নক্ষত্র রক্ষকের পুনর্জন্ম
নক্ষত্র রক্ষকের পুনর্জন্ম
রাত গভীর হয়ে আসছে। আকাশে চাঁদ নেই, কেবল অসংখ্য নক্ষত্রের আলোর রেখা টিমটিম করে জ্বলছে। রাতের আকাশ আজ অদ্ভুতভাবে পরিষ্কার। যেন কুয়াশার চাদর সরে গিয়ে মহাকাশ তার গভীর রহস্য উন্মোচন করতে প্রস্তুত। দূর থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, শহরের কোলাহল অনেক আগেই স্তব্ধ হয়েছে । আলো ম্লান হয়ে আসছে, রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো একাকী দাঁড়িয়ে আছে, যেন তারা, রাতের নিঃসঙ্গ সাক্ষী।
আমি স্বর্ণাদিত্যা......,
জানলার পাশে বসে ছিলাম, আমার সামনে খোলা ছিল একটি পুরনো নোটবুক, যার পৃষ্ঠাগুলোতে মহাকাশ সম্পর্কে নানান তথ্য ও স্কেচ আঁকা। আমি ছোটবেলা থেকেই মহাকাশের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতাম, আমি বহুদিন ধরে মহাকাশ নিয়ে পড়াশোনা করে আসছি, তবে সাম্প্রতিক কিছু দিন ধরে এই আকর্ষণটা যেন আরও গভীর হয়েছে। পাশে রাখা মোবাইল স্ক্রিনে ঘুরছিল একটি মহাকাশ পর্যবেক্ষণ অ্যাপ।
কিন্তু......,আজ রাতটা অন্যরকম লাগছে। আমার হৃদয় অস্থির, শরীরের মধ্যে যেন এক অদ্ভুত শিহরণ কাজ করছে। আমার মনে হচ্ছে, কিছু একটা ঘটতে চলেছে। একটা অদৃশ্য আকর্ষণ যেন আমাকে মহাকাশের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু কেন?......
হটাৎ আমার মোবাইল স্ক্রিনের অ্যাস্ট্রোনমি অ্যাপে চোখ পড়তেই আমি দেখতে পেলাম, আজ রাতের আকাশে এক বিরল মহাজাগতিক ঘটনা ঘটতে চলেছে—"অজানা উজ্জ্বল বস্তু 21:11 মিনিটে পৃথিবীর কাছ দিয়ে যাবে।......"
আমার কপালে ভাঁজ পড়ল। আমি আগে কখনো এই বস্তুটির কথাতো শুনিনি। নাসার কোনো রিপোর্টেও এর উল্লেখ নেই।
কৌতূহলী হয়ে, আমি দ্রুত আমার ছোট্ট টেলিস্কোপটি বের করলাম। জানলার পাশে সেট করে ধীরে ধীরে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। আমার হৃদয় অস্থির হয়ে উঠল।
হঠাৎ, কিছু একটা দেখতে পেলাম।....
আকাশের গভীরে......,নক্ষত্রগুলোর মাঝখানে......, একটা ক্ষীণ আলো ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। প্রথমে মনে হলো, হয়তো কোনো উল্কাপাত হচ্ছে, কিন্তু তারপরই আলোটা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠল।
তারপর......
একটা শব্দ!
না, আসলে শব্দটা ঠিক শোনা যায়নি। এটা ছিল এক অনুভূতি—একটা তরঙ্গ, একটা অজানা কম্পন, যা আমার শরীরের প্রতিটি স্নায়ুকে ছুঁয়ে গেল।......
আমার মোবাইল স্ক্রিন ঝলসে উঠল......একটা অদ্ভুত সংকেত আমার ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল—কোনো অচেনা ভাষা, যেটা পৃথিবীর ভাষার মতো নয়।
“Zzzrrkk...... Xyon..... Arrivaa....Trrvv...”
একটা কম্পনের মতো অনুভূতি আমার শরীর বেয়ে নামতে লাগল.....,শব্দটা যেন পৃথিবীর নয়.....,যেন কোনো অচেনা স্থান থেকে আসছে।.....আমার কানের মধ্যে যেন এক রহস্যময় ফিসফিসানি বাজতে লাগল।......
সারা শরীর কেঁপে উঠল আমার......ঠোঁট শুকিয়ে গেল, গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না।
এই সংকেত... এটা কোথা থেকে আসছে?
আমার মোবাইলের স্ক্রিনে তখন ভেসে উঠেছে এক অদ্ভুত চিহ্ন—এমন কিছু যা আমি আগে কখনো দেখেনি...... চিহ্নটা যেন জীবন্ত, আস্তে আস্তে নড়ছে....., বদলে যাচ্ছে।
আমি ধীরে ধীরে মোবাইলটা হাতে তুললাম, ঠোঁট শুকিয়ে আসছিল......আঙুল কাঁপছিল, তবু আমি স্ক্রিনে স্পর্শ করলাম।
.....হঠাৎ করেই আমার মাথার মধ্যে কোনো এক বিদ্যুৎ প্রবাহের মতো কিছু ছুটে গেল।.....
মোবাইলের স্ক্রিন হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল, চারপাশ নিস্তব্ধ।
কিন্তু, বাতাসের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি রয়ে গেল—যেন কেউ আমাকে দেখছে, খুব কাছ থেকে। আমি ধীরে ধীরে জানলার বাইরে তাকালাম।
আকাশের এক কোণে সেই অজানা আলো এখনো স্থিরভাবে জ্বলছে। যেন ওই আলোটি আমাকে দেখছে।
কিন্তু...., কেন আমার মনে হচ্ছে যে এটি শুধুমাত্র একটা সাধারণ মহাজাগতিক বস্তু নয়?
আমার মনে হচ্ছে, এই আলোর সঙ্গে আমার কোনো যোগসূত্র আছে।
পরের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে ওঠার পরও অদ্ভুত অনুভূতিটা আমাকে ছাড়ছে না। আমার মাথা ভারী লাগছে, যেন সারারাত আমি কিছু বিশ্রী স্বপ্ন দেখেছি, কিন্তু কিছুই মনে পড়ছে না।
আমি নিজের ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ নিজের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার চোখগুলো কেমন যেন চকচক করছে। কিন্তু তার চাইতেও অদ্ভুত হলো—আমার মনে হচ্ছে, আমি বদলে যাচ্ছি।
কিন্তু কিভাবে?......
আমি নোটবুক খুলে গত রাতের ঘটনাগুলো লিখতে গিয়ে আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম— আমার হাতের লেখাটাও বদলে গেছে!
এটা কি কোনো ভাষা?......
আমি কি নিজের অজান্তেই কোনো ভিন্ন ভাষায় লিখছি?.....
কিন্তু, কোথা থেকে এল এই ভাষা?...
আমার মনে পড়ে গেল, সেই সংকেতের কথা।
আমি চট করে ফোনটা হাতে তুলে নিলাম, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ফোনে সেই সংকেতের কোনো চিহ্ন নেই।
তাহলে কি সবকিছুই আমার কল্পনা ছিল?
না, এটা কল্পনা নয়।
কারণ, আমার হৃদয় বলছে—কিছু একটা ঘটছে। কিছু এমন, যা এই পৃথিবীর নয়।
গভীর রাত, আমি আজ অনেকক্ষণ পড়াশোনা করার পরও ঘুমিয়ে পড়তে পারিনি। আমার ভিতরে একটা অস্থিরতা কাজ করছে। মনে হচ্ছে, আমি কারও জন্য অপেক্ষা করছি—কিন্তু কিসের জন্য?
হটাৎ আমার ল্যাপটপের স্ক্রিনে একটি অদ্ভুত বার্তা ভেসে উঠল—
"তুমি কি কখনো ভেবেছো, কেউ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে বহুদূর মহাকাশে?"
আমি চমকে উঠলাম। আমি তো কোনো ওয়েবসাইটেও ছিলাম না, তাহলে এই মেসেজ কোথা থেকে এল?
আমি কিছুটা অজানা ভয় আর কৌতূহল নিয়ে উত্তর দিলাম, "তুমি কে?"
কিছুক্ষণ পর উত্তর এল—
"আমি একটা নীল জ্বলন্ত নক্ষত্র, অগ্নিসূর্য । আমি অনেক দূর থেকে তোমার সঙ্গে কথা বলছি।"
আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, এটা হয়তো কোনো বন্ধুর মজা। কিন্তু বার্তাগুলো এত গভীর হতে লাগলো যে, এক অদ্ভুত ভাবে আমি ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়লাম এই কথোপকথনে।
এই অপরিচিতের টান আমাকে আকৃষ্ট করে তুলছিলো। পরের কয়েক রাত ধরে, আমি আর "ওই নক্ষত্র....., অগ্নিসূর্য " কথা বলতে লাগলাম। সে বলল, সে দূর ছায়াপথের এক নক্ষত্র। তার ছায়াপথের নিয়ম অনুযায়ী, তাকে পৃথিবীর একজন মানুষের মতো আকৃতি পেতে হবে , নাহলে সে তার জ্বলন্ত নক্ষত্র রুপে-ই এক সময় ধ্বংস হয়ে যাবে, অন্য সাধারণ নক্ষত্র -এর মতো।
আমি প্রথমে বিশ্বাস করিনি, কিন্তু ধীরে ধীরে আমার মনের গভীরে এক অদ্ভুত অনুভূতি জন্মাতে শুরু করল।
একদিন অগ্নিসূর্য লিখল—
"আমি তোমাকে দেখতে চাই। তুমি কি রাজি?"
আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম। কল্পনার সীমানা পেরিয়ে সত্যিকারের মুখোমুখি হওয়া কি সম্ভব?
কিন্তু আমার মন বলছিল, "হ্যাঁ...।"
রাত তখন তিনটে ছুঁই ছুঁই। শহরের রাস্তাগুলো তখন সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ, মানুষের কোলাহল অনেক আগেই মিশে গেছে রাতের অন্ধকারে। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, মনে হচ্ছিল যেন কিছু অপেক্ষা করছে। গত তিন রাত ধরে আমার ভেতরটা ছটফট করছিল।
কারণ অগ্নিসূর্য বলেছিল, "আমি আসব।"
কিন্তু সে কে?.....
আমি জানি, অগ্নিসূর্য একজন সাধারণ মানুষ নয়। প্রথম দিন থেকেই আমি তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত মায়াবী টান অনুভব করেছিলাম। রাতের আকাশে চাঁদের মতো রহস্যময় ছিল সে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করেই কিছু একটা ঘটল।......
একটা অদ্ভুত আলো!..
একটি ছোট নীল আলো উত্তর দিক থেকে আসছিল, ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। মনে হচ্ছিল যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি সেটাকে আমার দিকেই টেনে আনছে। বাতাসে হালকা এক কম্পন অনুভূত হলো, যেন গোটা পৃথিবী এক মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস ধরে রেখেছে।
আমি শ্বাস রূদ্ধ হয়ে দেখলাম, সেই আলো আমার বাড়ির ছাদের ঠিক উপরে থেমে গেল।
তারপর—
একটা নরম হুইসেলিং শব্দের সঙ্গে আলোটা মাটির দিকে নামতে লাগল.....ধীরে ধীরে একটা গোলাকার, রুপালি গাড়ির মতো কিছু একটা দেখা গেল। সেটার গায়ে ছিল নীলচে আভা,......এক অদ্ভুত স্ফটিকের মতো চকচক করছিল। দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল, আর তার ভেতর থেকে ধোঁয়ার মতো নীলচে আলো বেরিয়ে এলো।....
আমার বুকটা ধড়ফড় করছিল।
ঘন নীলচে ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে একজন বেরিয়ে এল। ছেলেটি দেখতে প্রায় মানুষের মতোই, কিন্তু তার চামড়ায় একটা হালকা নীলচে আভা ছিল। উঁচু লম্বা গড়ন, গাঢ় রঙের পোশাক আর তার শরীর ছিল সুগঠিত কিন্তু এক অদ্ভুতভাবে ওজনহীন। মনে হচ্ছিল, সে যেন মাটির আকর্ষণ উপেক্ষা করেই হাঁটছে,..তার শরীর থেকে যেন নক্ষত্রের আলো ছড়িয়ে পড়ছিল..মুখটাও ছিল মানুষের মতোই, কিন্তু তার চোখ......
আমার শ্বাস আটকে গেল!
অগ্নিসূর্যের চোখ যেন আকাশের মতো গভীর, যেন অসীম শূন্যতার মধ্যে কেউ আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে......তার শরীরে একটা হালকা আভা ছিল, আর তার ত্বকের ওপর সূক্ষ্ম সোনালি রঙের রেখা দেখা যাচ্ছিল, যা প্রতিটি স্পন্দনের সঙ্গে ক্ষীণভাবে জ্বলজ্বল করছিল।.....
আমি মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম,
"তুমি..."
"আমি অগ্নিসূর্য," সে বলল, তার কণ্ঠস্বর ছিল শান্ত কিন্তু গভীর।
"তুমি বাস্তব?" বললাম আমি।
অগ্নিসূর্য হাসল, "তুমি কি বিশ্বাস করবে, যদি আমি তোমার হাত ধরি?"
আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম, কিন্তু কৌতূহল আমাকে পিছু হটতে দিল না। আমি ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে দিলাম।......
অগ্নিসূর্য খুব আলতো করে আমার হাত ধরল।
আমার শরীরটা কেঁপে উঠল....তার হাতের স্পর্শ উষ্ণ ছিল, কিন্তু একসঙ্গে যেন বিদ্যুতের হালকা কম্পন অনুভূত হলো। মনে হলো, সে কোনো সাধারণ মানুষ নয়—সে যেন জীবন্ত মহাকাশের একটা অংশ, যে এসেছে আমার জীবন বদলাতে।......
আমি কেমন যেন অভিভূত হয়ে গেলাম। যেন আমি অনেক আগেও এই মুহূর্তটা দেখেছি, যেন আমরা আগে থেকেই একে অপরকে জানি।
"তুমি কি... একজন মানুষ?" আবার জিজ্ঞাসা করলাম।
অগ্নিসূর্য মৃদু হাসল.."আমি কি তোমার মতো দেখতে?"
