Bhattacharya Tuli Indrani

Classics

2  

Bhattacharya Tuli Indrani

Classics

পুজোর মরশুম

পুজোর মরশুম

11 mins
637


কখনও এক পশলা বৃষ্টিতে ধুয়ে যায় পথ ঘাট, কখনও বা রোদে পুড়ে যায় গা... ভোরের দিকে দিব্যি ঠাণ্ডার আমেজ, দিনে তাপমাত্রা ক্রমবর্ধমান... স্বচ্ছ নীল আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ভেলা আর হাওয়ায় ভর করে উড়ে আসা এক এক ঝলক শিউলির গন্ধ মনে করিয়ে দিচ্ছে, মা আসছেন।

আশে পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসে গায়ত্রী মন্ত্র, শোনা যায় গণেশ বন্দনা... তাও বাংলার শত যোজন দূরের, ছিন্নমূল এই প্রবাসীরা মেতে উঠেছেন মাতৃ আরাধনায়। একসময়ে, এই নাগপুরের কাছাকাছি দণ্ডকারণ্যেই তো প্রথম বার বেজে উঠেছিল দাশরথির অকাল বোধনের শাঁখ।

প্রবাসের এই পুজোয় নেই কলকাতার জাঁকজমক, থীম পুজোর অভিনবত্ব কিন্তু এই দুর্গাপুজোতে জড়িয়ে থাকে ঘরছাড়া কতগুলো মানুষের অদম্য ভালবাসা আর প্রাণের টান।

পুজো উপলক্ষে, ধানতলিতে আয়োজিত হয় বিরাট মেলা ও প্রদর্শনী যা নাগপুরের অবাঙালিদের ভীষণ ভাবে আকর্ষিত করে। তাঁরা এখন নাগপুরের চিরাচরিত 'নবরাত্রির' উৎসবে পূজিতা অষ্টভূজা, শেরাওয়ালীর থেকে বাঙালির পুত্র- কন্যা সমন্বিতা, দশভূজা- সিংহবাহিনীর পুজোকে আলাদা করতে শিখে ফেলেছেন, বেশ ভাল ভাবেই। নাগপুরের সব পুজো প্যান্ডালেই প্রায় একই দৃশ্য। পুজো সমাপন হলে পুস্পাঞ্জলির পরে পাতায় করে ফল মিষ্টি প্রসাদ, তারপরে কোথাও বসে খিচুড়ি খাওয়া, কোথাও বা বাক্স করে ভোগ নিয়ে যাওয়া। কোল এম্পলয়ীস এ্যাসোসিয়েশন এর পুজোতে ফল প্রসাদের সঙ্গে বাড়তি প্রাপ্য থাকে ভোগের খিচুড়ি। দুপুরে পাতা পেতে পুলাও(বাঙালি মিষ্টি পোলাও নয়, অবশ্যই) পুরি, ডাল, তরকারি, চাটনি, স্যালাড আর মিষ্টি… বিবিধের মাঝে মিলন আনতে এই খাওয়ায় একটু অবাঙালি স্বাদ- গন্ধ থেকেই যায়… বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায় চ। কাউকেই ফিরে যেতে হয়না, রান্না চলতেই থাকে, যতক্ষণ না দুপুরের খাওয়া শেষ হয়।

রাতে উৎসব- প্রাণ আর ভোজন রসিক বাঙালির জন্যে নাগপুরের প্যান্ডালে প্যান্ডালে লেগে যায় মুখরোচক খাবারের স্টল। গৃহিণীরা এই চার পাঁচ দিন কড়াই- খুন্তির শেকল থেকে পান মুক্তি।

