রাধারাণীর অজানা কাহিনী
রাধারাণীর অজানা কাহিনী
আজ আমি শ্রীরাধা র অনেক অজানা তথ্য আপনাদের সামনে তুলে ধরব । প্রথমেই আমি বলে দিতে চাই যে, আজ আমি আমার যে সামান্য টুকু জ্ঞান আপনাদের সামনে তুলে ধরব - তা বিভিন্ন বই , বিভিন্ন প্রবন্ধ, বিভিন্ন রচনা ও পুরাণ পাঠে অর্জিত । এটা কোনো ভাবেই কোন ধারাবাহিক বা চলচ্চিত্র থেকে অনুপ্রাণিত নয় ।
কিছু মতবাদে শ্রীকৃষ্ণের অস্তিত্ব মানা হলেও শ্রীরাধা র অস্তিত্ব কে অস্বীকার করা হয় , বলা হয় তিনি শ্রীকৃষ্ণের প্রেম শক্তি র ম্যানিফেস্টেশন অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের প্রেম শক্তি কে মানবরূপে কল্পনা । সম্ভবত এই ধারণা র অন্যতম কারণ যে মহাভারত ও ভাগবতে শ্রীরাধা র উল্লেখ নেই ।
তবে এ মত গ্রহণযোগ্য নয় । কারণ মহাভারত কে পৌরাণিক ইতিহাস হিসেবে মানলে এবং তার চরিত্র গুলো ও শ্রীকৃষ্ণ র অস্তিত্ব কে মেনে নিলে শুধু মাত্র অনুল্লিখিত হওয়ার জন্য শ্রীরাধা কে কল্পনা হিসেবে ভাবা উচিত নয় । শ্রীকৃষ্ণ থাকলে রাধা থাকবেই । শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত শক্তির আধার তিনি । তিনি শুধু মাত্র কল্পনা হতে পারেন না । কল্পনা কে আশ্রয় করে কি কখনো পরমাবতার শ্রীকৃষ্ণ জগত কে প্রেমের শিক্ষা দিতে পারতেন । অর্থ ছাড়া যেমন শব্দ মূল্য হীন তেমনই রাধা ছাড়া শ্রীকৃষ্ণ লীলা হীন।
অনেকে ভাবে রাধা শুধু মাত্র কৃষ্ণের প্রিয় সখী তথা প্রেমিকা - আজকের ভাষায় girlfriend of Shree Krishna .....এক গোপী, যাকে শ্রীকৃষ্ণ সবার থেকে বেশি পছন্দ করতেন । কৃষ্ণের বাল্যলীলার প্রেমসঙ্গী - ব্যস এতটুকুই কি তার পরিচয়? জগত কে যে মোহিত করে তাকে মোহিত করার ক্ষমতা যার আছে সেই রাধারাণী কি আদেও এত সাধারণ ? না , একদমই নয় ।
অসাধারণ পরামবতার শ্রীকৃষ্ণের আরাধিকা এই রাধিকা, সে কি করে সাধারণ হতে পারে ? বলা হয় শ্রী বিষ্ণু কৃষ্ণ রূপে অবতীর্ণ হবার পূর্বে বৈকুন্ঠবাসী সকলেই মর্ত্যে জন্ম নেয় । দেবী লক্ষী ও জন্ম নেন বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে । নি:স্বার্থ প্রেম শেখাবার উদ্দেশ্যে নেন তার এই রাধা অবতার । যদিও মনে করা হয় যে লক্ষী নারায়ণের এই অবতার রাধাকৃষ্ণ আদি অনন্তকাল ধরেই গোলোকে বিরাজমান - মর্ত্যে জন্মের আগেও আর মর্ত্যে মৃত্যুর পরেও । এও বলা হয় যে শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণের eternal potency ......হ্লাদিনী শক্তি ।
পুরাণ আমার কাছে অতি প্রাচীন ইতিহাস । আর ইতিহাসের মতভেদের মত পুরাণেও মতভেদ আছে ।রাধারাণীর জন্মকাহিনী তে ও মতভেদ পরিলক্ষিত । তবে গোলক অভিশাপ মতে , গোলকে কৃষ্ণ সখা তথা কৃষ্ণভক্ত শ্রীদামা রাধার মাহাত্ম্য অনুধাবন করতে অক্ষম হন ও কৃষ্ণের হৃদয়ে রাধার প্রাধান্য দেখে ভাবেন রাধার মায়ায় শ্রীকৃষ্ণ আচ্ছন্ন । তখনই তিনি রাধাকে অভিশাপ দেন যে রাধা সব স্মৃতি ভুলে ১০০ বছর কৃষ্ণের থেকে দূরে থাকবে ।তারই ফল স্বরূপ রাধা মর্ত্যে জন্ম নেন । পরে কৃষ্ণ মর্ত্যে জন্ম নিয়ে রাধা কে সঙ্গ দিলেও অভিশাপ স্বরূপ রাধা তার পূর্বস্মৃতি হীন হওয়ায় মর্ত্যে নতুন করে শুরু হয় রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা ।( যদিও অন্য কিছু পুরাণ মতে , কৃষ্ণের সখা শ্রীদামা এই অভিশাপ টি মর্ত্যেই, বৃন্দাবনে দেন । যার পরিণামে কৃষ্ণ বৃন্দাবন ত্যাগ করে ও রাধা কে বিরহ সহ্য করতে হয় ও ১০০ বছর পর কৃষ্ণ শেষ ১৪ বছর রাধা র সহিত পুনরায় যাপন করেন । )
পুরাণ অনুযায়ী রাধা মর্ত্যে তার মাতার গর্ভ থেকে জন্ম নেন নি । তার মাতা বায়ুকেই গর্ভে ধারণ করেছিলেন এবং বায়ুকেই প্রসব করেন ।অপর দিকে গোলক ত্যাগ করে রাধা ও সেই স্থানেই বাল্য রূপে আবির্ভূত হন । আবার কিছু মতবাদে বলা হয় রাধা র পিতা বৃষভানু পদ্মের মধ্যে এক সদ্যোজাতা রূপে রাধা কে পান । আবার পদ্ম পুরাণ অনুযায়ী, বৃষভানু যজ্ঞভূমি পরিষ্কার করতে করতে রাধা কে ভূমিকন্যা রূপে শিশুকন্যা রাধা কে পান ।
জন্মের কাহিনী বা কারণ যাই হোক না কেন , এই বিষয়ে দ্বিমত নেই যে রাধা মথুরা জেলার রাভাল -এ (বরসানায়) জন্মান ।সময় টা ছিল ভাদ্রমাসের শুক্লাষ্টমী র মধ্যরাত । আকাশে অনুরাধা নক্ষত্র । পিতা বৃষভানু, মাতা কৃতিদা । রাধা জন্মের পর থেকে চোখ খোলেননি ।কারণ সে এই মর্ত্যলোকে এসে প্রথম দর্শন কৃষ্ণকেই করতে চেয়েছিলেন । রাধা ও কৃষ্ণের বয়স পার্থক্য নিয়ে ও মতভেদ আছে ।কারও মতে রাধা কৃষ্ণের থেকে সাড়ে এগারো মাসের, কারও মতে ৫ বছরের কারও মতে ৭ বছরের বড় ছিলেন ।তবে আমার মতে সাড়ে এগারো মাসের মত টি গ্রহণযোগ্য । কারণ আপনারাই ভাবুন এক টা ৯ -১০ বছরের শিশু কিভাবে ১৭-১৮ বছরের তরুণীর সাথে প্রেম করতে পারে ? বহু ক্ষেত্রে ই আমরা রাধা কৃষ্ণের একসাথে ক্রীড়া র উল্লেখ পেয়েছি .....সে ক্ষেত্রে পূর্ব স্মৃতি হীন রাধা নিশ্চয়ই তার থেকে ৭ বছরের ছোট শিশুর সাথে ক্রীড়া করত না .......নিশ্চয়ই তারা প্রায় সমবয়সী ই ছিলেন । তবে এ কথা ঠিক যে শ্রীরাধা ই পূর্বে আবির্ভূত হন ।
যেদিন মা যশোদা শ্রীকৃষ্ণ কে রাধা র সামনে নিয়ে এসেছিলেন ....সেদিন প্রথমবারের জন্য রাধা চোখ খুলেছিলেন নিজের প্রাণপ্রিয় কে দর্শন করার জন্য ।
রাধাকৃষ্ণের প্রেম এর জানা বিষয় গুলো নিয়ে আজ আর বলছি না । আমরা অনেকেই জানি রাধাকৃষ্ণ পরস্পরকে বিয়ে করেন নি কারণ তারা নিজেদের অভিন্ন মনে করতেন । কিন্তু ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণে বলা আছে , স্বয়ং ব্রহ্মা দেব বৃন্দাবন থেকে ১০ কিমি. দূরে বন্দির্বন (Bandhirvan) নামক স্থানে রাধাকৃষ্ণ-এর বিয়ে দেন । কিন্তু তাও কাউকে না পেয়ে ও যে ভালোবাসা যায় - তা প্রমাণ করার জন্য ই তারা এই বিয়েটা সমাজের সামনে আনেনি ।
কৃষ্ণের বৃন্দাবন ত্যাগের পর রাধা বিরহ ব্যথায় কাতর হন । আমরা অনেকে ভাবি যে এর পরে কৃষ্ণের জীবনে রাধার কোনো ভূমিকা নেই । কিন্তু তা সত্যি নয় ।কৃষ্ণ দেহ হলে রাধা আত্মা ।কৃষ্ণ গীত হলে রাধা সংগীত । শুধুমাত্র স্থল ভাগের দূরত্ব তাদের আলাদা করতে পারে না । হয়তো সামনা সামনি সাক্ষাৎ হত না । কিন্তু হৃদয় সংযোগের মাধ্যমে ভাব- বার্তা বিনিময় তো হত । তবে কি রাধা বিরহ ব্যথা অনুভব করত না ? অবশ্যই করত ....আপনি ই বলুন আপনার প্রিয় কারোর থেকে আপনাকে দূরে রেখে যদি শুধু video call এ কথা বলতে দেওয়া হয়, আপনার কষ্ট তো হবেই ।
রাধাকৃষ্ণ নামই বিচ্ছিন্ন হয় না তো ব্যক্তি কিভাবে বিচ্ছিন্ন হবে । শ্রীলক্ষীর এই অবতার স্বয়ং কৃষ্ণের অন্তরাত্মার সমান । কৃষ্ণের গোবর্ধন লীলার তর্জনীর শক্তি হোক কি রাসলীলার প্রেম, কিংবা দ্রৌপদীর লজ্জা নিবারণের বিবেক হোক বা মহাভারতের ধর্ম যজ্ঞ সবেতেই কৃষ্ণের হৃদয় রূপে রাধা তাকে প্রভাবিত করেছেন ।
জীবনের শেষ ১৪ বছর রাধা র সহিত পুনরায় যাপন করেন শ্রীকৃষ্ণ । কিছু পুরাণে বলা হয় , রাধা এই সময় নিজের পরিচয় গোপন করে কৃষ্ণদাসী হিসেবে কৃষ্ণের মহলে ছিলেন ।কৃষ্ণ তাঁকে সবার সামনে আনতে চাইলেও তিনি চাননি । রাধা তার জীবনাবসানের শেষ দিন কৃষ্ণের কাঁধে মাথা রেখে কৃষ্ণের বাঁশীর সুর শুনতে শুনতে ইহলোক ত্যাগ করেন । তারপর চিরকালের জন্য শ্রীকৃষ্ণ নিজের বাঁশি টা ভেঙে ফেলেন , যাতে আর কারও জন্য তা না বাজে ।
রাধাকৃষ্ণের প্রেম যে দেহজ ছিল না ,তা যে আত্মিক ছিল ,তার সব থেকে বড় প্রমাণ কী জানেন ? বড় প্রমাণ এটাই যে এত প্রেম সত্বেও রাধা র গর্ভে কৃষ্ণের কোন সন্তান জন্মায় নি ।
অনেকে ভাবে মধ্যযুগের সূচনালগ্নে জয়দেবের গীতগোবিন্দ এ রাধা চরিত্রের সৃষ্টি । কিন্তু তা নয় । রাধা তো দ্বাপরেই ছিলেন ।শুধুমাত্র গীতগোবিন্দের মাধ্যমে সব মানুষের হৃদয়ে স্থান পান তিনি । গীতগোবিন্দের বহু পূর্বে ই ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণ, পদ্ম পুরাণ,গর্গ সংহিতা,ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ এ তার উল্লেখ পাই । ব্যাস দেব মহাভারতে তার বর্ণনা দিতে পারেন নি কারণ তিনি রাধা নাম উচ্চারণ করলেই রাধা নামে এত মগ্ন হয়ে যেতেন যে পরবর্তী রচনা করতেই পারতেন না । ভাগবত বর্ণনা কালে সুকদেব ও এই কারণে ই রাধা প্রসঙ্গ আনেনি কারণ তা আনলে তিনি রাধা ভাবে এত বিভোর হয়ে যেতেন যে কয়েক বছর তা থেকে বেরোতে পারতেন না আর রাজা পরীক্ষিতের কাছে ভাগবত শোনার জন্য মাত্র ৭ দিন ই ছিল । এই সুকদেব পূর্বে রাধার নিকুঞ্জের শুক ছিলেন, তখন সর্বদাই রাধা নামে মগ্ন থাকতেন ।
এ কথা তো স্পষ্ট যে , রাধা শুধু মাত্র কৃষ্ণের প্রেমিকা ছিলেন না .....কৃষ্ণের জীবনে এনার গুরুত্ব ছিল অসীম । আর সে জন্যই কৃষ্ণ পত্নীদের বদলে তিনি আরাধিত হন জগদীশ্বরের সঙ্গে । আর জানেন, শ্রীকৃষ্ণ কি বলেছেন??? তিনি বলেছেন, " কোনো ব্যক্তি ' রা' উচ্চারণ করলেই আমি তাকে অপার প্রেম বর্ষণ করি আর তারপর 'ধা' উচ্চারণ করলে রাধা নাম শোনার লোভে আমি নিজেই তার পশ্চাৎ অনুসরণ করি । "
