Ajoy Kumar Basu

Classics

2  

Ajoy Kumar Basu

Classics

নতুন পথের সন্ধানে

নতুন পথের সন্ধানে

6 mins
717


আজ আমাদের বিয়ের তারিখ। কল্পনা থাকলে মজা হতো। একলা মনটা একটু উদাস উদাস লাগছে।

গতকাল জানলাম সারা জীবনের বৈজ্ঞানিক কাজের জন্যে আমাকে পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। একটা তৃপ্তির স্বাদ মনের মধ্যে ,তবু উচ্ছাসটা নেই। আমি পেছনের দিকে তাকিয়ে আমার রিসার্চ এর ফল একশোটা ছোট -মাঝারি industry গুলো দেখছি। হয়তো তাদের মধ্যে অনেকেই আর নেই ,কটা নিশ্চই অনেক বড় হয়েছে। প্রতিটাতে কমপক্ষে একটা Import sustitution এর জিনিষ বানাচ্ছে। কত রকমের product , ওষুধ থেকে Solid State Relay,গাড়ির Electronic Ignition System থেকে Machine Gun এর Bullet হেড। নতুন মিশ্র ধাতু , নতুন পাম্প ,ডিসেলের বদলে নতুন তেল। হাজার হাজার লোক কাজ করছে। দেশ নতুন স্বপ্ন দেখছে। ভাবছি জীবনটা কোশী নদীর মতো সব বছরে নতুন স্রোতে চলেছে।

কদিন আগে মেয়েটা জানালো তার নির্ণয় -মা হবার আনন্দটা পুরোপুরি উপভোগ করতে চায় ,তাই ইউনিভার্সিটির অধ্যাপনা ছাড়তে চায়। মায়েরই তো মেয়ে ,আমি খুব হাসলাম। আমার হাসিতে বাড়ীর অন্যরা একটু ক্ষুব্ধ। আমার কিছু যায় আসে না ,কিছু পেতে গেলে কিছুতো ছাড়তেই হয়।

একটু আগে ফোন এলো বৌমার ,মনে করিয়ে দিলো আজকের দিনটার কথা। দূর্গা প্রতিমার মতো মুখ আমার বৌমার ,লক্ষী আর সরস্বতী মেলানো ,আমাকে অর্থের চিন্তা থেকে মুক্তি দিয়েছে। সব দায়িত্ব বৌমার। একদিন তো রেগেই গেছিলো ,'বাবা,তোমরা কি বলতো ? যেমন তুমি ,তেমনি হয়েছে তোমার ছেলে মেয়ে ,টাকা পয়সার কোনো দাম নেই কারুর। '

আমরা খুশি মনে আমাদের কুবেরের পোস্ট তাকে দিয়েছি। আমাদের মুক্তি। মাঝে মাঝে কাগজে সই করতে হয় ,ব্যাস ওইটুকুই। দেখিওনা কিসে কোনো সই করলাম। মহিলা কুবেরের কাজ তাকেই একলা করতে হয়।

বৌমা জানালো তার কর্তার কথা ,সে নাকি একটা বড় বিদেশী কোম্পানির রিসার্চ ডিভিশনের গ্লোবাল হেড হয়েছে। আমার একটু অভিমান হোলো। এতবড়ো খাবারটা নিজে জানালোনা ! তারপরেই খুব হাসলাম ,বাপকা ব্যাটা - কাজটাই আসল ,পোস্টটা নয়।

শীতের সকালে বারান্দায় একটু রোদ এসেছে ,চোখ বন্ধ করে উপভোগ করছি। ভাবছি কতো পুরোনো কথা।

তখন নতুন সংসার পেতেছি। কল্পনা খুব সুন্দর আর ভালো। দৌড়ে দৌড়ে কাজ করে ,আপন মনে গান গায়। বিয়ের আগে স্কুলে পড়াতো ,রোজগারের দরকার ছিলোনা ,বিয়ের জন্যে অপেক্ষা ,তাই স্কুলে সময় কাটে আনন্দে। এমন টিচার কোথায় ,সব ছাত্রীর হেরোইন ,ক্লাস তো নয় ,একটা আনান্দমেলা। সবাইকে নিয়ে গান নাচের প্ল্যান ,নববর্ষ ,স্থাপনা দিবস ,নেতাজির জন্মদিন , কারণের অভাব নেই। রান্নাটা ভালো জানতোনা ;দুবছরে পাক্কা শেফ। বন্ধুরা আর তাদের বৌয়ের প্রায়ই হানা দেয় বৌদির হাতের রান্না খেতে আর গান শুনতে। কল্পনার কাজ সবাইকার hidden talent বার করা। কে কবিতা লিখতে পারে ,কার গলায় গজাল আর কার গলায় কীর্তন জমবে তার খোঁজ। সত্যিকারের আনন্দের সংসার আমাদের।

আমার তো ছন্নছাড়া জীবন। পড়াশুনায় ভালো ছিলাম ,তাই ভালো কলেজে চাকরি। বাবার তৈরী কলকাতার বাড়ীতে আমার একটা ঘর ,ঐটুকুই সম্পদ। চাকরির টাকাটা সম্বল। একদিন কল্পনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ,আমাকে বিয়ে করতে রাজি হলো কেন ,ওর তো অনেক বড়োলোকের বাড়ীতে বিয়ে হতে পারতো।

কল্পনা অনেক সম্বন্ধের কথা বলতো। একজন Chartered Accountant ,বিশাল চাকরি ,বিশাল পরিবার। মেক নিয়ে এসেছে কল্পনাকে দেখতে ,দুজনেই সেজে গুজে। কথা হলো কি পড়েছে ,কোন subject ভালো লাগে ,বাইরের জগতের সঙ্গে তাল মিল রাখতে পারে কিনা ,এইসব ভালো ভালো কথা। পাত্রের মুখে তার কাজ ,এর পর কোথায় কি পোস্টে যাবে তার খবর পাওয়া গেলো। পছন্দ হলো পাত্রীকে। কল্পনা তার মাকে বললো ,'পেন্সিলকে বিয়ে করতে পারবে না। ' বাড়ীর কেউ পছন্দ করলোনা এত ভালো পাত্র হাতছাড়া হওয়াতে।

আর একজন বিলেত ফেরৎ ইঞ্জিনিয়ার ,তার মুখে বিলেতের অনেক গল্প। প্ল্যান করেছে বিয়ের পর বিলেতে চাকরি করবে ,অনেক টাকা। পাত্রের বাবা আর এক সাহেব ,কিন্তু পাত্রীকে পছন্দ। বাতিল করলো কল্পনা ,শীতের দেশে গলা খারাপ হয়ে যাবে তাই।

আমাকে কেন পছন্দ করলো সেই প্রশ্নটা এড়িয়ে যেত ,কেমন যেন লজ্জা পেত। আমিও ছাড়বার পাত্র নোই। শেষে বলতেই হলো।

"আমার পরিবার দেখলো তোমার পড়াশুনার ইতিহাস ,ছেলের নাকি ফার্স্ট হবার হ্যাবিট। ডক্টরেটে করেছে হেসে খেলে। সবাইকে নিয়ে থাকতে ভালোবাসে ,ছাত্র মাস্টার নিয়ে নাটকের দল করেছে। ভবিষ্যত খুবই উজ্জ্বল।

আমাদের বাড়ীতে যেদিন এলে ,আমি দেখলাম সাধারণ শার্ট -প্যান্ট পড়া সাধারণ লোক। শুনছিলাম দাদাদের সঙ্গে তোমার কথা। তুমি বলছিলে তোমার স্বপ্ন। একশোটা ইন্ডাস্ট্রি করতে হবে নতুন জিনিস তৈরির। রিসার্চ করতে হবে। দেশের টাকা পয়সা নেই ,তবু কত লোকের খাবার বাদ দিয়ে তোমাকে তৈরী হতে সাহায্য করেছে। সেই ধার শোধ করতেই হবে। কেন জানি তুমি আমাকেই বলছো ,তোমার কল্পনা আর আমি কল্পনা এক হয়ে গেছি। কেমন কেমন লাগছিলো ,শরীরটাতে একটা শিরশিরে ভাব। তারপর তুমি কি করলে মনে আছে ?"

আমি মনে করতে পারলাম না। শুধু মনে পড়লো একটুকু সময়ের জন্যে কল্পনার চোখে দেখেছিলাম ওর ভাষাহীন সম্মতি।

"হটাৎ আমার দিকে সোজা তাকিয়ে বললে ,'আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন,আমি কোনোদিন কাউকে ঠকাইনি ,আপনাকেও ঠকাবোনা। '

পাত্রী দেখতে এসে এমন কথা কেউ বলেছে কি না জানিনা। আমার মনে হলো তোমার হাত ধরে চলাটা আনন্দের হবে। তাই সেদিন তোমাকে চোখ মেলে সম্মতি জানিয়েছিলাম।

বিয়ের পরে তোমাদের বাড়ীতে গিয়ে জানলাম তুমি আমাকেই বিয়ে করতে গেছিলে। তুমি বলতে 'মেয়েরা খেলনা নাকি যে দশ জনে দেখবে ,তারাই ঠিক করবে ? যাকে বিয়ে করবো প্রথমেই তাকে অসম্মান করবো ? আমি একজনকে দেখবো আর তাকেই বিয়ে করবো। ' সবাই হাসতো তোমার কথা শুনে। "

সেই কল্পনা -বাড়ী ফিরতেই হাসিমুখ ,দিনের কাজ কষ্ট ভুলে অন্য জগৎ। চাইবার কিছু নেই।

চাকরির জগৎটা এক্কেবারে আলাদা। সব বিষয়ে অমিল। আমার রিসার্চ পছন্দ নয় ; কলেজ পড়াচ্ছো ,পেপার লেখো ,হাত নোংরা করে জিনিস বানাচ্ছো কেন ? ছাত্রদের বই থেকে পড়াও ,সব সময়ে নতুন কিছু জোড়বার দরকার কি ? ছুটি নিয়ে বড় ইন্ডাস্ট্রি ভ্রমণে যাচ্ছ ,তাদের মেশিনের কাজ দেখছো ,কথা বলছো ,কোন দেশ থেকে আনা হয়েছে সে সব তোমার জেনে কি লাভ ? ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো টিচার সুলভ কাজ ?

বুঝতে পারছিলাম আমি একেবারে আলাদা হয়ে যাচ্ছি। কেউ সোজা ভাবে কথা বলে না ,এদিক ওদিক তাকায় ,হেড এর চোখে পড়লো কিনা চিন্তায়। হাতে গোণা কিছু ছাত্র -ছাত্রী আসে তাদের প্রজেক্টের কাজে -একটা বদনাম ,এই স্যারের কাছে কাজ শেখা যায় ,কিন্তু কালঘাম ছুটে যায়।

আমি একটা চোরাবালিতে পড়ে গেছি। না উঠতে পারছি ,না চলতে পারছি। চাকরি আর সংসার একদিকে জীবনের হাতছানি অন্যদিকে অনেক দূরে।

কল্পনা জানতো আমার দোটানা ;আমার কথায় ব্যবহারে ,বন্ধু পত্নীদের কাছ থেকে। চুপ করে থাকতো। আগে জিজ্ঞেস করতো, আজ কি করলে। সেই প্রশ্ন করাটা আস্তে আস্তে কমিয়ে দিয়েছে।

আমার জীবন চলছিল ঠিকই ,তবে আস্তে আস্তে ,দৌড়োচ্ছিলো না.কেমন বুড়িয়ে যাচ্ছিলো সব কিছু।

আমার হতাশা কল্পনাকেও ঘিরে ফেলছিলো। কদিন ধরেই দেখছি কেমন শুখনো মুখখানা। একটু অন্যমনষ্ক। প্রশ্ন করতাম ,এড়িয়ে যেত।

সেদিন কলেজ ফিরে কল্পনাকে হটাৎ কেন খুব সুন্দর লাগলো। একটু ফ্যাকাশে , কিন্তু চোখ দুটোতে একটা নতুন আলো। বলেই ফেললাম কি দেখছি। আর ওর কি হাসি ,ঝর্ণার জালের শব্দ। বললো ,'পাকোড়া বানিয়েছি ,এসো গরম গরম চা আর পাকোড়া খাই। '

দুজনে তৃপ্তি করে খেলাম ,মনটা কিন্তু কোথায় হারিয়ে গেছে। কল্পনা পাশে বসা ,আমার হাতটার ওপর ওর হাত। দুষ্টু গলায় বলে ,

"একটা কথা বলবো ,স্যার ?"

একটু অবাক হলাম। তবু ওর উচ্ছলতা আমার সুরেও ,'বলো বিষয়ে ,কী ত্বৰ বারতা। '

"আমি একটা স্বপ্নকে বিয়ে করেছিলাম ,তার পাশে থেকে স্বপ্নের দেশে ঘুরবো ভেবে। স্বপ্নটাকে ছেড়ে মানুষ আর চাকরি নিয়ে কি হবে ? চাকরিটা বাদ দাও। "

যুক্তি দিয়ে বোঝালাম যে আমি এখন আর একলা নোই। Bank Balance নেই। কোলকাতায় একটা ঘর আছে ,দিন চলবে কি করে।

কল্পনা অটল ,'আমি পুরোনো স্কুলে কাজ করবো আর তুমি একটা Tutorial class চালাবে। দিব্বি চলে যাবে দুজনের। ' ,একটু দ্বিধা ছিল শেষ শব্দে।

আমাকে মুক্তির নেশাটা পেয়ে বসলো। নতুন আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললাম ,'ঠিকই তো ,আর চাকরিতাতো কালই ছাড়তে পারবোনা ,তিন মাসের নোটিশ দিতে হবে ,তার মধ্যে কিছু একটা পেয়ে যাবোই। '

পরদিনই দিলাম চাকরিতে ইস্তফা। প্রধান একটু সন্দেহের চোখে দেখলেন ,'কোনো নতুন চাকরি পেয়েছেন নাকি ?আমাদের আগে জানান নি কেন ? নিয়ম অনুসারে আপনাকে কলেজের অনুমতি নিয়ে আবেদন করার কথা। '

আমার প্রাণে মুক্তির উচ্ছলতা। 'না স্যার ,করিনি কোথাও ;তিনমাস হাতে আছে,.করবো ,পেয়েও যাবো কোথাও না কোথাও। আপনি চিন্তা করবেন না। একটা সাহায্য চাইছি আপনার কাছে। পি এফ এর টাকাটা যদি হাতে পাই তাহলে আরও তিন চার মাস অসুবিধে হবে না -এটার একটা ব্যবস্থা আপনি যদি করে দেন তো খুব উপকার হয়।' প্রধান বিশ্বাস করলেন ,একটু অবাক হলেন ,তাঁর চোখে হঠাৎ একটু সম্মানের ছোঁয়া দেখলাম।

কল্পনা আর আমি আনন্দের মধ্যে কাটালাম।উপমা আর কফি খেলাম ,কোথায় কোথায় apply করবো তার একটা লিস্টি তৈরী করলাম। কল্পনা গান গাইলো,'জীবনের পরাম লগন। .';ওকে একটু বেশি ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। কিন্তু চোখের মধ্যে একটা দুস্টুমি উঁকি দিচ্ছিলো।

রাত্রে খুব কাছে শুয়ে বেশ ফিসফিস করে বললো ,

"একটু বেশি রোজগার করতে হবে গো । আমি মা হতে চলেছি। "


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics