Suravi Roy

Abstract Drama Inspirational

4.5  

Suravi Roy

Abstract Drama Inspirational

প্রতিবাদ

প্রতিবাদ

19 mins
539


অভীক আর নিশা দুই ভাইবোন। ওদের বয়েসের পার্থক্য অনেকটা হলেও ওরা ছিল বেস্ট্ ফ্রেন্ড-এর মত। এই দুই ছেলে-মেয়ে ই ছিল তাদের বাবা নিলাম্বর বাবুর চোখের দুই মণি। কিন্তু তাদের মা অনুপমা দেবীর কাছে ছেলে অভীক ছিল তার প্রাণ। কিন্তু তিনি মেয়ে নিশা কে একবারে সহ্য করতে পারতেন না। তিনি নিশাকে বাড়ির কাজের লোক মনে করে সব কাজই নিশাকে দিয়েই করাতেন। এমনকি অভীক কোনো দোষ করলেও তিনি অভীককে কিছু না বলে, বিনা কারণে নিশাকে মারধোর করতেন।

 অনুপমা দেবীর অনিচ্ছায় মেয়ে নিশার জন্ম হয়েছিল। কারণ তিনি যখন জানতে পারেন যে তার গর্ভে কন্যা সন্তান আছে, তখনই তিনি গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ তিনি একজন মেয়ের মা হতে কোনো দিনই চান নি। কিন্তু গর্ভপাতের কথা শুনেই নিলাম্বর বাবু ক্ষেপে ওঠেন এবং অনুপমা দেবীর গর্ভপাত বন্ধ করেন। একপ্রকার অনুপমা দেবীকে বাধ্য করেন তার মেয়ের জন্ম দিতে। 

তাই নিশা তার জন্মের পর থেকে কোন দিনই মা থাকতে মায়ের ভালবাসা পাইনি। তার মা অনুপমা দেবী তার সাথে সৎ মায়ের থেকেও খারাপ ব্যবহার করতেন। কিন্তু এই সব দেখেও নিলাম্বর বাবু কোনো দিনই তাঁর দাম্ভিক মেজাজের স্ত্রীর মুখের উপর কোনো প্রতিবাদ করতে পারেন নি। তিনি মুখ বুজে মেয়ের ওপর ঘটে যাওয়া অত্যাচার দেখেছেন। কিন্তু তিনি মেয়েকে খুবই ভালোবাসতেন।

 নিশা তার পিতার স্নেহে বড়ো হয়েছে। মায়ের তাকে স্কুলে পাঠানোর কোনো ইচ্ছা না থাকলেও বাবার জেদেই নিশা আজ মাধ্যমিক পাশ করে , ক্লাস ইলেভেন এ ভর্তি হয়েছে। কিন্তু অভীক তার মায়ের অতিরিক্ত আদরে মানুষ হলেও সে তার মায়ের মত মেন্টালিটি পাইনি। সে তার একমাত্র বোন নিশাকে তার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসত। কিন্তু মায়ের সামনে দেখাতো না। কারণ মা কোন দিনই তার আদরের ছেলেকে নিশার সাথে কথা বলতে পর্যন্ত দিতেন না। সবসময়ই তিনি ভাইবোনের মধ্যে ভেদাভেদ ও হিংসা তৈরীর চেষ্টা করতেন। কিন্তু তা নিলাম্বর বাবুরজন্য সম্ভব হয়নি।

 আজ অভীক ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সবে মাত্র চাকরি পেয়েছে। মা অনুপমা দেবীতো আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছেন। বাবাও খুব খুশি হয়েছেন। কিন্তু নিশা খুব খুশি হলেও তার দাদার সাথে আনন্দ করার সময় নেই। সে চোখে জল নিয়ে ঘরের এককোণে বাসন মাজছে। হঠাৎই অভীক তার মাকে বলল যে সে আগামীকাল তাকে একটা সারপ্রাইজ দেবে। আর এই কথা শুনে অনুপমা দেবী আগামীকালের অপেক্ষা করতে লাগলেন।

   ছেলের সারপ্রাইজের কথা ভেবে ভেবে সারারাত ঘুমই এল না অনুপমা দেবীর।....

 পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেই ছেলে অভীকের ঘরে গেলেন তিনি। গিয়ে দেখলেন অভীক ঘরে নেই এমনকি সে পুরো বাড়িতেই নেই। এই সব দেখে অনুপমা দেবীর খুব চিন্তা হল, যে এত সকালে ছেলেটা গেল কোথাই?

  তিনি চিল্লাচিল্লি করতে লাগলেন। তখনও নিলাম্বর বাবু তাকে শান্ত করে বললেন যে অভীক সারপ্রাইজ আনতে বাইরে গেছে। এই শুনে অনুপমা দেবী একটু খুশি ই হলেন। 

 হঠাৎই বাড়ির বাইরে অভীকের গাড়ির হর্ন শোনা গেল। শুনেই অনুপমা দেবী একপ্রকার দৌড়ে গেলেন দরজা খুলতে এবং দরজা খুলে যা দেখলেন তাতে অনুপমা দেবীর শরীরে বিদ্যুত খেলে গেল , তিনি পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন দরজায়।

 তার এই অবস্থা দেখে নিলাম্বর বাবু ও নিশা দৌড়ে গেল। এবং দেখল যে, অভীক একটা সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করে সঙ্গে নিয়ে এসেছে এবং তার সাথে মায়ের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলছে, " মা, এই হল মেঘনা। আমি মেঘনাকে অনেক ছোট থেকেই ভালোবাসতাম। তাই আজ চাকরি পাওয়ার পর মেঘনাকে বিয়ে করে , নিজের স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে, তোমার বৌমা করে নিয়ে এসে, তোমাকে সারপ্রাইজ দিলাম। এই হল তোমার সারপ্রাইজ।"

   কথাগুলো শুনে অনুপমা দেবীর চোখ কান্নায় ফেটে পড়ল এবং তিনি ভাবলেন তার ছেলে অভীক আজ পর হয়ে গেল।

  তিনি ভেবেছিলেন যে তিনি কোন দিনই তার আদরের ছেলে অভীকের বিয়ে দেবেন না , পাছে তার ছেলে তার কাছে পর হয়ে যায় এই ভেবে। কিন্তু তাই ই হল। অভীক আজ নিজেই বিয়ে করল।

   তিনি মেঘনাকে পুত্রবধূ মানতে অস্বীকার করলেন। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে অভীকও তার মাকে বলল, " তুমি যদি মেঘনাকে তোমার পুত্রবধূ হিসেবে মেনে না নাও তাহলে আমিও মেঘনার সাথে, এই বাড়ি ছেড়ে, তোমাকে ছেড়ে চলে যাব। তুমি তোমার আদরের ছেলে অভীককে হারাবে।"........

   ছেলের মুখে এতো বড়ো একটা কথা শুনে অনুপমা দেবী ভেঙে পড়লেন। তখনই তিনি নিশাকে বরণডালা সাজিয়ে আনতে বললেন। নিশা, আগে থেকেই দাদার ব্যাপারে সবই জানত তাই সে আগেই বরণডালা সাজিয়ে রেখেছিল। তাই সে তাড়াতাড়ি গিয়ে বরণডালা নিয়ে এসে তার মায়ের হাতে দিল। আর মা, অনুপমা দেবী মনে দুঃখ নিয়ে, ছেলের বউকে বরণ করে ঘরে নিয়ে এলেন।

তাদের জীবনে শুরু হল এক নতুন অধ্যায়।


  এরপর থেকে অনুপমা দেবী, ছেলের বউ, মেঘনাকে সহ্য করতে পারতেন না। কিন্ত ছেলের সামনে এমন করতেন যেন বৌমাকে তিনি কতই না ভালবাসেন। ছেলের সামনে বৌমাকে কোন কাজই করতে দিতেন না, পাছে তার ছেলে তার কাছে পর হয়ে না যায়। সব কাজই তিনি নিজেই করতেন। 

অন্যদিকে মেঘনা আসার পর থেকে নিশা খুব খুশি ছিল কারন মেঘনা নিশাকে নিজের বোনের মত ভালোবাসত। মা নিশাকে দিয়ে যে সব কাজগুলো করাতেন সেগুলো মেঘনা সবই মাকে লুকিয়ে করে দিত। মেঘনা নিশাকে পড়াশুনা করাত, বন্ধুর মতো গল্প করত। কিন্তু অনুপমা দেবী , মেঘনার তার মেয়ে নিশার প্রতি এতো ভালোবাসা সহ্য করতে পারতেন না। কিন্ত তিনি কিছুই বলতে পারতেন না।

মেঘনা তার শশুরমশাই নিলাম্বর বাবুকে নিজের বাবার মতোই শ্রদ্ধা করত। নিলাম্বর বাবুও মেঘনাকে মেয়ের মতই ভালোবাসতেন। এই সব অনুপমা দেবীর চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল।

 তাই অনুপমা দেবী সবসময়ই মেঘনার শারীরিক ত্রুটি খুজতে ব্যাস্ত থাকতেন, কারণ বিয়ের তিন বছর হওয়ার পরও মেঘনার কোনো সন্তান হয়নি। কিন্তু এই সবের কিছুই মেঘনা গুরুত্ব দিত না।

 অনুপমা দেবী তার ছেলে অভীকের কাছে মেঘনার বাচ্চা না হওয়ার জন্য শারীরিক ত্রুটির কথা বলে, মেঘনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেন। এমনকি তিনি অভীককে বলতেন মেঘনাকে তার বাপের বাড়িতে ফেলে আসার জন্য। কিন্তু অভীক তার মায়ের এই সব কথাগুলো সবসময়ই এরিয়ে চলত, কোন গুরুত্বই দিত না।

  এই ভাবেই চলছিল, কিন্তু একদিন মেঘনা, নিশাকে কলেজে পাঠাচ্ছিল, ঠিক তখনই অনুপমা দেবী একটু মেজাজের সঙ্গে বলে উঠলেন, " নিশা কলেজে যাবে না, নিশা শুধু বাড়ির কাজকর্ম করবে, বাড়িতে থেকে।" 

   মেঘনা কোন দিনই তার শাশুড়ির কোন কথার প্রতিবাদ করত না, কিন্তু অনুপমা দেবীর এই কথা শুনে মেঘনা শাশুড়ির বিরুদ্ধে গর্জে উঠলো এবং বলল, " নিশা কলেজে যাবেই। নিশা এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে, কাজের লোক নয়। নিশাকে কলেজে পাঠিয়ে পড়াশুনা শেখানো, মা হিসাবে আপনার দায়িত্ব। কিন্তু যদি আপনি তা না করেন, তাহলে আমিই নিশার অভিভাবিকা হিসাবে নিশাকে কলেজে পড়াশুনা করিয়ে উচ্চ শিক্ষিত করে তুলবো।"......

   মেঘনার বলা এই কথাগুলো শুনে অনুপমা দেবী রাগে ফেটে পড়েন এবং তিনি তার ছেলে অভীককে ডেকে এনে বলতে শুরু করেন," তুই এ কোন মেয়েকে বিয়ে করে এনেছিস, যে তোর মায়ের মুখের উপর এই ভাবে কথা বলে, তুই এখনই এই মেয়েকে বাপের বাড়িতে দিয়ে আয়। যে মেয়ে বিয়ের তিন বছর পরও বাচ্চার মা হতে না পারে, তাকে তুই বাড়িতে রেখেই বা কি করবি? বাড়ি থেকে বের করে দে মেঘনাকে।"....

   এতো দিন পর্যন্ত অভীক তার মায়ের সব কথাই এরিয়ে চলত কিন্তু আজ সে স্পষ্ট ভাবে মা কে জানিয়ে দেয়, " মা , মেঘনা যা কিছু বলেছে সব কিছুই ঠিক বলেছে , তুমি বোনকে কোন দিনই মেয়ে ভাবতে পারোনি , শুধু কাজের লোক ভেবেছ। আর মেঘনা এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না...। আর তুমি বলছ মেঘনার মা না হতে পারার ব্যপার; তবে শোনো , মেঘনা চাইলেই মা হতে পারবে, ওর কোন শারীরিক ত্রুটি নেই। কিন্তু আমিই চাইনা তোমার এই ব্যবহার আর এই রকম কদর্য পরিবেশে আমার বাচ্চা জন্মাক। আর তাই এই তিন বছর ধরে আমাদের বাড়িটাতে সুস্থ পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করে চলেছি।..."

   আদরের ছেলের কাছ থেকে এই কথাগুলো শুনে অনুপমা দেবী চিৎকার করে কাঁদতে লাগলেন এবং বললেন," এই বউ ই আমার ছেলেকে পর করে দিল...."।

তিনি দৌড়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

 অন্যদিকে এই সব দেখেশুনে মেঘনার চোখে জল চলে এসেছে আর নিশা তাকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। 

 এতক্ষণ ধরে নিলাম্বর বাবু সব কিছু চুপ করে দেখছিলেন এবার তিনি মেঘনার কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত রেখে বললেন, " বৌমা, তুই আজ প্রথম এই বাড়িতে একটা বড়ো ভালো কাজ করলি, তোর দাম্ভিক মেজাজের শাশুড়ির মুখের উপর তার অন্যায়ের তিব্র প্রতিবাদ করে।

আমি কোন দিনই নিশার ওপরে হওয়া অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে পারিনি।

আমি তোকে আশীর্বাদ করি বৌমা, সুখি হও। "

 শশুরের কথায় মেঘনা মনে জোর পেল এবং অল্প হেসে বলল, " বাবা, আমিই মায়ের মনের পরিবর্তন ঘটিয়ে, এই বাড়িতে একটা সুন্দর পরিবেশ গড়ে তুলব। কথা দিলাম।"

এবং অভীক ও নিশা একসাথে বলে উঠল, " আমরাও তোমার সঙ্গে আছি।"....

*

  বাড়িতে এই সব কান্ডের পর থেকে অনুপমা দেবী নিজের মতই থাকতেন, কারুর সঙ্গে তিনি ঠিক মতো কথা বলতেন না। কিন্ত বাড়ির বাকি সদস্যরা ভালো ভাবেই দিন কাটাচ্ছিল। .......

  কিন্তু এই সবের মধ্যে, হঠাত একদিন অনুপমা দেবী তার ছেলে অভীকের কাছে ক্ষমা চান এবং বলেন," তুই তো এটাই চাস যে আমি তোর বউ মেঘনাকে মন থেকে মেনে নি। আচ্ছা আমি তোর কথায় রাখলাম.....আমি বৌমাকে মন থেকে মেনে নিলাম। আর আজ থেকে নিশা বাড়ির সব কাজ একা করবে না, আমরা সবাই মিলে করব। আমার ভুলের জন্য আমায় ক্ষমা কর তুই।"....

  এর পর সবাই অনুপমা দেবীকে ক্ষমা করে দিল। পরিবারের সবাই মিলে আনন্দে দিন কাটাতে লাগলো।

  কিছু দিন পর সবাই জানতে পারলো মেঘনা অন্তঃস্বত্তা। বাড়িতে আনন্দের জোয়ার বইতে লাগলো। অনুপমা দেবী নিজে হাতে বৌমার যত্ন করতে লাগলেন। বৌমার প্রীয় খাবার রান্না করে দিতেন। তার নিজের হাতে মেঘনাকে খাইয়ে দিতেন। আর নিশা তার বৌদিকে সব সময়ই মজার মজার গল্প শোনাত এবং খুশি রাখত। আর অভীকতো গোটা বাড়ি বাচ্চার খেলনা আর বাচ্চাদের সুন্দর ছবিতে ভরিয়ে তুলছিল। আর নিলাম্বর বাবু এই সব দেখে খুব খুশি হতেন এবং মনে মনে মেঘনাকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করতেন।

   এই ভাবেই একদিন অনুপমা দেবী মেঘনাকে বললেন," বৌমা, আমার কিন্তু নাতি চাই, তাই তুমিও ছেলের জন্ম দেবে।" তারপর তিনি একটু মেজাজের সঙ্গে বললেন, " তুমি যদি মেয়ের জন্ম দাও, তাহলে কিন্তু এর ফল ভাল হবে না।"

  এই কথাগুলো শুনে মেঘনা হতভম্ব হয়ে গেল, এবং সে খুব ভালো করেই বুঝে গেল যে এতদিন তার শাশুড়ি ভালো হওয়ার নাটক করছিলেন। এবার শাশুড়ির কথার জবাবে মেঘনা চিৎকার করে বলল," না...! আমি পুত্র সন্তানের জন্ম দেব না। আমি একজন কন্যা সন্তানের মা হতে চাই, তাই আমি কন্যা সন্তানেরই জন্ম দেব। আর আপনি যদি আমার সন্তানের কোন ক্ষতি করার কথা ভুলেও ভাবেন তাহলে কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে ভালো হবে না । কথাটা ভালো করে মনে রাখবেন শাশুড়ির মা।"....


অন্যদিকে, মেঘনার চিৎকার করা কথা শুনে নিলাম্বর বাবু,অভীক ও নিশা একসাথে সবাই এসে দাঁড়িয়ে ছিল।এতো দিন পর নিলাম্বর বাবু তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মুখ খুললেন।তিনি অভীককে

বললেন ,"অভীক,তুই বৌমাকে নিয়ে ওর বাপের বাড়ি চলে যা আর বৌমার ঠিক মতো দেখাশোনার জন্য নিশাকেও সঙ্গে নিয়ে যা।নিশা বৌমার মাকে একটু সাহায্য করবে।"এবং তিনি মেঘনাকে বললেন,"বৌমা,আমি কিন্তু একটা সুস্থ নাতনি চাই।তাই তুই তোর বাপের বাড়ি যা।আর ডেলিভারি পর্যন্ত ওখানেই থাকবি।"

কথাগুলো শুনে মেঘনা কেঁদে ফেলল এবং নিলাম্বর বাবুকে প্রনাম করে, নিজের জিনিসপত্র নিয়ে অভীক আর নিশার সাথে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।আর নিলাম্বর বাবুও ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।এই সব দেখে অনুপমা দেবী রাগে গজগজ করতে থাকলেন।কিছু দিন পর মেঘনার ডেলিভারির ডেট্ এল।মেঘনাও একটা ফুটফুটে কন্যার জন্ম দিল।অভীকতো মেয়েকে দেখে বাবা হওয়ার আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল।নিশাতো খুবই খুশি হল।নিলাম্বর বাবুও মেঘনাকে ও নাতনিকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করলেন।এবং তারা সবাই মিলে ছোট্ট বাচ্চাটার নাম রাখলেন মৌমি।কিন্তু মেয়ে হয়েছে শুনে অনুপমা দেবী রাগে একবারও মেঘনাকে দেখতে আসেন নি।বাচ্চার জন্মের পর মেঘনা মৌমিকে নিয়ে কিছু দিন বাপের বাড়িতেই ছিল।আজ তার শশুরমশাই নিলাম্বর বাবু ও অভীক,মেঘনাকে বাচ্চাসহ শশুরবাড়ি নিয়ে গেল।কিছুক্ষণ পর মেঘনাকে আর মৌমিকে নিয়ে সবাই বাড়ি পৌঁছলেন।আর অভীকের গাড়ির হর্ন শুনে নিশা বরণডালা সাজিয়ে নিয়ে গেল দরজা খুলতে,মেঘনা আর মৌমিকে বরণ করে ঘরে আনার জন্য।আর অন্যদিকে অনুপমা দেবী মুখভার করে চুপ করে বসে রইলেন।নিশা ওদের বরণ করে ঘরে আনল।অনুপমা দেবী ওদের দিকে তাকাবো না মনে করেও একবার তিনি ছোট্ট মৌমির দিকে তাকিয়ে যেন তিনি মোহিত হয়ে গেলেন এমন অদ্ভুত সুন্দরী বাচ্চা তিনি কোন দিনই দেখেন নি।বাচ্চাটির চোখ যেন তাকে আকর্ষণ করছিল।ম্যাজিকের মতো অনুপমা দেবীর রাগ ঘৃণা নিমিষেই জল হয়ে গেল।তিনি দৌড়ে গিয়ে ছোট্ট মৌমিকে কোলে তুলে নিলেন এবং আদর করতে লাগলেন।হঠাৎই অনুপমা দেবীর এই রকম পরিবর্তন দেখে সবাই চমকে উঠল।তিনি নিশাকে আদরের মেয়ে বলে বুকে জড়িয়ে ধরে, সবার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।তিনি মেঘনাকে বললেন যদি কেউ আগে তার অন্যায়ের জন্য প্রতিবাদ করত তাহলে তিনি আরও আগেই ভালো হতেন। 

সবাই অনুপমা দেবীকে ক্ষমা করলেন। 

মৌমিকে নিয়ে খুশিতে তাদের পরিবার পরিপূর্ণ হয়ে গেল। 


   নাতনি মৌমিকে নিয়ে অনুপমা দেবীর পরিবারে দিনগুলো খুব আনন্দেই কাটছিল।সবাই অনুপমা দেবীর ভালো হওয়া মেনে নিলেও মেঘনার যেন কোন ভাবেই শাশুড়ির হঠাত এতটা পরিবর্তন হজম হচ্ছিল না।মনে একটা খটকা লেগেই থাকছিল। মনে একটু খটকা থাকলেও,মেঘনা তার স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি যে অনুপমা দেবী মৌমির জন্য এত বড়ো একটা ষড়যন্ত্রের জাল বুনছেন।

সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল।অনুপমা দেবীর, মৌমির প্রতি কোন রকম অস্বাভাবিক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়নি।বরং তিনি মৌমিকে একটু বেশিই ভালোবাসতেন এবং সবসময়ই নিজের কাছে রাখতেন।আর এই জন্য নিলাম্বর বাবু ও অভীক দুজনেই খুব খুশি ছিল।নিশারও তার মায়ের ব্যবহার ভালোই লাগছিলো।কিন্তু অনুপমা দেবীর মনের মধ্যে একটা প্রচন্ড বিষের ভান্ডার লুকিয়ে ছিল তা কেউই টের পাইনি।

 হঠাৎ একদিন নিলাম্বর বাবুকে তার এক বন্ধু ফোন করল এবং তার বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালো।কিন্তু নিলাম্বর বাবুর,ছোট্ট নাতনি মৌমিকে ছেড়ে,বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে যেতে মন চাইছিল না।কিন্ত অনুপমা দেবী তাকে বুঝিয়ে একপ্রকার জোর করেই নিলাম্বর বাবুকে বন্ধুর বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।কিন্তু এই সব কিছুই যেন মেঘনার কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হল।এর পর থেকে মেঘনা অনুপমা দেবীর ওপর একটু সচেতন ভাবেই নজর রাখতে শুরু করে।

