাড়ি আসছে মা কে নিয়ে যাবার জন্য।গাড়িতে মা আর ভাই কে পাঠিয়ে দিয়ে আমাকে ঘরে থাকতে বলল। কারণ ঘর একবারে ফাঁকা রাখা ঠিক হবে না। আমার সাহস আছে যেনে বাবা আমাকে জিজ্ঞাসা করল থাকতে পারব কিনা।আর যদি একা থাকতে না পারে তাহলে পাশের বাড়ির কেবুদাকে ডেকে নিতে বলল। বাবাকে বললাম,"আমি একাই থাকতে পারব।কাউকে ডাকার দরকার নেই।" বাবা বলল,"ঠিক আছে তাই কর।"
সেই মতো জামাইবাবু 12.30 সময় এসে মা ভাই কে নিয়ে গেল। মা-রা চলে গেলে বাইরের দরজা লাগিয়ে এসে আমি শুলাম। এতো বড়ো ঘরে আমি একা।ঘুম আসতে চাই না। দাদুর কথা মনে পড়ছিল। এর মধ্যে কখন যেন চোখ লেগে গেছে। হঠাৎ একটা শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল। রুমের জানলা দিয়ে বাগানে চোখ যেতেই মনে হলো কেউ যেন দাঁড়িয়ে। অন্ধকার থাকলেও একদম স্পষ্ট মনে হলো কেউ যেন একটা দাঁড়িয়ে। আমি "কে?" বলে চিৎকার করতেই সেই ছায়া মূর্তি সরে গেল।এর ঠিক কিছু পড়েই ঘরের মধ্যে একটা হাঁটার আওয়াজ পেলাম।ভাবলাম ঘর ফাঁকা যেনে কেউ চুরি করতে নামে নি তো? তাই আলো জ্বেলে বাইরেটা একবার দেখে এলাম কিন্তু কোথায় কিছু নেই। এসে আবার শুলাম।কিছুক্ষণ পরে আবার মনে হলো বাগানে কেউ যেন কথা বলছে।হাঁটছে।এবার স্পষ্ট দেখতে পেলাম।একটা কালো মুখ।মুখটা ঠিক পরিস্কার নয়,কিন্তু অবয়বটা আমার খুব চেনা। দেখে মনে হলো যেন দাদু।
বাগান থেকে ক্রমশ আমার ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে।পরিস্কার দেখলাম আমার ঘরে ঢুকল সেই ছায়া মূর্তি।কিন্তু মুখটা এখনও দেখা যাচ্ছে না।আমি শুয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে বাগানের দিকে তাকিয়ে এসব দেখছিলাম।এখন পরিস্কার বুঝতে পারছি ছায়া মূর্তিটা আমার শোবার ঘরে আমার মাথার পিছনে হাঁটছে।আমার মুখ থেকে আর আওয়াজ বেরচ্ছ না।আমি খুব জোরে চিৎকার করার চেষ্টা করছি কিন্তু বিশ্বাস কর আমার মুখ দিয়ে একটা শব্দও বেরচ্ছে না।আমার গোটা শরীর কাঁপছে,ঘামে ভিজে গেছে গোটা শরীর।আমার স্পষ্ট মনে হলো কেউ আমার খাটে বসল। আমার গোটা শরীর অসাড় হয়ে গেল। পরদিন সকালে বাবা বাড়ি ফিরে পাঁচিল টপকে ঘরে ঢুকে আমাকে অচৈতন্য অবস্থায় উদ্ধার করে।
এই ঘটনার পর আমি বেশ কিছুদিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম।
এখনও ওই রাতের কথা আমার মনে পড়লে গোটা গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। কেউ কেউ বলে ওটা আমার মনের ভুল ছিল। আবার কেউ কেউ বলে দাদু যেহেতু আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত শেষে আমাকে দেখতে চেয়েছিল তাই দাদু এসেছিল। কিন্তু সেদিন ঠিক কি ঘটেছিল আমি আজও বুঝতে পারলাম না। সেটা আমার মনের ভুল ছিল, না সত্যিই সেদিন দাদু এসেছিল,না অন্য কিছু আমি জানি না।
রতনের মুখ থেকে ওর বাস্তব অভিজ্ঞতা শুনতে শুনতে আমার গোটা গা একবারে কাঁটা দিয়ে ওঠে।আমার সঙ্গে এরকম ঘটলে কী হতো কে জানে!