সন্ধেতে থাকে ধুনুচি নাচ, শঙ্খ বাদন, আলপনা প্রতিযোগিতা ও নানা স্বাদ ও গন্ধের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, তবে প্রায় সব যায়গাতেই একটি দিন ধার্য্য করা থাকে অবাঙালি দর্শকদের জন্যে, তাদের দৃষ্টি ও শ্রবণকে তৃপ্ত করে অর্কেস্ট্রা সহযোগে পরিচিত গান, হিন্দি নাটক ইত্যাদি। সি এম পি ডি আই এর পুজোর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সকলের থেকে আলাদা। সেখানে বিভিন্ন ভাষা ভাষীদের নিয়ে কাজ করতে হয়, তাই অনুষ্ঠানে ব্যাবহৃত ভাষা সব সময়েই থাকে সর্বজনবোধ্য হিন্দি। অভাবনীয় ভাবে সেখানে মঞ্চস্থ হয় বুদ্ধু ভুতুম, লালকমল নীলকমল অথবা হিংসুটে দৈত্যের হিন্দি রূপান্তর। বাঙালি অবাঙালি দুই গোষ্ঠীরই মন ভরে যায়।      

পুজোর বেশ কিছুদিন আগেই পৌঁছে যান বাংলার যাদুকর মৃৎ শিল্পীরা... হাজির হন মণ্ডপ- কারিগরেরা, তাঁদের ময় দানবীয় কাজ কারবারের নিদর্শন রাখতে... সবশেষে চন্দননগরের আলোকমালায় সেজে ওঠেন রূপসী... দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না তাঁর।

স্কুল কলেজে চলতে থাকে পরীক্ষার চমক আর বাড়িতে এবং অনুষ্ঠানের রিহর্সালে, মা- মাসীদের ধমক।

'আজ না আর রান্না করতে ভাল লাগছে না, কতকিছুর স্টল লেগেছে, দেখেছ? আজ ওখান থেকেই কিছু কিনে নিয়ে খেয়ে নেব...'

কথা শেষ করতে পারে না শমিতা, দুই মেয়েই লাফিয়ে উঠে হাত বাড়িয়ে দেয় বাবার দিকে।

'হ্যাঁ বাবা, তাড়াতাড়ি টাকা দাও... দারুণ সব টেস্টি খাবার পাওয়া যাচ্ছে। তোমরা যখন খাবে খেয়ো, আমরা আমাদের বন্ধুদের সঙ্গে খাব।

নিদারুণ অনিচ্ছায় পকেটে হাত ঢোকায় নির্মল। মেয়েদের হাতে টাকা দিয়ে বলে, 'আমি কিন্তু এইসব খাব না। প্রপার ডিনার খাব... বিশেষ কিছুই চাই না, রুটি তরকারি হলেই চলবে।'

চোখ ভরে ওঠে জলে, শমিতা মুখ ফিরিয়ে গোপন করে তা... সকালে স্কুলে যেতে হয়েছিল। মেয়েরা আর সে এক স্কুলেই আছে... পরীক্ষা চলছে। নবমী আর দশমী ছুটি পাওয়া গেছে, তাও নবমী রবিবার বলে। বাচ্চাদের দিয়ে 'হিংসুটে দৈত্যের' রূপান্তর 'স্বার্থী দানবের' সার্থক মঞ্চায়ন করিয়েছে সে আজ... ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর। এই পুরুষ মানুষগুলোর কি হৃদয় বলে কিছুই নেই?

কিন্তু তাই বা বলে কীকরে! দলে দলে ছেলেরা তো খাচ্ছে কলোনীরই মহিলাদের লাগানো, নানারকম স্বাদের মুখরোচক খাবারের স্টল থেকে। তার জীবনটাই শেষ করে দিল তার এই ভালবাসার বিয়ের স্বামী। অসম্ভব অবুঝ আর স্বার্থপর। রাগে গর গর করতে করতে সে চলল নিজের কোয়ার্টারের দিকে।  

'ধ্যুস সালা, খাবই না আজ কিছু। কিন্তু... ওই হার্টলেসটার জন্যে তো কিছু বানাতেই হবে, নিষ্কৃতি নেই এই বিশেষ উৎসবের দিনেও।

আটাটাও মাখা নেই, ধ্যাৎ! পুজো বলে মাখিয়ে রাখেনি কাজের মেয়েকে দিয়ে। ভোগ খেয়ে কেটে যাবে দুপুরটা, সন্ধ্যেতে তো কতরকম মুখ বদলের আইটেম দিয়ে স্টল সাজিয়েছেন বৌদি আর ভাবীরা। মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক।

নবমীর সন্ধ্যেটা সাজানো হয়েছে স্থানীয় শিল্পীদের অর্কেস্ট্রার অনুষ্ঠান দিয়ে। রাগ করে বাড়ি থেকে বেরলই না শমিতা। চুপ করে শুয়ে রইল নিজের ঘরে। সদর দরজা খোলাই রয়েছে, মেয়েরা আসছে যাচ্ছে। সেক্রেটারি- কর্তাবাবু তো সারাদিনই পড়ে আছেন সেখানে, চা টা বাইরে হয়ে গেলেও রাতে তাঁর ঘরের খাবার চাইই...

'মা, তুমি যাবে না, অন্ধকার করে শুয়ে আছ কেন... মাথা ধরেছে?' কোনও উত্তর না পেয়ে আলো জ্বালিয়ে মা'র কাছে আসে মেয়ে।

'বুঝেছি, রান্না করতে হবে বাবার জন্যে! কিন্তু তোমার ভাল লাগছে না... তুমি সেটা ক্লিয়ারলি না বুঝিয়ে দিলে কেউ কখনও বুঝবেই না, মা।

চোখ থেকে হাত সরায় শমিতা। ১৩ বছরের একটা মেয়ে... সত্যি মেয়েরাই বোঝে মা'কে।

'কী করে বোঝাব, সে তো খাবেই না বাইরের খাবার।'

'অফিসে আসে না বাইরের খাবার, খায় না তখন? তুমি চল, আমরা সবাই খাব আজ... মাইতি আঙ্কল মুঘলাই পারাঠা বানাচ্ছে, চৌধুরী আন্টি পাঁঠার ঘুগনি... পাঁঠা কী হয় মা? আরও কত কী আছে...'

মায়ের উত্তর আসার আগেই সে বলে ওঠে

'বাবাকে বলে দাও, আজ কিচেন বন্দ হ্যায়, কুছভী নহী মিলেগা। চলো, আন্টিরা সবাই তোমার কথা জিজ্ঞেস করছে। সেই আবার কবে আসবে পুজো... দেখবে ফির কত্ত দুখ্ হবে। সত্যি কত কী যে শেখার আছে আজকের বাচ্চাদের কাছে।

তৈরি হয়ে প্যান্ড্যালে যায় শমিতা, মেয়ের হাত ধরে। রাস্তায় দেখা নির্মলের সঙ্গে, বাড়ি যাচ্ছে সে। চাবি হাতে ধরিয়ে দিয়ে শমিতা বলে 'আজ আমি প্যান্ড্যালেই খাব... যা ইচ্ছে। আমি রান্না করিনি, দেখে নিও তুমি কী করবে!'

স্বামীর জ্বলন্ত দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যায় সে আলো ঝলমলে দুর্গামণ্ডপের দিকে। আজ যেন বেশী উজ্জ্বল মনে হচ্ছে মণ্ডপটাকে, অন্যদিনের চেয়ে।

খুব ভোরে ভোরে দশমী পুজো। আজ ছুটি সবারই, দশেরার। দশমীতেও দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে, পুজো কমিটি... আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে। প্রচণ্ড হট্টগোল খাওয়ার যায়গায়... অনেকেই না কি তাঁদের একপাটি জুতো বা চপ্পল পাচ্ছেন না। এ আবার কী ধরণের চুরি! গেলে তো দুপাটিই যাবে না কি? রাগারাগি, চেঁচামেচিই সার... নিখোঁজ জুতো বা চটি তো আর ফিরে এল না... মালিকেরা নিজেদের অন্য একাকী পাদুকাটি দূরের বাঁশবনে ফেলে দিয়ে রাগে গজ গজ করতে করতে বেজার মুখে ঘরে ফিরলেন। 

রহস্য উদ্ধার হলো বিকেল বেলায়। একটু বিশ্রাম নিচ্ছিল শমিতা, একটু পরেই বিসর্জনের জন্যে রওনা হবে সবাই... সকালে জোরদার সিঁদুর খেলা হয়েছে, সেই সিঁদুর ভর্তি মাথা ধুতেই সময় গেছে অনেকখানি। পরেরদিন আবার স্কুল তো, সাতসকালে।

গত রাতে প্রবল ঝড়- তুফানে মূর্তির অবস্থা শোচনীয়। এই অসময়ে, এরকম দুর্যোগের আশঙ্কা করেনি কেউই, সাবধানতাও অবলম্বন করা হয়নি... অনেক চেষ্টা করা হয়েছে মূর্তি বাঁচাবার, বড় বড় পলিথিনের শীট দিয়ে ঢেকে রেখে। আপাত দৃষ্টিতে তো বোঝা যাচ্ছে না... ঠাকুর নামাবার সময়ে কেলেঙ্কারি না হয়, ভয়ে কাঁপছে সকলের বুক। মনটা ভার সকলেরই, বিসর্জনের ঢাক বেজে উঠেছে...

ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ ঠাকুর যাবে বিসর্জন

'মা, আমরা যাব না বিসর্জনে?' শমিতার বড়মেয়ে ইন্দ্রিলা এসে দাঁড়াল।

পুজো কমিটি খুব সুন্দর ব্যবস্থা করে, প্রতি বছরই বিসর্জনে যাওয়ার জন্যে। ট্রাকে যাওয়া যায়, তাছাড়াও বেশ কয়েকটা গাড়িও সঙ্গে থাকে... মহিলা আর বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়ার জন্যে। শমিতা যেতে চায় না, পরেরদিন স্কুল থাকার জন্যে... কিন্তু শেকড় ওপড়ানো এই বাচ্চাগুলোর কী দোষ! নিজেদের সংস্কৃতি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানার সুযোগই হয়না এদের।

'যেতে ইচ্ছে করছে? যা না... তোর বন্ধুরা তো যাবেই।'

'তুমি চল না প্লীজ... বাবা যেতে দেবে না নাহলে। পদ্মার বাবা তো ওকে যেতে দিচ্ছে না। কেমন করে এরা...'

জোরদার ঢাকের বাজনা শুরু হয়ে গেল। ভীষণ মন খারাপ লাগছে, এই অনুভূতির কোনও বদল নেই... ছোটবেলায় যেমন ছিল, এখনও তেমনই। এখন যেন আরও বেশী মন খারাপ হয়... নিজের হাতে পুজোর কাজ ক'রে, ভীষণভাবে পুজোর সঙ্গে জড়িত থেকে। মা যেন কখন মেয়ে হয়ে গিয়ে বিদায় নিয়ে চলে যান... কী ভীষণ শূন্যতা। ক'টা দিন ওই প্যান্ড্যালের দিকে আর তাকানোই যায় না। এই তো সেদিনের কথা... বাড়ির সামনে বাঁশ এসে পড়া থেকে নিয়ে পুরো মণ্ডপ তৈরি হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সে কী আগ্রহ সকলের। শমিতার মনে পড়ল, কলোনীতে পুজো শুরু হবে শুনে একদমই ভাল লাগেনি তার।

ব্যাস, পুজোর এ'কটা দিন যাও বা একটু বেরনো হতো... তাও গেল। ওই ঘরকুনো স্বামীটাকে তো আর ঘরের বা'র করাই যাবে না ...

সেদিনের কথা মনে করলে আজ হাসি পায় শমিতার। কবে- কখন যে সেই মন খারাপের ভাব উধাও হয়ে গেল আর প্রচণ্ডভাবে জড়িয়ে পড়ল সে এই এক্কেবারে একান্ত নিজের পুজোটাতে। ভোরে উঠে পুজোর কাজ করা থেকে, ভোগ রান্না ও বিতরণে সাহায্য, সন্ধ্যের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা... সবকিছুতেই উপস্থিতি তার। দশভূজার পূজা আয়োজনে, আর এক দশভূজা স্কুলের বায়নাক্কা তো চলতেই থাকে, বেশ কয়েকজন বাঙালি টিচারের পুজোর ছুটির আবেদনের উত্তরে শুনতে হলো 'আই উইল স্টপ এ্যাপয়েন্টিং বেঙ্গলি টিচার্স...'

ইল্লি আর কী! বেঙ্গলি টিচার্স যেন উনি মুখ দেখে এ্যাপয়েন্ট করেছেন... বদমাশের বিশতলা

'আচ্ছা যাব, চল তৈরি হয়ে নে। সেটা কোথায়, ছোটটা?'

'জানি না, ওর কথা আর বোল না মা... কী যে করে বেড়াচ্ছে তার ঠিক নেই।'

'করতে দে, এই তো ক'টা দিন, আবার যে কে সেই।'  

'করতে দে!! জান কী করেছে ওরা, কতগুলো শয়তান বাচ্চা?'

'ছ'বছরের শিশু, কী আর এমন শয়তানি করবে রে... কী করেছে?' 

'দুপুরে খাওয়ার যায়গায় আজ হাঙ্গামা শোননি? যারা খেতে বসেছিল, তাদের ছাড়া চপ্পলের পেয়ারের এক একটা নিয়ে কোথায় কোথায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে... আন্টিগুলো কী চিল্লাচ্ছিল।'

রেগে উঠতে গিয়ে প্রচণ্ড হাসি পেয়ে গেল শমিতার। উপযুক্ত সন্তান তার... ছোটবেলায় কী দুষ্টুই না ছিল সে।

'তুমি হাসছ! ছুটকির তো সাতখুন মাফ না? আপ বহুত পার্শিয়াল হো মাম্মা, আমি করলে পিঠের ছাল তুলে দিতে। এখনও শেষ হয়নি ওর কারনামা...'

'আরও আছে?'

'ঠাকুর নামিয়ে নেওয়ার পরে, ঠাকুরের বেদীর ওই কাঠের স্ট্রাকচারের নীচে ঢুকে পয়সা কুড়িয়েছে... জান তুমি?

'পয়সা! সেখানে পয়সা এল কোত্থেকে?'

'ওহ, ইউ আর সো নাইভ মা, সবাই পয়সা ফেলে না পণ্ডিতজীর দিকে...'

'তা, তোর রাগ হলো কেন... তোকে ভাগ দেয়নি তাই?'

'আমার চাই ও না। ছি! ভিখ- মাঙ্গাদের মতো... তুমি ওকে বকবে না?'

'নিশ্চয়ই বকব... ডেকে নিয়ে আয় ওটাকে। ভূতটাকে মনে হয় আজ গরমজলে সেদ্ধ করতে হবে'

'জান মা, কী হয়েছে?'

শমিতা মেয়েটাকে কাছে টেনে নেয়, চোখে জিজ্ঞাসা তার।

'কাল বৃষ্টি হয়েছিল, ঠাকুর ঢেকে দিয়েও বাঁচানো যায়নি..'

'বলিস কী!'

আঁতকে ওঠে শমিতা। মূর্তির অঙ্গহানি! সে তো খুবই অমঙ্গলের ব্যাপার। আজকাল এসব কথা আর কেউ মানে না... কিন্তু ছোটবেলায় মনের মধ্যে গেঁথে দেওয়া, দিদুর এই সংস্কারগুলো যাবে কোথায়?

'না মা, মা দুগগার কিচ্ছু হয়নি, অসুর কা হাথ টুট গয়া... বাস। আচ্ছা হী হুয়া... না মা? দুষ্টু লোকের পানিশমেন্ট হওয়া তো ভালই।'

যেমন এসেছিল, তেমনই আবার দৌড়ে বেরিয়ে গেল সে।

হাওয়ায় আবির উড়ছে, সকলের মুখে হাসি... চোখে জল। ঢাকের বাদ্যির সঙ্গে সন্দলের ধমাদ্ধম শব্দ জুড়ে সে যে কী এক প্রলয় ঘটে চলেছে... তার সঙ্গে নবকাত্তিকদের উদ্দাম নৃত্য। কলকাতায় কাটানো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল, শমিতার। ভাসান টাসানে যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না, বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাসানের নাচ উপভোগ করারও অনুমতি মিলত না... লুকিয়ে চুরিয়ে একটু আধটু, উপরি পাওনা দিদুর মুখের বাদ্যি।

ট্রাকে চড়ার ইচ্ছে থাকলেও নির্মলের রক্তদৃষ্টির কথা মনে পড়ায়, জীপেই বসে পড়ল শমিতা, দুই মেয়েকে নিয়ে। ছোটটা আবার এত দুরন্ত, চোখে চোখে রাখতে হবে... জলের ধারে যেতে দেওয়াই যাবে না।

গান্ধীসাগরের ধারে ট্রাক থামতেই মায়ের হাতের অস্ত্র শস্ত্র নেওয়ার ধূম পড়ে গেল। ইন্দ্রিলার কামনাময় চোখদুটো দেখে কষ্ট হলো শমিতার...

'যা, মল্লিক ভাইয়াকে বল... যেটা ভাল লাগে নিয়ে আয়।'

চোখের নিমেষে উধাও সে। ছোটটাও ব্যস্ত, হাত ছাড়াবার জন্যে... কানটা ধরে, 'বাবাকে ডাকব?' বলাতে একটু শান্ত হলো সে। 

নতুন নিয়ম হয়েছে, ফুল মালা সব খুলে নিয়ে তবেই বিসর্জন দেওয়া। ভালই তো, দূষণ রোধের চেষ্টা তো করছে। দূর থেকেই দেখা যায় যতটা, কাছে যাওয়ার সম্মতি নেই... নেই এর তো কোনও শেষ নেই। যাকগে বাবা, যেটুকু পাওয়া যায়... তাই বা কম কী?

মায়ের মূর্তির সঙ্গে সঙ্গেই 'জয় মা! জয় জয় মা!' ধ্বনিতে কে যেন একজন ঝাঁপ মারল জলে। হই হই করে উঠল সকলে। মুখে মুখে কথা এগোল কান পর্যন্ত। "খুশবাহা!" ওহ ওই পাগলটা! বাপরে, বিরাট ভগৎ উনি। আখ, চাল কুমড়ো বলির দেওয়ার জন্যে ওনাকেই ডাকা হতো... কেমন যেন বাহ্যজ্ঞানহীন হয়ে পড়তেন তিনি, সেই সময়ে। সবই মহামায়ার মায়া।

'আরে, এগুলো কী নামছে জলে?'

'ক্রেন, মা!' ইন্দ্রিলার কণ্ঠ শোনা গেল।

'ক্রেন! কেন, ক্রেন কেন?'

'মল্লিক ভাইয়া বলছিল আজ... কলকাতায় না কি নিয়ম হয়েছে, ঠাকুর ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই তুলে নেওয়া... টু প্রিভেন্ট পলিউশন মা'

'এ বাবা, তাহলে পুরোপুরি বিসর্জন তো হলই না... ঠাকুর যেন থেকেই গেলেন আমাদের সঙ্গে।'

মা জলে তলিয়ে গেলেন না, পরিবেশ দূষণও হলো না... মনের ভার যেন একটু হলেও লাঘব হলো। ঠাকুর থাকবে বহুক্ষণ ঠাকুর যায় না বিসর্জন।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics