প্রতিবাদী নারী
প্রতিবাদী নারী
বর্তমানে আমরা ঘরে বাইরে সর্বত্র মেয়েদের নানা কাজের ভিতর দেখতে পাই। সেটা চাকুরীজীবি থেকে শুরু করে এমনকি পাইলট, নাবিকের কাজ পর্যন্ত মেয়েরা করে চলেছে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। অথচ মেয়েরা গল্প লিখছেন শুনলে উনিশ শতকের প্রায় আশি শতাংশ পুরুষের মনে হত ‘আরশোলার পাখি হওয়ার ইচ্ছে হয়েছে।’ বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস নায়িকাপ্রধান, তাঁর নায়িকারা আত্মশক্তি এবং গরিমায় নায়কদের ছাপিয়ে গেছে। তারপরও বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্ত বলেছিলেন ‘নারিকেলের মালা বড় কাজে লাগে না, স্ত্রীলোকের বিদ্যাও বড় নয়।’
বাংলার প্রথম আত্মকথার লেখিকা রাসসুন্দরী দেবী স্বামীর ঘোড়াকে দেখে ঘোমটা দিতেন – উনিশ শতকে সংসারে নারীর অবস্থানের চিত্রটি ছিল ঠিক এই রকম। একবিংশ শতকের প্রথমার্ধে পৌঁছেও পুরুষশাসিত সমাজের কতজন পুরুষ সাফল্যের শীর্ষে ওঠা নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান আর স্বীকৃতি দিতে পারে? নানাভাবে নারীর সাফল্যকে তুচ্ছ, খাটো করার চেষ্টা করে থাকে পুরুষশাসিত সমাজ। সাফল্যের কথা যদি বাদও দিই, মেয়েদের যে একটা আলাদা অস্তিত্ব আছে, ধারণক্ষমতা আছে, নিজস্ব আকাঙ্খার জগৎ আছে, তারা স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে, নারী জীবনের এই সহজ, সাধারণ সত্যকে পুরুষরা অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্যই করে এসেছে চিরকাল। নারীর প্রতি তাচ্ছিল্য আর অপমান আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির অন্তর্গত হয়ে গেছে। কথা প্রসঙ্গে আলবেয়ার কামু একবার সিমোন দ্য বোভোয়ার কাছে মন্তব্য করেছিলেন, নারীর পিছিয়ে থাকার কারণে পুরুষরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় সবচেয়ে বেশি, কারণ তারা উপযুক্ত সঙ্গিনী পায় না। উপযুক্ত সঙ্গিনীর অভাবের কথা বলেছিলেন কামু। নারীর উপযুক্ত হয়ে গড়ে ওঠার পেছনে প্রতিবন্ধকতার কথা তিনি বলেননি। আর উপযুক্ত হলেও পুরুষতন্ত্র যে নারীকে তার অবস্থান থেকে নামিয়ে রাখতে পছন্দ করে এ-কথা তিনি ভেবে ছিলেন কিনা জানি না।
নারীর প্রতি পুরুষের এই লাঞ্ছনা, অবমাননার একটি সামাজিক ভিত্তি আছে। দুই হাজার ৩০০ বছর আগে অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, মেয়েরা পুরুষের তুলনায় অক্ষম ও স্বল্প বুদ্ধিসম্পন্ন। অ্যারিস্টটলকে অনুসরণ করে যুগের পর যুগ ধরে পুরুষেরা তোতাপাখির মতো একই কথা আউড়ে গেছেন। সমাজপতিদের দেওয়া অনুশাসন নারীর জীবন, স্বপ্ন, অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে বিকশিত হতে না দিয়ে যুগ-যুগ ধরে তাকে অন্দরমহলের অন্ধকারে আবর্জনার স্তূপে আবদ্ধ করে রেখেছে। মেয়েদের বুদ্ধির বিকাশের সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সব পথ বন্ধ করে দিয়ে বলা হয়, মেয়েদের বুদ্ধির বিকাশ ঘটে না। নারী প্রগতির এই সময়ে আজও আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেয়েদের অগ্রগতি, সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য, কৃতিত্ব রুখে দেওয়ার জন্য সদাতৎপর। দেশের শিক্ষিত শ্রেণি নিজেরাই পশ্চাৎমুখী চিন্তাভাবনায় আজও আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। পুরুষ পশ্চাৎমুখী চিন্তাভাবনায় আচ্ছন্ন এ-কথা বললে সমাজপতিরা ক্ষিপ্ত হবেন, কারণ সমাজটা আজও তাদের নিয়ন্ত্রণে। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়েই তাদের এই কূপমণ্ডূক চিন্তাভাবনা প্রকাশ পায়। নারী আজ যখন সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখছে, শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, খেলাধুলা, সব রকমের পেশায় সাফল্যের পরিচয় দিয়ে নিজেকে পুরুষের সমকক্ষ প্রমাণ করেছে তখনও আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষিত রক্ষণশীল সম্প্রদায় নারীর বিকাশকে সর্বপ্রকারে স্তব্ধ করতে তৎপর। গত প্রায় ৫০-৬০ বছরে সর্বক্ষেত্রে নারীর বিস্ময়কর অগ্রগতি সত্ত্বেও নারীকে হেয় করার প্রবণতা, নারীনির্যাতন, লাঞ্ছনা বেড়েই চলেছে। নারী ভোগের বস্তু, অতএব তাকে দখলে রাখতেই হবে। এখনো নারীর পরিচয় নির্ধারিত হয় পুরুষের উপভোগ্যতা সাপেক্ষে। নারীকে দেখা হয় পুরুষের পরিপ্রেক্ষিতে। কুমারী হলে পিতৃপরিচয়, বিবাহিত হলে স্বামীর পরিচয়ে, প্রাচীন সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধের সমাজে নারীর পরিচয়ে পুরুষের পটভূমিকা অত্যন্ত জরুরি এবং আবশ্যক।
‘আরশোলার পাখি’ হওয়ার ইচ্ছা ব্যাপকভাবে না হলেও এদেশের ঊনবিংশ শতাব্দীতে মেয়েরা লেখালেখি শুরু করেছিল। সকলের দৃষ্টির আড়ালে, সারাদিনের কাজের শেষে অবসর খুঁজে তারা তাদের কথা লিখত। কেউ পড়বে – এই আশা নিয়ে হয়তো লিখত না। তাদের কুণ্ঠিত লেখালেখির আড়ালে হয়তো থাকত অন্তর্গত তাগিদ অথবা অবদমিত আত্মপ্রকাশের যন্ত্রণা। উনিশ শতকের সূচনাকালে এদেশে মেয়েরা ছিল শিক্ষার আলোক থেকে বঞ্চিত, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে সম্পর্কশূন্য, মানবিক প্রায় সমস্ত অধিকার থেকেই বঞ্চিত। কন্যাসন্তানের পৃথিবীতে আগমনকে শঙ্খধ্বনি দিয়ে কেউ স্বাগত জানাত না। অনাকাঙ্ক্ষিত জীবনের ভার সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হতো। ভালোভাবে কিছু বোঝার আগেই বিয়ে হয়ে যেত, কৈশোরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতে হতো। আর কৈশোর না পেরোতেই শুরু হতো সন্তানের জন্মদান। নারীর জীবনের চাকা এভাবেই ঘুরত। রাসসুন্দরীর আত্মকথায় সেকালের নারীজীবনের এই চিত্র আমরা দেখতে পাই।
সভ্যতার পীঠস্থান ইংলন্ডে অষ্টাদশ শতাব্দীতে যে-নারী শুধুমাত্র কলমের শক্তিতে সমাজ এবং রাষ্ট্রকে সচকিত, জাগ্রত করেছিলেন তিনি ম্যারি ওয়ালস্টোনক্র্যাফট (১৭৫৯-৯৭)। তিনি ছিলেন নারীমুক্তি এবং মানুষের মুক্তির প্রথম উচ্চকণ্ঠ, স্পষ্টভাষী প্রচারক। নারীমুক্তির প্রথম পথপ্রদর্শক। ইংলন্ডে এনলাইটেনমেন্ট যুগের চিন্তানায়ক। নারীশিক্ষা, স্বাধীনতা, নারীর অধিকার বিষয়ে প্রথম পুস্তকের লেখিকা হিসেবে ইতিহাসে মেরি সুনির্দিষ্ট স্থান করে নিয়েছেন।
ম্যারি ওলস্টোনক্রাফট (ইংরেজি: Mary Wollstonecraft, এপ্রিল ২৭, ১৭৫৯ - সেপ্টেম্বর ১০, ১৭৯৭) অষ্টাদশ শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজ লেখিকা। নারীবাদী আন্দোলনের ইতিহাসের সাথে তার নাম বিশেষভাবে যুক্ত। তার জন্ম লন্ডনের স্পিটাফিল্ডসে।
ছোটবেলায় তার পরিবারের স্বচ্ছল উপার্জন ছিল, তবে তার বাবা আস্তে আস্তে তার অনুমানমূলক প্রকল্পগুলিতে ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন । ফলস্বরূপ, পরিবারটি আর্থিকভাবে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে এবং ওলস্টোনক্র্যাফটের যৌবনে তারা প্রায়শই এক জায়গা থেকে অন্যত্র সরতে বাধ্য হন । পরিবারের আর্থিক পরিস্থিতি অবশেষে এতটাই মারাত্মক হয়ে উঠল যে ওলস্টনক্র্যাফটের বাবা তাকে বাধ্য করেছিলেন যে তিনি তার সাবালক হওয়ার পরে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হতে পারেন সেই টাকা সংসারে ব্যবহারের জন্য।তদুপরি, তিনি স্পষ্টতই হিংস্র লোক ছিলেন, তিনি মাতাল হয়ে রাগে স্ত্রীকে মারতেন। কিশোর বয়সে ওলস্টনক্র্যাফট তার সুরক্ষার জন্য তাঁর মায়ের শোবার ঘরের দরজার বাইরে শুয়ে থাকতেন। ওলস্টোনক্র্যাফ্ট তার সারাজীবন তার বোনদের এভারিনা এবং এলিজার জন্য একই রকম মায়ের ভূমিকা পালন করেছিলেন। 1784 সালে একটি সংজ্ঞায়িত মুহুর্তে, তিনি সাহায্য করেন এলিজাকে ,যিনি সম্ভবত ভুগছিলেন প্রসবের বিষণ্নতায় , তার স্বামী এবং শিশুকে ছেড়ে চলে যেতে। ওলস্টোনক্র্যাফ্ট এলিজার পালানোর সমস্ত ব্যবস্থা করেছিলেন, সামাজিক নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করার ব্যাপারেও তিনি তার আগ্রহ প্রকাশ করেন । তবে মানুষের বিচার তীব্র ছিল: তার বোন সামাজিক নিন্দার শিকার হয়েছিলেন এবং যেহেতু তিনি পুনরায় বিবাহ করতে পারেননি, দারিদ্র্য ও কঠোর পরিশ্রমের জীবনে ডুবে ছিলেন।
দুটি বন্ধুত্ব ওলস্টনক্র্যাফ্টের প্রথম জীবনকে আকার দিয়েছে। প্রথমটি ছিল জেন আরডেন-এর সঙ্গে বেভারলিতে । দু'জন ঘন ঘন একসাথে বই পড়ে এবং আর্ডেনের পিতা, স্বধারার দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী। আর্ডেনের পিতার দ্বারা উপস্থাপিত বক্তৃতাগুলিতে উপস্থিত হয়ে অংশ নিয়েছিলেন। ওলস্টোনক্র্যাফ্ট আর্দেন পরিবারের বৌদ্ধিক পরিবেশে পছন্দ হয়েছিল এবং আর্দেনের সাথে তার বন্ধুত্বকে অনেক মূল্যবান বলে মনে করেছিল, কখনও কখনও আবেগগতভাবে প্রভাবিত হয়ে, ওলস্টোনক্র্যাফ্ট তাকে লিখেছিলেন: "আমি বন্ধুত্বের রোম্যান্টিক ধারণা তৈরি করেছি ... আমার ভালবাসা এবং বন্ধুত্বের চিন্তায় আমি কিছুটা একক হয়েছি; আমার অবশ্যই প্রথম স্থান পেতে পারি বা কোনওটিই নয় ।" আর্দনের কাছে ওলস্টনক্র্যাফ্টের কয়েকটি চিঠিতে তিনি উদ্বিগ্ন এবং হতাশাবোধ প্রকাশ করেছেন যা তাঁর সারাজীবন তাকে ঘিরেই থাকবে। দ্বিতীয় এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুত্ব ছিল সঙ্গে ফ্যানি (ফ্রান্সেস) ব্লাড, যিনি হ্যাক্সটন নিবাসী ক্লেরেস দম্পতির সাথে ওলস্টনক্র্যাফ্টের পরিচয় করিয়েছেন ,যারা তার কাছে পিতামাতার ব্যক্তিত্ব হিসাবে পরিচিত হয়েছিলেন; ওলস্টনক্র্যাফ্ট এর সম্পূর্ণ প্রশংসা ব্লাডকে দিয়েছিলেন।
ম্যারির সাহিত্য জীবন ক্ষণস্থায়ী, মাত্র ৯ বছর জুড়ে তার ব্যাপ্তি। এই সময়ে তিনি নারীবাদ সহ দর্শন, শিক্ষা, রাজনীতি, ধর্ম, ইতিহাস, ইত্যাদি নিয়ে লেখালেখি করেছেন। ওলস্টোনক্রাফটের শ্রেষ্ঠ রচনা আ ভিন্ডিকেশন অফ দ্য রাইটস অফ ওম্যান (১৭৯২), যেখানে তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে নারী প্রাকৃতিকভাবেই পুরুষ অপেক্ষা হীন, এমনটি নয়। শিক্ষার অভাবেই নারী পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে পড়ে। তিনি প্রস্তাব করেন নারী এবং পুরুষ উভয়কেই যুক্তিবাদী সত্ত্বা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত এবং এর মাধ্যমে তিনি যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত সামাজিক শৃঙ্খলা খুঁজে পাওয়ার কথা কল্পনা করেছেন। ম্যারি বিয়েবিরোধী ছিলেন কিন্তু আবার প্রেম এবং স্বাধীন যৌনতার পক্ষে ছিলেন, বিংশ শতাব্দীর শেষ দিক পর্যন্ত ম্যারির লেখার চেয়ে ম্যারির ব্যক্তিগত প্রেম এবং যৌনতা নিয়েই গবেষকরা বেশি মাথা ঘামিয়েছেন কারণ ম্যারির নিজের ব্যক্তিগত প্রেম বা যৌনতা সম্পর্কে অত বেশি কিছু জানা যায়নি। সুইজারল্যান্ডের চিত্রশিল্পী হেনরি ফুজেলি (১৭৪১-১৮২৫), যিনি যার জীবনের একটা বড় অংশ ইংল্যান্ডে কাটিয়েছেন, ম্যারির সঙ্গে প্রেম করেছিলেন যদিও এ ব্যাপারে আজ অবধি কোনো স্পষ্ট এবং শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে তারা প্রেমই করতেন, তবে মার্কিন ব্যবসায়ী গিলবার্ট ইমলে (১৭৫৪-১৮২৮) ম্যারির গর্ভে ফ্যানি ইমলে নামের একটি মেয়ের জন্ম দিয়েছিলেন এটির প্রমাণ আছে কারণ গিলবার্টকে ম্যারি খুব সম্ভবত বিয়ে করেছিলেন, ম্যারির দ্বিতীয় বিয়ে ছিলো দার্শনিক উইলিয়াম গডউইনের সঙ্গে, ম্যারি তার সাথে সহবাস করেন এবং দ্বিতীয় বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান মাত্র ৩৮ বছর বয়সে এবং এই দ্বিতীয় মেয়েটির নাম গডউইন ম্যারিই রেখেছিলেন, মেয়েটি কবি পার্সি বিশি শেলি এর পত্নী হয়েছিলেন।
বিংশ শতাব্দীর শেষ অবধি, ওলস্টোনক্র্যাফ্টের জীবন, যা সে সময় বেশ কয়েকটি প্রচলিত ব্যক্তিগত সম্পর্ককে ঘিরে ছিল, তার লেখার চেয়ে বেশি মনোযোগ পেয়েছিল। আজ ওলস্টনক্রাফ্টকে অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বিবেচনা করা হয় নারীবাদী দার্শনিক, এবং নারীবাদীরা প্রায়শই তার জীবন এবং তার কাজ দুটিকেই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হিসাবে উল্লেখ করেন।
তাঁর সংক্ষিপ্ত কর্মজীবনে তিনি গ্রন্থনা করেন উপন্যাস, ভ্রমণ আখ্যান, একটি ইতিহাস ফরাসি বিপ্লব, পরিচালনা বই, এবং একটি শিশুদের বই। ওলস্টোনক্রাফ্ট সবচেয়ে বেশি পরিচিত নারীর অধিকারের একটি প্রতিচ্ছবি (১৭৯২), যার মধ্যে তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে মহিলারা স্বাভাবিকভাবেই পুরুষদের থেকে নিকৃষ্ট নয়, তারা কেবল শিক্ষার অভাবে দেখা দেয়। তিনি পরামর্শ দেন যে পুরুষ ও মহিলা উভয়কেই যুক্তিযুক্ত প্রাণী হিসাবে বিবেচনা করা উচিত এবং ক সামজিক আদেশ ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।
ওলস্টোনক্র্যাফ্টের মৃত্যুর পরে, তার একটি প্রকাশিত স্মৃতিচারণ (1798) তার বিধবা জীবনের, তার অপ্রচলিত জীবনধারা প্রকাশ করে, যা প্রায় এক শতাব্দীর জন্য অজান্তেই তার খ্যাতি ধ্বংস করে দেয়। তবে, এর উত্থানের সাথে নারীবাদী আন্দোলন বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, ওলস্টোনক্র্যাফ্টের মহিলাদের সমতা ও প্রচলিত নারীত্বের সমালোচনার ভাবনা ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
ম্যারির রচনাসমূহ :
*Thoughts on the Education of Daughters (১৭৮৭)
*Mary: A Fiction (১৭৮৮)
*Original Stories from Real Life (1788)
Of the Importance of Religious Opinions (1788) (translation)
*The Female Reader (1789) (anthology)
*Young Grandison (1790) (translation)
* Elements of Morality (1790) (translation)
* A Vindication of the Rights of Men (1790)
* A Vindication of the Rights of Woman (1792)
* An Historical and Moral View of the French Revolution (1794)
* Letters Written during a Short Residence in Sweden, Norway and Denmark (1796)
* Contributions to the Analytical Review (1788-1797) (published anonymously)
* The Cave of Fancy (1798, published posthumously; fragment)
*Maria, or The Wrongs of Woman (1798, published posthumously; unfinished)
* Letters to Imlay (1798, published posthumously)
* Letters on the Management of Infants (1798, published posthumously; unfinished)
*Lessons (1798, published posthumously; unfinished)
* On Poetry and our Relish for the Beauties of Nature (1798, published posthumously)
মাত্র ৩৮ বছরের জীবনে ম্যারি তাঁর শ্রম, সাহস, সততা দিয়ে যে অসাধারণ কাজ করে গেছেন পুরুষশাসিত সমাজ তার কোনো মূল্যায়ন করেনি, বেঁচে থেকে তিনি অপমান আর অপবাদ পেয়ে গেছেন। সীতাকে অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। সর্বক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমকক্ষ প্রমাণিত হওয়ার পর আজও নারীর শরীরে লেপ্টে থাকে ‘Frailty thy name is woman..’ ধারণাটা পুরুষ নারীর মনে দৃঢ়ভাবে গেঁথে দিয়েছে।
ম্যারি লেখনীর মধ্য দিয়ে বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটিয়ে ছিলেন, ম্যারির লেখার বিষয় ছিল নারীর শিক্ষা, স্বাধীনতা এবং সমাজে নারীর অবস্থান। ম্যারির ব্যক্তিজীবন সুখের ছিল না, যে বৈপ্লবিক বিশ্বাস এবং আদর্শের কথা তিনি বলেছিলেন নিজের জীবনে তার বাস্তবায়ন করতে পারেননি।
ভিনডিকেশ্যান প্রকাশের এক শতাব্দী পর নৈরাজ্যবাদী এমা গোল্ডম্যান দীর্ঘদিনের অবহেলিত মেরিকে ‘আধুনিক নারীত্বের প্রথম প্রবক্তা’ বলে আখ্যায়িত করেন। স্বশিক্ষিত মেরি অবহেলা আর অসম্মান সত্ত্বেও নিজের বিশ্বাসে অবিচল ছিলেন।
স্বাধীন, স্বনির্ভর কোনো নারী আজও যদি তাঁর মুক্তবুদ্ধির নির্দেশ অনুযায়ী বাঁচতে চান তবে তার বিরুদ্ধে কুৎসা, কলঙ্ক ছড়াতে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আজও কি পিছিয়ে থাকে?
আজকের নারীর সবচেয়ে বড় সমস্যা তার আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের সমস্যা। জৈবিক কারণে নারী ও পুরুষের সামাজিক অবস্থান এবং ভূমিকা আলাদা হতে বাধ্য। নারীত্ব নারীর জন্মগত পরিচয়। এই পরিচয় নারীকে আজন্ম বহন করে চলতে হয়। নারীত্ব নারীর শারীরিক ও মানসিক গুণ যা পুরুষের সঙ্গে তার পার্থক্য গড়ে তোলে। জৈবিক যে-কারণটি নারীকে পুরুষের থেকে অবস্থান নামিয়ে রাখে সেটি হলো তার ধারণক্ষমতা। নারী সন্তান ধারণ করে। এই একটি মাত্র প্রাকৃতিক ঘটনাই পুরুষকে কোথাও কোথাও বাড়তি সুবিধা দেয় যা নারী পায় না। নারীর এই শরীরকেন্দ্রিক ব্যাপারটিকে পুরুষ কাজে লাগায়। নারীর শরীরকে কাজে লাগিয়ে সে কিছু বাড়তি সুবিধা আদায়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে নারীর ওপর। এ যাবৎকাল সবকিছুই পুরুষের স্বার্থে, সমাজ-ক্ষমতা সবকিছুই পুরুষের হাতে, পুরুষের প্রয়োজনে হয়ে এসেছে, নারীর জন্য শুধুই থেকেছে গৃহকোণ। পুরুষতন্ত্র কখনো নারীকে
বুঝতে দেয়নি পরিবার এবং সমাজে নারী-পুরুষ উভয়ের ভূমিকা সমান।
শেষ করতে চাই একালের এক নারীর নিঃসঙ্কোচ দৃপ্ত উচ্চারণ দিয়ে – ‘অবমাননা থেকে মুক্তির দায়িত্ব নারীকে নিজেই নিতে হবে। অচেতন জড়ত্বের অবমাননা থেকে বেরিয়ে এসে পালন করতে হবে সচেতন অস্তিত্বের ভূমিকা। হোক সে-ভূমিকা সংঘাতময়, হোক সে-ভূমিকা আত্মকেন্দ্রিক। প্রজাতির প্রতি পরিপূর্ণ নিবেদন থেকে অব্যাহতি নিয়ে ব্যক্তিগত বিকাশে মনোযোগী হতে হবে। সমতুল্য হয়ে উঠতে হবে সচেতন অস্তিত্বের। মুছে ফেলতে হবে অমর্যাদার চিহ্ন।’
