SUPRIYA MANDAL

Tragedy Thriller Others

3  

SUPRIYA MANDAL

Tragedy Thriller Others

ডায়েরি

ডায়েরি

6 mins
179



"অন্ধকার কেটে গিয়ে আলোর দেখা মিললে, বা বন্ধ্যা, ঊষর মাটিতে কোনো অলীক কারণে সবুজ প্রাণ জেগে উঠলে যে'রকম আনন্দ হয়, ঠিক তেমনই হয়েছিল আমারও। বহুদিনের হাজারো তপস্যা, মানত, এ ডাক্তার ও ডাক্তার দেখানোর প্রায় দশ বছর পরে আমার মধ্যে সঞ্চার ঘটেছিল নতুন প্রাণের। বন্ধ্যা, বা বাঁজা শব্দটা শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হওয়া কান যেন এক আকাশ শান্তি পেয়েছিল। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে সবাই হঠাৎ করেই যেন রাতারাতি ভাল হয়ে গেল, রোজ খোঁজ নিত আমার স্বাস্থ্যের। দশ মাস পরে এল সেই শুভ মুহূর্ত। আমার কোল আলো করে এল সে, এক ছোট্ট রাজপুত্র, খুব কষ্ট করেই এল। কিন্তু আর একজনের আসার কথা থাকলেও সে আর এল না। হামাগুড়ি দিয়ে আধো আধো বুলিতে মা, বাবা ডাক যে এত মধুর হতে পারে তা দেরিতে হলেও জানলাম।"


ডায়েরিটা বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল সুদীপ। একটা পুরোনো ডায়েরি, ওর মায়ের লেখা। "এ'সব মা লিখেছে! হাতের লেখা তো তাই-ই বলছে" নিজের মনেই বলল সুদীপ। সুদীপের বয়স বছর ত্রিশ হবে, এখনও বেকার। বাবা মারা গিয়েছে প্রায় বছর পনেরো আগে। ওর বাবার মারা যাওয়াটা ছিল রহস্যজনক; সুদীপ আর ওর মা একদিন বাড়িতে ছিল না, কোথায় গিয়েছিল, ফিরে এসে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়। পুলিশ এসে তদন্ত ক'রে আজ পর্যন্ত কিছু উদ্ধার করতে পারেনি। অবশ্য কিছু ব্যাপার নিয়ে সন্দেহের তীর সুদীপের মায়ের দিকেই সবাই করেছিল। ওর মায়ের অস্বাভাবিক আচরণ এবং অসংলগ্ন কথাবার্তা আর সুদীপকে দেখতে পেলেই মারতে যাওয়া। ঘটনা আরো জটিল হল যখন মাস ছয়েক পরে সুদীপ সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিল। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরাই ওর মা-কে অ্যাসাইলামে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। অবশ্য বর্তমানে সুদীপদের সঙ্গে আর কারোরই তেমন যোগাযোগ নেই, কেউই আর কোনো খবর রাখে না, সম্পর্কও নেই সে'রকম। সুদীপ বাড়ি থেকে বেরোয়ও খুবই কম, ও যে বাড়িতেই রয়েছে তাও বোধহয় ওর পাড়ার লোকেরা জানে না।


ডায়েরিটা পেয়ে প্রথম পাতাটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে একটু থামে সুদীপ। "মা তাহলে ডায়েরি লিখত? সবকিছু তাহলে এতেই লেখা আছে!" বলেই আবার বন্ধ ডায়েরির পাতা খুলে পড়তে শুরু করল। পরপর কয়েকটা পাতায় নিজের জীবনের সুখ-দুঃখ মা লিপিবদ্ধ করেছে। এরপর একটা লাইনে গিয়ে আটকে গেল সুদীপ।


"আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি ও এ'রকম হবে! আজকে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতে পারতাম না। কেউ কিভাবে নিজেকেই ক্ষত-বিক্ষত করতে পারে! কী থেকে যে কী হয়ে গেল বুঝতে পারছি না।"


"মা কার কথা বলছে? মা কি কিছু জানে কোনো ব্যাপারে?" বিড়বিড় করে বলে উঠল সুদীপ। "নাহ্, আজকেই ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলতে হবে, আর মায়ের শরীরটাও খুব ভাল যাচ্ছে না।"



পরদিন দুপুরে—


"হ্যালো"

"হ্যালো, ডাক্তারবাবু, আমার মায়ের জন্য ফোন করেছি আপনাকে, এর আগেও করেছিলাম। কিছু বুঝতে পারলেন?"

"দেখো, আমি তো আগেই বলেছি যে, এই ধরনের রোগীরা একটুতেই উত্তেজিত হয়ে পড়ে, হঠাৎ করে রেগে যায়, এমনকী কাউকে মারতে যেতেও একবারের বেশি ভাবে না, আবার পরক্ষণেই হাসতে থাকে এমনভাবে যেন কিছুই হয়নি। এদের চোখে চোখে রাখতে হবে, আর তুমি তো সেটা বেশ ভালই বুঝতে পারছ, নিজের মায়ের যত্ন নিচ্ছ। ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিস্অর্ডারের পেশেন্টদের ট্রিটমেন্ট এ'রকমই সাইকোথেরাপির মাধ্যমে এবং বাড়িতেই বাড়ির লোকদের সাহচর্যেই ভাল হয়। তোমার মা-কে একদিন চেম্বারে নিয়ে এসো না, সামনাসামনি দেখেই নাহয় কথা বলব।"

"ঠিক আছে, ডাক্তারবাবু, নিয়ে যাব, নিয়ে যাব, আমি এখন রাখছি। মা উঠে পড়বে ঘুম থেকে। মায়ের জন্য খুব দুশ্চিন্তায় আছি।"

"আরে, অত চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।"


ফোনটা রেখে সুদীপ ঘরটার দরজা লাগিয়ে সিঁড়ি বেয়ে একটা অন্ধকার ঘরে ঢুকল, যেখানে ওর মা আছে, দোতলার উত্তর দিকের একটা ছোট ঘরে, দরজা, জানালা সব বন্ধ, সূর্যের আলো এই অংশে প্রবেশ করতে পারে না। সুদীপ ধীর পায়ে ঢুকে দেখল, মা এখনও ঘুমিয়ে আছে। মায়ের মাথার কাছে আস্তে করে একটা টুল টেনে বসল। তারপর একদৃষ্টে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, একটু উঠে গিয়ে মায়ের মাথায়, কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। মেডিক্যাল রিপোর্টে ওর মা সাইকিয়াট্রিক পেশেন্ট। সুদীপ মা-ভক্ত সন্তান, মায়ের জন্য ও নিজের ইচ্ছা, সুখ সব বিসর্জন দিয়েছে।


"মা, তুমি আবার এ'রকম করছ? তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে? তুমিও আমাকে চিনতে পারছ না?" শান্ত গলায় বলল সুদীপ।


সুদীপ ওই ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে চলে এল। দরজার ছিটকিনি তুলে দিয়ে টেবিলের কাছে একটা চেয়ার টেনে বসল। তারপর ড্রয়ার থেকে বের করল সেই ডায়েরিটা, ওর মায়ের লেখা। সন্ধ্যা নেমে আসছে নিঃশব্দে, একটা নিস্তব্ধতা ঘিরে রেখেছে সুদীপ, ডায়েরি আর ওর চারপাশের বদ্ধ পরিবেশকে। ডায়েরির একটা পৃষ্ঠায় গিয়ে আবারও থেমে গেল ও।

"আমি পাগল, আমি উন্মাদ? আমাকে বাড়িতে রাখা যাবে না? বানিয়ে বলা আমার নামে? তোকে চিনতে আমার আর বাকি নেই। তুই আমার চোখের সামনে থেকে সরে যা, আমাকে একটু শান্তি দে। ওর বদলে তুই যে কেন মরলি না! আমার সারাজীবনের আফশোস তোর মত শয়তানের সবকিছু জেনে গিয়েও চেপে যাওয়া। একদিন সত্যিটা বলে দেব সবাইকে, সব্বাই জানতে পেরে যাবে।"


"কোন্ সত্যির কথা বলছে মা?" নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করল। "আজকে ডায়েরিটা শেষ করতেই হবে, কোনো সত্যি, কোনো ঘটনা যদি জানা যায়, যদি ডায়েরিটা এমন কারোর হাতে পড়ে যে আমাদের ক্ষতি করেছে, বা করবে তাহলে বড় বিপদ মায়ের। এতে তো সত্যির দলিল লেখা আছে" বলেই পড়তে শুরু করল।


"ও পাগল। ওর মানসিক সমস্যা আছে। ও পাগল না হলে নিজের বাবাকে অতটুকু বয়সে কেউ খুন করে? ওর বদলে সবাই আমাকে জোর করে পাঠাল অ্যাসাইলামে। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করল না।"

সুদীপ নিশ্চুপ, নির্লিপ্ত; কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে ডায়েরির পাতাগুলো আবার ওল্টাতে থাকল।

"ভগবানের যে কী উদ্দেশ্য ছিল, মেয়েটা গর্ভেই চলে গেল, উনিও চলে গেলেন, আর আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তিলতিল ক'রে কষ্ট পাওয়ার জন্য। এর থেকে আমাকে মেরে ফেলতে পারতেন।"


প্রায় দু'ঘন্টা ধরে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা পড়তে পড়তে এক সময়ে এসে থামল, শেষ লাইনে একজনের নাম, সুদীপের চোখ-মুখের ফ্যাকাশে রং বদলে উত্তেজনায় ফুটে উঠে টকটকে লাল। ডায়েরিতে আর কিছু লেখা নেই, এখানেই সমাপ্তি।


ডায়েরিটা বন্ধ করে হাতে নিয়ে দরজা খুলে ও বেরিয়ে গেল। পা টিপে টিপে আবার ওর মায়ের ঘরে গিয়ে সুইচ অন করল, কম পাওয়ারের একটা হলুদ আলোর বাল্ব জ্বলে উঠল।


"এখনও মা ঘুমোচ্ছে। কতক্ষণ আর এভাবে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ে থাকবে তুমি?"


সুদীপ ডায়েরিটা বিছানায় রেখে এগিয়ে গিয়ে ঘুমন্ত মা-কে ডেকে তোলার চেষ্টা করতে লাগল। সুদীপ কাছে গিয়ে ওর মা-কে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে আওয়াজ করে কাঁদতে লাগল, তারপর হঠাৎই থেমে গেল।


"এ কী! মা কোথায় গেল? এখানেই তো ছিল।" বলার পরেই সুদীপ খুব সন্তর্পণে ঘরে ঢোকার ঠিক বাঁ দিকের দেওয়ালের দিকে এগিয়ে গেল। দেওয়ালে টাঙানো পুরু ধুলোর আস্তরণ জমা, অনেকদিনের বদল না-হওয়া শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ফুলের মালা ঝোলানো এক মহিলার ঝাপসা সাদা-কালো ফোটোর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, "তুমি আবার আমার সাথে লুকোচুরি খেলছ? অনেকদিন খেলা হয়নি। তুমি যেখানেই লুকিয়ে থাকো না কেন, তোমাকে আমি ঠিক খুঁজে বার করব, মা।"



মায়ের যাতে ঘুম ভেঙে না যায় তাই আস্তে এসে খাটের ওপরে একটা নোংরা ছেঁড়া পাশবালিশকে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে "মা, মা" বলে কাঁদতে লাগল আবার। ডায়েরিটা পাশ থেকে তুলল। তারপর একদম শেষ পৃষ্ঠায় গিয়ে একটা শব্দের ওপরে ডান হাতের তর্জনী ক্রমাগত ঘোরাতে থাকল। ওর ভ্রু জোড়া যেন বিরক্তিতে কুঁচকে যাচ্ছে, কান দু'টোও যেন রাগে লাল হয়ে যাচ্ছে।


"তুমি আমার নামটা কেন লিখেছ?" সুদীপ প্রশ্ন করল।

"হা হা হা হা" সুদীপ হেসে উঠে বাঁকা চোখে তাকিয়ে আবার বলল, "আমার কথা লিখেছ কেন? সত্যি জানাবে সবাইকে? আ আ আমি পাগল? হা হা হা হা।"


কথাগুলো বলেই সুদীপ তাড়াতাড়ি করে ডায়েরিটা একরকম বগলদাবা করে দরজা বন্ধ করে ছুট্টে নিচে চলে এল। তারপর বহু পুরোনো ময়লা পড়া তারকাটা একটা ল্যান্ড ফোনের রিসিভার তুলে কানে ঠেকিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ভয় পাওয়ার মত করে বলতে আরম্ভ করল, "হ্যা, হ্যালো, ডাক্তারবাবু"

"হ্যালো"

"আমার মায়ের জন্য ফোন করেছিলাম আপনাকে, এর আগেও করেছি। কিছু বুঝতে পারলেন?"

"তোমাকে তো সব বলেইছি"

"..."

"..."


বেশ অনেকক্ষণ ধরে নিজের সাথে নিজের বার্তালাপ চলল।

 

এরপর ফোনটা রেখে দিয়ে সুদীপ নিজেকে নিজেই আঘাত করতে থাকল, নিজের মাথার চুল টেনে টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করতে লাগল। তারপর হিংস্র পশুর মত প্রচণ্ড রাগে ডায়েরিটা ছিঁড়ে ফেলে ছেঁড়া টুকরোগুলোকে নিয়ে রান্নাঘরে এসে ওভেনে জ্বালিয়ে দিল। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল একটা গোপন সত্যি। সুদীপ লক্ষ্য করলে দেখতে পেত, ডায়েরির সবটা পুড়ে গেলেও শুধু একটা অংশ অক্ষত অবস্থায় রয়ে গেল, সেটা কয়েকটা লাইন— "ও একটু বড় হলে জানতে পারলাম ও ডিসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিস্অর্ডারের পেশেন্ট, কাউকে বলিনি যদি এই নিয়ে কেউ মজা করে ওর সাথে। আরো ভাল ডাক্তার দেখাব ওকে, আমার সুদীপ ঠিক সুস্থ হয়ে উঠবে। আমি…"


একটা দমবন্ধকর গন্ধ, কাগজের ছাই উড়ে বেড়াতে লাগল ঘরময়। সুদীপের স্থিরদৃষ্টি তখনও জ্বলন্ত ওভেনে পোড়া ডায়েরির দিকেই।








Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy