পাশ- ফেল
পাশ- ফেল


শ্রাবণে- ফাল্গুনে
'বুঝসনি মনু… ঝটপটি এই যোগখানা কইরা ফালাও, তাইলে পরে এ্যাডভার্ব জিগামু।
দু'ভাই বসেছে অংক করতে। কালো মেঝের ওপরে, দেড়ফুট চওড়া তিনফুট লম্বা যোগের অংক দিয়ে মাস্টারমশাই বাড়ির ভেতরে গেছেন। চক দিয়ে মাটিতে লিখে চলেছে তারা, বসার ঘর ছেড়ে দাওয়ায় চলে গেল লিখতে লিখতে… ফিকির আলাদা। ফাঁক পেলেই পালাবে।
গোধূলির আলো তখন বাড়ির পাশের বড় মাঠের গোলপোস্টের বাঁশ ছুঁয়ে দিচ্ছে- খেলাতে ভাগ নিতে না পারলেও, বল কুড়িয়ে দাদাদের হাতে তুলে দেওয়াতেও প্রবল উত্তেজনা। কিন্তু যোগ না মিললে তো… দাদার মাথাটা পরিস্কার। অংক, ইংরিজি সবই তাড়াতাড়ি করে ফেলে। শ্রাবণের মাথার মধ্যে এ্যাডভার্বের 'রুডলি', 'রেগুলারলি' ধীরে ধীরে ফেন্ট হয়ে আসতে থাকে। দাদা ঝটপট সব মুখস্থ করে ফেলে। আজ এ্যাডভার্বের পরীক্ষা আছে।
বনার তখনও হাতে খড়ি। উননব্বই এর নামে নয়, হাতে...
'কি লুতুর ফুতুর করত্যাসো মনু? একজন তো কাইট্যা পরসে, তুমিও...'
মুহূর্তের মধ্যে ঘর ফাঁকা।
অনেক খোঁজাখুঁজির পরে বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে এক বাঙালি টিউটরের সন্ধান পেলেন ধীরাজ। বহুদিন আগে দেশ ছেড়েছেন মনোরঞ্জন মুখোপাধ্যায়, একমাত্র সন্তানের চাকরি সূত্রে। অকালে মৃত্যু হয়েছে সেই পুত্রের। স্বামী- স্ত্রী আর ফিরে যাননি। এখানেই বসবাস করছেন। ছোট বাচ্চাদের ইংরিজি পড়িয়ে আনন্দ পান মনোরঞ্জন বাবু।
অনেক সাধ্যসাধনার পরে তাঁকে রাজী করানো গেল সোনা আর বনার পড়াশোনাটা দেখে দেওয়ার জন্যে। স্কুলে ভর্তি হতে হবে, পাশ করতে হবে তো।
ধানখেতের আলের ওপর দিয়ে মাস্টারের বাড়ি পড়তে যাওয়া। ফেরার পথে হাতে লন্ঠন নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। ধানখেতের জমা জলে সর সর করে সাপ খোপ চলে যায়, দুই ভাই অবাক হয়ে দেখতে থাকে। হাফ প্যান্টের বোতাম নেই, মার ছেঁড়া শাড়ির পাড় দিয়ে কষে বাঁধা... হাঁচি বা কাশি এলে ছিঁড়ে যাবার প্রবল সম্ভাবনা।
বহু কষ্টে জমানো দুটো পয়সা দিয়ে ঘুগনি কিনে, পুরো পাতাটাই ধরে দেয় বনা, দাদার হাতে।
'তুই পাস্ট টেন্সটা ভাল করে পড়ে এসেছিস?'
'কেন তুই পড়িসনি? দাঁড়া স্যারকে বলছি।'
'তোকে পুরো ঘুগনিটা দিয়ে দিলাম...
'বছর খানেকের বড় দাদা একটু ভাবুক হয়ে পড়ে, বলে- 'স্যার ভার্বের প্রেসেন্ট দেবেন, পাস্টে বদলিয়ে বাক্য রচনা করতে হবে। তাড়াতাড়ি করবি কিন্তু… আমার লেখা হয়ে গেলেই পাতা উল্টিয়ে দেব।'
স্যার দিলেন কতগুলি শব্দ।
'এইগুলার পাস্ট টেন্স ল্যাখ্যা ফালাও দেহি, হ্যার পরে সেনটেন্স ল্যাখবা… বুঝসনি মনু।'
'দাদা, ক্যাচের পাস্ট টেন্স কি রে… ক্যাচড না?' একগাল হেসে সে তাকায় দাদার দিকে গর্বভরে। 'তুই কি লিখছিস সেনটেন্স?'
'তুই নিজের মত লেখ, খবর্দার আমারটা লিখবি না,' সোনা বলে।
'তুই বল না, আমি বদলে লিখব… আচ্ছা, আমি বলছি। দ্য পোলিস ক্যাচড দ্য থিভস...'
দাদার মুখও হাসিতে ভরে ওঠে।
'দাঁড়া, আমি এটাকেই বদলে লিখি… দ্য থিভস ওয়্যার ক্যাচড বাই দ্য পোলিস।'
'হেইডা কি লিখসো মনু...ক্যাস কট কট, ক্যাস কট কট... কত্তবাইর যে কইয়া দিসি। মন কোথায় থাকে তোমাদের?'
কদিন ধরেই ফাল্গুন আর শ্রাবণের নজর কাড়ছে উঠোনের ধারের পেয়ারা গাছটি, ঝুমঝুমে পেয়ারা ধরে রয়েছে। স্যারের কাছ থেকে ছাড়া পেয়েই দুই ভাই পেয়ারা গাছের হনুমান… কাঁচা- পাকা- কষ্টা যা পাচ্ছে মুখে পুরছে, পকেটে ভরছে... এমন সময় 'গলায় ইস্টাকিন, পায়ে কম্ফর্টার' ম্যাষ্টরের উদয়...
'পাজি, উল্লুক, বেল্লিক! পই পই কইর্যা নিষেধ করসি কাঁসা প্যায়রা গুলি না খাইতে, তা কেডা শনে কার কথা। রোষ, আইজ না রইব বাঁশ না বাইজব বাঁশুরি...'
দাদা কখন যেন পাকা পেয়ারার মত টুপ করে খসে পড়ে হাওয়া... কি স্বার্থপর!
ঘুগনির টাকাটা জলে গেল।
স্যারনি এসে বাঁচালেন। 'করত্যাসো কী? আগে পোলাডারে লাইমতে দাও, আগেই দাও লইয়া আইসেন...'
'হ...পরুক হারামজাদা! অরে শুদ্দাই কাটুম ডাল।'
স্যারনি স্যারের হাত থেকে দা'টা কেড়ে নিয়ে, তাঁর বেতো কোমর নিয়েই হাত বাড়িয়ে বনাকে পেড়ে ফেলেন।
সন্তানহীনা এই রমণীর সন্তান স্নেহ প্রকাশ পায় তাঁর স্বামীর খুদে পড়ুয়াগুলিকে আদর দিয়ে।
বাড়ি ফিরেও নিস্তার নেই। সেখানে আবার বাবার দেওয়া হোমটাস্ক। শ্রাবণের তা কখনোই করা হয়ে ওঠে না।
সন্ধ্যেবেলা পড়ার টেবিলে বই খুলে বসলেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে। ঢুলতে ঢুলতে একদমই ঢলে পড়ে বই-এর ওপরে। পড়ার ব্যবস্থা তো বাবার ঘরে। বাবা এসে কান ধরে টেনে তুললে দুই হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে বনা বলে 'আমি মোটেও ঘুমোইনি।'
'তোমার আর পাশ দেওয়া হবে না দেখছি… ফেলই করবে তুমি, স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি।'
বাবা রাগে গজগজ করতে থাকেন। শাস্তি স্বরূপ আলোর নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও মাথা ঢুলে পড়ে ঘুমে। মা এসে উদ্ধার করেন… বাবাকে খেতে ডেকে নিয়ে যান।
দাদা কেমন সব কাজ ঠিকঠাক করে রাখে, বনার আর হয়ই না। এক দুবার আগের দিনের কাজে বাবার করা সই মুছে দিয়েও চেষ্টা করেছে, ঠিক ধরা পড়ে যায়।
স্কুলে ভর্তির পরীক্ষার দিন এসে গেল। বনার কোনই হেলদোল নেই।
প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে কিছুই বোঝে না সে… কালো কালো অক্ষর নেচে বেড়ায় চোখের সামনে। দাদা কেমন লিখে চলেছে, মন দিয়ে। আঁকিবুঁকি কেটে, কোনরকমে সময় কাটিয়ে খাতা জমা করেই মাঠের দিকে দৌড়াতে থাকে সে। আজ বড় ম্যাচ আছে, ক্রিকেটের।
ফল বেরলে, দেখা যায় পঞ্চম শ্রেণীর ভর্তির লিস্টে শ্রাবণের নামই নেই… পাস করতে পারেনি সে। ফাল্গুনের নাম উঠেছে।
বাবা চললেন, মনোরঞ্জন বাবুকে নিয়ে, এই ছেলের তো বয়েস কম… চতুর্থ শ্রেণীতে নিয়ে নেওয়ার তদবির করতে।
অবশেষে ফেল নাম ঘুচিয়ে, পাস দিয়ে চতুর্থ শ্রেণীর বই খাতা নিয়ে, স্কুলে যেতে লাগল শ্রাবণ।