রেলগাড়ি
রেলগাড়ি
কলিং বেলের শব্দে ঘুম থেকে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলেন সম্পূর্ণা দেবী। বয়স হয়েছে, হাঁটুর ব্যাথাটাও বেড়েছে তার সাথে। দেওয়াল ঘড়িটা টিকটিক করে চলছে। সাড়ে চারটে মত বাজে। দুপুরে ভাত-ডাল খেয়ে শুয়ে কখন যেন দু চোখের পাতা লেগে গেছিল। কোনোরকমে বিছানা ছেড়ে নামলেন সম্পূর্ণা দেবী। এরইমধ্যে দ্বিতীয়বার কলিংবেলের শব্দ বাইরের আগন্তুকের ব্যস্ততা প্রমাণ করল। সম্পূর্ণা দেবী চেঁচিয়ে উত্তর দিলেন
- যাই-ই…
খুক খুক করে কেশে নিয়ে কথাটা শেষ করলেন উনি।
- যাই, কে এসছ?
দরজার বাইরে থেকে উত্তর এল
- দিদি, আমি তপু। দরজা খোল।
- তপু! কত বছর পর রে! দাঁড়া, খুলছি। হাঁটুর ব্যাথাটা যে কি বেড়েছে কি বলব!
- হুমম হুমম, আস্তে আস্তে আয়।
দরজা খুললেন সম্পূর্ণা দেবী। মুহূর্তে যেন সব ব্যাথা ভ্যানিস হয়ে গেল নিজের ভাইকে দেখে। দিদি, ভাই, দুজনেরই মুখের হাসিতে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে আসা অস্তমিত সূর্যের রশ্মি প্রতিফলিত হয়ে চিকচিক করছে।
- কতদিন পর তোকে দেখলাম রে ভাই!
- হা হা! তারপর বল, কেমন আছিস?
- এই তো চলছে রে। তুই কেমন আছিস?
- চলে যাচ্ছে। কিরে! ঘরে ঢুকতে দিবি না?
জিভ কাটলেন সম্পূর্ণা দেবী।
- আরে আয় আয়!
- ব্যাগটা..
- দে আমাকে। তুই এক কাজ কর। হাত পা ধুয়ে রেস্ট নে। আমি বরং তোর জন্য চা বানাই।
- আরে ছাড় না দিদি। তোকে আর কষ্ট করতে হবে না।
- এই, তুই ছোট না আমার থেকে। চুপচাপ যা বলছি শোন।
- যথা আজ্ঞা দিদি।
সম্পূর্ণা দেবী যখন চা বানাচ্ছেন, রান্নাঘরের দরজার সামনে তপু এসে দাঁড়ালো। লাল টি শার্ট, ধবধবে সাদা পাজামায় তপু যেন এক্কেবারে বছর তিরিশ বয়স কমিয়ে বছর পঁচিশের যুবক তখন
- উরিব্বাস! কি সেজেছিস রে!
- না বাপু, আমি ওরম নই যে শুধু আমি সাজব আর তোকে সাজাব না।
- মানে! কি করেছিস তুই?
- কি আবার! একটা শাড়ি কিনে এনেছি। এখন ওটা পরবি তুই।
- পারিসও বটে।
- আরেকটা জিনিসও আছে।
- কি রে?
- ট্যানট্যানা! চকোলেট!!
- তাই?
- ইয়েস মাই সিস্টার!
সম্পূর্ণা দেবী বাম গালে টোল ফেলে হাসলেন হি হি করে। কৃত্রিম হাসিখানা অবশ্য ধরতে পারে নি তপু। সে কিন্তু ভেবেছে সম্পূর্ণা দেবী সত্যিই খুশিতে ডগমগ। সম্পূর্ণা দেবী ফ্রিজের মধ্যে আরো হাজারো চকোলেটের ভিড়ে তপুর আনা চকলেটটাও রেখে দিলেন। সেই সঙ্গে রেখে এলেন একটা দীর্ঘশ্বাস।
- এই দিদি ঘরটা গুমোট হয়ে আছে তো পুরো। দরজা জানালা খুলবি না?
- হুমম, না রে পোকা আসে। খুলি না তাই।
- কখনোই খুলিস না?
- না রে।
- দিনের বেলায় খুলিস না কেন?
- বাদ দে না। বললাম তো পোকা আসে।
- ধ্যাৎ! হতেই পারে না।
- বাদ দে। এই নে, চা এনেছি। ডিম ভাজব?
- না রে, কষ্ট করতে হবে না আর। বোস দেখিনি। গল্প করি। কত দিন পর দেখা!
- আরে রাতের খাবার রেডি করতে হবে তো।
- একদম না। আজ শুধু গল্প। আমি অর্ডার করে নেব খাবার অনলাইনে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও ফেললেন না সম্পূর্ণা দেবী। অল্প হেসে সায় দিলেন তপুর কথায়।
- ছবি দেখবি দিদি? দাঁড়া দেখাই।
মোবাইলটা বের করল তপু। নিজের অখেয়ালেই দু হাতের মধ্যে লুকিয়ে স্ক্রিন লক খুলল তপু। ফোন গ্যালারিটা খুলে প্রথম ছবি একটা জলাধারের সামনে তপুর পরিবার দাঁড়িয়ে আছে।
- এই দ্যাখ দিদি। এটা হল গিয়ে তোর সিডনির একটা ওয়ার্ল্ড ফেমাস প্লেস। ওই যে দূরের আর্কিটেকচারটা দেখতে পাচ্ছিস ওটা হল সিডনি অপেরা হাউস। বুঝলি!
- বাহ, খুব সুন্দর তো। এই তোর নাতি কত বড় হল?
- তিন বছর রে।
- কই! ওর ছবি দেখি!
- দাঁড়া! এই দিদি, জানলাগুলো খোল না। কি বন্ধ করে রেখেছিস বলতো!
- গরম লাগছে রে? পাখাটা জোরে করে দেব?
- না রে। গুমোট হয়ে আছে। আমি খুলি?
- বললাম না পোকা আসে। জানলা না খুললে মরে যাচ্ছিস নাকি?
- খুলবি নাই বা কেন? আমি খুলছি দাঁড়া।
উঠে দাঁড়িয়ে জানলা খুলতে যায় তপু। সম্পূর্ণা দেবীর চোখে মুখে হঠাৎ করেই আতঙ্কের ছাপ। শক্ত করে তপুর হাতটাকে চেপে ধরলেন সম্পূর্ণাদেবী।
- খুলিস না রে।
- তোর সমস্যাটা ঠিক কি, বলবি তো। এমনিই তো জামাইবাবু আমাদের ছেড়ে চলে যাবার পর থেকে তেমন কোথাও বাইরেও যাস না। তার মধ্যে যদি বাইরের আলো বাতাসও ঘরে না ঢোকাস তবে চলবে কি করে।
- আমি তোকে পরে একদিন সবকিছু বলব। আজ চ না, গল্প করবি বললি যে।
তপু অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে সম্পূর্ণাদেবীর দিকে। সত্যিই তো, সামান্য জানলা দরজা খুলতে এমন কি-ই বা আপত্তি থাকতে পারে সম্পূর্ণা দেবীর! জানলা খোলার কথা শুনলেই সম্পূর্ণা দেবীর আতঙ্কগ্রস্থ দৃষ্টি যে কোনো লোককেই তো চিন্তায় ফেলতে বাধ্য করবে। তপু লক্ষ্য করল সম্পূর্ণা দেবী এখনও দু হাত দিয়ে শক্ত করে তপুর হাত ধরে রয়েছে।
- দিদি, ছোটবেলা মনে আছে তোর প্রতিদিন কি কি ঘটতো সব এসে আমাকে তোর বলা চাই-ই চাই।গোটা পৃথিবীর কাছে কত কিছু সিক্রেটই থেকে যেত, কিন্তু আমায় সব বলতি। তুই বল, দ্যাখ, সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করব নিশ্চই।
তপুর হাতটা আস্তে আস্তে ছেড়ে দিয়ে ঘুরে তপুর দিকে পেছন ফিরে বসলেন সম্পূর্ণা দেবী। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন পাঁচটা পনেরো।
- তপু দ্যাখ, সোয়া পাঁচটা বাজে। ডাউন ট্রেনটা পাঁচটা কুড়িতে ছাড়বে। তারপর আবার পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ। তারপর ছ’টা পাঁচ। সারা দিন, সারা রাত ধরে শুধু ট্রেন চলে যেতেই থাকে স্টেশন থেকে। সেই ট্রেনের শব্দ আমি সহ্য করতে পারি না জানিস! একদম সহ্য করতে পারি না। বুকে কষ্ট হয়, হার্টবিট বেড়ে যায়। মনে হয় আমায় একা ফেলে রেখে সবাই চলে যাচ্ছে। তাই সব জানলা দরজা সবসময় বন্ধ করে রাখি।
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সম্পূর্ণা দেবী। তপু বেশ খানিকটা অবাক হয় অবশ্য।
- বলিস কি রে দিদি। ছোটবেলা মনে আছে তুই আমার হাত ধরে ছুটতে ছুটতে ট্রেন দেখাতে নিয়ে যেতিস। সবাই বলত ওই দ্যাখ অপু দূর্গা আসছে ট্রেন দেখতে। সেই তুই ট্রেনের শব্দ সহ্য করতে পারছিস না! বলিস কি রে! ডাক্তার ফাকতার..
- মেয়ে গতবার যখন পুনে থেকে এসেছিল, তখন নিয়ে গেছিল। ডাক্তার বলেছিল থেরাপি লাগবে। ফোনোফোবিয়া না কিসব যেন হয়েছে। কিছু করাইনি থেরাপি ঠেরাপি।ভালো লাগে না ।
- আমি বলি কি, চ ট্রেন দেখতে যাবি ছোটবেলার মত?
- কি হবে গিয়ে বল! কালকেও যাবি তো ছোটবেলার মত? তবেই যেতে পারি।
- না, মানে কাল ভোরেই তো আমার আসলে ট্রেন। বাড়ির ওদিকে কাজ আছে রে কিছু।
হাসলেন সম্পূর্ণা দেবী। হাসির মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে একরাশ বেদনা, যন্ত্রণা। চোখের জল বোধ হয় শুকিয়ে গেছে আজ। তাই সুখ, দুঃখ সবেতেই হাসি পায় সম্পূর্ণা দেবীর।
- জানিস তো, আমার বাড়িটা না সবার হলটিং স্টেশন। পাশেই এয়ারপোর্ট। ফ্লাইটে করে সবাই নামে। তারপর ওই জংশনটা থেকে ট্রেন ধরে যে যার বাড়ি চলে যায়। মাঝের সময়টুকুর জন্য আমি সবার কাছে খুব প্রিয় হয়ে উঠি। পরিবার পরিজন, বন্ধু বান্ধব সবার কাছে। ক্ষনিকের আনন্দ, ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়ে চলে যায় তারা। তারপর কেউ খোঁজও নেয় না রে বুড়িটা বেঁচে আছে না মরে গেছে। আবার খোঁজ নেবার দরকার পড়বে আবার যখন সে ফ্লাইটে আসবে। ট্রেন ধরার মাঝে চার ঘণ্টা, আট ঘন্টা, বারো ঘন্টা সময়! তখন। ওই যে শো পিসটা, ওটা ব্যাঙ্গালোরের। ওই যে ওয়াল হ্যাংগিংটা- ওটা লন্ডনের। ওই যে ফুলদানিটা, ওটা আমেরিকার। ফ্রিজ ভর্তি কত শহরের চকলেট। জমুক!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ হয়ে যায় সম্পূর্ণা দেবী। ক্ষনিকের স্তব্ধতার মাঝে শোনা যায় পাঁচটা কুড়ির ডাউন ট্রেনটার শব্দ। জানলা বন্ধ, তাও বেশ ভালো জোরেই শব্দ ঘরে ঢুকছে। সম্পূর্ণা দেবীর কাঁধে হাত রাখে তপু।
- দিদি, পরেরবার দেখিস। শুধু তোর কাছেই আসব।
- সেই লিস্টও বড্ড লম্বা রে তপু, যারা পরেরবার শুধু আমার কাছেই আসবে, কিন্তু হয়ে ওঠেনি কোনো না কোনো কারণে। সেই লিস্টটাও বড্ড লম্বা!