ওরা পাঁচজন
ওরা পাঁচজন
ডাইনিং স্পেসে গিয়ে ভালো করে চোখ বোলালো সায়র, সব ঠিক ঠাক, গুনে গুনে বোতলগুলোও সাজিয়ে রেখেছে, আগে হার্ড ড্রিংক দিয়ে শুরু হোক, লাঞ্চ পরে অনলাইনে অর্ডার করে দেবে। আজ অনেকদিন পর বাওয়াল হবে, হ্যা, বাওয়ালই হবে। পাঁচ বছরের ম্যারেড স্টেটাস একেবারে পানসে হয়ে গেছে মশাই, এবার একটু চার্জ চাই।
সারাদিন অফিস বাড়ি করে বোর হয়ে গেছে সায়র, কতদিন অফিসে ফাইলের খাঁজে কিংবা বাড়িতে বউএর লালচোখ দেখে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে মনে হয়েছে, নিজের মতো করে একটা গোটা দিন যদি পাওয়া যেত! উপরওয়ালাও বোধহয় সায়রের মতোই ভুক্তভোগী, তাই সায়রের আর্জি এত তাড়াতাড়ি ফলপ্রসূ হলো; অনুশ্রীর পিসতুতো বোনের বিয়ে, দুদিন আগে যাওয়ার কথা, সায়র মিটিং ফিটিং বলে একদিন চেপে দিয়েছে। বউ বিনা একা ঘর, পাগলে হাতছাড়া করে। আর ছেলেরা তো একা হওয়া মানেই বন্ধুদের সাথে দঙ্গল, ওসব মেয়েদের মতো "নিভৃতে নির্জনে, একা বসি আনমনে.." ছেলেদের পোষায়না।
তমাল, মৈনাক, সুমিত, পরাগের সাথে রাতারাতি প্ল্যান হয়ে গেল, একে উইকেন্ড তার ওপর ফাঁকা বাড়ি, উফফ যা হবে না!
সকাল টপকে দুপুর এগোতেই সুরসুর করে সব আসতে শুরু করলো, তমাল ঢুকেই শুরু করলো, "কি ব্যাপার মামা? হঠাৎ এই টং ইনভিটেশন? বাবা হচ্ছো নাকি?"
অমনি, চার জোড়া চোখ গোলগোল ,কৌতূহল;
সায়র বরাভয় দিলো, "এমনিতেই চব্বিশে বিয়ে করে হাপিত্যেস করছি, আবার ঊনত্রিশেই বাবা হয়ে হিমালয় যাবো নাকি রে ব্যাটা?"
মৈনাক চোখ টিপল, "ছাড় তো, বহুদিন পর, আবার পঞ্চপাণ্ডব স্বাধীনতা পেয়েছি, চল আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই!"
ওদের পাঁচজনের মধ্যে সুমিত খানিক নিরীহ, "সায়রের না হয় বউ ঘরে নেই, আরে আমরা টং হয়ে ঘরে ঢুকলে কি সিনক্রিয়েট হবে ভেবে দেখেছিস?"
পরাগ এতক্ষন চুপ ছিল, এবার মুখ খুললো, "এই এটাকে বের করে দে, শালা বউ ভক্ত ড্যাশ, কেন ডেকেছিস এটাকে?"
পরিস্থিতি গরম দেখে সায়র হাত তুললো, "ওরে তোরা থাম থাম, ঝগড়া করতে এসেছিস? যা হবে দেখা যাবে, সেরকম হলে বাড়িতে ফোন করে বলে দে, আমরা পাঁচজন উইকেন্ডএ দীঘা যাচ্ছি কাল বিকেলে ফিরবো, আমি এখান থেকে অনুশ্রীর পিসির বাড়ি, আর তোরা রেস্ট নিয়ে নরমাল অ্যাসপেক্টে নিজেদের বাড়ি, ব্যাস খেল খতম, অ্যালকোহল হজম"।
মৈনাক সায়রের পিঠ চাপড়ে দিলো, "বাহ বন্ধু, বৌ বিনা তোমার মগজ তো বেশ সাফসুত্র হচ্ছে? ভাবতেই হেব্বি লাগছে, বস কে ছেড়ে, বউকে ছেড়ে, একটা পুরো দিন আমার, নিজের!"
সত্যি সায়রের নিজেকেই নিজের বাহবা দিতে ইচ্ছে করছে। এরকম বুদ্ধি সঙ্গ দিলে মাঝেমধ্যেই কিন্তু দারুন এরকম ব্যাচেলার পার্টি হয়ে যায়!
"চিয়ার্স" !পাঁচটা গ্লাস শূন্যে ভাসলো। চুমুকে চুমুকে সোনালী তরল কন্ঠনালী বেয়ে উদরে প্রবেশ করছে, হালকা হচ্ছে মাথা, নেশারু হচ্ছে শরীর।
-"সায়রটা করে দেখালো মাইরি, জিও, আশীর্বাদ করি বন্ধু তুমি এমনি করেই প্রতি মাস বউকে গাপ্পি দাও, কি বলিস রে তমাল?"
-"ঠিক বলেছিস পরাগ, আমরা শালা ওকে কেবলুস ভাবতাম, আর ও-ই কিনা এমন বাউন্ডারি মারলো?
-"এতগুলো বছর আমরা বউএর ভয়ে মেপে জুপে, এই এই এতটুকুন মাল গলায় ঢালতাম! তাতেই শালা বউ ধরে ফেলতো", মৈনাক হাউমাউ কেঁদে ফেললো, "জানিস সেবার তমালদের অ্যানিভার্সারীতে বাড়ি ফিরে পর্ণা আমায় বিছানায় ঘেঁষতেই দিলোনা!"
-"সেই জন্যই তো আমার এই প্ল্যানটা বন্ধু, আমিও এর ভুক্তভোগী, দিনরাত এক করে খাটছি, কার জন্য? বল, কার জন্য? তিনি পার্লার যাচ্ছেন, প্রত্যেক সপ্তাহে শপিংয়ে যাচ্ছেন, আর আমি একটু গলায় ঢাললেই, আমি ইতর? জানোয়ার?"
-"এই, এই জন্যই বউদের মাথায় তুলতে নেই, ছবি তোর বউএর কাছে আমার নামে কেঁদে কেঁদে মহাভারত বলে না, সায়র, এবার বুঝলি, এই শর্মা, দি গ্রেট তমাল মজুমদার কেন বউকে পাত্তা দেয়না?
-"একদম ঠিক করেছিস তুই তমাল, সুমিতকেই দেখ সারাদিন শুধু বউকে মিউ মিউ করে, ব্যাটার কোনো পার.. পারসোনালিটিই নেই!"
-"চোপ, একদম বলবি না, আমি মিউ মিউ করি, বেশ করি, আমার আমার একটা মাত্র বউ... আমার একটা মাত্র বউ...!"
-"ধুর শালা, বউ কটা হয় রে? এই পরাগ তুই ওখানে ব্যোম হয়ে বসে আছিস কেন?"
-"ভাল্লাগছেনা, ভাই, নিশাটা আজ একমাস বিছানায় আসছেনা, আচ্ছা বলতে পারিস কোন অফিস দেড়টা পর্যন্ত চলে? আমি শালা ওয়েট করে করে...
-"এই, এই পরাগ দেখ আমাকে দেখ, অনুশ্রী বাড়ি নেই, আমি ফুল এনজয় করছি কিনা, তুইও কর, নিশা পাত্তা দিচ্ছে না, তুই কাউকে নিয়ে ...খ্যাক... খ্যাক...! চল আজকেই যাবো, এই কটা বাজে? বাইপাশের কাছে সন্ধ্যে বেলায় অনেক ঝিঙ্কু মামনি দাঁড়িয়ে থাকে,...এই চল সবাই, আজ কিচ্ছু মানবোনা, কিরে ওই সুমিত, যাবি তো?"
মৈনাক গ্লাসের তলানি গলায় ঢেলে বললো, "আলবাত যাবে, ও যাবেনা, ওর বাপ যাবে, শালা একসাথে মাল খেয়ে একা একা বউএর আঁচলে ঢুকবে? চল...!
তমাল এবার বরাভয় দাতা, "আরে বউ তো রোজকার ডাল ভাত, একটা দিন তো বিরিয়ানি, রেশমি কাবাব চেখে দেখ!"
শহরের রাস্তায় সন্ধ্যে জমাট বাড়ছে। অফিস ফেরত লোকজন, পথচারী সব মিলিয়ে রাস্তা ভিড়ে ঠাসা হলেও বাইপাসের এদিকটা একটু অন্যরকম। একগজ ছাড়া ছাড়া রং মেখে ঝলমলে শাড়ি পরে মেয়েগুলো দাঁড়িয়ে থাকে। খদ্দেরের গাড়িতে উঠে পড়ে, সস্তার হোটেল কিংবা গাড়িতেই খরিদ্দারী করে পাই পয়সা বুঝে নেয় মেয়েগুলো।
সায়রের গাড়িটা এমনই একজন মেয়ের কাছে এসে থামলো, পাঁচজন খদ্দের, তাও নেশায় বুঁদ। মেয়েটাকে গাড়িতে তুলতে যাবে, এমন সময় পিছনে পুলিশ ভ্যান।
অন্যায় করার চেয়েও অন্যায় করে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়টা বেশিই।
ততক্ষনে নেশা কেটে গেছে, পালানোর আগেই , নিজেদের গাড়ি ছেড়ে পুলিশ ভ্যানে উঠতে হলো ওদের।
-"স্যার, বিশ্বাস করুন, আমরা কিচ্ছু করিনি, আমরা ভদ্র ঘরের ছেলে!"
সুমিতকে দাবড়ে দিয়ে ওসি বললো, "ওরকম সবাই বলে, ধরা পড়লেই ,ভদ্রলোক, লকাপে ঢুকে দেখ আমিও কেমন ভদ্রলোক হয়ে উঠি, মেয়ে দেখলেই ছোঁকছোঁকানি?"
কি করবে এবার ওরা? গাড়িটা বাজেয়াপ্ত হয়েছে, টাকা পয়সা মোবাইল এখনো পর্যন্ত নিয়ে নেয়নি, টাকা পয়সা দিয়ে যদি কিছু? কথাটা মৈনাককে বলতেই মৈনাক চুপ করিয়ে দিল সায়রকে ," আজকাল পুলিশগুলো খুব সত্যসারথী হয়েছে, চোপ, একটাও কথা বলবিনা, আমি যা করার করছি"...
বলেই মৈনাক এগিয়ে গেলো ওসির কাছে, "ইয়ে মানে, স্যার, একটা ফোন করার ছিল..."
-"কেন বউকে জানাতে চাইছেন যে রোড-গার্লের আঁচল ধরে লকাপে এসেছেন ,যেন চিন্তা না করে?"
মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে তবু কিচ্ছু করার নেই, দোষ না করলে সায়ক একাই বুঝিয়ে দিত সে কি জিনিস, কিন্তু পরিস্থিতি যা, চুপ থাকাটাই ঠিক।
পাঁচ পাঁচটা টগবগে ব্যক্তিত্ব নিজ নিজ অপরাধের ভারে নিশ্চুপ একটা কোনায় বসে আছে।
কিছুক্ষন পর তমাল এগিয়ে এসে ওসিকে বলে, "উই নিড টু মেক এ কল টু আওয়ার লইয়ার, প্লিজ.. "
ওসি কিছুক্ষন সবাইকে সরু চোখে জরিপ করে আঙ্গুল নাড়িয়ে ফোন করার ঈঙ্গিত দিল।
ফোনটা কেটে দীর্ঘশ্বাস ফেললো তমাল, "আমার মামাতো দাদা, হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করে, ওকেই বললাম সবকিছু। ছাড়া পেতে পেতে কাল দুপুর।
আজ রাতের মধ্যে কিছু হওয়ার চান্স নেই।"
পুলিশ কাস্টোডিতে ওরা পাঁচজন।
কি কুক্ষনেই যে মেয়েছেলের ভুত মাথায় চাপলো!
ইতিমধ্যেই যে যার বাড়িতে ফোন করে পূর্বপরিকল্পিত; বন্ধুরা মিলে উইকেন্ডে বেড়াতে যাওয়ার অজুহাত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, গরম আবহাওয়া কাল সকালে রিলিজের কথা শুনে খানিকটা শীতল। হালকা গল্প চলছে নিজেদের মধ্যে। একমাত্র সায়র কোনায় বসে, একা।
আজকের এই সবকিছুর জন্য দায়ী সে। কয়েক ঘন্টার আগের সেই একঘেঁয়ে রোজকার রুটিনটাকে বড্ড সৌভাগ্যজনক মনে হচ্ছে।
ঐযে রোজ অনুশ্রীর ঠেলায় ঘুম থেকে উঠে গরম চায়ে চুমুক দিয়েই বাজারে ছোটা, স্নান খাওয়া সেরে অফিস ছোটার ফাঁকে বউএর সাথে হালকা আলাপ, অফিসের কাজ, কলিগ, ইউনিয়ন, ক্যান্টিন, প্রজেক্ট, বাড়ি ফিরতি পাড়ার ক্লাবে তাসের আড্ডা, চা, তেলেভাজা, তারপর সেই পুরোনো দশটার ডিনার, বউ, বিছানা, বালিশ, নাইটল্যাম্প, শরীরী খেলা, বউএর বকুনি, ঝগড়া, খুনসুটি, অভিমান , মানভঞ্জন , আজ সব, সব কিছু একঘেয়েমিই বড় লোভাতুর হয়ে উঠছে সায়রের চোখে, মনে, মস্তিষ্কে।
***************
বিকেল চারটে। অনুশ্রীর কেনা নেভিব্লু শার্ট টা ,(যেটা কিনা এতদিন কিন্ডার গার্টেন ইউনিফর্ম ছিল সায়রের কাছে) পরেছে সায়র। সন্ধ্যে সাতটায় ট্রেন, অনুশ্রীর পিসির বাড়ি যাচ্ছে সায়র, বিয়ে অ্যাটেন্ড করতে।
আবার সব পুরোনো ফিরে আসবে জীবনে, বউ, সংসার ,অফিস, ক্লাব, ক্যান্টিন.... ওরা পাঁচজন, উকিল, পুলিশ ছাড়া আর কেউ জানলো না, ওদের গতকালের বাওয়ালি। যে মেয়েটিকে কেন্দ্র করে ওদের গতকালের দুর্ভোগ, সেও ওদের ভুলে নতুন করে রং মেখে রাস্তায় দাঁড়াবে নতুন খদ্দেরের আশায়।
********** বিয়েবাড়ি আলোয় ঝলমল। বহুদিন পর জামাই এসেছে, অনুশ্রীর বাবা মা পিসি পিসো এমন কি যার বিয়ে সেই চুমকিও সায়রকে পেয়ে দারুন খুশি।
আনন্দ আর আলোর রোশনাইয়ে ভোরে উঠেছে চারিদিক। লাল গোলাপ রঙা শিফন পরেছে অনুশ্রী।
রূপের ছটায় চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
ভিড়ের মাঝে সুযোগ বুঝে সায়রকে কাছে টানলো অনুশ্রী। সায়র এই ইশারার মানেটা বোঝে, স্বামীর মুখে প্রিয়বাক্য শুনতে চাইছে স্ত্রী, সৌন্দর্যের পূর্ণতা চাইছে স্বামীর প্রশংসায়। চাইছে নিবিড়তা।
সায়ক পারছেনা, দুচোখ তুলে স্ত্রীর চোখে তাকাতে আজ বড্ড বাঁধছে তার।
ঠিক তীক্ষ্ণ আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার মতন।
ওদিকে বাকি চারজনেরও কি একই অবস্থা? সায়ক জানে না, দেখা হলে জিজ্ঞেস করবে, জিজ্ঞেস করতে পারবে তো?
নাকি নিজের কাছে নিজেকে বাঁচাতে লুকোচুরি খেলতে হবে বন্ধুদের সাথে, নিজের সাথে?