 অন্যদিকে মৌমিও একটু করে বড়ো হচ্ছিল।কিন্তু মৌমি মাঝে মাঝেই একটু করে অসুস্হ হয়ে পড়ছিল।মেঘনা আর অভীকের মেয়ের প্রতি চিন্তা দিন দিন বেড়েই চলছিল।তারা মৌমিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতেই,অনুপমা দেবী বাধা দিয়ে বলতেন,"আরে,ও রকম একটু জ্বর-শরীর খারাপ এই বয়েসে সব বাচ্চাদেরই হয়,আর এইটুকুতেই মৌমিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।"আর মায়ের কথা শুনে অভীক ভাবল,মা তো তাদেরও মানুষ করেছে তাই মা হয়তো জানে ছোট বাচ্চাদের এই রকমই হয়।তাই সে আর কিছু বলল না।

কিছু দিন পর হঠাত অভীক,মেঘনাকে বলল,"

আমাকে তিন মাসের জন্য অফিসের কাজে শহরের বাইরে যেতে হবে।কিন্তু মৌমির শরীরটাও খুব ভালো যাচ্ছে না।ওকে এই অবস্থাই ফেলে যেতে একদমই ইচ্ছা করছে না।"মেঘনা অভীককের কথার উত্তর দেওয়ার আগেই অনুপমা দেবী তাড়াতাড়ি এসে বললেন,"অভীক, তুই তোর কাজে যা।তোকে মৌমির আর বৌমার কথার কথা চিন্তা করতে হবে না,আমিতো আছি।আমি ওদের ঠিক দেখাশুনা করব।"অভীকও মায়ের কথায় একটু খুশি হল।জিনিস পত্র গুছিয়ে নিয়ে মেঘনাকে বলে আর মৌমিকে একটু আদর করে কাজে বেরিয়ে গেল।কিন্তু এই সব মেঘনার কাছে আরও অস্বাভাবিক হয়ে উঠতে লাগল।অনুপমা দেবীরও মেয়ে ও বৌমার প্রতি ব্যবহার ধীরে ধীরে খারাপ হতে শুরু করে।নিশাও এই সব আস্তে আস্তে বুঝতে পারে।এই ভাবেই চলতে থাকে।.......


  একদিন অনুপমা দেবী মৌমিকে তেল মাখাচ্ছিলেন।তখনই হঠাত মৌমি কেঁদে ককিয়ে উঠল।বাচ্চার এতো উচ্চ স্বরে কান্না শুনে মেঘনা তাড়াতাড়ি এসে শাশুড়ির কাছে থেকে মৌমিকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগল।নিশাও দৌড়ে এল।........


   মেঘনার এতটুকু বুঝতে সময় লাগল না যে তার শাশুড়িই মৌমিকে তেল মাখানোর বাহানায়, মৌমির শরীরের কোন অংশে প্রচন্ড জোরে আঘাত করেছে।...আর তার জন্যই মৌমির এত উচ্চ স্বরে কান্না।........

এতদিন ধরে চুপ থাকা মেঘনা এবার রেগে উঠল এবং তার শাশুড়ির অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে উঠল," মা,আপনি কি মনে করছেন,যে আপনার অভিনয় আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি।তবে আপনি ভুল ভেবেছেন।আমি খুব ভালো করেই বুঝে গেছি মৌমিকে কাছে পেয়ে,ওর ক্ষতি করার জন্যই আপনি মেয়েকে ভালোবেসে,সব কিছু মেনে নেওয়ার নাটক করেছেন সবার সামনে। ........ কিন্তু আমি এবার আপনাকে সাবধান করে দিয়ে বলছি, আপনি যদি আর আমার মেয়ের ক্ষতি করার চেষ্টা করেন বা তার আশেপাশেও আসার কথা ভাবেন, তাহলে আপনার এই বৌমা মেঘনার অন্য এক ভয়ংকর প্রতিবাদী রূপ দেখবেন। কথাটা যেন ভালো ভাবে মনে থাকে।.." ........কথাগুলো বলে মেঘনা, মৌমিকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। নিশাও এতক্ষণ ধরে সবকিছু শুনছিল, সেও অনুপমা দেবীর দিকে ঘৃণার দৃষ্টি দিয়ে, মেঘনার সাথেই ঘরে গেল। ...........

আর অনুপমা দেবীর অভিনয় ধরা পড়ে যাওয়ায় আবার নতুন করে ভালো সাজা যায় তার পথ খুঁজতে লাগলেন।.....


এই ঘটনার পর কিছুদিন সব ঠিকঠাক থাকলো। কিন্তু এই সব ঘটনার কিছুই নিলাম্বর বাবু বা অভীক জানত না, মেঘনাই ওদের কিছু জানাই নি।.....  অনুপমা দেবীও আর মৌমির কাছে যেতেন না....আসলে মেঘনা আর নিশা সবসময়ই মৌমিকে আগলে রাখত, তাই অনুপমা দেবী মৌমির কাছে যাওয়ার সাহস পেতেন না। কিন্ত ভিতরে ভিতরে অনুপমা দেবী আরও শয়তান হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মৌমিকে একবারে মেরে ফেলার সুযোগ খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু বারবারই তিনি অসফল হচ্ছিলেন।

অন্যদিকে মৌমিও বড়ো হচ্ছিল, সে সারা বাড়িতে হামা টেনে বেড়াত আর হাসত।এই ভাবে মৌমিকে দেখে মেঘনার মন খুশিতে ভরে উঠত।কিন্তু অনুপমা দেবী রাগে গজগজ করতেন মৌমিকে দেখে, সহ্য করতে পারতেন না।

 একদিন মেঘনা আর নিশা মৌমিকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে যাওয়ার কথা ভাবল। কিন্তু কি যেন একটা ভেবে মেঘনা অনুপমা দেবীকেও সঙ্গে নিয়ে গেল।

  মেঘনা, মৌমিকে নিয়ে কিছু কেনাকাটা করতে লাগল। আর একটু দূরেই নিশা ও অনুপমা দেবী দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখনই কিছু বদমাশ টাইপের ছেলে এসে নিশাকে উত্যক্ত করতে শুরু করে। প্রথমে নিশা এর প্রতিবাদ করলে, তারা আরও বেশী নোংরা কথা বলে তাকে উত্যক্ত করতে শুরু করে। চারিদিকে অনেক মহিলা-পরুষের ভিড় জমে যায়। কিন্তু তারা কেউই এর প্রতিবাদ করে না, শুধু তাকিয়ে দেখতে থাকে। 

 অন্যদিকে মেঘনা, মৌমিকে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একটু দুরে চলে গেছিল, সে এই সব খেয়ালই করে নি। হঠাৎই এত ভীড় দেখে, কি হয়েছে দেখার জন্য মেঘনা ভীড়ের মধ্যে গিয়ে যা দেখে তাতে ওর মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে। ও দেখে, কতকগুলো ছেলে নিশাকে অতিরিক্ত ভাবে উত্যক্ত করছে আর তার মা অনুপমা দেবী পাশে সরে দাঁড়িয়ে এই সব দেখে মুচকি হাসছেন। 

  এই দেখে মেঘনা আর এক মুহূর্ত দেরি না করে, নির্ভয়ে সোজা চলে গিয়ে ছেলেগুলোর সামনে দাঁড়ায় আর সামনে থাকা গুন্ডা মার্কা ছেলেটাকে সপাটে চড় মারে মেঘনা। প্রতিবাদী মেঘনার সাহসি চড়ের শব্দে শুধু ওই ছেলেগুলোর মধ্যে নয়, সমস্ত ভীড়ের মধ্যে যেন একটা ভুমিকম্প ঘটে যায়। 

 এবার মেঘনা ঘোর প্রতিবাদের সঙ্গে ভীড়ের মধ্যে থাকা নারী-পুরুষদের উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলে ওঠে," আপনারা কি মানুষ? এই শয়তানগুলো তখন থেকে একটা নিরীহ মেয়েকে এই ভাবে উত্যক্ত করে চলেছে আর আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে কোন প্রতিবাদ না করে মজা দেখছেন?... ছিঃ!!

 আপনাদের লজ্জা করা উচিত। আজ আপনাদের মতো ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলাদের এই সবে প্রতিবাদ না করে শুধুমাত্র চুপ করে থাকার জন্য, সমাজে ইভটিজিং ও ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ দিন দিন বেড়েই চলেছে। শুধু মাত্র আপনাদের চুপ থাকার জন্য এই শয়তান গুলো মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগ পাই, আপনাদেরই মেয়েদের দিকে কু-নজরে তাকানোর সুযোগ পাই। আর মহিলাদের উদ্দেশ্য করে বলছি, আপনারই যদি একজন মেয়ে হয়ে, একজন মেয়েকে রক্ষা না করেন, তাহলে কাল যখন আপনি বিপদে পড়বেন তখন আপনাকে কে বাঁচাতে আসবে ভেবে দেখেছেন?.... তাহলে কেন আপনারা মহিলারা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন না? ?....

 ঐক্যবদ্ধ হোন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহস নিয়ে প্রতিবাদ করুন। আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, সমাজে এদের মতো শয়তানরা আর কোন দিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। সমাজে ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে।

আর আপনারা যারা মেয়েকে ভালোবাসে না, তাদের উদ্দেশ্যে বলি,মেয়েকে ভালোবাসুন, তাদের সাহসী ও সেল্ফ ডিপেনডেন্ট্ করে তুলুন। যাতে তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে।

  হ্যা । আর এই যে দেখছেন দাঁড়িয়ে আছে ইনিই ওই মেয়েটির মা আর আমার সম্মানিয় শাশুড়ি মা। যিনি এতক্ষন ধরে কোন প্রতিবাদ না করে হাসি মুখে মেয়ে ওপর হওয়া অত্যাচার দেখেছেন। এই রকম মাকে মা বলে পরিচয় দিতেও ঘৃণা হয়। ছিঃ!!......."

   

    মেঘনার কথা শেষ হতেই, দাঁড়িয়ে থাকা শয়তানগুলোর উপরে জনতার মার ও জুতোর বর্ষণ হতে থাকে। আর মেঘনাও গর্বের সাথে মৌমিকে কোলে নিয়ে নিশার হাত ধরে বেরিয়ে আসে। অনুপমা দেবী রাগে গজগজ করতে থাকেন।...


   বাড়ি ফিরে এসে নিশা, মেঘনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল আর মেঘনা নিশাকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। সেই সময়ে অনুপমা দেবী গজগজ করতে করতে বাড়ি ঢুকলেন। নিশা তার মাকে দেখে পাগলের মতো চিৎকার করে উঠল এবং বলল," তোমার মতো মা থাকার থেকে, না থাকা ভালো। নিজের মেয়ের ওপর হওয়া অত্যাচার তুমি প্রতিবাদ না করে হাসি মুখে দেখ, তুমি মা? ছিঃ!! তোমাকে মা বলে ডাকতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে। পৃথিবীর কোন মেয়ে যেন, তোমার মতো মায়ের কোলে না জন্মায়।"

  এবার অনুপমা দেবী ক্ষেপে ওঠেন এবং মেঘনাকে উদ্দেশ্য করে নিশাকে বলেন," তুই আমার মুখের উপর এই ভাবে কথা বলছিস?...যে কোনদিন আমার মুখের উপর কথা বলেনি, আমার সব হুকুম মাথা পেতে মেনে নিত, কোন প্রতিবাদ না করে। সে আজ এই ভাবে কথা বলছে শুধুমাত্র মেঘনার জন্য। এই মেঘনাই তোকে, আমার বিরুদ্ধে করে দিয়েছে নিশা।"

  এর উত্তরে নিশা বলে," না মা। বৌদি আমাকে নিজের বোনের মত ভালোবাসে, তাই বৌদি আমাকে সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে। আমার ওপর অত্যাচার দেখে ,তোমার মতো খুশি হয়নি। সে আমাকে, ওই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আমাকে বাঁচিয়েছে। তোমার মতো দাঁড়িয়ে মজা দেখেনি। তুমি মা হতে পারো না, তুমি একটা ডাইনি।" কথাগুলো বলে নিশা কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে চলে গেল। আর মেঘনাওওর সঙ্গে গেল।

  অন্যদিকে অনুপমা দেবী মনে মনে ভাবতে লাগলেন, " এই মেঘনার জন্য সব কিছু হচ্ছে। তাই মেঘনাকে শাস্তি দিতে হলে, যে ভাবেই হোক মৌমিকে মেরে ফেলতে হবে।" এবার তিনি কি করবেন চিন্তা করতে লাগলেন।.......


  সন্ধ্যে থেকে মৌমি কোন কারণ ছাড়াই খুব কান্নাকাটি করছিল। মেঘনাও এর কোন কারণ খুঁজেও পাচ্ছিল না। তাই সে মৌমিকে খাইয়ে, ঘরে ঘুম পারিয়ে দিয়ে, নিশার ঘরে এল। নিশা মন খারাপ করে বসে আছে, মেঘনা ঘরে আসতেই, মেঘনাকে বলল," বৌদি, এই সব ঘটনা দাদা ও বাবাকে জানাতে হবে, মায়ের শয়তানি দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। এবার কিছু করলে আমরা আর সামলাতে পারবো না।"

  নিশার কথা শুনে মেঘনা বলল," আমিও সেটাই ভাবছি নিশা, আর এই রকম অত্যাচার সামলানো কঠিন হবে। আর মৌমিও একটু বড়ো হচ্ছে, সবসময় ওকে চোখে চোখে রাখা সম্ভব হবে না।

তাই তোর দাদা ও বাবাকে জানাব, তারাই এসে কিছু একটা ডিসিশন নেবে।"

"এবার চল নিশা, খেয়ে নিয়ে শুয়ে পর। ওদিকে মৌমিও একা আছে। সন্ধ্যা থেকে কেঁদে চলেছে, কেন কিছু বুঝতে পারছি না।"

   এরপর নিশা আর মেঘনা খেয়ে শুতে চলে গেল, মেঘনাও সারাদিন ক্লান্ত হয়ে ছিল। তাই তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়ল। 

  হঠাৎই মৌমির প্রচন্ড কান্নায়, মেঘনার ঘুম ভেঙে গেল এবং ও মৌমিকে কোলে তুলে নিয়ে যা দেখল তাতে মেঘনার শরীর হিম হয়ে গেল। সে দেখল, মৌমির শরীর বরফের মতো ঠান্ডা, খুব আস্তে আস্তে নিঃশ্বাস পড়ছে আর মাঝে মাঝে প্রচন্ড জোরে কেঁদে উঠছে। মেঘনা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত 2:30 am.

   এবার মেঘনা চিৎকার করে নিশাকে ডাকতে লাগল। নিশাও দৌড়ে এল। মৌমির অবস্থা দেখে নিশার চোখে জল চলে এল। মেঘনা, নিশাকে বলল," নিশা, তাড়াতাড়ি অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করে আসতে বল, মৌমিকে হসপিটাল নিয়ে যেতে হবে, ওর অবস্থা খুবই খারাপ।"

 নিশাও তাই করল। কিছু সময়ের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স চলে এল, মেঘনা, নিশা যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থাতেই মৌমিকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে হসপিটাল চলে গেল। আর অন্যদিকে অনুপমা দেবী দরজায় দাঁড়িয়ে আনন্দের হাসি হাসতে থাকলেন।

  মেঘনা, মৌমিকে হসপিটালে ভর্তি করে, ডাক্তারের কাছে মেয়েকে বাঁচানোর জন্য প্রার্থনা করতে লাগল। ডাক্তারও, মেঘনাকে বুঝিয়ে মৌমিকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলেন। মেঘনাও কাঁদতে লাগে, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে লাগে তার মেয়েকে বাঁচানোর।

  অন্যদিকে নিশা, নিলাম্বর বাবু ও অভীকে ফোন করে সব জানিয়ে দিয়ে, তখনই হসপিটালে চলে আসতে বলে। মেয়েটার ওই অবস্থার কথা শুনেই অভীক পাগলের মত করতে থাকে। নিশা, মেঘনার মা-বাবাকেও ফোন করে হসপিটাল আসতে বলে।

  এরপর নিশা মেঘনার কাছে গিয়ে তাকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।

 দু’ঘণ্টার মধ্যে নিলাম্বর বাবু ও মেঘনার মা-বাবা এসে পড়ে। তারাও মেঘনাকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ পর ডাক্তারবাবু অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসে বলেন," অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে কিন্তু ওর কন্ডিশন সম্পর্কে এখন কিছু বলা যাচ্ছে না।"

  এবার মেঘনা ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞাসা করল," ওর আসলে কি হয়েছিল? "

  এর উত্তরে ডাক্তারবাবু বললেন," অনেকদিন ধরেই কেউ মৌমিকে স্লো পয়জেন ইনজেকশন দিচ্ছিল। যার জন্য ও বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ছিল।

আজ ওর ডোজ্ টা খুব বেশি হয়ে যাওয়ার কারণে ওর এই অবস্থা হয়েছে। ওকে ঠিক সময়ে না আনলে বাঁচানো যেত না।" ডাক্তার চলে গেল।

  মেঘনা সবই বুঝতে পারল এবং সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে পড়ল। এবং বলল,"কোন মা কি এতো বড়ো শয়তান হতে পারে?"

   হসপিটালে বসে বসে সকাল হয়ে গেল,কেঁদে কেঁদে মেঘনার অবস্থা আর দেখা যায় না। অন্যদিকে অভীকও এসে পৌঁছাল। তার সেই এক রকম অবস্থা। মেয়ের চিন্তাই পাগল হয়ে উঠেছে।

  হঠাৎই ডাক্তারবাবু এসে জানালেন, "মৌমি সুস্থ আছে, আপনারা ওকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন।"

  কথাগুলো শুনে সবার যেন প্রাণ ফিরে এল। মেঘনাও মৌমিকে কোলে তুলে নিল, আদর করতে শুরু করল। একে একে সবাই মৌমিকে আদর করল। এবার নিলাম্বর বাবু বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা বলতেই মেঘনা বলে উঠল," নিশ্চয়ই বাড়ি যাব বাবা, তার আগে আমার একটু কাজ আছে। আপনারা বাড়ি যান। আমি আর নিশা মৌমিকে নিয়ে একটু পরে যাব।"......

  অভীক বলল," মা যে ইচ্ছা করে আমার প্রাণের চেয়েও অনেক বেশি প্রীয় মেয়ে, আমার ছোট্ট মৌমিকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে তার শাস্তি মাকে পেতেই হবে।"....

  এই বলে ওরা বাড়ি ফিরে গেল। অনুপমা দেবী অভীক আর নিলাম্বর বাবুকে দেখে চমকে উঠলেন।

বললেন," তো-ত-ত-ত-ত-তমরা এখানে?..."

এই কথা শেষ না হতেই অভীক পাগলের মতো চিৎকার করে প্রচন্ড ধাক্কা দিয়ে অনুপমা দেবীকে ফেলে দিয়ে বলল," তুমি এতবড়ো শয়তান? আমার মৌমিকে তুমি মেরে ফেলতে চেয়েছিলে??"

 অভীকের এই রকম ব্যাবহারে অনুপমা দেবী হতভম্ব হয়ে গিয়ে বললেন, " আমি মেয়েকে সহ্য করতে পারি না, তাই আমি মৌমিকে মেরে ফেলতে চেয়েছি। আমিতো নিশাকেও মেরে ফেলতাম কিন্তু তোর বাবার জন্য সম্ভব হয়নি।".....

  এতক্ষণে মেঘনা ও নিশা মৌমিকে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে, সঙ্গে পুলিশ নিয়ে । তারাও সব শুনল।

অনুপমা দেবীর কথার উত্তরে অভীক কিছু বলার আগেই মেঘনা বলে উঠল," আপনিও তো একটা মেয়ে। যদি আপনার মা, আপনার সাথে এই রকম ব্যাবহার করত তাহলে আপনি কি করতেন? কিন্তু আপনার মা ওই রকম করেন নি, আপনার মা আপনাকে মানুষ করেছেন। কিন্তু আপনার মায়ের উচিত ছিল ,আপনার জন্মের পরই আপনাকে মেরে ফেলা। তাহলে নিশা আর মৌমির মত দুটো নিস্পাপ মেয়ের জীবনে এত কষ্ট আসত না।"......

এর পর অনুপমা দেবীর কিছু বলার আগেই মেঘনা সবাইকে অবাক করে, অনুপমা দেবীকে সজোরে একটা চড় মারল এবং বলল," আপনাকে বলেছিলাম না, যে আমার মেয়ে মৌমির কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করলে আপনার বৌমা মেঘনার এক অন্য প্রতিবাদী রূপ দেখবেন । তাহলে এটাই আমার একজন মা হিসাবে সবথেকে বড়ো প্রতিবাদ ।" ......

   কথাটা শেষ হতেই নিলাম্বর বাবু পুলিশদের বললেন, " নিয়ে যান, এই মা রূপি শয়তান অনুপমাকে। আর চেষ্টা করবেন ও যেন কঠোর শাস্তি পাই।"

  এই কথাগুলো শুনে অনুপমা রাগে ক্ষোভে কাঁদতে লাগলেন, পুলিশরা একপ্রকার তাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল। কেউ একটা কথাও বলল না।


 কিছু দিন পর অনুপমা দেবীকে বিচারে চোদ্দ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। আর এতে সবাই খুশি হয়। কিন্তু তিনি একবছরের মধ্যেই মানসিক রোগীতে পরিনত হন। জেলের মধ্যেই নানা রকম পাগলামি শুরু করেন, যে কোনো সময়ে জেলের অন্য কয়েদিদের মেঘনা মনে করে মেরে ফেলতে উদ্যত হতেন। ওই অবস্থাই তাকে সামলানো অসম্ভব ছিল এবং সবসময়ই তার উপর নজর রাখাও সম্ভব ছিল না। তাই ওই জেলের জেলার সাহেব, অনুপমা দেবীর ছেলে অভীকের সাথে কথা বলে, অনুপমা দেবীকে চিকিৎসার জন্য জেলের মানসিক হাসপাতালে পাঠান। এবং সেখানে তার কঠিন ভাবে চিকিৎসা শুরু হয়। বাকি তেরো বছর তাকে সেখানেই কাটাতে হয়।

এই চোদ্দ বছরের চিকিৎসার পর আইনত সাজা শেষ করে, ধীরে ধীরে অনুপমা দেবীর মানসিক পরিবর্তন ঘটে, তিনি সত্যিই ভালো হয়ে যান।

  তিনি চোদ্দ বছরের কারাদণ্ড শেষ করে বাড়ি ফিরে আসেন। তখন মৌমি পনেরো বছরের মেয়ে। অনুপমা দেবী তাকে দেখে খুবই খুশি হন। এবং তার করা ভুলগুলোর জন্য সবার কাছে তিনি ক্ষমা চান। মৌমিকেও তিনি খুব ভালোবাসেন। সবাই তাকে ক্ষমা করতে না চাইলেও মৌমির কথাই সবাই অনুপমা দেবীকে ক্ষমা করে দেন। তাদের পরিবার আনন্দের জোয়ারে পরিপূর্ণ হয়ে যায়।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract