প্রয়োজন
প্রয়োজন
সেই সকাল থেকে বৃষ্টি হয়েই চলেছে।
একটুও থামার নাম নেই। সকালে অফিসে বেড়িয়ে জয় ভিজেছে একচোট।
দুপুরে যদিও একটু ধরেছিল, বিকেল থেকে আবার শুরু।
মিনিবাস থেকে নেমে ছাতা খাটানোর সুযোগই পেলো না আর, তার আগেই আকাশ ছেঁচা জলে ভিজে সপসপ।
এভাবে বাসে ট্রামে ট্রাভেল করলে নিজেকে কেমন কেরানী কেরানী মনে হয় জয়ের, নাহ! এবার একটা ফোর হুইলার চাইই চাই!
আপাতত বাড়ি গিয়ে স্নান সেরে জমিয়ে এক কাপ কফি চাই।
বাসস্ট্যান্ড থেকে গুনেগুনে কুড়ি পা হাটলেই তাদের সুখনীড় আবাসন, বছর পাঁচেক হল জয় আর সুমি এখানে এসেছে। রাস্তা পেরিয়ে আবাসন গেটে আসতেই পুরো কাকভেজা, তাড়াতাড়ি দোতালায় উঠে বেল বাজাল জয়, বার চারেক।
সুমি নেই নাকি বাড়িতে? না! তাহলে তো দরজায় তালা দেওয়া থাকতো, আশ্চর্য!এত দেরি করছে কেন দরজা খুলতে?
"কী ব্যাপার, কোথায় ছিলে? কখন থেকে বেল বাজাচ্ছি! " দরজা খুলতেই জয় হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পরল।
সুমি কোনো উত্তর দিলনা। সোফায় বসে নিজের মোবাইল ফোনটা ঘাঁটতে থাকলো। সে দিকে একরাশ বিরক্তি ছুঁড়ে দিয়ে জয় জুতো খুলে শ্যুকেসে রাখল, ঘরের চপ্পলখানা পায়ে গলিয়ে সোফায় এসে বসল,"সেই ফেসবুক, সারাদিন কী এত করো ফেসবুকে? এক কাপ কফি করো তো কড়া করে"!
সুমি ফোন হাতে নিঃশব্দে চলে গেল রান্নাঘরে।
জয় ঘরে এসে জামা খুলল, বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার চালিয়েই মটকা গরম, সুমি গিজারটাও অন করে রাখেনি, অফিস থেকে ফিরে উষ্ণ জলে স্নান করা জয়ের চিরকেলে অভ্যেস,খুব ভাল করেই জানে সুমি!
একি! হ্যাঙ্গারে তো জামাও রাখা নেই, কী করে কী সারাদিন বাড়িতে বসে? আগে তো সব কিছু হাতের কাছেই থাকতো!
জয়ের মুখ দিয়ে কথা পড়তে না পড়তেই জিনিস হাজির হয়ে যেত! ইদানিং সুমি যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে, আনমনা থাকে, প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলে না, সারাদিন মোবাইল হাতে।
ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, কী করে সারাদিন ফেসবুকে? বাথরুম থেকে জয় একবার উঁকি দিল রান্নাঘরের দিকে, হ্যাঁ যা ভেবেছে তাই, সসপ্যানে জল চাপিয়ে সুমি মোবাইলে ব্যাস্ত।
হাল্কা পাঞ্জাবি গলিয়ে জয় সোফায় এল।
টিভি চালিয়েছে, চোখ নিউজ চ্যানেলে, সুমি কফি রেখে গেছে, মাইক্রোয়েভ ওভেনে খাবার গরম করছে চুপচাপ।
জয় টিভিতে চোখ রেখেই চুমুক দিল কফিতে, দিয়েই মুখ কুঁচকেছে,"এতো মিস্টি দিয়েছো কেন কফিতে? তুমি জানোনা, আমি চা কফিতে চিনি কম খাই?"
কোন প্রত্যুত্তর দিলোনা সুমি, আঁচলে হাত মুছতে মুছতে জিগ্যেস করল, "খাবার বাড়ি?"
টিভিতে এখন সেনসর বোর্ডের জোর আলোচনা।
জয় টিভির ভলিউম আরো চার ঘাট বাড়িয়ে দিয়ে টেবিলে এলো,
সুমি ক্যাসারোল খুলে রুটি বার করছে,"কটা দেব?"
টিভি থেকে চোখ না সরিয়েই জয় বলল, "ওনলি থ্রি "।
চিলি চিকেন মুখে তুলে আবার চেঁচিয়ে উঠল জয়,"এত ঝাল দিয়েছ কেন, তুমি জানোনা, ঝাল আমি খেতে পারিনা?"
নিরুত্তর সুমি। জয়ের প্লেটে কাস্টার্ডের বাটিটা তুলে দিল।
বৃষ্টিটা থেমে এসেছে প্রায়, জয় বেডরুমের দক্ষিণ দিকের জানলাটা খুলে দিল, এদিক দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসে খুব, বিছানা ভিজিয়ে দেয়, সুমি রান্নাঘরে। গ্যাস পরিস্কার করছে। সকাল পর্যন্ত কাজের মেয়ের আশায় সব কিছু ফেলে রাখা সুমির ধাতে নেই।
শোয়ার আগে সব কিছু সাফা না করলে তার ঘুম আসেনা।
জয় টিভি খুলে বসলো।
এবার নিউজ ছেড়ে মিউজিক চ্যানেলে, বাংলা গান চলছে, "মাঝে মাঝে তোর কাছে জেনে শুনে হেরে যাই..."
পর্দায় নায়ক নায়িকা ঘুরে বেড়াচ্ছে, সমুদ্রের ধারে।
জয় আর একবার ঘাড় ঘুরিয়ে সুমিকে দেখল, রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বাথরুমে ঢুকেছে সুমি। এবার ব্রাশ করবে, ক্রিম মাখবে, চুল বাঁধবে, সারাঘরে চোখ বোলাবে তারপর শুতে যাবে।
এ সুমির বরাবরের অভ্যেস।
জয় টিভি বন্ধ করে ঘরে এল, সিঙ্ঘানিয়াদের অর্ডারটা জয়রা পেয়ে গেছে। প্রায় দু কোটির অর্ডার, দায়িত্বটা জয়ের উপরেই ছিল, জয়ও নিজেকে প্রমাণ করতে জান লাগিয়ে খেটেছে। একবার এই ক্লায়েন্ট, একবার ওই ক্লায়েন্ট, প্রেজেন্টেশন, ফাইলস্, মিটিং, প্রায় একটা বছর, তার স্নান খাওয়া ঘুমের ঠিক ছিল কৈ? তার উপর লুসির সাথে আউটিং। বাড়ি ফেরার সময়ই ছিলনা! অবশেসে, ইয়েস! জয় দত্ত দ্য এক্সিকিউটিভ অফিসর, নিজের চেয়ারটা পাকা করতে পেরেছে।
বস এখন হেব্বি প্লিজড তার ওপর, সামনের প্রজেক্টটা উতরে দিলে সে চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার হয়ে যাবে। কিন্তু জয়কে যে ম্যানেজিং বোর্ড অফ ডিরেক্টরসদের চেয়ারগুলো বড্ড টানে!নতুন ফ্ল্যাট, নতুন গাড়ি, বিদেশে হলিডে... না না আরও কনসেনট্রেট করতে হবে তাকে। সামনের সপ্তাহে মন্দারমনি প্ল্যান আছে লুসির সাথে।
লুসির পেলব দেহ, নীল চোখ, সোনালি চুল, ফর্সা বুকে উন্মুক্ত খাঁজ, সরু কোমর, উহহহ!
জয়ের পুরুষাঙ্গ সজীব হয়ে ওঠে, সি ই ও হওয়ার পর সুইজারল্যান্ড যাবে, লুসিকে কথা দেওয়া আছে, খুব মস্তি হবে। জীবন টাকে হাতের তালুতে এনজয় করবে। সিগারেট ধরাল জয়।
সুমি ঘরে এসেছে ,সাদার উপর নীল ফ্লোরাল প্রিন্ট নাইটি।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে মুখে ক্রিম ঘষছে।
জয় ভ্রুকুটি হানল, যতই ক্রিম ঘষো, লুসির কাছে ইউ আর নাথিং বাট আ ফিগ !
জয় অ্যাসস্ট্রেতে সিগেরেট নেভাল চেপে চেপে,সুমি বিছানায় এলো, হাতে মোবাইল, আঙুল বুলিয়ে চলেছে, এই সময়টা তাদের রতিক্রিয়ার সময়, অথচ, জয়কে যেন গ্রাহ্যের মধ্যেই আনছেনা সুমি!
জয়ের ব্রহ্মতালু তেতে গেল, যে জয় দত্তের জন্য ক্লাবহাউস পাগল, সেই জয় দত্তকে তার বউ বিছানায় পাত্তাই দিচ্ছে না!
এক ঝটকায় ফোনটা সুমির হাত থেকে কেড়ে নিল জয়।
স্ক্রিন সরিয়ে দেখছে... প্রবাল দাস, সুমির সাথে চ্যাট করছে।
কেমন আছ...
কী খেয়েছ...
বর ফিরেছে?....
শুয়ে পড়েছো .... গোছের মেসেজ।
জয় দাঁত চেপে তাকাল সুমির দিকে, "কী হচ্ছে এ সব? এই জন্যে গিজার চালানো হয়না? কফিতে চিনি বেশি হয়? মাংসে ঝাল বেশি হয়? স্বামী- সংসারের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য সব ভুলে বেলেল্লাপনা তো ভালোই হচ্ছে আজকাল! আমার বাড়িতে এসব চলবে না, বুঝেছো?"
সুমি অপলক তাকিয়ে আছে জয়ের দিকে, এই চাহনি জয় চেনে না, যেন সুমিকে নয় জয়কেই জবাবদিহি করতে হবে সুমির কাছে।
শান্ত নিষ্প্রাণ চোখে সুমি বলে চলেছে, "দুমাস আগে আমি কন্সিভ করেছিলাম জয়, তুমি জানোনা, তোমাকে বলা হয়ে ওঠেনি আমার।
ডাক্তারের কাছ থেকে সোজা তোমার অফিসে গিয়েছিলাম, তোমায় সুখবরটা দেব বলে।
তোমাদের অফিসের গেটে দাঁড়িয়ে তোমায় ফোন করলাম, তুমি বললে মিটিংএ আছ, কখন ফ্রি হবে জানোনা।
আমি বিশ্বাস করে চলেই আসছিলাম।
তারপর দেখলাম, একটা কালো মার্সিডিসে তুমি, সাথে একটা মেয়ে, কাঁধ ধরে বসেছিলে তুমি। মিটিংটা বোধহয় খুবই ইমপর্ট্যান্ট ছিলো তোমার কাছে? আমার পাশ দিয়ে চলে গেলে অথচ আমায় খেয়ালই করলেনা! সন্ধ্যেবেলা ফোন করে বললে, সার্ডেন ট্যুরে যাচ্ছি, ফিরতে সময় লাগবে।
সেদিন তুমি লুসিকে নিয়েই বেড়িয়েছিলে না?
আমি কাওকে বলিনি জয়, সেদিন রাতে খুব জ্বর এসেছিল আমার, সারারাত কষ্ট পেয়েছি আমি।
না জ্বরে নয়, নিজের প্রথম প্রেমকে অন্য কারোর হয়ে যেতে দেখে।
পরদিন আমার ব্লিডিং শুরু হয়।
বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে যায়, আমি কাওকে বলিনি।
তুমি ফিরে এলে।
আমাকে দেখলেওনা ভালো করে, আমি তো আর লুসি নই!
তোমার পকেটে সেদিন ব্লু ভিউ হোটেলের বিল পাই, আর একটা ম্যানফোর্স কন্ডোমের প্যাকেট।
কাওকে বলিনি আমি। তোমাকেও না।
সেদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো ভেবেছিলাম।
সন্ধ্যেবেলা বৃষ্টিতে ভিজে তোমার জ্বর এল।
তোমার যে খুব ঠান্ডার ধাত, আমি যেতে পারলাম না।
সারারাত তোমার মাথার পাশে জেগে বসেছিলাম।
আমি তোমায় বলিনি।
আমি তোমার 'প্রয়োজন' হয়ে গেছি জয়।
কিন্তু আমারও তো বেঁচে থাকতে কিছু একটা প্রয়োজন!
তোমাকে তো আমি আর পাইনা জয়!
ফেসবুকে আমার অনেক বন্ধু।
আমার খোঁজখবর নেয়, হয়তো আমার প্রয়োজনে তারা আসেনা, কিন্তু সিম্প্যাথি জানায়, মিথ্যে হলেও, 'পাশে আছি' কথাটা অনেকখানি মনের জোর বাড়িয়ে দেয় জানো!
একজন অচেনা মানুষের থেকে এরথেকে বেশি কী আর আশা করা যায় বলো? গত কয়মাস অনেক ভেবেছি।
চলে যেতে চেয়েছি তোমাকে ছেড়ে, পারিনি।
আমি যে তোমায় ভালবাসি জয়।
তোমার অস্তিত্ব আমার মনে প্রাণে জড়িয়ে আছে।তোমাকে না দেখে আমি থাকতে পারবনা। হ্যাঁ, আমি ফেসবুক অ্যাডিক্টেড।
কী করব বলো, ভালো থাকতে হলে একটা কিছুর সাথে অ্যাডিকশান তো দরকার! নিছক কর্তব্য পালন করতে হলেও সোজা হয়ে দাঁড়াতে হয়!
তোমার প্রতি কর্তব্য পালনের মাধ্যমেই কেবল তোমায় ছুঁতে পারি আজকাল।
তুমি বড়ো হও, খুব বড়ো হও।
যেদিন বুঝব আর আমাকে তোমার প্রয়োজন পড়ছেনা, আমি সেদিন ঠিক চলে যাব, দেখো!
সুমির বুকটা ভেঙ্গে যাচ্ছে, অথচ দুচোখে একফোঁটা জল নেই। জয় এই প্রথম বুঝল যখন চোখ আর মনের বিবাদ লাগে, বুকের ভিতরে কতোটা রক্তক্ষরণ হয়!
চোখ না ভিজলেও মনকে দমিয়ে রাখা যে কি ভীষণ কষ্টের সুমিকে দেখে তা বেশ ভালোই টের পেল জয়।
সুমি বেরিয়ে গেল বসার ঘরে, জয় আঁটকালো না।
কাঁদুক, আজ সুমি প্রাণ ভরে কাঁদুক।
বুকের কষ্ট যখন মুখে আসে চোখের জলও চলে আসে পিছুপিছু।
কী ভেবে জয় সুমির মোবাইল ফোনটা তুলে নিল, লগ অন করে সুমির প্রফাইল খুলল ঝটপট, পেজে জ্বলজ্বল করছে সুমির না পাওয়া টুকরো সুখ-
"আমরা দুজন একটা ঘরে থাকি,
এক বিছানার সমান ভাগিদার।
একটা লেপের নিচে মুখমুখি,
মাঝের দেওয়াল অনেক খানি পার।
আমরা দুজন একটা আকাশ জুড়ে-
নীহারিকার পথে করি বাস।
দুই কিনারার মাঝে অনেক তারা,
হাত ধরবার নেই যে অবকাশ।
এইতো সেদিন দুজন একসাথে-
অর্ধশত দুয়ার যেথায় ঠাঁয়-
কাটিয়ে ছিলাম ঝলসে যাওয়া দুপুর,
শীতল প্রেমের সোহাগ মেখে গায়।
সেদিনও তোমার কাতর দুটি চোখ-
ভালবাসার মেগেছিল ভিখ্।
সবই কি তবে ক্ষণিক আবেগ ছিল?
আজও তা বুঝতে পারিনি ঠিক।
আমি তো বেশ ভাবতেছিলুম মনে-
সারাজীবন রইবো দুজন একই,
যতই ঝঞ্ঝা তুফান আসুক নেমে,
দুজনকে কেও দেবনা ফাঁকি।
তোমার সাথে কাটল কতো বেলা,
দু:খ সুখে স্মৃতির আঙিনায় ।
আমি কিন্তু মানতে পারিনা ঠিক ,
সময়টাই প্রেম পুড়িয়ে দেয়!!! "
বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে।
দখিনের জানলায় জলের ছাঁট্ লেগে বিছানা ভিজে যাচ্ছে।
জয় উঠে জানালা বন্ধ করলোনা।
জয়ের মোবাইল বাজছে, লুসির ফোন, জয় ধরলোনা।
বোধহয় এই প্রথমবার নিজের মধ্যে সুমিকে দেখছে জয়।
উপলব্ধি করছে সুমির যন্ত্রনা, অনেকদিন পর সুমিকে পাশে পেতে ইচ্ছে করছে খুব।
কিন্তু সুমির নাম ধরে ডাকার সাহস আজ আর জয়ের নেই।
হঠাত্ কাঁধে কারোর হাতের ছোঁয়া পেলো মনে হলো, একি! সুমি এসে বসেছে তার পাশে, পিছনের জানালা বন্ধ করলো বিছানায় উঠে। জলের ছাঁটে ভিজে যাওয়া জয়ের চুল মুছে দিলো তোয়ালে দিয়ে। আজও না চায়তেই তার প্রয়োজন মেটালো সুমি।
জয়ের সাহস নেই সুমির হাত ধরে, আরও জোরে বৃষ্টি এল বাইরে, আসুক, ভিজিয়ে দিক সবকিছু, ভিজিয়ে দিক জয়কে, যেন কোনো মতেই সুমি জয়ের চোখের জল না দেখতে পায়।
(সমাপ্ত)