আমি একটু বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম.."তোমাকে দেখাচ্ছে একজন মানুষের মতো, কিন্তু... কিছু একটা আলাদা।"
অগ্নিসূর্য এক ধাপ এগিয়ে এলো...বলল, "কারণ, আমি শুধুই মানুষ নই।"
আমি আর এক ধাপ পিছিয়ে গেলাম। আমার হৃদস্পন্দন দ্রুত হচ্ছিল।
"তুমি কি ভয় পাচ্ছো?" অগ্নিসূর্য মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করল।
আমি মাথা নেড়ে বললাম, "না...আমি ভয় পাচ্ছি না, কিন্তু তোমাকে বোঝার চেষ্টা করছি...তুমি কে? কেন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছো?"
অগ্নিসূর্য এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, "তুমি কি কখনো ভেবেছো, পৃথিবীর বাইরেও কোনো ভালোবাসা থাকতে পারে?"
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম,"তুমি কী বলতে চাচ্ছো?"
অগ্নিসূর্য হাত বাড়িয়ে দিল, বলল, "চলো, আমার সঙ্গে এসো.... আমি তোমাকে এমন কিছু দেখাবো যা তুমি আগে কখনো দেখোনি।"
......আমি তার দিকে মুগ্ধ ভাবে তাকিয়ে ছিলাম। একদিকে এক অদ্ভুত আকর্ষণ, অন্যদিকে এক অজানা ভয়।
আমি কি বিশ্বাস করবো তাকে?
আমার কি অগ্নিসূর্যের সঙ্গে যাওয়া উচিত?
কিন্তু আমি জানতাম, এই মুহূর্ত যদি হাতছাড়া করি, তাহলে আমি সারাজীবন আফসোস করবো।
আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম...অগ্নিসূর্য আমার হাত স্পর্শ করল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, সময় থমকে গেছে। তারপর, আমরা দুজনেই একসঙ্গে ধীরে ধীরে সেই রুপালি যানটির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম।
অগ্নিসূর্যের হাত ধরে আমি ধীরে ধীরে রুপালি যানটির ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভেতরে ঢুকতেই আশেপাশের পরিবেশ পাল্টে গেল। যেন আমরা এক অদ্ভুত জগতের অংশ হয়ে গেছি।
যানের অভ্যন্তরটি ছিল সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, চারদিকে তারার মতো ক্ষুদ্র আলোর কণা ভাসছিল, আর মাঝখানে ছিল এক গোলাকার স্ফটিকের মতো বসার জায়গা, মনে হচ্ছিল, যেন আমরা আকাশের মধ্যেই ভাসছি।
"এটা... এটা কীভাবে সম্ভব?" আমি অবাক হয়ে চারপাশ দেখছিলাম।
অগ্নিসূর্য মৃদু হাসল এবং বলল, "এটা একধরনের শক্তি যা তোমাদের পৃথিবীতে নেই। আমি চাইলে এই যানটিকে পুরোপুরি অদৃশ্য করতে পারি, চাইলে স্বচ্ছ রাখতে পারি।"
আমি তাকিয়ে থাকলাম ওর চোখের দিকে। অগ্নিসূর্যের চোখের গভীরতা যেন অসীম মহাকাশের মতো—একই সঙ্গে রহস্যময়, একই সঙ্গে উষ্ণ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম "তুমি কোথা থেকে এসেছো?"
অগ্নিসূর্য একটু থামল, তারপর বলল, "একটা জায়গা থেকে, যা পৃথিবীর অনেক দূরে। একদম অন্য এক মাত্রায়।"
"অন্য মাত্রা?" আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
"হ্যাঁ। আমি কোনো গ্রহ থেকে আসিনি, আমি এক আলোর জগতের অংশ। সেই জগতে সময় নেই, দুঃখ নেই, শুধু শক্তি আর অস্তিত্ব আছে। কিন্তু..." বলে অগ্নিসূর্য একটু থেমে গেল।
"কিন্তু কী?" আমি প্রশ্ন করলাম।
অগ্নিসূর্য তাকাল আমার দিকে, তার চোখের মধ্যে যেন এক অদ্ভুত যন্ত্রণা খেলা করছিল, "আমি তোমাকে খুঁজছিলাম, স্বর্ণাদিত্যা।"
আমার হৃদস্পন্দন থমকে গেল..."আমাকে?"
"হ্যাঁ। আমি জানি এটা তোমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন, কিন্তু আমাদের দেখা আগেও হয়েছে... অনেক অনেক আগে।"
"আগে?" আমি হতভম্ব হয়ে গেল। "কোথায়?"
অগ্নিসূর্য ধীরে ধীরে আমার হাত ধরল। তার স্পর্শ ছিল উষ্ণ, কিন্তু সেই উষ্ণতার মধ্যে এক অদ্ভুত শক্তি ছিল, যা সরাসরি হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করছিল,
"আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল অনেক সহস্র বছর আগে, এক নক্ষত্রের ছায়ায়।"
"কিন্তু আমি তো তখন ছিলাম না!".... বললাম আমি।
অগ্নিসূর্য হাসল, কিন্তু সেই হাসির মধ্যে এক অদ্ভুত বিষাদ ছিল। বলল, "তুমি ছিলে, কিন্তু অন্য নামে, অন্য শরীরে। আমরা একসঙ্গে ছিলাম, কিন্তু ভাগ্য আমাদের আলাদা করে দিয়েছিল।"
আমার ভেতরটা কেমন যেন শিহরণ দিয়ে উঠল। "তাহলে... আমি কি তোমাকে ভালোবাসতাম?"
অগ্নিসূর্য ধীরে ধীরে আমার খুব কাছে এসে বলল,"তুমি শুধু আমাকে ভালোবাসতে না, তুমি আমার জীবন ছিলে, আমার অস্তিত্ব।"
আমার শ্বাস ভারী হয়ে এল। আমার চারপাশের সময় যেন স্থির হয়ে গেছে... বললাম,"কিন্তু কেন আমি কিছুই মনে করতে পারছি না?"
"কারণ এই পৃথিবী তোমার স্মৃতিকে আটকে রেখেছে। তুমি এক সাধারণ মানুষের শরীরে জন্ম নিয়েছো, যেখানে তোমার পুরোনো অস্তিত্ব লুকিয়ে আছে। কিন্তু আমি জানি, তুমি সেই একই আত্মা।"
আমি কিছু বলার আগেই, আচমকা চারপাশে এক অদ্ভুত ঝলকানি দেখা দিল। রুপালি যানটি আলোকিত হয়ে উঠল, চারপাশে নীল ও সোনালি আলো খেলা করতে লাগল।
"এটা কী হচ্ছে?" আমি বিস্মিত হয়ে
বললাম।
অগ্নিসূর্য গভীরভাবে তাকাল আমার চোখের দিকে....বলল,"তুমি প্রস্তুত?"
"প্রস্তুত কিসের জন্য?" আমি অবাক হলাম।
"প্রস্তুত তোমার স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে, আমাদের অতীতের সব সত্য জানতে।" ও বলল।
আমি নিঃশ্বাস নিলাম। আমার হৃদয় একদিকে ভয়ে কাঁপছিল, অন্যদিকে এক অদ্ভুত উত্তেজনায় ভরে উঠছিল।
"আমি প্রস্তুত।" দৃঢ় স্বরে বললাম।
অগ্নিসূর্য একদম কাছে এল, আমার কপালের ওপর আলতো করে তার হাত রাখল....এক মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু বদলে গেল।......
আমার সামনে এক নতুন জগত খুলে গেল—এক বিশাল স্বর্গের মতো স্থান, যেখানে আলো আর নক্ষত্রের নৃত্য চলছিল......এক বিশাল সোনালি মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অগ্নিসূর্য, আর তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন...
আমি নিজেই!!
........কিন্তু অন্য রূপে। লম্বা কালো চুল, গাঢ় লাল পোশাক, আর কপালে এক উজ্জ্বল চিহ্ন।
আর আজ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অগ্নিসূর্য, কিন্তু তার চেহারা তখনকার চেয়ে কিছুটা আলাদা। তার সোনালি শরীর তখন আরও উজ্জ্বল ছিল, তার চোখ ছিল আরও গভীর।
"তুমি আমার সঙ্গে থাকবে?" অগ্নিসূর্য জিজ্ঞেস করেছিল।
"চিরকাল......।" বলেছিলাম ওই রুপের আমি।
....ঠিক সেই মুহূর্তে বিশাল এক আলো এসে আমাদের আলাদা করে দিল।
আর আমি ধড়ফড় করে বাস্তবে ফিরে এলাম।
আমার শ্বাস দ্রুত হচ্ছিল, আমি অগ্নিসূর্যের হাত শক্ত করে ধরে ফেললাম.....বললাম, "আমি সব দেখেছি!"
অগ্নিসূর্য আমার দিকে গভীর ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকাল ....,"তাহলে এবার বলো, তুমি কি আমার সঙ্গে আসবে?"
আমার চোখে জল এসে গেল।
আমি জানতাম, এই ভালোবাসা কেবল একটি জীবনের নয়...,"আমি আসব অগ্নিসূর্য। চিরদিনের জন্য।"
অগ্নিসূর্য হাসল, আর আমাদের চারপাশটা তারার আলো এক উজ্জ্বল আলোকচ্ছটায় বদলে গেল।
আমরা দুজনে মহাকাশের পথে যাত্রা করল, চিরন্তন ভালোবাসার সন্ধানে......
অগ্নিসূর্যের সঙ্গে আমি যখন রুপালি যানটিতে বসে আকাশপথে উড়ে চলছিলাম, তখন চারপাশের দৃশ্য একেবারে পাল্টে যেতে লাগল.....নীচে পৃথিবীর চেনা শহরগুলো ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো হয়ে গেল, আর তাদের চারপাশে গভীর অন্ধকার মহাশূন্যের মাঝে অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করছিল।
আমার মন এখনো সেই পুরোনো স্মৃতির ধাক্কায় অস্থির। আমি যেন অনুভব করতে পারছিলাম, আমার আত্মার গভীরে লুকিয়ে থাকা অতীত ধীরে ধীরে জেগে উঠছে।
"আমাদের গন্তব্য কোথায়?" আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।
অগ্নিসূর্য এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল, তার চোখে সেই একই গভীরতা, যেখানে মনে হয় হাজার নক্ষত্রের গল্প লেখা আছে।
বলল, "সেখানে, যেখানে তুমি একদিন ছিলে। নক্ষত্রলোক।"
"নক্ষত্রলোক?" আমি আমার অবাক হলাম।
"হ্যাঁ, এক সময় তুমি ছিলে এক নক্ষত্রের রক্ষক। তুমি ছিলে স্বর্ণিকা, আলো আর শক্তির এক রক্ষক, তুমি ছিলে নক্ষত্রলোকের সিংহাসনের অধিকারী। কিন্তু এক অভিশাপ তোমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিল, সাধারণ মানুষের মতো করে।"
আমার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল....গলা বুজে আসতে লাগল..,"তাহলে... আমি আসলেই মানুষ নই?"
অগ্নিসূর্য একটুও দ্বিধা করল না....,"তুমি আলোর সন্তান, যাকে পৃথিবীর সীমাবদ্ধতায় আটকে রাখা হয়েছে।"
আমি জানতাম, আমি ছোটবেলা থেকেই অদ্ভুত সব অনুভূতি পেয়ে এসেছি। আমার চারপাশের পৃথিবীকে কখনোই নিজের মতো মনে হয়নি। এখন সবকিছু স্পষ্ট হচ্ছে।
"কিন্তু এই অভিশাপ কেন? কে দিয়েছিল?" আমি জিজ্ঞেস করলাম।
অগ্নিসূর্যের চোখে এক মুহূর্তের জন্য গভীর দুঃখ ফুটে উঠল.....,"একজন, যে তোমাকে ভালোবাসতো কিন্তু তোমার ভালোবাসা পায়নি।"
আমার শ্বাস আটকে গেল। বললাম,"কে সে?"
অগ্নিসূর্য ধীরে ধীরে বলল, "গ্রহান্তক।"
এই নাম শোনামাত্রই আমার হৃদয়ের গভীরে এক অদ্ভুত শীতলতা নেমে এলো। যেন কোথাও এক চাপা স্মৃতি জেগে উঠতে চাইছে...."সে কে?"
অগ্নিসূর্য বলতে শুরু করল....,
"এক শক্তিশালী দানব, যে একসময় তোমার পাশে থাকার স্বপ্ন দেখত। কিন্তু তুমি যখন আমাকে ভালোবেসেছিলে, সে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে নক্ষত্রলোক ধ্বংসের পরিকল্পনা করেছিল। তোমাকে তার করায়ত্তে আনতে চেয়েছিল। কিন্তু তুমি নিজে আমাদের জগতের শক্তি নিয়ে তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলে।"
......আমি ধীরে ধীরে অনুভব করছিলাম, সেই পুরোনো যুদ্ধের স্মৃতিগুলো আমার ভেতরে আবারও জেগে উঠছে....,"আমি তাকে থামিয়েছিলাম?"
অগ্নিসূর্য মাথা নাড়ল....."তুমি শুধু তাকে থামাওনি, তুমি তাকে চিরতরে বন্দি করেছিলে মহাশূন্যের এক অন্ধকার কক্ষে। কিন্তু যাওয়ার আগে সে তোমাকে অভিশাপ দিয়েছিল—যেন তুমি তোমার শক্তি ভুলে যাও, যেন তুমি জন্ম নাও এক সাধারণ মানুষের রূপে, যেখানে তুমি নক্ষত্রলোকের কথা কোনোদিন মনে করতে পারবে না।"
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।......
"আর এখন সে জেগে উঠছে," অগ্নিসূর্য গভীর স্বরে বলল।
"তাহলে আমাদের থামাতে হবে ওকে!" ....আমি বললাম।
অগ্নিসূর্য মৃদু হেসে বলল, "এই জন্যই আমি তোমাকে খুঁজেছি, স্বর্ণাদিত্যা। আমরা একসঙ্গে লড়াই করব, যেমন আগে করেছিলাম।"
আমি অগ্নিসূর্যের হাত আরও শক্ত করে ধরলাম....
"আমি প্রস্তুত, অগ্নিসূর্য।"
ঠিক তখনই, তাদের যানটি প্রবল আলোতে ঝলসে উঠল। এক বিশাল সাদা দরজা মহাকাশের মাঝে খুলে গেল, যেন সময়ের এক অদ্ভুত ফাটল।
"এই নক্ষত্রলোকের দরজা," অগ্নিসূর্য বলল। "তুমি তৈরি?"
আমি একবার শ্বাস নিলাম, তারপর মাথা নাড়লাম....,"হ্যাঁ, চলো আমার প্রকৃত বাড়িতে।"
.....অগ্নিসূর্য, আমার হাত শক্ত করে ধরে দরজার ভেতরে প্রবেশ করল, আর আমরা দুজন আলোয় বিলীন হয়ে গেলাম।.....
আমি আর অগ্নিসূর্য যখন নক্ষত্রলোকের দরজা দিয়ে প্রবেশ করলাম, এক মুহূর্তের জন্য সময় যেন থমকে গেল। চারপাশের মহাশূন্যের গভীর অন্ধকার হঠাৎ করেই রূপ নিল এক অসীম আলোয়—হাজারো নক্ষত্রের সমাহারে, যেন কেউ এক স্বপ্নের পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে আমাদের।......
আমি বিস্ময়ে চারপাশে তাকালাম। আমার হৃদয়ের গভীর থেকে এক পরিচিত অনুভূতি ছুটে এল...."আমি এখানে ছিলাম.." আমার কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে স্মৃতির ভারে কেঁপে উঠল।
অগ্নিসূর্য আমার হাত আরও শক্ত করে ধরল....,"হ্যাঁ, তুমি এখানে জন্মেছিলে, এই মহাজাগতিক জগতে....স্বর্ণিকা নামে।"
আমি অনুভব করলাম, আমার শরীরের প্রতিটি কোষ যেন সেই নাম শুনে জেগে উঠছে। আমার চোখে একের পর এক দৃশ্য ফুটে উঠল—এক সুবর্ণ প্রাসাদ, যেখানে আমি একসময় বাস করতাম, এক বিশাল নীল আকাশ যেখানে এক অনন্ত শক্তির প্রবাহ ছিল, আর সেখানে ছিল এক সিংহাসন, যেখানে আমি বসতাম একা....."আমি... সত্যিই এই পৃথিবীর অংশ ছিলাম?"
অগ্নিসূর্য হাসল.... "তুমি শুধু অংশ নও, তুমি ছিলে নক্ষত্রলোকের সর্বোচ্চ রক্ষক এবং..."
সে একটু থেমে বলল,"তুমি ছিলে আমার ভালোবাসা।"
আমার গলা বুজে এল...,"আমরা একে অপরকে ভালোবাসতাম, তাই তো?"
অগ্নিসূর্যের চোখ গভীর হয়ে উঠল..., "হ্যাঁ, কিন্তু আমাদের প্রেম কখনো সহজ ছিল না।"
"কেন?" আমি জিজ্ঞেস করলাম।
অগ্নিসূর্য চোখ নামিয়ে বলল,"আমাদের একসঙ্গে থাকার কথা ছিল না... কারণ, আমি ছিলাম একজন সাধারণ একমাত্র নীল নক্ষত্র।
কিন্তু তারপরও আমরা একে অপরকে ভালোবেসেছিলাম।"
আমার মনে একটা ঝড় উঠল.... আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার ভেতরের পুরনো অনুভূতিগুলো ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। কিন্তু আমার হৃদয়ের গভীরে কোথাও একটা অদ্ভুত অস্থিরতা ছিল।
ঠিক তখনই, তাদের সামনে এক বিশাল প্রবেশদ্বার খুলে গেল। নক্ষত্রলোকের বিশাল স্বর্ণময় নগরী ফুটে উঠল চোখের সামনে।
"আমাদের সত্যটা জানতে হবে, স্বর্ণাদিত্যা।" বলে উঠলো অগ্নিসূর্য।
নক্ষত্রলোকের প্রাসাদ এক বিশাল সোনালী কাঠামো, যার উপরে ছড়িয়ে আছে অগণিত নক্ষত্রের আলো। প্রবেশ করতেই আমার হৃদয়টা কেঁপে উঠল।
"এটা আমার রাজ্য ছিল?" আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
"তুমি ছিলে এই প্রাসাদের রাজকন্যা, আর সেই সঙ্গে ছিলে নক্ষত্রলোকের রক্ষক। কিন্তু তোমার অভিশাপের পর, আমরা সবাই তোমাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম।" বলল অগ্নিসূর্য।
আমার চোখ বন্ধ হয়ে এল। আমার মনের ভেতর কিছু দৃশ্য উঁকি দিতে লাগল— আমি একসময় এক তেজস্বী রক্ষক ছিলাম, যাকে সবাই শ্রদ্ধা করত। কিন্তু একদিন, এক বিশ্বাসঘাতকতা আমার পুরো জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছিল।
"গ্রহান্তক ..." আমি মৃদু স্বরে বললাম।
অগ্নিসূর্য আমার আরও কাছে এসে দাঁড়ালো.....বলল, "তুমি মনে করতে পারছো?"
আমার মস্তিষ্কের ভেতর এক ঝড় বয়ে চলছিল......।
"আমি মনে করতে পারছি... গ্রহান্তক আমায় ভালোবাসত, কিন্তু আমি তার ভালোবাসা গ্রহণ করিনি। আমি..."
আমি জোড়ে শ্বাস নিলাম..... বললাম,
"আমি তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। এই নক্ষত্রলোকের একমাত্র নীল নক্ষত্রকে।"
অগ্নিসূর্যের মুখে এক মুহূর্তের জন্য প্রশান্তির ছোঁয়া ফুটে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই সে গম্ভীর হয়ে উঠল...." গ্রহান্তক ফিরে এসেছে, স্বর্ণাদিত্যা। সে প্রতিশোধ নিতে চায়।"
আমি চমকে উঠে বললাম..."কী বলছো!!"
"সে তোমার স্মৃতি ফিরে আসার আগেই তোমাকে ধ্বংস করতে চায়। কারণ, যদি তুমি ফিরে পাও তোমার সমস্ত শক্তি, তবে তোমাকে আর থামানো যাবে না।" ...অগ্নিসূর্য বলল।
আমার পুরো শরীরটা কেঁপে উঠল.... বললাম,"আমাদের কী করতে হবে?"
অগ্নিসূর্য বলল, "তোমাকে তোমার সত্যিকারের শক্তি ফিরিয়ে আনতে হবে।"
অগ্নিসূর্য আর আমি নক্ষত্রলোকের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেই আকাশ কেঁপে উঠল। দূর থেকে ভেসে এলো এক বিকট অন্ধকার শক্তির তরঙ্গ।
"সে চলে এসেছে!" অগ্নিসূর্য বলে উঠল।
আমি অনুভব করলাম, আমার হৃদয়ের গভীর থেকে এক প্রবল আগুনের স্রোত বেরিয়ে আসছে.....আমার চারপাশে সোনালী আলোর বলয় সৃষ্টি হয়ে গেল।
"স্বর্ণিকা পুনর্জন্ম লাভ করেছে!"......এক শক্তিশালী বজ্রধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলো আকাশজুড়ে।
........গ্রহান্তক এক বিকট গাঢ় অন্ধকারে আচ্ছাদিত হয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। তার চোখে প্রতিশোধের আগুন, আর তার কণ্ঠস্বর বিকট।
"তুমি ফিরে এসেছো, কিন্তু এটা তোমার শেষ দিন হবে, স্বর্ণিকা!"
আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম.... হাতের তালুর ভেতর এক উজ্জ্বল স্বর্ণালী শক্তির বল গড়ে উঠল.. হুঁ-কার দিয়ে বললাম,"তুমি আমাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলে, কিন্তু ভালোবাসা তোমার চেয়ে শক্তিশালী!"
অগ্নিসূর্য আমার হাতটা শক্ত করে ধরল ....বলল,"আমরা একসঙ্গে লড়ব।"
আমি মৃদু হেসে বললাম,"হ্যাঁ, একসঙ্গে।"
এক মুহূর্তের জন্য চারপাশের সমস্ত নক্ষত্র-রা
একসঙ্গে আলো ছড়িয়ে দিল, অন্যদিকে আমি আর অগ্নিসূর্যের শক্তি এক হয়ে মহাকাশের বুকে এক প্রবল বিস্ফোরণ ঘটালো।
গ্রহান্তক বিকট চিৎকার করে উঠল...."না-আ-আ-আ!!"
তার পুরো দেহ ধীরে ধীরে ভেঙে যেতে লাগল, আর এক সময় সে মহাশূন্যের অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেল।
নক্ষত্রলোক আবারো আলোতে ভরে উঠল....।
অগ্নিসূর্য আমার দিকে তাকাল, তার চোখে প্রশান্তির ছোঁয়া। বলল,"তুমি ফিরে এসেছো, স্বর্ণিকা।"
আমি এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে, তারপর বললাম,
"না, আমি শুধু স্বর্ণিকা নই, আমি স্বর্ণাদিত্যা। আমি দুটো জীবন-ই একসঙ্গে বহন করি।"
অগ্নিসূর্য মৃদু হেসে বলল, "তবে এবার কি তুমি আমায় একা ছেড়ে যাবে না, স্বর্ণাদিত্যা?"
আমি এগিয়ে এসে অগ্নিসূর্যের হাতে হাত রাখলাম..."না, এবার নয়..আমি জানি আমার স্থান কোথায়..তোমার পাশে আর আমার এই নক্ষত্রলোকে।"
অগ্নিসূর্য, মুখটা কাছে আনল,"তাহলে আমরা চিরকালের জন্য একসঙ্গে থাকব?"
আমি চোখ বন্ধ করলাম, "হ্যাঁ,এই নক্ষত্রলোকের আলোয়, আমরা একসঙ্গে থাকব..চিরদিন।"
আর সেই মুহূর্তে, মহাকাশের সমস্ত নক্ষত্র,উজ্জ্বল হয়ে উঠল,যেন তারা সাক্ষী থাকল এই অনন্ত প্রেমগাথার, যেখানে ভালোবাসা, আত্মত্যাগ আর পুনর্জন্ম একসঙ্গে মিলিত হলো।।
___________*___________

