নারীশক্তি
নারীশক্তি
শাড়ির কুচিটাকে ভালো করে কোমড়ে গুজে হাতে ঝাটা নিয়ে উঠোনে পড়ে থাকা ঝড়াপাতা গুলোকে ঝাট দিয়ে এক জায়গায় করছে রিমলি, আর নিজের মনেই বকে চলেছে জীবনের চলার পথটা একেবারে কাঁকরে পূর্ন হয়ে গেল, কি.... ভাবে যে.... বাকি পথটা চলব তার কোনো সীমানা নেই। আর আমার মানুষটাকে দেখ সেই যে... বেড়িয়েছে তিনদিন হলো এখনও বাড়ি ফেরার কোনো নাম নেই!!! আর ফিরবেইবা কি... করে?
গলা পর্যন্ত মদ গিলে রাস্তার ধারে কোথাও বেহুশ হয়ে পড়ে আছে মনে হয়। নেশার ঘোর কাটতেই বাড়ির কথা মনে পড়বে, তখন চলে আসবে, আর এসেই শুরু করবে গালিগালাজ। আর রোজ রোজ এই জীবন যন্ত্রনা আর সহ্য হচ্ছেনা!
হাতের কাজটা সেরে রিমলি বসল বিড়ি বাঁধতে আজ যে করেই হোক বিড়ি কটা বেঁধে দিয়ে আসতে হবে বিমল দাকে, না হলে এই কাজটা গেলে, যে কটা টাকা আসত সে কটাও আসা বন্ধ হয়ে যাবে। আর ঐ... মানুষটা থাকা আর না থাকা সমান, টলতে টলতে আসবে এসে গায়ে হাত তুলবে, টাকা পেলে যে পথ দিয়ে এসেছিল সেই পথ দিয়েই চলে যাবে আবার টলতে টলতে, আর না পেলে ঘরের যা বাসন পত্র আছে বেচতে চলে যাবে, সংসার টিকে থাকল না...ভসে গেল তাতে কিছুই যায় আসবে না! বিড়ি কটা বেঁধে প্যাকেটে ভরে কেরসিন তেলের লম্ফ জালিয়ে মুখ বন্ধ করতে লাগল রিমলি। ততঃখনে সূর্য মধ্য গগনে বিরাজ করছে। উঠোন জুড়ে তীব্র রোদ খাঁ...খাঁ... করছে। রোদের দিকে তাকিয়ে রিমলি যেন অতীতের পথে হারিয়ে যাচ্ছে।
কত সখ আহ্লাদ নিয়ে রিমলি অমলের হাত ধরে সংসার করতে এসেছিল, কিন্তু সংসার করার সব স্বপ্ন রিমলির ভেঙ্গে চুড়মার হয়ে গেছে কবেই!!! রিমলির বাবা রিক্সা চালাতো দিন আনা দিন খাওয়া সংসার হলেও, রিমলি বাবাকে কোনদিন নেশা করে বাড়ি ফিরতে দেখেনি, মায়ের গায়ে হাত তুলতেও দেখেনি, অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতেও দেখেনি। বাবা সবসময় মায়ের সাথে আলোচনা করেই কাজ করত। কিন্তু রিমলির কপালে সবকিছু উল্টো হয়েছে তাও রিমলির নিজের দোষে। সদ্য যৌবনে ওঠা রিমলি অমলের কথার যাদুতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে, অমলকে বিয়ে করে পালিয়ে না আসত যদি এই দূর শহরে, তাহলে রিমলির জীবনটা হয়তো এতটা কাঁকরে ভরে উঠতোনা। রিমলি তো... এখন লোকের মুখে কানাঘুষো শুনতে পায় অমলের খারাপ স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে। ভালোবাসার জোয়ারে গা ভাসিয়ে রিমলি যেন কিছুই খারাপ গুন দেখতে পেতনা অমলের, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ভালোবাসায় কেমন একটা ভাটা পড়ে গেল, আর কষ্ট এবং যন্ত্রনার কাঁকর গুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগল।
রিমলি কতবার ভেবেছে জীবনটাকে আর রাখবেনা শেষ করে দেবে, কিন্তু ঐ... অন্ধকারের বুকে এক চিলতে আলো হয়ে জ্বলে আছে ওর ছেলে খোকন। ওর মুখের দিকে তাকিয়েই এই কাঁকর যুক্ত পথেই হেঁটে চলেছে রিমলি। রিমলি খোকনকে সব সময় অমলের থেকে দূরে দূরে রাখে। রিমলি ভয় পায় খোকন যদি ওর বাপের মত হয়ে যায় এই ভেবে! তবে এর জন্য রিমলিকে অনেক কটূকথা এবং মারও খেতে হয়। অমল তো রিমলিকে দোষারোপ করে, এমনকি খোকন ওর ছেলে কিনা সেই নিয়েও রিমলিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। কিন্তু রিমলি চুপচাপ সব মুখ বুজে সহ্য করে নেয় খোকনের কথা ভেবে। রিমলি মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে খোকনের ওপর অমলের এই কালো ছায়া পড়তে দেবেনা।
রিমলি রোদে ভরা শূন্য উঠোনের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে, পাশে লম্ফটা কালো ধোঁয়া উড়িয়ে জ্বলছে, রিমলির চোখের কোনে নোনা জল জমে উঠেছে। হঠাৎ দুটো ছোট ছোট হাত রিমলির চোখটা চেপে ধরল।
---------রিমলি ছোট হাতের ওপর হাত রেখে বলে উঠল, আরে আমার খোকন এসে গেছে দেখছি, আমিতো ভয় পেয়ে গেছিলাম!
-----------খোকন হাসি মুখে বলে উঠল, কি.... মজা কি... মজা মা ভয় পেয়েছে!!! মা ভয় পেয়েছে!!
-------রিমলি ছেলেকে কোলে বসিয়ে বলে উঠল হুম... পেয়েছিতো!!
----------খোকন বলে উঠল, তুমি ভয় পেওনা মা..... আমি সবসময় তোমার পাশে আছি। খোকন উঠে একটা লাঠি নিয়ে রিমলির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, এইটা হলো আমার অস্ত্র।
----------রিমলি ছেলের কান্ড দেখে হেসে উঠল, আর মনে মনে বলে উঠল, আমি এটাই চাই তুই সবসময় আমার পাশে থাক, তোর বাবার মত যেন হয়ে না....যাস।
---------রিমলি বলে উঠল, তা....আজ স্কুলে কি...খাওয়া হলো শুনি আমার খোকন বাবুর।
--------খোকন বলে উঠল মা... ডিম ভাত। আমি আজ অনেকটা ভাত খেয়েছি। ডিমটা খেতে খুব ভালো ছিল।
------------রিমলির চোখের কোনটা আবার জলে চিকচিক করে উঠল। মনে মনে বলে উঠল, ছেলেটাকে একটু মাছ, ডিম খাওয়াতেও পারেনা। মাংসতো অনেক দূরের কথা। ঐ.... স্কুলের খাবার টুকুই যা... ভরসা দুপুরটা পেটভরে খেতে পারে।
----------খোকন মায়ের গলা ধরে বলে উঠল, তুমি খেয়েছ মা...?
-----------রিমলি হাসিমুখে বলে উঠল, এইতো খাবো। তোর জন্য অপেক্ষা কর ছিলাম।
********************************
রিমলি গামছা নিয়ে ছেলের হাতধরে পুকুরে একটা ডুব দিয়ে আসল। তারপর রান্নাঘরে ঢুকে কালকের দুটো বাসিভাতে জল ঢেলে নুন লঙ্কা নিয়ে বসল খেতে। খাবারটা সবে মুখে তুলেছে পিছন থেকে চিৎকার আসল...........
-----------এই যে রিমলি সুন্দরি খাওয়া হচ্ছে বুঝি! এদিকে স্বামী কি... খেল, বাঁচলো কি....মরল সেদিকের কোন খোঁজ নেই!
---------রিমলি খাবারটা বাটিতে রেখে খোকনকে বলে উঠল, খাবারটা নিয়ে তুই ঘরে যা.....!
----------অমল সাথে সাথে চিৎকার করে বলে উঠল, খোকন ঘরে যাবে কেন? ওর বাপের সাথে বসে কথা বলবে এখন!!!
---------রিমলি জোড়ে ধমকের সুরে বলে উঠল, খোকন তুই ঘরে যা....। খোকন মায়ের কথায় গুটি গুটি পায়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। রিমলি বলে উঠল, বাপ তা... তুমি কেমন বাপ শুনি! ছেলে কি... খাবে! কোথায় পড়বে! তার কোন চিন্তা আছে তোমার। মুখে বাপ বললেই বাপ হওয়া যায় না কাজে করতে হয়।
------------অমল তেড়ে গিয়ে রিমলির চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলে উঠল শয়তান, মেয়ে মানুষ তুই আমাকে বাপ হওয়া শেখাবি। আমার পরিচয় ওর আসল পরিচয়, সে আমি যেরকম মানুষ হইনা কেন... সবাই বলবে ওটা অমলের ছেলে।
--------রিমলি অমলকে এক ধাক্কা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেই,আর অমল টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়। রিমলি বলে ওঠে, ওর পরিচয় ও নিজে তৈরী করবে। তোমার মাতাল, নেশাখোর, লম্পটের, পরিচয়ে ওর পরিচয় হবেনা।
অমল কোন রকমে টলতে টলতে নিজেকে দাঁড় করিয়ে গাল দিতে দিতে রিমলিকে তেড়ে মারতে যাবে, ঠিক তখনই লক্ষ্য করে ছোট্ট খোকন হাতে লাঠি উঁচিয়ে রিমলির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে রাগ ফেটে পড়ছে ঐ টুকু ছেলের।রিমলি খোকনকে দেখে অবাক হয়ে যায় সাথে সাথে দুচোখে আনন্দে জল ভরে আসে এইভেবে যে... ওর ছেলে বাপের মত হয়নি! অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানে। অমল এই দৃশ্য দেখে কিছুটা থমকে যায়। আসলে এটা আশা করেনি। অমলের মতে রিমলি তো.... ওর নিজেস্ব সম্পত্তি ওকে যখন খুশি মারা যায়, ব্যবহার করা যায়, গালাগালি দেওয়া যায় আবার ছুড়েও ফেলা যায়, কিন্তু আজ নিজের সম্পত্তিও ওপর জোড় খাটাতে এই রকম বাঁধা পাওয়ায় অমল অবাক হয়।
---------রিমলি খোকনকে বলে ওঠে, তুই বেড়িয়ে এলি কেন....? ভিতরে যা.....
-----------অমল বলে ওঠে, বাহ্ ভালো ছেলে মানুষ করছো? বাপকে মারবে বলে লাঠি দেখায়, আজ ওর ঐ..... লাঠি ওর পিঠেই ভাঙ্গব আমি।
অমল তেরে খোকনের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নিয়ে খোকনকে যেই মাড়তে যাবে, অমনি রিমলি অমলকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, এবং উঠোনে পড়ে থাকা চেলাকাঠ উঠিয়ে বলে,,,.......
-----------এক্ষুনি এই বাড়ি থেকে বেড় হবে, না.... হলে আজ তোমাকে মেরে এইখানেই পুঁতে রাখব আমি, কেউ টের পাবেনা। আর বাড়ি মুখো তবেই হবে যবে এই স্বভাব পাল্টাতে পারবে তবে!! না... হলে এই বাড়ি ফেরার কথা স্বপ্নেও অানবেনা, মনে থাকে যেন।
অমল কেমন ভ্যাবলা হয়ে তাকিয়ে আছে রিমলির দিকে। অমল এত বছর ধরে এত অত্যাচার করেছে রিমলির ওপর তবুও কোনদিন রিমলির এই চন্ডীরূপ দেখেনি। আজ অমলের রিমলিকে দেখে কেমন মা দূর্গা... মনে হচ্ছে, আর নিজেকে মনে হচ্ছে অশুর, এই বুঝি নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে দূর্গা রূপি রিমলি অশুর রূপি অমলকে বধ করবে। আর কোন রকমের কথা না.. বাড়িয়ে অমল টলতে টলতে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় হাঁটতে শুরু করল। আর রিমলি হাতের চেলাকাঠটা ফেলে খোকনকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। খোকন যত্ন সহকারে রিমলির চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বসিয়ে মুখের সামনে খাবারটা তুলে ধরে বলল.....
-----------তুমি ভয় পেওনা মা...., আমি সবসময় তোমার পাশে আছি।
-----------রিমলি ছেলের হাত থেকে খাবারটা মুখে পুরে, চোখ বন্ধ করে ভগবানের উদ্দেশ্যে একটা প্রনাম ঠুকে নিয়ে মনে মনে বলে উঠল, আমার জীবন পথের সমস্ত কাঁকর বুঝি এইবার চাপা পড়ে যাবে এবং চলার পথটা মসৃন হবে তুমি শুধু দেখো ঠাকুর।
