প্রতিষ্ঠার প্রতিশোধ
প্রতিষ্ঠার প্রতিশোধ


প্রতিষ্ঠা রায়, ফিজিক্স অনার্স নিয়ে ফাস্ট ইয়ারে নতুন ভর্তি হয়েছে কলেজে। প্রতিষ্ঠা, প্রথম দিন আজ কলেজ যাচ্ছে, তাও কলেজ শুরুর দু’সপ্তাহ পর। আজ প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস আছে। প্রতিষ্ঠা ক্লাসে ঢুকল। কেউ চেনা নেই তার, তার ওপর ক্লাসমেটগুলো সবাই ছেলে ।যাক্ ক্লাসটা শেষ হল। প্রতিষ্ঠা ক্লাস থেকে বের হতে যাবে সেই সময় তার মনে পড়ল, তার কাছে ক্লাস রুটিন নেই। কাল প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস কটায় সে জানে না।
তাই সে আবার ক্লাসের দিকে গেল এবং একজন ছেলে তখনই ক্লাস থেকে বের হচ্ছিল। প্রতিষ্ঠা ওই ছেলেটিকে সামনে দেখে জিজ্ঞাসা করল, " কাল কটায় প্র্যাকটিক্যাল আছে রে?"...ছেলেটা কোনো উত্তর না দিয়ে হা করে প্রতিষ্ঠার দিকে তাকিয়ে থাকল । ছেলেটার ওই ভাবে তাকানো প্রতিষ্ঠার অসহ্য লাগল । সে অন্য একটি ছেলের কাছ থেকে ক্লাসের টাইমটা জেনে নিয়ে...ওই ছেলেটির সামনে দিয়ে হন্ হন্ করে হেঁটে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল।....
তারপর থেকে প্রতিষ্ঠা যখনই কলেজে যেত, সব সময়ই ওই ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে থাকত। আর সামনে সব সময় লাফালাফি করত। প্রতিষ্ঠা ওই ছেলেটির সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, ছেলেটার নাম অঙ্কিত চ্যাটার্জি, কলেজে এক প্রকার," চকলেট বয়" নামে পরিচিত, সব সময়ই মেয়ে পটাতেই ব্যস্ত থাকে। এরপর থেকে প্রতিষ্ঠা যখনই ওই ছেলেটা মানে অঙ্কিতকে দেখত আর ওর মনে মনে খুব হাসি পেত ।...
একদিন প্রতিষ্ঠা কলেজ থেকে ফোনটা অন্ করে দেখল তার ফেসবুকে একটা নতুন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এসেছে আর ওটা খুলতেই দেখল, অঙ্কিত চ্যাটার্জি। প্রতিষ্ঠা কি যেন কি মনে করে রিকোয়েস্টটা এক্সসেপ্ট করল ।
তারপর থেকেই শুরু হল প্রতিষ্ঠা আর অঙ্কিতের নতুন বন্ধুত্ব। ওদের হোয়াটস্ অ্যাপ চ্যাটিং, ফেসবুকে গল্প, ইয়ারর্কি, দিনের পর দিন চলতে থাকল । বন্ধুত্বটা আরও গভীর হল ।
একদিন প্রতিষ্ঠা পড়াশুনার ব্যাপারে অঙ্কিতের সাথে হোয়াটস্ অ্যাপে কথা বলছিল। হঠাৎই অঙ্কিত ফালতু ইয়ারর্কি করতে শুরু করল, প্রতিষ্ঠা ওকে থামতে বললেও অঙ্কিতের ইয়ারর্কির মাত্রা বেড়েই চলছিল এবং হঠাৎই অঙ্কিত, প্রতিষ্ঠাকে কিছু অশ্লীল কথা লিখে ইয়ারর্কি করে। এমনিতেই প্রতিষ্ঠা যাই সহ্য করুক না কেন, নিজের অপমান সহ্য করতে পারে না। সেই সময়েই প্রতিষ্ঠা, অঙ্কিতের উপর গর্জে ওঠে।...
তখনই প্রতিষ্ঠা আর অঙ্কিতের মধ্যে প্রচন্ড ঝগড়া শুরু হল হোয়াটস্ অ্যাপ চ্যাটিং -এর মাধ্যমে।....প্রায় তিন ঘণ্টা ঝামেলা চলার পর একটু থেমে গেলে .... হঠাৎই অঙ্কিত বলে ওঠে," আমার কোন কথার প্রতিবাদ করার আগে তোর নিজের স্ট্যাটাসটা ভালো করে দেখ, আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে এসেছিস।"
প্রতিষ্ঠা ওর কথা শুনে আগুনের মতো জ্বলতে থাকে এবং অঙ্কিতের কথার যোগ্য জবাব দিয়ে বলে, " আমার স্ট্যাটাস দেখার আগে তোর নিজের স্ট্যাটাসটা ভালো করে দেখ...আর একটা কথা আমি কিন্তু তোর সাথে নিজে বন্ধুত্ব করতে যাইনি অঙ্কিত। তুই ই এসেছিলি আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে। কোন মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করে এই রকম অশ্লীল কথা বলতে তোর লজ্জা করে না। ছিঃ!!...."
এর কথাগুলো শুনে অঙ্কিত আর একটা কথাও বলেনি...তার আধ ঘণ্টা পরে নিজের ভুলটা বুঝতে পারে অঙ্কিত। তখন "সরি" ম্যাসেজ করে। এবং বন্ধুত্ব রাখার জন্য বলে।...অঙ্কিত নিজের ভুল বুঝে "সরি " বলার , প্রতিষ্ঠাও ক্লাসমেট হিসাবে বন্ধুত্বটা রেখে দেয়। আর আগের মতো বন্ধুত্ব রাখতে পারে না প্রতিষ্ঠা। কারণ অঙ্কিতের বলা স্ট্যাটাসের কথাটা প্রতিষ্ঠার মনে আঘাতের সৃষ্টি করেছিল যেটা ভোলার নয়।....
অন্যদিকে অন্য বন্ধুরা জানতে পারে প্রতিষ্ঠা আর অঙ্কিতের ঝামেলার কথা। কলেজে অনেক ছেলেই ছিল যারা ওদের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব সহ্য করতে পারত না। এর পরেই সেই ছেলেগুলো একটা সুযোগ পাই ওদের বন্ধুত্ব ভাঙার। এই জন্যই ছেলেগুলো অঙ্কিতকে, প্রতিষ্ঠার সম্পর্কে উল্টো-পালটা কথা বোঝাতে থাকে। আর অঙ্কিতও প্রতিষ্ঠার প্রতি হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠাকে সহ্য করতে পারে না। কথা বলাও বন্ধ করে দেয়। প্রতিষ্ঠা প্রথমে এসব না বুঝলেও পরে সবই বুঝতে পারে। অন্য বন্ধুদের ব্যবহারও পালটাতে থাকে। আর কয়েকজন ছেলে-মেয়ে ছিল যারা প্রতিষ্ঠার কাউকে ভয় না পাওয়া, একজন মেয়ে হয়ে সবসময়ই ছেলেদের সমতুল্য হয়ে থাকা...এই সব পছন্দ করত না। তাই তারাও ওই ছেলেগুলোর সঙ্গে মিলে যাই। প্রতিষ্ঠা কোনো দোষ না থাকলেও ওরা সবাই প্রতিষ্ঠার শত্রু হয়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে বিনা দোষে এই রকম ব্যাবহারের প্রতিশোধ নিতেই হবে।......এরপর প্রতিষ্ঠা ফাস্ট ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষার আগেই কাউকে কিছু না জানিয়েই কলেজ ছেড়ে চলে আসে।...
কলেজ ছেড়ে চলে আসার পর প্রতিষ্ঠা কলেজের কারওর সাথে আর যোগাযোগ রাখেনি। কেন সে সব ছেড়ে চলে গেল কলেজ থেকে তা কলেজের কোনও কেউই জানতে পারলো না। ওই ছেলে-মেয়েগুলো এটা ভেবেই আনন্দ করতে লাগল যে, প্রতিষ্ঠা তাদের ওই রকম ব্যাবহারের ভয়েই চলে গেছে।
এর প্রায় পাঁচ বছর পর,প্রতিষ্ঠার সাথে অঙ্কিতের সামনাসামনি দেখা হয় একটা বড়ো হসপিটালসহ নার্সিংহোমে।অঙ্কিতের একজন নিকট আত্মীয় এই নার্সিংহোমেই ভর্তি ছিল তাই সে তার সাথে দেখা করতে এসেছিল।কিন্তু এখানে প্রতিষ্ঠাকে এত বছর পর দেখে চমকে ওঠে। অঙ্কিত,প্রতিষ্ঠার সাথে কথা বলতে চাই,প্রতিষ্ঠাও তাকে এরিয়ে যাই নি।সে অঙ্কিতের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে,কারণ সে এত বছর ধরে এই দিনটার জন্যই তো অপেক্ষা করছিল....অঙ্কিত তার জীবনে করা ভুলগুলো বলতে থাকে প্রতিষ্ঠাকে,প্রতিষ্ঠার সাথে করা খারাপ ব্যবহার এবং বন্ধুদের কথাই প্রতিষ্ঠাকে ভুল বুঝে দোষী করার জন্য,প্রতিষ্ঠার কাছে বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে।কথাগুলো বলতে বলতে অঙ্কিতের গলা ভারী হয়ে আসে।..প্রতিষ্ঠা,অঙ্কিতের কথাগুলো দাঁড়িয়ে শোনে কিন্তু একটা কথাও বলে না।এরপর অঙ্কিত হঠাৎই বলে ওঠে,"আমি তোকে খুবই ভালোবাসি প্রতিষ্ঠা,আমি তোকে ছাড়া বাঁচতে পারব না,..তুই ছাড়া আমার জীবন অসম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠা।"কথাগুলোর সঙ্গে অঙ্কিতের চোখে জল এসে গেল।
এবার প্রতিষ্ঠা মুখ খোলে এবং অঙ্কিতকে বলে,"আমাকে ভালোবাসার কথা বলতে এসেছিস?.তুই তোর নিজের স্ট্যাটাসটা ভালো করে দেখেছিস তো?"
অঙ্কিত,প্রতিষ্ঠার কথা শুনে বলে,"আমি সেদিন ভুল করেছিলাম রে..তোকে ওই রকম একটা কথা বলা আমার উচিত হয়নি,আমাকে ক্ষমা করে দে।"
এবার প্রতিষ্ঠা বলে,"আমি আমার নয়,তোর স্ট্যাটাসের কথা বলছি..আমার স্ট্যাটাসের সাথে তোর মত একটা নগন্য ছেলের মেলে না..তুই আমার যোগ্য নয় অঙ্কিত।"
অঙ্কিত,প্রতিষ্ঠার কথা শুনে চমকে উঠে বলল,"মানে?.,তুই কি বলতে চাইছিস প্রতিষ্ঠা?আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না!"
এমন সময়ে নার্সিংহোমের একজন নার্স এসে প্রতিষ্ঠাকে বলে,"ডক্টর রায়,একটা এমারজেন্সি অপারেশন আছে,আপনি তাড়াতাড়ি চলুন।"নার্সের কথায় অঙ্কিত হতভম্ব হয়ে প্রতিষ্ঠার দিকে তাকিয়ে দেখে, তার বুকে লাগানো ব্যাচে লেখা,"ডাঃ প্রতিষ্ঠা রায়"।
ডাঃপ্রতিষ্ঠা,অঙ্কিতের দিকে তাকিয়ে জয়ের হাসি হেসে তার প্রতিশোধ সম্পূর্ণ হওয়ার আনন্দে অপারেশন থিয়েটারের দিকে পা বাড়াই।