SHUBHAMOY MONDAL

Classics

4  

SHUBHAMOY MONDAL

Classics

না চাহিলে যারে পাওয়া যায় - ৩

না চাহিলে যারে পাওয়া যায় - ৩

4 mins
342


না চাহিলে যারে পাওয়া যায় - ৩য় পর্ব

শুভময় মণ্ডল


জলের পূর্ণচন্দ্র আর তার মুখমণ্ডলের সাদৃশ্যের (আদৌ ছিল কিনা বিচার্য হতে পারে, কিন্তু তখন ঐ অবস্থায় কিনা, আমার চোখের দোষ দেওয়া চলে না তাই।) ভাবনায় আমার তখন মনে আসছে এক একটা করে গজল।


যাকগে, সে প্রসঙ্গে পরে কোনদিন আলোচনা করা যাবে। জলের সেই চাঁদের ছায়াটা হঠাৎ কেঁপে উঠলো যেন। একটু বোধ হয় হাওয়াও চলছিলো তখন, তা'তেই জলে ঢেউ উঠেছিলো বলেই হবে বোধ হয়।


আমার মস্তিষ্ক নেহাত শুষ্ক বা ষণ্ডগব্যাকীর্ণ ছিলো না, কিন্তু আগেই বলেছি - বুদ্ধি সুদ্ধি সব বোধ হয় লোপ পেয়েছিলো আমার। নয়তো নিশ্চয়ই নজরে পড়তো - গাছের একটা পাতাও নড়লো না, আর জলে ঢেউ উঠলো?


যাই হোক, চাঁদের ছায়াটা জলের ঢেউয়ে নাচতে নাচতে, ক্রমশঃ দূরে সরে যেতে লাগলো। আমার দৃষ্টি তার গতিপথ অনুসরণ করছিলো। ছায়াটা আমার ঠিক দশ বারো হাত দূরে ছিলো প্রথমে। আর এখন সরতে সরতে উল্টো দিকের ঘাটে গিয়ে পৌঁছালো!


ঐদিকের ঘাটটা আমার নজরে আসে নি আগে। আদৌ যে ওখানে ঘাট ছিলোই না - সেটা পরদিন জানতে পারলাম। যাই হোক, দেখি ওদিকের সেই ঘাটে বসে আছে কেউ! আমি ভালো করে লক্ষ্য করলাম - আরে ঐ তো, আমার সেই চপলা হরিণী!


ওঃ, বিয়ে বাড়িতে আমার থেকে গোলাপ নিয়ে লজ্জায় পালিয়ে এসে, একবারে পুকুর ঘাটে এসে বসেছে! তার মানে ওদিকেও কি হৃদয়জুড়ে দোলা লেগেছে - আমারই মত?


চেয়ে রইলাম তার পানে। মনে হলো, সেও দেখতে পেয়েছে আমায়। আমি তাকে ইশারা করলাম হাত তুলে। কিন্তু সে কিছু বললো না। আমি বুঝতে পারছি - সে আমায় দেখছে, আমার ইশারাও বুঝতে পারছে, কিন্তু সাড়া দিচ্ছে না।


আমি আর ধৈর্য রাখতে না পেরে, পুকুর পাড়ের গাছপালা ঝোপ ঝাড় অতিক্রম করে ঐদিকের ঘাটে গিয়ে হাজির হলাম। ওমা, দেখি সেও ওখান থেকে পালিয়ে আমার সেই আগের ঘাটে চলে গেছে।


তাই আমি আবার ওখানে ফেরত এলাম। দেখি - সেও আবার তার নিজের ঘাটে ফিরে গেছে। আমি যতবার তার কাছে যেতে চেষ্টা করি, ততই সে দূরে সরে যায়। দুজনের মধ্যে পুকুরের ব্যবধানটা যেন ঘোচে না।


ঠিক করলাম, তবে জলে নেমে সাঁতরে ওর কাছে যাবো। সেই মত পড়নের শেরওয়ানি কুর্তা সব খুলবো ভাবছি, এমন সময় - আমার পাশ দিয়ে এসে, এক বয়স্ক পুরোহিত ঠক ঠক করে হেঁটে জলে নেমে গেলেন।


এত রাতে খালি গায়ে ইয়া মোটা একটা পৈতে গলায়, খাটো ধুতি পড়ে ভদ্রলোক জলে নেমে গেলেন! আমি একটু বিরক্ত হলাম মনে মনে তাঁর ওপরে। কারণ, তাঁকে দেখতে গিয়ে আমার দৃষ্টি সরে গিয়েছিলো সেই কন্যাটির থেকে।


এখন বারংবার এদিক ওদিক চেয়েও, আর তার কোন হদিশ পেলাম না। ওপারের ঘাটটা, তার পাশে চাঁদের ছায়া কিছুই নজরে এলো না। জলে যেখানে আগে দেখেছিলাম, চাঁদের ছায়াটা এখন আবার সেখানে ফিরে এসেছে!


আমি এতক্ষণ ধরে একটানা পুকুরের এপাড় ওপাড় দৌড়াদৌড়ি করে, বেশ ক্লান্তও হয়ে পরেছিলাম। তাই ঘাটের সিঁড়িতেই বসে পরলাম। হঠাৎ খেয়াল হলো - তাইতো, ঐ পুরোহিতটা যে জলে নামলো, গেলো কোথায়?


আবার পুকুরের জলে ভালো করে নজর দিলাম, আসে পাশেও তাকিয়ে দেখলাম ভালো করে, কিন্তু তাঁর টিকিটিরও দেখা পেলাম না! তবে কি বেচারী বুড়ো মানুষ জলে ডুবে গেলো? তাহলে তো আবার জলে নামতে হয়, নাকি বিয়েবাড়িতে ফিরে গিয়ে খবর দেবো সবাইকে?


এইসব ভাবছি, এমন সময় সেই পুরোহিত মশায় জল থেকে উঠে এলেন। আমি ভাবলাম - ইস, কি লজ্জার ব্যাপার হতো, লোকজনকে ডাকাডাকি করলে। উনি তো ডুব দিয়েছিলেন জলের মধ্যে, সেটা ভাবিইনি!


এইসব ভাবতে ভাবতেই, পুরোহিত মশাই জল থেকে উঠে এসে, আবার ঐ ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে আমার পাশ দিয়ে চলে গেলেন! খেয়াল করলাম - জল থেকে উঠে আসলেও তাঁর গায়ে একবিন্দু জল লেগে নেই বা পড়নের কাপরটাও একটুও ভেজা নয়!


ভালো করে তাঁর দিকে খেয়াল করতে, দেখলাম - তাঁর পা মাটি স্পর্শ করছে না। আর তিনি গিয়ে সড়সড় করে চড়লেন শিবমন্দিরের গা বেয়ে ওঠা বড় বেলগাছটার ওপরে। গাছের পাতার আড়ালে চোখের নিমেষেই তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন!


আমার সামনে তাঁর এই অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ঝটকাটা - আমার জন্য এতটাই আচমকা এবং কল্পনাতীত ছিলো যে, নিজের সংজ্ঞা ধারণ করে থাকা, বা তৎক্ষণাৎ ঐ স্থান ত্যাগ করে বাড়িতে ফিরে যাওয়ার মত চলচ্ছক্তিলাভও সম্ভব হলো না।


অগত্যা জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পরলাম ঐ ঘাটের সিঁড়িতেই। খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা, স্নানাদি সেরে কাজকর্ম শুরু করা - সব গ্রামের মানুষদেরই অভ্যাস। 


তেমনই, ঐ গ্রামেরই কোন এক ভদ্রলোক, সকাল বেলা প্রাতঃকর্মে যাওয়ার পথে, আমায় ঐ ঘাটে কাত হয়ে শুয়ে থাকতে দেখেন। তিনিই আমার পড়নের পোশাক দেখে, কি মনে করে এসে আমায় পরীক্ষা করে দেখেন।


আমি জীবিত আছি, যদিও আমার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিলো, দেখে তিনিই চোখে মুখে জল ছিটিয়ে আমার জ্ঞান ফেরান। কি হয়েছে না হয়েছে আমায় তিনি কিছুই জিজ্ঞাসা করলেন না, শুধু আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন ঐ শিবমন্দিরে।


মন্দিরের ভিতর থেকে একটু চরণামৃত এনে আমায় পান করিয়ে, মাথায় ফুল দূর্বা ছুঁইয়ে দিয়ে বললেন - বিয়ে বাড়িতে এসেছেন তো, রাত বিরেতে একা এইসব জায়গায় আসেন কেন? 


বরাতের জোড়ে আজ বেঁচে গেলেন খুব। আর কখনও এইরকম ভুল করবেন না, যান বাড়ি চলে যান। তখন সকাল হয়েই এসেছিলো প্রায়। আমি ভদ্রলোককে প্রণাম করে, ওখান থেকে চলে গেলাম।


পরে জানতে পেরেছি, সেই চপলা হরিণী সেদিন রাতে সেই যে লজ্জা পেয়ে ঘরে লুকিয়েছিলো, পরের দিন আমরা নবদম্পতিকে নিয়ে সেই বাড়ি ত্যাগ না করা অবধি আর নাকি বারই হয়নি। 


কনেযাত্রীর দলে তাকে আবার দেখলাম তার পরের দিন। সেদিনের কথা তোলা থাক, আর কোন একদিন ফুরসতে সেসব কাহিনী শোনানো যাবে। তবে পুকুর ঘাটের সেই রমণী যে তিনি ছিলেন না - একথা আমিও বুঝেছি, আর আশা করি আপনারাও।

-----চলবে------


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics