প্রতিশোধ
প্রতিশোধ
সুধানগর গ্রামের মানুষ অনেক আগে থেকেই পানির জন্য কুয়ো ব্যবহার করত। কিন্তু টিউবয়েল আসার পর থেকে কুয়োর ব্যবহার অনেকটা কমে গেছে। আবার কুয়োর পানি অনেকেই ব্যবহার করে। তরকারী রান্নার সময় কুয়োর পানির চাইতে ভালো কিছু আর হতেই পারে না। তেমনি একদিন এক মহিলা সকাল বেলায় কুয়োর পানি নেও্যার জন্য বালতি ফালালেন। কিন্তু পানি তোলার পর দেখলেন বালতির পানি লাল হয়ে আছে। মহিলাটি প্রথমে কিছু মনে করলেন না। বালতির সবটুকো পানি ফেলে দিয়ে আবার কুয়োতে বালতি ফালালেন। কিন্তু একই অবস্থা। বালতির পানি লাল। মহিলাটি মনে মনে ভাবলেন, কেউ মনে হয় পানিতে রঙ ফেলেছে। এমনকি যারা এই কাজ করেছে তাদেরকে তিনি গালি দিতে লাগলেন। মহিলাটি চলে গেল।
অনেকেই কুয়োতে পানি নিতে এসেছিল কিন্তু কেউ পানি নিতে পারে নি।
৪-৫ দিন পর মহিলারা পানি তোলার জন্য গিয়ে কুয়োতে বালতি ফেলে পানি তুলল। কিন্তু এইবার পানির রঙ একটু কালো হয়েছে। আর পানিতে প্রচুর দূর্ঘন্ধ সবাই মনে করল কোন প্রাণী মরে পচে আছে। যার কারনে দূর্ঘন্ধ ছরাচ্ছে। গ্রামের মানুষ তাই কুয়োর পানির ব্যাবহার বন্ধ করে দিতে চাইল।
সবাই টিউবয়েল থেকে পানি আনা নেওয়া করে। কিন্তু কুয়ো ছাড়া গ্রামের মানুষের পানির অভাব রয়ে গেল। কারন সব বাড়িতেই তখন টিউবয়েল ছিল না। তাই কিছু গামের যুবকরা উদ্দেগ নিল যে তারা কুয়োর সবটুকো পানি সেচে ফেলে দিবে। সবাই একত্র হয়ে কাজ করতে হবে। গ্রামের কিছু যুবকেরা বাড়ি থেকে বালতি ও দড়ি আনল। তারপর তারা কাগ শুরু করে দিল। ২ জন লোক পানি তোলার কাজ করছে। আর অন্যরা পানি নিয়ে অন্য কোথাও ফেলে দিয়ে আসছে।
সবারই খুব কষ্ট হচ্ছে। কুয়োর পানি সেচ দেওয়া তো সহজ কথা নয়। আবার মাটিন নিচ থেকে পানি উঠে পরে। বিকাল পর্যন্ত তারা কুয়োর পানি সেচ করল। কিন্তু সারাদিন পানি সেচ করার পরেও যদি কুয়োতে পড়া প্রাণীটা না উথানো যায় তবে পরিশ্রমের কোন মূল্যই রইল না। তাই তারা আরো কিছুক্ষন কাজ করতে লাগল।
অনেক্ষন কাজ করার পর তারা খেয়াল করল। মানুষের মতো যেন মাথা দেখা যায়। তারপর বালতি দিয়ে সেটা উঠানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্ত পারল না। তারা খেয়াল করল আস্তে আস্তে সেটা ভেসে উঠছে। তারপর সেটা মানুষের আকার ধারন করল। গ্রামের লোকজন সকলেই অবাক হয়ে গেল। কুয়োর ভেতরে একটা বাচ্চা মেয়ের লাশ। তার দেহে কাঁটা দাগ। কেউ যেন তাকে দা দিয়ে কুপিছে। গ্রামের সকল মানুশের কাছে খবর চলে এল। লোকজন সেটা দেখতে এলো। মেয়েটার লাশটা পচে সাদা হয়ে আছে। তখন মানুষ বুঝতে পারল কিসের জন্য কুয়োর পানি লাল হয়ে ছিল।
মেয়েটার ঠিকানাও কেউ জানে না। তবে এটা তারা বুঝতে পারল যে কেউ হয়তো মেয়েটাকে খুন করে এই কুয়োতে ফেলে দিয়ে গেছে। অনেক মানুষ দেখতে এল। মেয়েটার লাশ বেশিক্ষন রেখে দিলেই পচে যাবে। কেউ থানা পুলিশ করার সাহস পেল না। মেয়েটাকে দাফন করার জন্য টাকা পয়সা দরকার । সবাই কিছু কিছু দিয়ে বাজার থেকে কাফনের কাপড় কিনে
আনল।
কাজ করতে করতে ওনেক রাত হয়ে গেল। অবশেষে প্রার রাত ১০ টার (অনুমানে, কারণ তখন সবার কাছে ঘড়ি ছিল না) জানাজার নামাজ পড়িয়ে কবর দেওয়া হল। সবাই সবার বাড়ি চলে গেল। রইল শুধু অজানা মেয়ের কবরটা।
৭ দিন আগের ঘটনা............
সুধানগর গ্রাম থেকে ৩ মাইল দূরে রামপুর গ্রাম। গ্রামের মানুষ অতটা ভালো বললেও অনেক লোক আবার খুব খারাপ। তার মধ্যে একজন হল কাদের। কাদের রাতের বেলা বেলা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়। মদ গাঁজা খায়। আবার রাতের বেলায় মাতাল হয়ে আবল তাবল বলতে বলতে বাড়িতে ফিরে আসে। কাদেরের বউ খুব ভাল মানুষ। কিন্তু কাদেরের এই অচারনে কাদেরের বউ এখন পাগল পাগল বেশ ধরেছে। এমনিতে বউটা খুব ভাল। রান্না বান্না থেকে শুরু করে ঘড় দোয়ার পরিস্কার করা সহ সকর কাজ করে। কিন্তু কাদের তার রান্না মোটেও পছন্দ করে না। সারাদিন মদ খেয়ে একটু সাধারন খাবার খেলেই ঝালে মরে যায় আর আলুনের মতো লাগে। মাঝে মাঝেই তার বউয়ের সাথে ঝগড়া করে।
কাদেরের ছোট্ট মেয়ের নাম হাফিজা । হাফিজার মতো মেয়েরা হাফিজাকে নিয়ে টিটকারি করে। বলে, হাফিজার বাবা মদ খায়। মাতালের মেয়ে ইত্যাদি বলে ঠাট্টা করে। মাঝে মাঝেই হাফিজা দড়জা বন্ধ করে মুখ লুকিয়ে কান্না করে।
একদিন হাফিজা তার বাবাকে বলেছিল, আর মদ খেও না।
কিন্তু তার বাবা তাকে খুব মেরে ছিল। হাফিজা সেই দুঃখ এখনো ভোলেনি। কাদের তার বউকেও মাঝে মাঝে মারে।
সেই রাতের মতো একদিন রাতে কাদেরের বউয়ের খুব জ্বর। পাশে হাফিজা বসা। কাদের বাড়িতে নেই। বাড়িতে টাকা পয়সা নেই। ওষুধ কেনার টাকা নেই। হাফিজার রাতে ঘুম আসছে না। হাফিজার মা জ্বরে কোকাচ্ছে। হাফিজার মা রান্না করতে পারে নি। রাত ১ টা নাগাদ কাদের আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফেরে। এমনকি আগের দিনের মতোও নেশা করে বাড়ি ফিরে এসেছে। এসেই দেখে কাদেরের বউ শুয়ে আছে।
কিরে শুয়ে আছিস কেন?
বাবা, মার অনেক জ্বর। একটু দাক্তারের কাছে নিয়ে যাও না!
চুপ... মুখে মুখে কথা।
তোর মাকে বল ভাত বেড়ে দিতে।
মা রান্না করতে পারে নি।
এই কথা শোনার পর যেন হাফিজার মায়ের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল কাদের। হাফিজার মা নিস্তেজ হয়ে আছে। কাদের তাকে কিল ,ঘুষি, ও লাথি দিতে লাগল। কিন্তু কাদেরের বউ আধামরা হয়ে আছে। হাফিজা ছাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু তার বাবার শক্তির তুলনায় হাফিজার শক্তি কিছুই না। হাফিজা কাদেরের হাতের মধ্যে একটা জোরে কামর দিল। রাগের মাথায় হাফিজার মাকে ছেড়ে দিয়ে হাফিজাকে ধরে ফেলল। হাফিজা ছাড়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। কাদেরের মাথায় হুস ছিল না। হাফিজাকে চেপে ধরে কি দিয়ে যেন একটা আঘাত করল। হাফিজা মারা গেল। হাফিজা মারা যাওয়ার পর কাদেরের মাথা থেকে সেই শয়তানটা চলে যায়। তখন কাদেরের হুস ফিরে আসে। কাদের এইবার খেয়াল করল তার হাতে রক্তাত্ব দা। হাফিজার মা অজ্ঞান হয়ে আছে। কাদের আখন কি করবে! ভয়ে এখন তার গা হিম হয়ে আছে। কাদের কখনো মানুষ খুন করে নি। কাদের হাফিজাকে নিয়ে ভাবতে লাগল। কি করবে এখন বুঝতে পারছে না।
রাত ২ টার দিকে কাধে করে বাইরে নিয়ে গেল হাফিজাকে। হাফিজাকে গর্ত করে পুতে রাখলে মানুষ দিনের বেলা সন্দেহ করবে। কাদের মত পাল্টাল। কাদের আরো হাটতে লাগল। সামনে শুধানগর গ্রাম। কাদের লাশ নিয়ে সুধানগর গ্রামে প্রবেশ করল। এখানে এসে কাদের কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। অবশেষে কাদের হাফিজার লাশটাকে সুধানগর গ্রামের কুয়োর মধ্যে ফেলে দিল।
কাদেরের বউয়ের শরীরটা জ্বরে নিথর হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু কাদের কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। কেউ যদি হাফিজাকে না পেয়ে পুলিশকে খবর দেয়। তবে তো কাদেরের জেল হয়ে যাবে। কাদেরের মনে হল মাথার চুল ছিরে ফেলতে। রাগের মাথায় তার মেয়েকে চিরদিনের জন্য হারাল।
প্রায় ২ বছর পর.........
কাদের হাফিজাকে প্রায় ভুলে গেছে। কিন্তু তার অভ্যাসটা তেমনি রয়েছে। কাদেরের বউ সে বছর মারা গিয়েছিল। মারা যাওয়ার সময় কাদেরকে বলেছিল ভাল হয়ে যেতে। কিন্তু কাদের চেষ্টা করেও ভাল হতে পারে নি। এখনো কাদের রাতের বেলায় আড্ডা দেয়। কাদের নতুন বিয়ে করেছে। নতুন বউ জানে না যে কাদের এতো খারাপ লোক।
একদিন কাদের রাতের বেলা আগের দিনের মতো আড্ডা দিচ্ছিল । অনেক মদ খাওয়ার পর একসময় মাথাটা কেমন জানি চক্কর দিল। মাথা চক্কর দেওয়া নতুন কিছু না। অনেক সময়ই তার মাথা ঘুড়ায়। কিন্তু আজকে কেমন জানি একটু বেশিই খারাপ লাগছে।
কাদের বলল, তোরা থাক ! আমি চলি।
আরে এখনি কোথায় যাবি? আরে বেশি রাতই তো হল না!
আরে! মাথাটা বড্ড ঘুড়াচ্ছে। আমি বরং চলি , তোরা থাক।
এতো দিন কাদের আড্ডা দিতে দিতে সবাই মিলে একসাথে বাড়িতে গেছে। সবার কাছে লাইট থাকে বলে কাদের লাইট আনে না। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মদ্যে কাদের এগোচ্ছে। একটু চাদের আলোও আজকে নেই। সমনেই বিশাল একটা পুকুর। গা ছমছমে ব্যপার। পুকুর পার থেকে ঠান্ডা বাতাস কাদেরের গায়ে লাগছে। কাদের তারাতারি হাটতে লাগল। পুকুর পারে আসার পর কাদের খেয়াল করল একটা ছোট্ট মেয়ে একটা গাছের নিচে বসে আছে। কাদেরের ভয় একটু কমেছে। মেয়েটার পাশে গ্য্যে কাদের বলল, এতো রাতে তুমি এখানে কি করছ? তারপর মেয়েটা কাদেরের দিকে তাকায়। কিন্তু যা দেখল তা দেখে কাদেরের গা পাথর হয়ে গেল। এটাতো কাদেরের মেয়ে হাফিজা। কাদের খেয়াল করল তার গায়ে দা দিয়ে কোপানোর চিহ্ন। কাদের দৌরে পালাতে লাগল। কিন্তু কাদের খেয়াল করল কে যেল তাকে শক্ত করে ধরে আছে। কাদের পিছন দিকে তাকাল। কাদের ২ জন মানুষ দেখতে পেল। একটি হল হাফিজা আর একটি হল তা মা।
কাদের চিৎকার করে বলল, আমাকে ছেরে দাও। আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি। কাদেরের বউ বলল, তোর অবহেলার কারনেই আমরা বেচে নেই। এইবার তোর পালা। কাদের বলল, আমাকে মাফ করে দাও। কাদেরের বউ বলল, যেই কাজ তুই করে ফেলেছিস সেই কাজ এর ক্ষমা তুই কোনদিন পাবি না।
কাদের আস্তে আস্তে নিস্তেগ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে এক্ষনি পরে যাবে। কাদের দৌড়াতে পারছে না। ২ জন কাদেরের দিকে এগিয়ে আসছে। কিন্তু কাদের কিছু করতে পারছে না। এক সময় কাদের মাটিতে পরে যায়। ধপাস করে কাদের পরে গেল। কাদের খেয়াল করল তারা তার পাশে বসল। বসার পর তারা তার হাতটা বুকের উপর ধরে বুকটা চিড়তে লাগল। বুক ফেটে রক্ত বের হতে লাগল। কাদের নিজের হ্রৎস্পন্দন দেখতে পেল। একসময় কাদেরের হ্রৎপৃন্ড চিরদিনের নামে থেমে গেল।
সকাল বেলা পুকুর পারে পাওয়া গেল কাদেরের লাশ। কেন মারা গেল কেউ বুঝতেই পারে নি। কারন কাদেরের দেহে কোন ক্ষত চিহ্ন ছিল না।

