নিশির ডাক - ২
নিশির ডাক - ২
নিশির ডাক - ২
শুভময় মণ্ডল
বিষয়টায় শুধু অবাক হলাম না, মনে মনে একটু ভয়ও পেলাম। তারপর কি মনে হতে, দেওয়ালের ছবিটার দিকে তাকালাম। ওমা! দেখি - ফ্রেমটা খালি, সেখানে মার্গারেটের ছবিটা নেই!
ঠিক তখনই আমার কানের কাছে এসে, কে যেন ফিস ফিস করে বললো - সেদিন এখানে ঠিক কি ঘটেছিলো দেখতে চাও? তাহলে এখনই এই ঘর থেকে বেড়িয়ে যাও।
আমি তো ভয়ে শিউড়ে উঠে, কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে, খাটের ওপর আমার বিছানাতেই জড়সড় হয়ে বসে থাকি। কিন্তু, কিছুক্ষণ পর, আমিই সেখান থেকে উঠে, ধীরপায়ে সত্যিই বাইরে বেড় হয়ে গেলাম!
স্পষ্ট মনে আছে আমার - আমি মোটেও স্বেচ্ছায় ঘর ছাড়িনি। কিন্তু সেই সময় যন্ত্রমানবের মত কোন অদৃশ্য অঙ্গুলী হেলনে, পায়ে পায়ে হেঁটে ঘরের বাইরে চলে আসি আমি!
বাইরে থেকে ঘরের দিকে তাকাতে দেখি - ঘরটা নিমেষে বদলে গেছে! কোনো আসবাব পত্র নেই - পুরো খালি হয়ে গেছে ঘরটা, ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলছে। তার পাসে হেঁট হয়ে বসে, একটা ছোটো পিঁড়ির ওপর বাইবেল খুলে, মন দিয়ে পড়ছে কিশোরী মার্গারেট!
এমন সময় জনা তেরো লোক উদয় হলো ঘরটায়। এসেই তাকে জিগ্গেস করলো - কি রে তোর পাদ্রী বাপটা কোথায়? এসব কি হচ্ছে এখানে - লোক ধরছিস আর তোদের মত ম্লেচ্ছ খ্রীষ্টান বানাচ্ছিস?
মার্গারেট তাদের বোঝাতে লাগলো যে - খ্রীষ্টানরা মোটেই ম্লেচ্ছ নয়, পৃথিবীতে সবথেকে সভ্য নাকি তারাই। শুরু হল তর্কাতর্কি - এতগুলো অন্ধ ধর্মের ষাঁড়ের সঙ্গে, এক নিষ্পাপ ধর্মপ্রাণ সেই কিশোরীর অসম লড়াই!
ঐটুকু মেয়ের সহজ সরল প্রশ্ন আর যুক্তির সাথে, পাল্লা দিতে পারলো না লোকগুলো! তারা তখন দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করার পথই বেছে নিলো। বললো - তোদের যীশু কিভাবে মরেছিলো জানিস তো? সাধারণ মানুষের ধর্মনষ্টের অপরাধের সাজা কি, তোকেও সেভাবেই মেরে দেখাই আয়।
এই বলে, তাকে চাগিয়ে তুলে নিয়ে গেলো তারা ঐ দেওয়ালে। একজন একটা এত্তবড়, প্রায় একহাত লম্বা একটা পেরেক এনে ঠেকালো তার কপালে। আর অন্য একজন হাতুড়ি তুলে, পেরেকটা তার কপালে পোঁতার জন্য ঘা মারতে উদ্যত হল!
আমি নির্বাক দর্শকের মত, হাঁ করে এতক্ষণ সব দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। কিন্তু এই ভয়ানক দৃশ্য যেন আমার বিহ্বলতা কাটিয়ে দিল। আমি স্থান কাল পাত্র সব ভুলে, দৌড়ে ঘরে ঢুকলাম। লোকগুলোর হাত থেকে ছোট্ট মার্গারেটকে জোড় করে ছাড়িয়ে নিতে গেলাম।
কিন্তু, দেখি তাদের গায়ে আসুরিক শক্তি। আমার বাধায় তারা বিন্দুমাত্র বিচলিত বোধ করলো না। উল্টে তাদের একজনের পায়ের জোড়ালো লাথি খেয়ে, আমি ঠিক যেন ফুটবলের মত উড়ে ছিটকে গিয়ে পড়লাম দরজার বাইরে।
বারান্দার কার্নিশে প্রচণ্ড জোড়ে ঠুকে গেলো আমার মাথার পিছনটা।ঝনঝন করে উঠলো মাথাটা। চারিদিক নিমেষে যেন অন্ধকার হয়ে এলো। চোখের দৃষ্টি সম্পূর্ণ হারাবার আগে দেখলাম - মার্গারেটের মাথায় সেই পেরেকটা ঠুকে, তাকে ঝুলিয়ে দিয়েছে তারা ঐ দেওয়ালে!
তার ছবিতে, যে এত্তবড় লাল টিপটা দেখেছিলাম কপালে - সেখানেই গর্ত করে পেরেকটা পুঁতে, তাকে টাঙিয়ে দিয়েছে দেওয়ালে। ঝড়ঝড় করে কপাল বেয়ে রক্ত ঝড়ে, ভেসে যাচ্ছে তার মুখ গোটা শরীর। কিন্তু তবু তার মুখে লেগে যেন এক নিষ্পাপ হাসি! ঠিক যেন প্রভু যীশুর মতই বলছে সেও - প্রভু ওদের ক্ষমা করো, ওরা জানেনা ওরা কি করছে!
সকালে জ্ঞান ফিরতে দেখি - আমি ঘরের এই আরাম কেদারায় বসে, ঘরের জিনিসপত্র সব যেমন ছিলো তেমনই গোছানো আছে!
কানে অনেক লোকজনের গলার আওয়াজ আসছিলো অনেকক্ষণ থেকেই। তাই, জানালা দিয়ে নীচে তাকিয়ে দেখি - একটা শববাহী কাঠের খাটিয়ায় শোয়ানো আমারই শরীরটা!
মাথার পিছনটা থেঁতলে গিয়েছে একবারে। রক্তে ভিজে জমাট বেঁধে গেছে চুল গুলো, কালো হয়ে কপালে ঘাড়ে এখনও জমে আছে চাপ চাপ রক্ত!
ওরা আমার সেই বন্ধুর আসার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি ছবিটার দিকে আবার তাকাতে দেখি - মার্গারেট আবার সেখানে ফিরে এসেছে, হাসিমুখে চেয়ে আছে আমার পানে। রজনীগন্ধার সেই মালাটা এখন ঝুলছে আমারই গলায়!
। সমাপ্ত।