নীল ঘুড়ি
নীল ঘুড়ি
"এই পড়ে যাবি, সব সময় তোকে বলি যে খোলা ছাদে এভাবে ঘুড়ি ওড়াবি না; নিচে চল", বিনীতাদেবী একরকম ধমকের সুরে বাবানকে বললেন কথাগুলো।
"আমি তো ছাদের ধারে যায়নি মা, এদিকটাতে ওড়াচ্ছিলাম।"
"না, ছাদে নয়, খেলার মাঠে গিয়ে যত খুশি ওড়াও।"
"মা, তুমি তো জানো যে, রাজু, বিট্টু এরা আমাকে খেলতে নেয় না। তাই আমি ছাদেই ওড়াবো। তোমার যত ইচ্ছে বকতে পারো। কিন্তু আমি ওদের সাথে আর খেলতে যাবো না", অভিমান করে বললো বাবান।
"না, বাবান, এরকম করতে নেই। ওদের সাথে গিয়ে কথা বলো, নাহয় আমিই যাবো। বন্ধুদের সাথে খেলবে।"
"মা, আমি কারোর সাথে না, তোমার সাথে খেলব" বলেই বিনীতাদেবীর আঁচলের মধ্যে গিয়ে ঢুকে পড়লো বছর দশেকের ছোট্ট বাবান।
"আমার সোনা ছেলে", বিনীতাদেবী বাবানকে তাঁর স্নেহ-ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরলেন।
মায়েদের গায়ের গন্ধ, শাড়ির গন্ধ যেন পৃথিবীর সব ধরনের দামি সুগন্ধিকে হার মানায়।
" কী গো, কী হলো, ঘুড়িটার দিকে ওরকম তাকিয়ে আছো কেন?", বাবানের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো রিমা, বাবানের স্ত্রী।
"ও কিছু না"
"কিছু না বললেই হবে। তোমার চোখ, মুখ বলে দিচ্ছে কী যেন ভাবছ!"
"ওসব ছাড়ো, রিভু কোথায়?"
"ও তো সেই সাম্যদের বাড়ি গিয়েছে ওকে ডেকে এনে এই নতুন কেনা ঘুড়িটা দেখাবে বলে।"
আবার কেমন চিন্তান্বিত হয়ে পড়লেন ড. বিদ্যুৎ চৌধুরী অর্থাৎ বাবান।
"রিভুকে ঘুড়ি কিনে দেওয়ার একদম ইচ্ছে আমার ছিল না, নেহাতই তুমি জোর করলে। তবে ভালো লাগছে দেখে যে, রিভুর বন্ধু আছে", এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললো বাবান।
"কী আশ্চর্য! একটা সামান্য ঘুড়িই তো চেয়েছে বাচ্চাটা, তুমি ওর বাবা হয়ে এটুকু কিনে দিতে পারবে না? আর তার ওপরে তুমি ডক্টর, একটা ঘুড়ি কিনে দেবার সামর্থ্য তোমার নেই, এটা কেউই মানতে পারবে না", বেশ রেগে গিয়ে বলে উঠলো রিমা।
"বাদ দাও, তুমি এখন যাও।"
"হ্যাঁ, যাচ্ছি, তুমি থাকো বসে, কিন্তু ঘুড়িটা দাও", ঘুড়ি নিয়ে চলে গেলো রিমা।
বাবান রিমার হাতে ধরে নিয়ে যাওয়া ঘুড়িটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। তারপর কেমন যেন আনমনা হয়ে পড়লো।
"মা, এই দেখো, ঘুড়িটা ছিঁড়ে গিয়েছে", কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো বাবান।
"কই দেখি, ওহো, একেবারেই ছিঁড়ে গিয়েছে দেখছি। তাতে কী হয়েছে, আমি কালকেই একটা নতুন ঘুড়ি কিনে এনে দেবো কেমন", বিনীতাদেবী বাবানকে কাছে টেনে নিলেন।
পরদিন বিকেলে বাবা-হারা বাবানকে সাথে করে বিনীতাদেবী দোকান থেকে ওর পছন্দমতো কিনে দিলেন একটা নীল রঙের কাগজের ঘুড়ি।
সেই ঘুড়িটা পেয়ে পুচকে বাবানের আনন্দ দেখে কে! রাত্রে ঘুমোতে যাওয়ার সময়েও ও ঘুড়িটাকে সাথে করে নিয়ে শুতে গেলো। তাই দেখে বিনীতাদেবী হেসেই অস্থির।
"বাপি, আমরা ওখানে কবে যাব?", রিভুর ডাকে সম্বিত ফিরে পেলো বাবান। কখন যে পেছন থেকে রিভু এসে দাঁড়িয়েছে, খেয়ালই করেনি ও।
আজকে বাবানের শরীরটা ভালো না থাকায় চেম্বারে যায়নি ও। রিমাও অফিসে যায়নি বাবানের শরীর খারাপের জন্য। রিভুকে দেখভালের জন্য একজন ন্যানি রেখেছে রিমা, ঘরের দৈনন্দিন কাজের জন্য হেল্পার রয়েছে তবুও পাঁচ বছরের বাচ্চার জন্য সপ্তাহে রবিবার বাদে আরও একটা দিন ওর বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু উপায় নেই, তাই আজকে অফিসের বসকে কল করে জানিয়ে দিয়েছে, আজকে যেতে পারবে না। আজকে বাবানের সাথে রিভুর সঙ্গেও পুরো দিনটা কাটাবে ঠিক করেছে রিমা।
কয়েকদিন ধরেই রিভু বায়না করছিলো একটা ঘুড়ি কিনে দেওয়ার। ওর বন্ধু সাম্যকে ওর বাবা ঘুড়ি কিনে দিয়েছে। আর যাবে কোথায়! বাবানকে বলাতে ও তো প্রথমেই না করে দিয়েছে। ওই শুনে রিভু কেঁদে কেঁদে যখন ওর টুকটুকে ফর্সা গাল দুটো আর চোখ দুটো লাল ক'রে ফেললো, ছেলের কান্না দেখে রিমা স্থির থাকতে পারেনি।
তাই আজকে ছুটি পেয়ে রিভুকে সাথে করে দোকানে গিয়েছিলো। রিভু বেছে বেছে পছন্দ করেছে নীল রঙের একটা ঘুড়ি। ঘুড়িটা প্লাস্টিক পেপারের মানে আজকাল যেগুলো পাওয়া যায়; দোকানদার বলে দিয়েছে, এটা এত সহজে ছিঁড়বে না, যদিও ওরা বিক্রি করার জন্য অনেক কিছুই বলে থাকে। রিভু এটা পেয়ে এত খুশি যে পাশের বাড়ির বন্ধুকে ডেকে এনে দেখিয়েছে। এরপর দু'জনে মিলে একসাথে ওড়াবে, কারটা বেশি দূর যায়, তারও কম্পিটিশন করবে, ঠিক করে নিয়েছে ওরা।
কিন্তু ঘুড়িটা কিনে বাড়িতে নিয়ে আসার পর থেকে বাবান কীরকম যেন একটু ব্যবহার করছিলো। যাইহোক, ওর হয়তো শরীর খারাপ, তাই এরকম করছে, ভাবছিল রিমা।
আবার রিভু বাবানের গায়ে হাত দিয়ে ডাকলো,"ও বাপি, কবে যাব, বলো না।"
রিমাও এসে দাঁড়িয়েছে। "ও কখন থেকে তোমাকে জিজ্ঞাসা করছে বলোতো? তোমার শরীর কি খুব খারাপ করছে? একবার তোমার বন্ধু তূর্যকে ডাকবো?"
"না না, তেমন কিছু হয়নি, মাথাটা কাল থেকে একটু ধরেছে, আমি ট্যাবলেট খেয়ে নিয়েছি, সেরে যাবে। তুমি কাউকে ডেকো না।"
"সে ঠিক আছে, একটু রেস্ট নাও আজকে, শুধু চেম্বার আর পেশেন্ট, নিজের শরীরের একটু যত্ন নাও না কেন? আর ওখানে কবে যাবে কিছু ঠিক করেছো?"
"আমার যত্ন নেওয়ার জন্য তুমি তো রয়েছো, তোমরা ছাড়া আমার আপন কে আর আছে? তোমরাই আমার জীবন, আমার পৃথিবী।"
বাবান রিমাকে ওর বুকের কাছে টেনে নিলো।
রিমা বাবানের মাথায় হাত বুলিয়ে চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলো। ওদিকে রিভু ব্যস্ত ওর নতুন কেনা ঘুড়িটা নিয়ে। কখন যে বিকেল হবে, আর ও সাম্যর সাথে গিয়ে ঘুড়ি ওড়াবে, এই ভাবতে ভাবতে এঘর ওঘরের মধ্যে ঘুড়িটাকে নিয়ে দৌড়ে বেড়াতে লাগলো।
আজকে রবিবার, ড. বিদ্যুৎ মানে বাবান তাঁর স্ত্রী, ছেলে ও একজন হেল্পারকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন কলকাতা শহর থেকে দূরে রঘুনাথপুর নামে একটি জায়গায়। এখানের অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছে বাবান। ওখানে গিয়ে একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোকের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে তাঁর সাথে কথা বলে পরিবারের বাকি সদস্যদের পরিচয় করিয়ে গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময়ে সেই ভদ্রলোক পেছন থেকে ডেকে বললেন, "তা বাবা, তোমরা কি এখন ওখানেই যাচ্ছ?"
"হ্যাঁ, কাকু, ওখানে দু'দিন থাকবো বলে ছুটি নিয়ে এসেছি।"
"বেশ, সাবধানে যেও, বউমা, দাদুভাইকে নিয়ে আবার এসো কিন্তু, আমাকে ভুলে যেও না।"
"কী যে বলেন কাকু! আপনি, আপনারা আমাকে বড় করেছেন, আর আমি আপনাদের ভুলে যাবো? আবার অবশ্যই আসবো, এখন আসি।"
"আচ্ছা, এসো।"
গাড়ি অনাথ আশ্রম ছেড়ে মাটির রাস্তা ধরে এগিয়ে চললো। জায়গাটা আধা শহর। ওরা একটা পুরোনো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। রিভু ভীষণ আনন্দিত, খুব মজা করবে ও।
এটা সেই বাড়ি, আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে এখান থেকে অনাথ আশ্রমে যেতে হয়েছিলো বাবানকে। ওখান থেকেই ও পড়াশোনা করে আজ ডাক্তার হয়েছে। রিমাকে বিয়ে করে একটা সুন্দর, সুখী সংসারও হয়েছে। রিমা আজকে একটা হালকা সবুজ রঙের শাড়ি পড়েছে, ও আজকালকার মেয়ে, অনুষ্ঠান ছাড়া শাড়ি সেরকম পড়া হয়ে ওঠেনা। বাবানই ওকে বলেছিলো শাড়ি পরে আসতে, রিমা প্রথম দিকে পড়তে চায়নি, কারণ শাড়ি পড়ে বেড়াতে যাওয়া খুব ঝামেলার। কিন্তু বাবান একপ্রকার নাছোড়বান্দা ছিল, অগত্যা স্বামীর কথামতো ওকে পড়তেই হলো।
বাড়িটা অনেক পুরোনো, যদিও বাবান মাঝে-মধ্যে লোক লাগিয়ে বাড়িটা পরিষ্কার করায়, তবুও ওদের বিয়ের পর থেকে আর কোনোদিনই এখানে আসা হয়ে ওঠেনি, রিভু জন্মাবার পরে আজ ওরা ওকে নিয়ে প্রথম এলো। রিভু কিন্তু সাথে করে নিয়ে আসতে ভোলেনি ওর প্রিয় সেই নীল রঙের ঘুড়িটা।
ঘরে ঢুকে সবাই টিউবওয়েলে হাত, মুখ ধুয়ে নিলো। বিছানায় পাতার চাদরটা বিছিয়ে ওদের কলকাতার বাড়ি থেকে আনা খাবার খাওয়া-দাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাবান চুপ করে একটা ছবির সামনে বসে আছে, বাড়িটার চারপাশ কেমন যেন নিরিবিলি, হয়তো একটু গ্রাম্য পরিবেশ বলে। বাবান রিমাকে শাড়ি পরতে বলেছিলো কারণ মেয়েরা শাড়ি পরলে ওর খুব ভালো লাগে, শাড়িতেই নারীর সৌন্দর্য ফুটে ওঠে বলে ও মনে করে। সামনের ছবির মহিলার শাড়ির গন্ধ এখনও যেন ও পায়, তিনি যেন ওর কাছেই আছেন।
রিমা ওর পাশে এসে বসে। "মন খারাপ কোরো না, আমি এই জন্যই আসতে চাইছিলাম না। চলো, খাবার রেডি হয়ে গেছে। রিভুকে ডেকে খেতে এসো।"
"কেন, রিভু কোথায়?", বাবান উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে।
"দেখো, কোথাও গিয়ে হয়তো ঘুড়ি ওড়াচ্ছে।", রিমা শান্ত গলায় বললো।
"ঘুড়ি ওড়াচ্ছে মানে! আমি তোমাকে কতবার বলেছিলাম, না কিনতে, তুমি তাও শুনলে না, আবার এখানেও সাথে করে নিয়ে এসেছে।"
"আহা! তুমি এত উত্তেজিত হচ্ছো কেন? ওই তো সামান্য একটা ঘুড়িই এনেছে, খেলুক না একটু নিজের মতো করে; এই খোলামেলা জায়গা তো আর কলকাতায় পাওয়া যায় না", রিমা অভিযোগের সুরে বললো।
বাবান ওর কথায় কান না দিয়ে এদিক-ওদিক দেখে রিভুকে না পেয়ে কী মনে করে দৌড়ে ছুটে চলে গেলো ছাদে। ভাঙা দরজা খোলাই ছিল। রিভু একমনে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, নীল রঙের ঘুড়িটা আকাশের নীলের সাথে মিশে গেছে একদম, আলাদা করে বোঝা যাচ্ছে না। বাবানও একভাবে ঘুড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে।
লাটাইটা ধরে ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে রিভু খোলা ছাদের একেবারে ধারে এসে পড়ে, আর তখনই 'বাপি' বলে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার।
বাবান তাকিয়ে দেখে রিভু পড়ে যাচ্ছে নিচে। যেমন করে পঁচিশ বছর আগে ও পড়ে যাচ্ছিলো…
"মা, বাঁচাও"
লাটাইটা ফেলে দিয়ে খোলা ছাদের ধার থেকে পড়ে যাচ্ছিলো বাবান।
ঠিক তখনই বিনীতাদেবী ছুটে এসে বাবানকে ছাদের ওপরে টেনে তুলতে গিয়ে নিজে পা পিছলে পড়ে গেলেন নিচে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথেই মারা যান, বাবানকে কোনো আত্মীয় নিজের কাছে রাখতে চায়নি, সবার সেই সম্পত্তির ওপর লোভ, এরপর অনাথ আশ্রমেই ওর বড় হওয়া। সেই থেকে ঘুড়ি আর নীল রঙের প্রতি একটা রাগ, বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে।
আজকেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি, কিন্তু বাবা হয়ে ও নিজের সন্তানকে বাঁচাতে পারল না, এইসব ভাবতে ভাবতে দেখতে পেলো, কোনো অদৃশ্য কিছু যেন রিভুকে ওপরে ঠেলে তুলে দিচ্ছে। রিভু ছুট্টে এসে জড়িয়ে ধরলো ওর বাপিকে। তবে কি?
মায়েরা বোধহয় এমনই হয়, চলে গিয়েও সন্তানের টানে, ভালোবাসার আশ্রয়ে ফিরে আসে। চিরকাল সন্তানের মঙ্গল করে যান।
বাবা-ছেলে দু'জনেই তাকিয়ে দেখলো, নীল রঙের ঘুড়িটা হাওয়ায় ভেসে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে ওপরের নীল আকাশে।