ওটা কে?
ওটা কে?
বাইরের বৃষ্টিটা যেনো আর বাড়লো। টিনের চালের আওয়াজ যেনো তার জানান দিচ্ছে। কারেন্ট সেতো অনেক আগেই চলে গেছে।
দাদু বলল দাদুভাই কারেন্ট আজ আর আসবে না, এটাতো আর শহর না রে, যে কারেন্ট গেলেই কিছু ক্ষণের মধ্যে চলে আসবে। টুকায় যাতো বাবা লন্ঠনে একটু তেল ভরে দে (টুকায় হল আমার মামার ছেলে)।
টুকায় বলেsaha আরেক বার শোনাতে হবে কিন্তু। এই বলে টুকায় লন্ঠনে তেল ভরে নিয়ে এল।
দাদু চেয়ারে বসে চাদরটা দিয়ে নিজেকে ভালো করে মুড়িয়ে নিল। আমি আর টুকায় দাদুর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে,
তবে দাদু বলার আগেই কিছু একটা ব্যাঘাত পেয়ে রেগে উঠে বলল ওরে শালা ভূতের গল্প শুনবি এত আলোতে যা লন্ঠনের শিখাটা একটু কমিয়ে দে (মা বলে দাদু যখন গল্প বলে তার আগে পটভূমি টা একটু সাজিয়ে ন্যায়)।
লন্ঠনের শিখাটা কমাতেই যেনো একটা ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি হল। বাইরে মুশল ধারে বৃষ্টি, টিনের চালে তার আওয়াজ আর মাঝে মধ্যে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে তার কিছু ক্ষণ পর মেঘ ডাকার শব্দ, মাঝে মাঝে এক রাশ শিতল বায়ু জানালা দিয়ে এসে লন্ঠনের শিখাটা একটু করে নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
শোন টুকায় এটা কোন বানানো গল্প না। এটা আমার ছোটোবেলার কথা, ওই কত হবে আমার বয়স ১১ -১২ বছর।
এই রকমই এক শীতের রাতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল আমি আর আমার কাকার ছেলে পঁচা ঠিক করলাম কাল ভোরে উঠে তাল কুড়াতে যাব, এখন তোরা কি বুঝবি তাল কুড়ান আম কুড়ানোর মজা একটু দেরি করলেই আর কিছু পাবি না, আর পাঁচ ছয়টা ছেলের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে আম জাম কুড়ানোর মজায় ছিল আলাদা। যেমন ভাবা তেমন কাজ পরের দিন ভোররাতে তাল কুড়াতে বেরিয়ে পরলাম, হাতে একটা লন্ঠন আর ব্যাগ নিয়ে।
লন্ঠনের আলোতে কুয়াশায় ঢাকা বৃষ্টিতে ভেজা কাঁচা রাস্তার কাদাতে পেছল কাটতে কাটতে পৌছালাম বাঁশ বনের পাশে তাল বাগানে। সারি সারি ভাবে সাত আটটা তাল গাছ এখন বেঁচে রয়েছে মুখার্জি দের তাল বাগানে।
পঁচা বলে উঠলো এখনো কেউ আসেনিরে ভোলা অনেক তাল কুড়ানো যাবে। তুই এই সামনের গাছ থেকে শুরু কর আমি ওই দিকের গাছ গুলো থেকে আনছি। আমার প্রায় ছয় সাতটা তাল ব্যাগে ভরার পর পঁচার গলার চিৎকার শুনতে পেলাম।
- দে এটা আমায় দে।
লন্ঠনটা হাতে নিয়ে পঁচার দিকে দৌড়ে গেলাম।
প্রায় দূর থেকে দেখতে পেলাম বাঁশ বনের পাশে যে শেষ গাছটা আছে সেটার নিচে পঁচা আর কে একজন মারামারি করছে। কুয়াশার জন্য ঠিক করে দূর থেকে দেখতে পচ্ছিলাম না। আমি কাছে যেতেয় ছেলেটা পঁচাকে সপাটে একটা চর মেরে মাটিতে ফেলে দৌড়ে বাঁশ বনের দিকে চলে গেল।
পঁচা চিৎকার করে বলল দারাও ব্যাটা একবার ধরতে পায় তার পর বুঝিয়ে দেবো, কার সথে তুমি পাঙ্গা নিয়েছো এই বলে দিলাম।
পঁচা আর আমি তাল ভরা বস্তা নিয়ে বাড়ি পৌছালাম।
কিছু ক্ষণ পর সূর্য উঠল। পঁচা বলল ভাই শরীরে বড্ড যন্ত্রনা হচ্ছে। দুপুর হতে হতে পঁচার প্রচন্ড জ্বর এল কাকিমা মাথায় জল পট্টি দিয়েও জ্বর নামাতে পারল না। কাকু ডক্তর কে খবর দিল।
বিকেলে ডক্তর এল, কিছু ওষুধ দিয়ে চলে গেল। রাতে পঁচার জ্বর আর বারল।
পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙ্গলো কন্নার আওয়াজে। ঘুম থেকে উঠে বাইরে বেরোতেয় কী হয়েছে জানতে চাইলে মা আমায় জরিয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল পঁচা আর নেই রে ভোলা পঁচা আর নেই। এটা শুনে আমি যেন কেমন হতবাক হয়ে গেলাম মনের কোণে জমে থাকা অজস্র কষ্ট যেন যেনো অস্রু হয়ে ঝড়ে পড়তে লাগলো, আস্তে আস্তে কাকুর ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম ঘরে ভেতর ঢুকে দেখি পঁচা বিছানায় নিশতেজ হয়ে পড়ে আছে, আর কাকিমা পঁচাকে জরিয়ে ধরে অঝরে কেঁদে যাচ্ছে।
কিছু ক্ষণ পর গ্রামের সবাই এল গ্রামের ডোমদের ডাকা হল তারা মাঁচা নিয়ে এসে খই ছেটাতে ছেটাতে পঁচার শেষ বিদায় জানানো হল।
পঁচার মারা যাওয়া বেশ কিছু দিন হয়েছে। রাত্রি বেলা খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমি আর কাকিমা শুয়ে আছি, কাকু নিজের ব্যবসার কাজে বাইরে গেছে।
আমি প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ করে ঘুমটা ভেঙে গেল কী একটা আওয়াজে। কাকিমাকে দেখতেই বুঝতে পারলাম কাকিমা কিছু একটা দেখে আতঙ্কিত হয়েছে, কাকিমার চোখ অনুসরণ করে তাকাতেই ভয় ও আতঙ্কে আমার হাত পা যেন অবস হয়ে গেল মনে হচ্ছে কোন এক অজানা শক্তি তার মন্ত্র বলে আমাকে বেঁধে ফেলেছে।
স্পল লন্ঠনের আলোয় বুঝতে পারলাম যে একটা বাচ্চা ছেলে মত কালো ছায়া গোটা ঘরে পাগলের মত ছুটে বেড়াচ্ছে আবার কখন জানলায় বসে দোল খাচ্ছে। আমি সমস্ত স্নায়ুর শক্তি একত্রিত করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলাম ও-ও-ওওটা কে?
কিছু ক্ষণ নিঃশব্দ তার পর কাকিমা নিচু স্বরে বলল চুপ করে শুয়ে থাক।
আমি প্রায় দম আটকে শুয়ে শুয়ে দেখতে লাগলাম ছায়া মূর্তিটি কে।
ছায়া মূর্তিটি কখন হাঁসে আবার কখন কাঁদে আবার পরক্ষণেই জানলায় বসে দোল খায়। এই রকম কত ক্ষণ হল জনি না তবে হঠাৎ নিঃশব্দতায় গোটা ঘরটা ভরে গেল, আমি আস্তে আস্তে ঘরের চারিদিক চায়তে লাগলাম দেখলাম ছায়া মূর্তিটা আর ঘরের মধ্যে নেই।
এত ক্ষণ ভয়ে গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছিল, আমি হাঁপ ছেড়ে জলের গ্লাশটার দিকে হাতটা বাড়াতে যাব অমনি কিছু ঘরের বাইরের দরজাটা কাছে কিছু একটা ঘষার শব্দ পেলাম, দরজাটার দিকে মাথাটা ঘুরিয়ে দেখলাম বাইরে লন্ঠনটা কে যেন টেনে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার পর হঠাৎ লন্ঠনের আলোটা নিভে গেল আর সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় অন্ধকার ঘর টাকে গ্রাশ করল। এই গাঢ় অন্ধকারের চাপে আমার বুকে কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হতে লাগলো আস্তে আস্তে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসল তারপর আমি কিছু জানিনা।
পরের দিন সকালে মা এর ডাকে আমার জ্ঞান ফিরল, মা আমায় চোখ খুলতে দেখে কাঁদতে লাগল চারপাশে তাকিয়ে দেখি ঘরের সবাই আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।
ঠাকুরমা দেখি কোথা থেকে পূষ্প আর বেল পাতা নিয়ে আমার কপালে ঠেকিয়ে বলে উঠলো হে ঠাকুর আমাদের রক্ষে কর রক্ষে কর।
ঠাকুরদা রাগান্বিত ভাবে চিৎকার করে বলে উঠলো নিমাই কে কখন পাঠিয়েছি পাশের গ্রাম থেকে সাধু মহারাজ কে নিয়ে আসতে এখনও তার পাত্তা নেই।
বিকেল হতে হতে বাবা আর সাধু মহারাজ ঘরে প্রবেশ করল।
সবাই মহারাজের কাছে হাত জোড় করে বসে পড়লো।
ঠাকুরদা পুরো ঘটনাটা খুলে বললেন। ঠাকুরমা জল বাতাসা নিয়ে এসে সাধু মহারাজ কে দিলেন। মহারাজ বললেন মা তোর ঘরে যে অশুভ শক্তি আছে রে মা, আমি যে তোর ঘরে ভোজন বা জল কিছু যে গ্রহণ করতে পারব না।
সাধু মহারাজ এই বার আসনে বসে চোখ বন্ধ করলেন তারপর নিজের ঝুলি থেকে একটা বোতল বের করে হাতে একটু জল নিয়ে কি একটা নিজের মনে বির বির করে বলে জয় মা বলে চারিদিকে ছিটিয়ে দিতে লাগল, তার পর বলল ঠাকুরমার দিকে তাকিয়ে বললেন মা তোর ঘরের কিছুটা স্থান আমি আমার শক্তি দিয়ে বেঁধে দিয়েছি আজ রাতে এইটুকু স্থানের মধ্যে থাকলে তোদের কিছু ক্ষতি হবে না, তবে সেটা শুধু আজ রাত্রিটুকু। ঠাকুরদা বলল এর কোন প্রতিকার নেই বাবা,
- সাধু মহারাজ ঠাকুরদার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো আছে জগা এই গৃহ তুই ত্যাগ কর এই গৃহ আর থাকার যজ্ঞ না এই বলে সাধু মহারাজ ঘরে থেকে বেরিয়ে চলে গেল। বাবা ও মহারাজের পেছন পেছন গেলো।
সেই দিন রাত্রি সবাই ভয়ে এক জায়গায় শুল, লন্ঠনের শিখা আজ আর কমানো হল না। সবাই নিঃশব্দে চারিদিকে তাকাচ্ছে কেউই আতঙ্কে আজ ঘুমতে পারছেনা। অনেক ক্ষণ কিছু না হওয়ায় আমর চোখটা একটু লেগে গেছিল হঠাৎ রান্না ঘরের ভেতর থেকে কিছু মাটিতে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলার আওয়াজ শুনতে পেলাম কিন্তু কেউ উঠে যাওয়ার সাহস দেখালো না। পরে দিন সকালে দেখি সব বাসনপত্র মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে আছে। ঠাকুরদা বলল সবার ভালোর জন্য এই বাড়ি আজি ছেড়ে দেব।
তার পর কিছু দিন গ্রামের মন্ডল দের বাড়ি তে আশ্রয় নেওয়া হল পরের দিন ঘরামিকে ডেকে এই বাড়িটা বানানো হয়।
- আমি বলে উঠলাম দাদু ওই বাড়িটা এখন কোথায় আছে?
- দাদু বলল এখন শুয়ে পড় কাল দেখিয়ে আনব।
পরের দিন সকালে দাদু দেখিয়ে নিয়ে এল ওই বাড়িটাকে এখন ওটা দেখতে সত্যি একটা ভূতুড়ে বাড়ি মনে হয়, অনেকটা জায়গা জুড়ে বাড়িটা তৈরি, চারিদিকে বড় বড় ঝোপ ঝাড় বাড়িটার ওপর একটা বড় বট গাছ জন্মেছে তার থেকে বেড়িয়ে আসা শেকর গুলো নাগ পাশের মত জড়িয়ে রেখেছে বাড়িটাকে।