SUPRIYA MANDAL

Romance Tragedy Others

3  

SUPRIYA MANDAL

Romance Tragedy Others

প্রথম ভালোবাসা

প্রথম ভালোবাসা

10 mins
326



"কতক্ষণ এসেছিস?", শিল্পা পেছন থেকে পূজার ঘাড়ে হাত দিয়ে জিজ্ঞাসা করল। 

পূজা ওর ফোন দেখছিল, আচমকা ঘাড়ের কাছে কারোর স্পর্শ পেয়ে তাকিয়ে দেখল শিল্পা দাঁড়িয়ে। "এই তো মিনিট দশেক হবে, তোর জন্যই ওয়েট করছিলাম, বাকিরা ভেতরে আছে, চল্", উত্তর দিলো ও।

"চল্" বলেই শিল্পা পূজার কনুই ধরে সবুজ লন পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল।


ভেতরে বলতে একটা দারুণ তিনতলা রেস্তরাঁর মধ্যে ঢুকল ওরা। "গ্রিন অর্কিড", অনেকদিনের পুরোনো রেস্তরাঁ, প্রায় পঁচিশ বছর আগের। তখন অবশ্য অন্য নাম ছিল, "চাইনিজ় রেস্টুরেন্ট"। আকারে ছোট হলেও খুব ভিড় হতো, বিশেষ করে রবিবার, বিকেল থেকে শুরু করে রাত দশটা পর্যন্ত লোকে আসতো শুধু ওদের স্পেশ্যাল চাইনিজ় আইটেম খাবে বলে। এখন আমূল বদলে গিয়েছে চেহারা, চাকচিক্যে সেই পুরোনো রেস্তরাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, এমনকি নামটাও, কিন্তু খাবারের স্বাদ একই রয়ে গেছে। স্পেশ্যাল চাইনিজ়, এটাই এখানকার মাপকাঠি, আর তাই তো এখনও মানুষ ছুটে আসে। আগের থেকে আরো বেশি জনপ্রিয় হয়েছে এই রেস্তরাঁ আর মালিকও বদলে গিয়েছে; সেই কালের মালিকের ছেলে বর্তমান মালিক, সে তার বাবার ব্যবসাটা এখন সামলায়। 


পূজারা দরজা খুলে ঢুকে দেখল মোটামুটি সবাই এসে গেছে। 

"আরে আয় আয়, কতদিন পরে দেখা বল্ তো, কেমন আছিস তোরা?", রাজীব স্মিত হেসে জিজ্ঞাসা করল ওদের। 

"এই তো চলে যাচ্ছে, তুই বল্", পূজাও পাল্টা প্রশ্ন করল। 

"আমারও তাই রে, তোদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম কবে আবার সবাইকে একসাথে দেখতে পাব। তবে শিল্পা, তুই যার কথা ভাবছিস সে আর একটু পরেই এসে যাবে, আমাকে জানিয়েছে জ্যামে আটকে পড়েছে", শিল্পার এদিক ওদিক তাকানো দেখে রাজীব বললো। 


"কী যে বলিস" বলে একটু অপ্রস্তুত হাসি হাসলো ও। 


এর মধ্যে তৃণা, পাপিয়া, করবী, শান্তনু, উজ্জ্বল আরো সবাই এসে ওদের ঘিরে ধরেছে। প্রায় তেইশ বছর বাদে আবার একসঙ্গে দেখা চুরানব্বইয়ের ক্লাস ট্যুয়েলভের ব্যাচের, যদিও মাঝে মধ্যে দু'একজনের এর ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, কিন্তু একসাথে সেই ফেয়ারওয়েলের পরে আজকে; স্কুলের রিইউনিয়ন একবার হয়েছিল তবে ওদের গ্রুপের শান্তনু ইউএসএ থেকে আসতে পারেনি, করবীর হাজব্যান্ড অসুস্থ থাকায় ওউ পারেনি। অতএব আজকের দিনটা সবাই আগে থেকে ভিডিও কলে ঠিক করে রেখেছিল, আর এই রেস্তরাঁর সঙ্গে কৈশোরের যে স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাকে উপেক্ষা করে কোথায় আর যাবে, তাই এটাই ওদের মিটিং পয়েন্ট।


আজকের এই দিনটা কিন্তু আসলে রিইউনিয়ন নয়, দিন পনেরো আগে এমন একজন মারা যায় যাঁর মৃত্যুর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতেই ওদের সমবেত হওয়া। যে এই দিনটার প্রধান উদ্যোক্তা সে এইমাত্র এসে উপস্থিত হলো। সাদা ফুল স্লিভ শার্ট, ব্ল্যাক ট্রাউজ়ার আর রিমলেস চশমা পরে যখন দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলা বন্ধ করে ওর দিকেই তাকিয়ে থাকলো। রাজীব এগিয়ে গিয়ে ওর পিঠে হালকা চাপড়ে বাকিদের উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,"আমাদের গ্রুপের বহু প্রতীক্ষিত ব্যক্তি চলে এসেছে। প্রীতম, দ্য ফার্স্ট বয় অ্যান্ড লাস্ট বেঞ্চার"। ছেলেরা সবাই প্রীতমের কাছে গিয়ে হাত মেলালো। শিল্পার চোখ ওর চোখে পড়তেই দু'জনেই আলতো হাসলো, কো-এড স্কুল হওয়ার দরুন ছেলে, মেয়ে একইসঙ্গে পড়তো, আর শিল্পারও খুব ভালো লাগত ওকে। এখন যদিও এসব কিছুই আর নেই, তবুও একটা ভালো লাগা ওই আর কী।


প্রীতম ওর হাতে করে আনা একগোছা সাদা চন্দ্রমল্লিকার বোকেটা নিয়ে এগিয়ে গেল ওদের সামনে চেয়ারের ওপরে রাখা একটা ফোটোর কাছে, রজনীগন্ধার সাদা মালা আগে থেকেই ফ্রেমের ওপরে ঝুলছিল, জুতো খুলে হাঁটু গেড়ে বোকেটা বাড়িয়ে দিল ফোটোর ব্যক্তির দিকে, দেখলে মনে হবে যেন প্রোপোজ় করছে। ফোটোর মেয়েটা বড্ড ভালোবাসতো সাদা রঙের চন্দ্রমল্লিকা, স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে খোঁপার পাশে এই ফুল গুঁজে সে আসতো; তাই তো প্রীতম অর্ডার করে তোড়াটা বানিয়ে নিয়েছে, এই গরমে ওদের শহরে কোত্থাও পাচ্ছিল না এই ফুল, কিন্তু ওপরওয়ালা হয়তো চেয়েছিলেন শেষ উপহারটা যেন ও দিতে পারে, তাই একজনের কাছে বলতেই সে বেশি টাকায় এনে বানিয়ে দেয়। আর রাজীবকে বলেছিল ফোটো প্রিন্ট করিয়ে ফ্রেমে বাঁধাই করে নিতে। ফোটোটা অবশ্য একমাত্র প্রীতমের কাছেই ছিল, রাজীব ইমেইলে পেয়ে গিয়েছিল এক মাস আগে; তারপর সবার সাথে যোগাযোগ করে, সবাইকে খুঁজে একত্র করা। প্রীতম খুব চেয়েছিল ওর প্রথম ভালোবাসার শেষ কাজে ওর সেইসব দিনের সাক্ষী থাকা বন্ধুগুলোই যেন শুধু আসে। কিন্তু সেদিন তাড়াতাড়ি অত কম সময়ের মধ্যে কাউকে পায়নি, শ্রাদ্ধাদি ও নিজেই করেছে কিন্তু একটা দিন সবার কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছিল যাতে সবাই আসতে পারে তার প্রথম ভালোবাসার মানুষটাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মরণ করতে। জায়গাটা ও এটাই ঠিক করেছিল কারণ এখানেই তো সেই চন্দ্রমল্লিকাপ্রেমী মেয়েটা বাইশ-তেইশ বছর আগের প্রায় প্রতি উইকেন্ডে আসতো প্রিয় চাইনিজ় খেতে।

দেড় ঘণ্টার জন্য বেশি টাকা দিয়ে হলেও এই রেস্তরাঁর একটা ফ্লোর বুক করতে চেয়েছিল প্রীতম, কোনো কিছুই তো তাঁকে দিতে চেয়েও পারেনি, তাই রেস্তরাঁর সেকেন্ড ফ্লোরটা পেয়ে গিয়েছে রাজীবের সাহায্যে, ও এসে ম্যানেজারের সাথে কথা বলে সব ঠিক করে রেখেছে।

আজকে ওরা তাঁর প্রিয় চাইনিজ় অর্ডার করেছে, চেয়ারটার সামনে প্লেটটা রেখে নিজেরাও নিজেদের পছন্দমতো খাবার অর্ডার করলো। শুধু হাজার বলা সত্ত্বেও প্রীতম কিছু মুখে দিল না, হাঁটু গেড়ে মিনিট দশেক ফোটোটার দিকে চেয়ে বসে রইল, বাকিরা কেউ আর বিরক্ত করল না। এক ঘন্টা ওখানে কাটিয়ে যে যার মতো চলে যাওয়ার পালা, প্রীতম এসেছে সোজা মুম্বাই থেকে ফ্লাইটে, তারপর কলকাতায় নেমে গাড়ি করে ওর জন্মভূমি, ওর শহর হরিপুরে; ওকে ফিরে যেতে হবে আজকেই, ফেরার টিকিটও কাটা আছে।


হরিপুরও কত বদলে গিয়েছে, শহরটা তার পুরোনো রূপ ঝেড়ে ফেলে একদম ঝকঝক্ করছে, পুরোনো বাড়ির স্থানে গজিয়ে উঠেছে কত ফ্ল্যাট, মুদিখানা দোকান ভেঙে তৈরি হয়েছে মাল্টিপ্লেক্স, শপিং মল; চেনা শহরটাই কেমন অচেনা হয়ে গেছে। প্রীতমের বাবা, মা উভয়েই গত হয়েছেন, ওদের পৈতৃক বাড়ি তালা দেওয়াই পড়ে থাকে, ওউ এসে থাকে না, শেষ এসেছিল তাও হবে প্রায় বছর পাঁচেক আগে। মুম্বাইতেই এখন পাকাপাকিভাবে থিতু স্ত্রী স্নেহা আর একমাত্র মেয়ে রায়াকে নিয়ে কিওর অ্যান্ড কেয়ার ক্যান্সার হসপিটালের অঙ্কোলজিস্ট ডাঃ প্রীতম বসু।


একে অপরের থেকে বিদায় নিতে গিয়ে অনেকের চোখেই জল, পূজা তো রীতিমতো কাঁদছে।

"কবে যে আবার দেখা হবে, ভালো থাকিস রে তোরা সবাই" চোখের কোণে জল নিয়ে বললো উজ্জ্বল। "আমরা চাইলে আবার নিশ্চয়ই দেখা হবে, প্রতি বছর একবার করে এরপর থেকে মিট আপ করার চেষ্টা করব, কী বলিস?", রাজীব উত্তর দিল। 

"হ্যাঁ, অবশ্যই হবে, আর তাছাড়া সবার ফোন নাম্বার তো থাকলোই, আমি একটা গ্রুপ বানিয়ে তোদের অ্যাড করব। যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় নেই তারা সেখানে কথা বলব, ছবি শেয়ার করব", পূজা বেশ উৎসাহ নিয়ে বললো। এই ব্যাচের পূজা আর শিল্পার মধ্যেই যোগাযোগটা এখনও রয়েছে, সেই স্কুল লাইফের বেস্ট ফ্রেন্ড ওরা। 

শিল্পা একটু এগিয়ে গিয়ে প্রীতমের কাছে গিয়ে বললো,"ভালো থাকিস প্রীতম, যে যাবার সে তো যাবেই, তা ভেবে অকারণ কষ্ট পাস না, কোনো কিছুই আমাদের হাতে নেই। আমাকে বন্ধু মনে করলে যোগাযোগ রাখিস।"

প্রীতম শুধু হালকা হেসে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালো। একে একে সবাই চলে যেতে লাগলো, বাকি থাকলো রাজীব আর প্রীতম। রাজীবও একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললো,"আসি রে, তুই তো আমার বাড়িতে থাকবি না, এত করে বললাম। যাইহোক, সাবধানে যাস আর পুরোনো কথা বেশি মনে করবি না, এতে কষ্টটা আরো বাড়বে। যারা আছে তাদের নিয়েই সুখী থাকিস"।

"না রে, ফ্লাইট আছে, যেতেই হবে, পরে অন্য সময় ছুটিতে আসব। আর সবকিছু কি চাইলেও মুছে ফেলা যায়?"

"জানিনা রে। আমি তবে এগোলাম" 

"হ্যাঁ, তুই এগো, আমিও বেরিয়ে যাব", কথাগুলো বলে প্রীতম আর একবার দেখে নিল রেস্তরাঁটাকে। তারপর উঠে পড়লো দাঁড়িয়ে থাকা ফোর হুইলারে। শহরটাও যেন ওদের চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে বলে উঠলো, আবার এসো। সত্যিই তো, কত সুখ, দুঃখের স্মৃতি মিশে আছে এই শহরের আনাচে কানাচে। 


ড্রাইভারের পেছনের সিটে বসে কাঁচটা নামিয়ে দিল, এক দমকা হাওয়া এসে চোখে মুখে লেগে যেন কারোর ঠান্ডা হাতের পরশ দিয়ে গেল। সব ভুলেই গিয়েছিল প্রীতম, যদি না এক মাস আগে তাঁকে আবার দেখত…।


সেদিন হসপিটালে ওর চেম্বারে পেশেন্টের ভিড়, পরপর আসছে দেখাতে। এরপর অ্যাসিস্ট্যান্ট একজনের নাম ধরে বাইরে ডাকতেই পেশেন্ট এলো, সাথে একজন মহিলা। প্রীতম তখনও চিনতে পারেনি, কিন্তু কথা বলার সময় তাঁর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ করেই বুকে কিসের একটা ধাক্কা লাগল, পেশেন্টের নামটাও…অস্ফুটে বলে ওঠে,"পৃথাদি"। রোগিনীটি চুপ করেই বসেছিলেন, পাশের মহিলাটি বাঙালি ডাক্তার জেনে বাংলাতেই বলে যাচ্ছিলেন,"এখন আপনিই শেষ ভরসা, আশা নেই জানি তবুও যে কয়েকদিন বাঁচানো সম্ভব…"। 

প্রীতম বলে উঠল,"পৃথাদি, আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি, আমি প্রীতম"। 

পৃথাদিও অনেকক্ষণ ভালো করে প্রীতমের মুখমণ্ডল পর্যবেক্ষণ করার পরে বললেন,"একেবারেই চিনতে পারিনি, কত বড় হয়ে গেছিস, কত নাম হয়েছে তোর, ভালো আছিস তো?"

চেম্বারের মধ্যে থাকা বাকিরা তখন ওদের মুখের দিকে চেয়ে। পৃথা নামের ভদ্রমহিলাটি তাঁর পাশের মহিলাকে বললেন,"ও হচ্ছে প্রীতম, আমার একসময়ের খুব প্রিয় ছাত্র, হরিপুর হাই স্কুলের। তুই যে চিনতে পেরেছিস আমাকে শিক্ষিকা হিসেবে এটাই বড় প্রাপ্তি"।

প্রীতম ততক্ষণে সমস্ত রিপোর্ট চেক করে দেখে যা বোঝার বুঝে নিল, তাঁকে অ্যাডমিট করানোর জন্য যা যা দরকার সঙ্গের মহিলাকে বলে দিল।


ক্যান্সারের ফাইনাল স্টেজে এসে ওর কাছে উপস্থিত হয়েছে পৃথাদি, সেই পৃথাদি যাঁকে রোজ একবার দেখার জন্য স্টাফ রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত, বাকি টিচাররা দাঁড়ানোর কারণ জিজ্ঞাসা করলে এটা সেটা বলে চালিয়ে দিত। "আজ তিনি এসেছেন আমার কাছে, তিনি এসেছেন, অবশেষে", মনের মধ্যে বিড়বিড় করে বলেছিল প্রীতম। 

পৃথাদির সাথে যিনি এসেছিলেন প্রীতম জানতে পেরেছিল উনি পৃথাদির দিদি। আর কেউ আসেনি কেন জিজ্ঞাসা করাতে জানতে পারল, আর কেউই নেই। কিন্তু ওরা স্কুল পাশ করার পরের বছরেই ইংরেজির শিক্ষিকা পৃথাদির সঙ্গে স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক সুদীপ স্যারের বিয়েটা যে হয়েছিল, তা রাজীবের থেকে জানতে পেরেছিল প্রীতম। সেই সময়টা কেমন একটা কষ্ট পেয়েছিল যা একজন সদ্য বয়ঃসন্ধি পেরোনো ছেলেকে ভেতরে ভেতরে অস্থির করে তুলেছিল, বাইরে যদিও সে শান্ত, স্থির।


পৃথাদিকে দেখার পরেই মনের টাইম মেশিনে চড়ে ফিরে গিয়েছিল ফেলে আসা দিনগুলোতে, হরিপুর হাই স্কুলের ইলেভেনের সায়েন্স ক্লাসে। 

তখন সবে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ইলেভেনে উঠেছে, স্বাভাবিকভাবেই বড় হয়ে ওঠার প্রাথমিক ছাড়পত্র না পেলেও সাবালকত্বের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল ছেলে, মেয়েগুলো। জীবনের রঙিন দিন, রঙিন বসন্ত শুরুর নতুন অধ্যায়টা যেন হুড়মুড়িয়ে এসে পড়েছিল প্রীতমের কাছে। বরাবরই পড়াশোনায় ভালো, মাধ্যমিকেও দারুণ রেজাল্ট করে হরিপুরের বিখ্যাত নিজের বাংলা মিডিয়াম হরিপুর হাই স্কুলেই সায়েন্স নিয়ে ভর্তি, ডাক্তার হবার তীব্র বাসনা। মুখচোরা ছেলেটা যে প্রেমে পড়ে হাবুডুবু খাবে সেটা ওর বন্ধুরাও টের পায়নি।

ওদের স্কুলে সে বছর জয়েন করলেন বছর চব্বিশের পৃথা সরকার, ইংরেজি বিষয়, লম্বা, ছিপছিপে, ফর্সা দেখতে। প্রথম দিন তিনি আকাশি রঙের তাঁতের শাড়ি পড়ে এসেছিলেন। প্রীতমের সেই ভালো লাগা শুরু; ইংরেজি, সাহিত্য এসব ভালো না লাগলেও শুধুমাত্র পৃথাদিকে দেখবার জন্যই ওঁর ক্লাসটা করত। পৃথাদির পড়া বোঝানোর সময় হাঁ করে তাকিয়ে দেখত, উনি পড়াতে পড়াতে এরকম করে তাকিয়ে থাকা দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়তেন, তারপর পড়া জিজ্ঞাসা শুরু করে দিতেন। স্কুলের স্পোর্টসে, বা বার্ষিক অনুষ্ঠানে পৃথাদির খোঁপায় সাদা চন্দ্রমল্লিকা লাগানো যেন নির্দিষ্ট ছিল। ভারী সুন্দর দেখাতো তাঁকে। পরে যখন রাজীব, করবীরা জানতে পেরেছিল তখন বেঞ্চের ওপরে বদমাশি করে ওরা 'প্রীতম-পৃথা', 'পিপি', নামের আদ্যক্ষর দিয়ে 'পপ' এসব লিখে রাখত। সেই নিয়ে কী রাগারাগি। স্কুল ছুটি হওয়ার পরে ওঁকে ফলো করতে করতে ভাড়া বাড়িটা পর্যন্ত দেখে এসেছিল প্রীতমরা। তারপর এক বিকেলে সুদীপ স্যারের সঙ্গে রেস্তরাঁর দিকে যেতে দেখতে পায়। পৃথাদির চোখে চোখ পড়তেই সাইকেল ঘুরিয়ে চলে আসে। এর মধ্যে স্কুলে কানাঘুষো শুনতে থাকে সুদীপ স্যারের সঙ্গে সম্পর্কের। প্রীতম নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি, কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। অবশ্য সবার সামনে নয়, বাথরুমে বন্ধ দরজার পেছনে। ষোলো বছরের একটা ছেলে মনে আঘাত পেলে ভেঙে তো পড়বেই। এরপর বেশি করে পড়াশোনাকে আঁকড়ে ধ'রে এই শহর থেকে দূরে চলে যেতে চায় ও। পেরেওছিল, জয়েন্টে ভালো র‌্যাঙ্ক করে কলকাতায় মেডিকেলে চান্স পেয়ে এখন বিখ্যাত অঙ্কোলজিস্ট। পৃথাদি বারবার বলতেন, পড়াশোনাটা ঠিক রাখতে, বাকি কাজের জন্য পরে অনেক সময় আসবে। তিনি বোধহয় বুঝতে পেরেছিলেন প্রীতমের আচরণ, ওর মনস্তত্ত্ব। কিন্তু ছাত্রের সঙ্গে শিক্ষিকার এই সম্পর্ক কোনোদিনই সম্ভব নয় জেনেই তিনি ওর ভবিষ্যতে ভালোর জন্যই প্রীতমকে শাসনের ছলে বোঝাতে চেষ্টা করেন। প্রীতমও শহর ছাড়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে সব ভুলে গিয়েছিল। স্নেহার সাথেও দশটা বছর বেশ কাটিয়ে দিল।


পৃথাদির সঙ্গে ট্যুয়েলভের ফেয়ারওয়েলে শেষ দেখা, তারপর আবার এই হসপিটালে। পৃথাদি ভর্তি হওয়ার পরে তিন সপ্তাহ মতো সময় দিয়েছিল প্রীতমকে ওঁর কাছাকাছি থাকার। প্রীতম রাউন্ডে এসে দেখে তো যেতই, তাছাড়াও নার্সকে বলে বিশেষ খেয়াল রাখত, একটা সিঙ্গল কেবিনেরও ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। পৃথাদির দিদির থেকে জেনেছিল সন্তান জন্মদানে অক্ষম পৃথাদি আর বদমেজাজি সুদীপ স্যারের ডিভোর্সের ঘটনা।

একদিন দুপুরে যখন পৃথাদির রিপোর্ট আর প্রেসক্রিপশন দেখছিল চেম্বারে বসে তখনই নার্স এসে খবর দেয় সব শেষ। ভগবান এখানেও হয়তো চেয়েছিলেন শেষদিনে প্রীতম যেন ওঁর আশেপাশে থাকে। অনন্তের পথে যাওয়ার দিন তিনেক আগে পৃথাদি প্রীতমকে ডেকে শুধু বলেছিলেন,"সব পাওয়া হয়ে গেলে সেই আনন্দটা আর থাকে না; কিছু অপ্রাপ্তি, কিছু অপূর্ণতা থাকে যা আমাদের জীবনটাকে অন্যরকমভাবে উপভোগ করতে শেখায়। তাই সবকিছুর হ্যাপি এন্ডিং না থাকাই শ্রেয়। ভালো থাকিস, সুখে সংসার করিস"। পৃথাদি তাঁর প্রতি প্রীতমের ভালোলাগার ব্যাপারটা জানতেন বলেই হয়তো এরকম বলেছিলেন। এছাড়াও ও যে বিয়ে করেছে সেটাও জানতে পেরেছিলেন হসপিটালে থাকার সময়েই, মাঝে মাঝে খোঁজ নিতেন ওর স্ত্রী, মেয়ের। প্রীতম আপ্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেনি ওর প্রথম ভালোবাসাকে। 

সবাই যাওয়ার সময়ে বলে যায় ভালো থাকতে কিন্তু এত ভালো, সুখী পরিবার পেয়েও ঠিক ভালো থাকাটা আর হয়ে ওঠেনা। "আকাশের তারাগুলোর কোনটা আপনি, পৃথাদি?" চল্লিশে পৌঁছেও এইসব ছেলেমানুষি প্রশ্নেরা মাথার মধ্যে জড়ো হয়। পৃথাদি একটা সময়ে খুব আসতেন এই রেস্তরাঁতে সুদীপ স্যারের সাথে, প্রায় প্রতি রবিবার চাইনিজ় খেতে, একান্তে দু'জনে সময় কাটাতে; কানের ঠিক ওপরেই সাদা রঙের চন্দ্রমল্লিকা গোঁজা থাকত, খুব পছন্দের ফুল ছিল ওঁর।



"স্যার, এয়ারপোর্ট এসে গেছে। স্যার, স্যার।" 

ড্রাইভারের ডাকে সম্বিত ফিরল প্রীতমের, ডাঃ প্রীতম বসুর। "ওহ্, এসে গিয়েছি, এত তাড়াতাড়ি" বলে গাড়ি থেকে নেমে সুদূর সাগরপারের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। হরিপুর, মুম্বাই সব জায়গাতেই ছড়িয়ে আছে টুকরো টুকরো স্মৃতি, তাদের কুড়িয়ে সঞ্চয় করে রাখতে হবে যে, শেষ বয়সের জন্য, তখন ঝাঁপি খুলে আবারও উঁকি দিয়ে দেখা যাবে এই দিনগুলোকে।


কিছু সম্পর্ক এভাবেই রয়ে যায়, তাদের মিলতে নেই। হোক্ না এ এক নিষিদ্ধ প্রেমের কাহিনী, অবৈধ, অনৈতিক, কিন্তু মনের তো কোনো দোষ নেই, সে বাধা মানতে চায় না, কোনো নীতিকথাও শুনতে চায় না। না থাকুক কারোর সমর্থন, তবুও প্রথম ভালোবাসার স্পন্দনে স্পন্দিত এক ষোড়শ বালকের হৃদয়ের কথা শোনার জন্য কিছু মানুষ অবশ্যই থাকবে এ বিশ্বাস রয়েছে, কারণ তারাও যে তাদের প্রথম ভালোবাসাকে কোথায় কিভাবে হারিয়ে ফেলেছে আজ আর মনে করতে পারে না। অসমাপ্ত ইচ্ছেরা থেকে যাক্ এভাবেই আকাশকুসুম কল্পনায় বিলীন হয়ে, কারোর চোখের জলে, গল্পের পাতায়, মনের গোপন কোনায়।



-সুপ্রিয়া মণ্ডল 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance