Partha Pratim Guha Neogy

Abstract Romance Others

4.0  

Partha Pratim Guha Neogy

Abstract Romance Others

নিঃসঙ্গতার আশীর্বাদ

নিঃসঙ্গতার আশীর্বাদ

6 mins
506


মানুষের জীবন বড় অদ্ভুত - সে নিজেই নিজেকে পূর্ণ ভাবে জানেনা, আজ যে জিনিস তার কাছে মূল্যহীন মনে হয় সময়ের পরশ কাঠির ছোঁয়ায় সেটাই তার মনজুড়ে থাকে। তাই সময় আর ভালোবাসা - দুইটিই খুবই শক্তিশালী প্রভাবক। প্রতি সপ্তাহের সোমবার আউটডোরে ভিড়টা একটু বেশিই থাকে। সেই ভিড় ঠেলে নিজের রুমে ঢুকতে গিয়ে সেদিন প্রথম দেখেছিল শ্যামলা মেয়েটিকে –‌ হুইল চেয়ারে একটি ছেলেকে নিয়ে শান্ত পদক্ষেপে,অথচ দুশ্চিন্তার প্রলেপ মেখে এগিয়ে যাচ্ছিল অনকোলজি ডিপার্টমেন্টের দিকে। এই হসপিটালের বড় ভয়ানক বিভাগ এই অনকোলজি বিভাগ। এখানে কত শত নারী-পুরুষের উদ্বিগ্ন,শোকাতুর, মুমুর্ষু চেহারা প্রতিদিন অর্জুন প্রত্যক্ষ করে এই হাসপাতালে,তার ইয়ত্তা নেই। তাহলে কী এমন বিশেষ ছিল মেয়েটির মধ্যে!... তা হয়তো অর্জুন নিজেও জানে না।


হুইলচেয়ারে বিবর্ণ চেহারার যুবকটি সম্পর্কে মেয়েটির ঠিক কে,তা দেখে বোঝা কখনোই সম্ভব নয়,তবে আপাত দৃষ্টিতে ঘনিষ্ঠ কেউ নিশ্চয়ই। এরপর আরো বেশ কয়েকবার মেয়েটিকে হাসপাতালে ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে এদিক ওদিক, কখনও রিসেপশনে,কখনও মেডিক্যাল স্টোরে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছে। বাইশ/তেইশ বছরের মেয়েটার ছিপছিপে সাদামাটা শ্যামলা চেহারায় চোখটা খুব মায়াবী আর উজ্জ্বল যেটা অন্য মানুষকে খুব আকর্ষণ করে । যেতে আসতে,যতবারই মেয়েটির বেখেয়ালী দৃষ্টি অর্জুনের দিকে পড়েছে, ভাবের রসায়নে যেন ছিটিয়ে গেছে কয়েক ফোঁটা অনুঘটক.. অর্থাৎ অর্জুনের ঘুমন্ত মনটাকে আন্দোলিত করে দিয়ে গেছে। কিন্তু মেয়েটি ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে একজোড়া চোখ প্রতিদিন ওকে খুঁজে ফেরে এই হাসপাতাল চত্বরটার ইতি-উতি।

সেদিন ইন্ডোরের পুরুষ ওয়ার্ডে রাউণ্ড দেওয়ার সময় মেয়েটির দেখা পেল আবারও অর্জুন , একটা আকাশনীল রঙা সালোয়ার কামিজে ধীর পায়ে লম্বা করিডোরটা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল সিঁড়ির অভিমুখে। পোস্ট অপারেটিভ রুমে একশো সাত নাম্বার বেডে ছেলেটি ভর্তি আছে। হসপিটালের তথ্য বলছে ছেলেটির নাম প্রিয়রঞ্জন ,গলার ক্যানসারের পেসেন্ট, থার্ড স্টেজ। দুদিন আগেই সার্জেন ডক্টর চ্যাটার্জী ওর অপারেশন করেছেন।


***


হাসপাতালের ঠিক সামনের চায়ের দোকানটায় দাঁড়িয়ে তখন চা খাচ্ছিল মেয়েটা। পিঠে সেই কালো ব্যাগটা,যা ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী। ভিজিটিং আওয়ার শুরু হতে এখনও আধ ঘন্টা বাকি।


--দাদা এককাপ কড়া করে..

অর্জুন মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে দোকানিকে আওয়াজ দিল। দোকানি জানে ডাক্তারবাবু কড়া দুধ চা ছাড়া খান না।


--আপনি প্রিয়র বাড়ির লোক তো? নিজের মনের চাহিদা দূর করার জন্য মেয়েটির সাথে আলাপ জমাতে চেষ্টা করে অর্জুন । মেয়েটা প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেও, পরে সম্মতি জানায়।অর্জুন বলে, --কাল/পরশু ওকে ছেড়ে দেওয়া হবে।

মেয়েটি নিরুত্তর।

--আপনি কে হন প্রিয়র?

--বন্ধু ।

বলে এবার একটু ইতস্তত বোধ করে মেয়েটি।


এই উত্তরটা অপ্রত্যাশিত ছিল,একদমই প্রস্তুত ছিলনা অর্জুন …ভেবেছিল মামা,কাকা,দাদা এমনই কোন আপনজন হবে হয়তো। বন্ধু শব্দটা শুনে কেমন যেন বুকে একটা মোচড় অনুভব করল,আর কথা বাড়াতে ইচ্ছা হল না।


***


এর মধ্যে মাঝখানে অতিক্রান্ত হয়েছে বেশ কয়েকটা দিন। মেয়েটার সাথে অর্জুনের আবার একদিন দেখা হল হাসপাতালে ঢোকার মুখে। খোঁজ নিয়ে জানল প্রিয়র কেমোথেরাপি চলছে। মেয়েটি বেশ গম্ভীর প্রকৃতির,বেশি কথা খরচ করেনা। এক ডাক্তারের এতটা কৌতুহল দেখানো বা যেচে খোঁজ খবর নেওয়াটা কি ঠিক দেখাচ্ছে?!.. অতশত না ভেবে শুধুমাত্র মনের তাগিদে মেয়েটির অন্তঃস্হলের গভীরে ডুব দিতে চাইছিল অর্জুন , হয়তো কিছুর নাগাল পাওয়ার আশায় ।


এরপর থেকে প্রায়শই দেখা হতে থাকে ঐ হাসপাতাল চত্বরেই,কথা হতে থাকে নানান বিষয়ে। ক্যান্টিনে চা আর স্যাণ্ডুইচ খেতে খেতে, কখনও বা রাস্তার চায়ের দোকানে আলাপচারিতার সাথে বাড়তে থাকে সখ্যতা।


মেয়েটির নাম বিজয়িনী, সবাই ওকে জয়ী বলে ডাকে আর প্রিয় ওর প্রেমিক। খুব ছোট থেকেই ওরা একে অপরকে চেনে,তারপর সেই বন্ধুত্ব থেকে জন্ম হয় প্রেম। সব ঠিকঠাকই চলছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই এই রোগটা যেন সবকিছু ওলোট-পালোট করে দেয়। জয়ী তখন মাস্টার্স করছে আর প্রিয়র ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল ইয়ার। প্রিয়র বাবা নেই, বিধবা মায়ের পেনশনেই সবটা চলে।তবে এ রোগের যা খরচ! কতদিন কিভাবে চালাতে পারবে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।..জয়ীর মুখেই সব শোনা অর্জুনের। আজকাল জয়ী অনেকটাই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে অর্জুনের সাথে কথা বলতে। অর্জুনের কাছে খোলামেলা ভাবে নিজেদের সমস্যাগুলো মেলে ধরতে আজকাল আর কুন্ঠাবোধ করে না,বরং সব কথা শেয়ার করতে পেরে খানিক স্বস্তি পায়।


অর্জুন বেশ বুঝতে পারছে মেয়েটার প্রতি দিন-দিন ও বেশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। ওর মত একটা উন্নাসিক, আত্মম্ভরিতা সর্বস্ব ছেলে কিভাবে একটা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের অতি সাধারণ মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে!..ভাবলে নিজেরই অবাক লাগে ওর। আসলে ভালবাসায় মেয়েটার সমর্পণই ওকে সাধারণের গণ্ডি পেড়িয়ে অসাধারণ করে তুলেছে....সেটাই হয়তো অর্জুনকে নাড়া দিয়েছে। বর্তমানে চারদিকে ঠুনকো সব কারণে কত শত সম্পর্ক ভঙ্গুর কাঁচের মত নিঃশব্দে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে; সম্পর্কের ওপর বিশ্বাস, ভরসা সব হারাচ্ছে মানুষ। অথচ এই মেয়েটি কি ভীষণ যত্নে নিজের ভালবাসাকে আগলে ধরে বাঁচতে চাইছে,বাঁচাতে চাইছে, ভালবাসাকে টিকিয়ে রাখার মরিয়া প্রয়াস করছে। অর্জুনের মনের কোণে কোথায় যেন অনুরাগের বসত গড়েছে মেয়েটা। ভালবাসার প্রতি মেয়েটার আনুগত্য যত দেখছে, ততই মুগ্ধ হচ্ছে অনির্বাণ,মেয়েটা যেন ভালবাসার রাজ্যের 'আত্মঘাতী রানী'।


ভিজিটিং আওয়ার শেষে,ডক্টরের সাথে কথা বলে পার্কিং লটে অর্জুনের গাড়ির কাছে অপেক্ষা করছিল জয়ী,পার্কিং স্পেসের হ্যালোজেনের আলোয় ওর মুখে বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট। চিকিৎসায় সেভাবে সাড়া দিচ্ছেনা প্রিয় । ডাক্তার আরো উন্নত চিকিৎসার জন্য বাইরের কোন এক বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রিয়র বৃদ্ধা মা তার সমস্ত সঞ্চয় আর ঐ সামান্য কটা পেনশনের টাকা ছেলের সুস্থতার কামনায় উজাড় করে চলেছেন,এই ছেলেই তার শেষ পুঁজি। কিন্তু ওনার পক্ষে চিকিৎসার জন্য দৌড়ঝাঁপ করা সম্ভব নয়,তাই বাকি যা কিছু জয়ীকেই সামলাতে হবে। মেয়েটার পোড়া মনের আঁচ লেগে অর্জুনের ঝলসানো বুকের যন্ত্রনাটা চাগাড় দিয়ে ওঠে। খুব জানতে ইচ্ছা হয় জয়ীর বাড়ির সবার হাত ওর মাথায় আছে তো?


--আগে সব ঠিকঠাকই ছিল।কিন্তু যবে থেকে প্রিয়র অসুস্থতার খবর সবাই জানতে পেরেছে,তবে থেকে এই সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে।

-- তার মানে প্রিয়র জন্য তুমি যা করছ,যেটুকু করছ, সবটাই তোমার বাড়ির বিরুদ্ধে গিয়ে?

… বিস্মিত হয় অর্জুন ,তবে বাড়ির মানুষগুলোকেও দোষ দেওয়া যায় না।


আবারও জয়ীর নীরবতা সদর্পে যেন বলে যায় অনেক কথা। জয়ী জানে নীরবে কিভাবে ভালবেসে যেতে হয়,ভালবাসা জাহির করার জিনিস নয়,এই অনুভূতি সুখ দিক বা অসুখ, শুধু নীরবে যাপন করতে হয়।


এক কিশোরী প্রেম পরিণত হয়ে পূর্ণ যৌবনা হয়েছে। সেই অবাধ্য প্রেম এখন কিছুতেই কোন বাধা বা বারণ শুনতে নারাজ। কোনকিছু না ভেবেই মন ডুব দিতে চায় অথৈ জলে। সে তার প্রেমকে আঁকড়ে ধরে আগলে রেখেছে বুকের পিঞ্জরে, সবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে।


বৈবাহিক বন্ধনে জয়ীকে বাঁধতে রাজী ছিল না প্রিয় ,অসুস্থ শরীরে বহুবার বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল জয়ীকে। প্রিয় জানত যে শেষ পর্যন্ত মাঝপথেই হয়তো জয়ীর হাত ছেড়ে চলে যেতে হবে ওকে,তাই ও চায়নি জয়ীকে এক অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দিতে। বার বার বোঝানোর চেষ্টাও করেছিল,কিন্তু শোনে নি জয়ী। নিখাদ ভালবাসাকে সম্বল করে,প্রেমের জোয়ারে ডিঙি ভাসিয়ে দিয়েছিল। এমন এক দিকশূন্যপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিল যেখানে শুধুই বর্তমানের বাস,যেখানে ভবিষ্যতের ভয় মানুষকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে জর্জরিত করে স্বার্থান্ধ করে তোলে না।


ওদের রেজিষ্ট্রি ম্যারেজের ঐ বিশেষ দিনটিতে, ভালবাসার উদযাপনে সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত ছিল অর্জুনও। জয়ীর প্রতি অর্জুনের মনের কোণে যে পেলব প্রকোষ্ঠটা ভাললাগা, ভালবাসা আর অনুরাগে টলটল করছিল..সেগুলো শ্রদ্ধা আর সম্মানে উথলে পড়ছে। জয়ী যে যুদ্ধে আগুয়ান হয়েছে,তাতে কতটা সফলতা পাবে,তা হয়তো নিশ্চিত নয়,তবু তার ভালবাসাকে কুর্নিশ না জানিয়ে পারা যায় না।


বিভিন্ন এনজিও র সহায়তায়,কিছু আর্থিক সহযোগিতায় আর অর্জুনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রিয়র চিকিৎসার জন্য ওরা দুজনে পাড়ি দেয় কলকাতার বাইরে। অর্জুন শুধু চায় জয়ীর ভালবাসা বাঁচুক। নিজের মনের অন্তঃকরণে জয়ীর জন্য পুঞ্জীভূত ভালবাসাটুকু এভাবেই উৎসর্গ করে দিতে চায় ও।


***


তিন সপ্তাহ ধরে অপেক্ষায় ছিল 'শান্তি ভিলা', অর্জুনের পৈত্রিক ভিটে। নানান ব্যস্ততার মাঝে বাবা মা-র সাথে দেখা করতে আসা হয়নি অর্জুনের । মায়ের কোলে মাথা রাখলে যেন সকল দুঃখের,সকল ব্যথার উপশম হয়।


--সারাদিন হাসপাতাল আর রোগী নিয়ে ব্যস্ত থাকিস, নিজের দিকে খেয়াল রাখার সময় পাস না।আমি বলি কি এবার একটা ভাল মেয়ে দেখে বিয়েটা করে ফেল,আমরাও একটু নিশ্চিন্ত হই। তোর যদি কাউকে পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে বল,আমাদের কোন আপত্তি নেই। 

...আগেও বহুবার মা এ কথা বলেছেন,নতুন কিছু নয়। মায়ের কথার উত্তরে সেই নীরবতাকেই আশ্রয় করে অর্জুন। তার ভালবাসায় আক্রান্ত হৃদয়টা হয়তো কোনদিন আর সেরে উঠবে না। জয়ী যে উচ্চতায় ভালবাসাকে নিয়ে গেছে,তার নাগাল পাওয়া ভার। জয়ীর ভালবাসাকে ছুঁতে পারেনি অর্জুন , অসম্পৃক্ত থেকে শুধু দূর থেকে পরিক্রমা করে গেছে,ওর উপছায়ায় নিভৃতে দাঁড়িয়ে জোছনা মেখেছে অর্জুন । অর্জুনের ধমনীতে শোণিতের মত বইছে জয়ী,সেই জয়ীকে প্রতিস্থাপন করতে হয়তো লেগে যাবে আরো কিছু সময়,হয়তো বা কোনদিনও আর তা সম্ভব হবে না।

তাছাড়া কিছু যন্ত্রনা আছে যা হৃদয়ে থেকে গেলে হয়ত প্রতিনিয়ত রক্ত ক্ষরণ হলেও মনে এক স্বর্গীয় আনন্দের অনুভূতি দেয়, যা আগামী দিনে বাঁচার রসদ বা শক্তি যোগায়। মানুষ এই অনুভূতি নিয়ে বাকী নিঃসঙ্গ জীবনটা পরিপূর্ণতার সাথে কাটায়, হয়ত একেই বলে ' নিঃসঙ্গতার আশীর্বাদ'।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract