Subhashish Chakraborty

Classics

4.6  

Subhashish Chakraborty

Classics

ন হন্যতে

ন হন্যতে

11 mins
24.1K


অনেকবার ঠেলার পর দরজাটা একটা বিশ্রী আওয়াজ দিয়ে খুললো। অনেকদিন বাদে খুললাম ত -- যেন অভিমান করেছিল। অনেকদিনের বেশ কিছু জমা ঝুল আর বেয়াড়া মাকড়শার জাল সরিয়ে দেখলাম সেই পুরোনো ঘিঞ্জি সিঁড়িটা কিরকম থমকে দাঁড়িয়ে আছে। অদ্ভুতভাবে আমার দিকে চেয়ে। যেন আমি আসবো ও ভাবতেই পারেনি। টর্চের অন্যমনস্ক আলোটা একবার ফেললাম -- অনেক নিচে নেমে গেছে সিঁড়িটা। অদ্ভুত এক গন্ধ জায়গাটাতে কিলবিল করছে। অনেকদিন বাদ বন্ধ কোনো কামড়া খুলতেই যে গন্ধটা নাকে আসে। একটা ভ্যাপসা, গুমোট বাতাস দরজাটা খোলা পেয়েই দপ করে বেরিয়ে গেলো। আমি সিঁড়ির মুখটায় এসে দাঁড়ালাম। এতো নিচে -- টর্চের আলো ও পৌঁছয় না। না-ই পৌঁছয় সূর্যের আলো।

“অসূর্যা নাম তে লোকা অন্ধেন তমসাবৃতা 

তা:স্তে প্রেতাভিগচ্ছন্তি যে কে চ আত্মহন জনা:।।“  

কই না ত! তুমি ত তেমন কিছু অপরাধ করনি -- তোমার পরিণতি এমন হলো কেন? শুয়ে আছো অন্ধকারে। এক অদ্ভুত সিঁথিল করা ঠান্ডায়। এক অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের জন্য!

কেন? কিসের জন্য তোমার এতো কষ্ট?

মাকড়সার জালের ধানক্ষেত সরিয়ে নামতে থাকলাম। আমার পায়ের আওয়াজে চমকে উঠে পালালো নীরবতা -- শবাধারের শৈথিল্য যেন ফিসফিসিয়ে অনেক কথা বলছে আমায় নিয়ে। ওরা বিরক্ত আমি আসায়। ভেঙে গেছে ওদের গোপনীয়তা। কিলবিল করা এক সাপের মতন নিচে নেমে গেছে অন্ধকার। চামড়া ওঠা সিঁড়ির ধাপ গুলোর গায়ে গায়ে আগাছার ঝাঁক, আমি সরু সিঁড়িটার দুপাশের দেওয়াল ধরে ধরে নামতে থাকলাম, বছর জুড়ে জমা শ্যাওলার যানজট টপকে। হ্যাঁ, তা বটে। অনেক কিছু মনে উঁকি মারছিলো। ওই যে কি যেন বলে -- mixed feelings। খানিকটা ভয়, খানিকটা এড্রেনালিন, খানিকটা ভয়ানক এক উত্তেজনা, খানিকটা হারিয়ে যাওয়া কিছুকে আবার ফিরে পাবার এক অদম্য আনন্দের ঢেউ। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো হঠাৎ। তুমি...তুমি কি সত্যি ফিরে আসবে কখনো? আজ....এখন কি তোমায় দেখতে পাবো? উঠে গেছো ঘুম থেকে? আমার জন্য এতক্ষন বসেছিলে। বাচ্ছাদের মতন গোঁসা করে বসে। কিংবা হঠাৎ আমায় আস্তে দেখে হেসে উঠলে তুমি, হাততালি দিয়ে। কিংবা হয়তো তুমি উঠে বসলে আমার পায়ের আওয়াজে। ঘুম ভাঙলো তোমার। তোমার চেহারাটা হঠাথ যেন অন্ধকারে দুলে উঠলো। স্মৃতির তেলকিষ্ঠে কোনো এক কোণ থেকে। তোমার সেই হাসি, দুগালের খিলান বেঁয়ে তোমার মোটা ঝুলপি অবধি চলে যায়। তুমি হাসলে তোমার চোখ ও হাসত। Backcombed চুলে হাত চালাতে চালাতে কিছু একটা বললে তুমি। এক ভয়ানক কথা বলার ক্ষমতা ছিল তোমার। কথা বলা শুরু করলে, লোকে হাঁ করে শুনতো। মা তো তোমার কথা শুনেই তোমার প্রেমে পড়েছিল। আচ্ছা, তোমার কলেজে কটা গার্লফ্রেন্ড ছিল -- সেটা তো খোলসা করে কখনো বলোনি? তুমি এরকম secretive কেন গো?  

আজ তুমি নেই, মা ও নেই। এই স্মৃতিগুলো এই সিঁড়িগুলোর বেড় বয়ে ওপর নিচ করছে, গুনগুন করে বেড়াচ্ছে তোমার স্পর্শ, তোমার গায়ের গন্ধ, তোমার মুছে যাওয়া কাঠামোটা। 

থামলাম আমি। নিজেই জানি না কখন এতগুলো সিঁড়ি নেমে এসেছি। ওপরে চেয়ে দেখি, সন্ধ্যার ফিকে হওয়া সূর্যের কোনো চিহ্নই কোথাও নেই, সিঁড়িগুলো বাঁকতে বাঁকতে এতটাই উঁচুতে উঠে গেছে, যে ওপরের কিছু আর দেখা যাচ্ছে না। আমি এখন অনেক নিচে। প্রকৃতির যোনি ভেদ করে জঠরে -- মায়ের পিঞ্জরের সেই সোঁদা সোঁদা গন্ধটা যেন ঘিরে ধরছে আমায়। আমি সুরক্ষিত, মায়ের উষ্ণ বেষ্টনীতে, যেন এক লহমায় অনেক গুলো বছর পেরিয়ে পৌঁছে গেছি আমি। 

সেই ক্ষণটার কথা মনে আছে তোমার? তোমায় যেদিন প্রথম বাবা বলে ডেকেছিলাম? আমার জীবনে প্রথম পুরুষ তুমি ,বাবা। আমার প্রথম ক্রাশ তুমি, বাবা। আমার প্রথম গুরু তুমি, বাবা। আমার সংসার তুমি, বাবা, আমার ব্রম্ভান্ড তুমি, বাবা। আজ ও তাই ভাবতে পারি না....তুমি নেই। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে সুইচবোর্ডটা খুঁজে পেলাম। ঠান্ডায় যেন জমে যাচ্ছে নিশ্বাস। টর্চের আলো ফেললাম -- তোমায় দেখতে পেলাম, তুমি শুয়ে আছো। ঠিক যেভাবে রেখে গেছিলাম শেষবার।  

আলোটা জ্বালালাম। ধিমি করা মোম জোছনায় দেখতে পেলাম তোমাদের। কেমন যেন হাত ধরাধরি করে শুয়ে আছো। 

বা যেন গল্প করছিলে এতক্ষণ, আমায় দেখে চুপ করে গেলে।

বা যেন ঘুমিয়ে থাকার ভান করছো।

এগিয়ে এলাম আমি। তোমার গায়ে হাত দিলাম, নরম ঠান্ডা গা যেন আলগা হয়ে খুলে যাচ্ছে তোমার ঘুন ধরা আলনা থেকে, তোমার গা থেকে চামড়ার পল খুলতে শুরু করেছে, গালের হা-টা যেন বেড়ে গিয়েছে, আর দেখা যাচ্ছে তোমার সারি সারি দাঁত। তোমার চোখ দুটো বোজা অবস্থায় ও খোলা, যেন আমায় তুমি দেখছো। আমি তোমার হাতটা ধরলাম। গন্ধটা....গন্ধটা খুব বেশি এখানে, তোমার পচন ধরা মাংসপিন্ড চিরে যেন তোমার না বলা কথাগুলো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে, তোমার নির্নিমেষ, পৈশাচিক হাসিটা যেন আমাকে মসকরা করে পালিয়ে যেতে বলছে। 

মায়ের দিকে দেখলাম। মাকে দেখতে এখনো তোমার মতন অতটা বিকট না হলেও, আমি জানি মা-এর ও মাংস খসতে শুরু করছে আসতে আসতে, নিষ্প্রাণ বুড়ো আলনাটা যেন অনেক কথা বলতে চাইছে আমায়। মায়ের মাথায় হাত বোলালাম, খসে আসছে মাথার চুলগুলো, ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। আমি তোমাদের দুজনের মাঝে রাখা চেয়ারটায় বসলাম। জানো, এই চেয়ারটা আমি কেন রেখে গেছি? বাবা যাতে উঠে বসে এখানে কিছুক্ষণ এসে বসে -- বাবা আবার বেশিক্ষণ শুয়ে থাকতে পারেনা, পিঠে ব্যাথা করত, তাই না বাবা? খুব ইচ্ছা করে জানো, আবার সবাই মিলে বসে চুটিয়ে আড্ডা দি। বেমতলব আড্ডা -- কথা বলার টপিকের কোনো বাছ-বিচার নেই। তোমার তো কোনো জিনিসের প্রতিই আগ্রহের সীমা ছিল না -- টপিকের অভাব কখনোই তাই হয় নি। 

ফেলে আসা সেই বিকেল গুলো খুব মিস করি, জানো বাবা? কলেজ থেকে ফিরে এসে, ঘটুর দোকানের সিঙ্গাড়া (কখনো বা অর্জুন-দার দোকানের deep-fried নিমকি বা পাড়ার মোড়ের মাথার মোমো), চা আর তোমার এক্সপোর্ট কোয়ালিটির খোরাক। 

কোথায় সব হারিয়ে গেলো বলো তো? কৈ, আমার কথা তো তোমাদের আর মনে পড়ে না?

Auld lang syne…

বিকট নিস্তব্দতা যেন ডুকরে কেঁদে উঠে সায় দিলো। অজান্তে কখন যেন বলে উঠলাম কথাটা। "বাবা, তোমাদের...তোমাদের এখানে খুব কষ্ট, তাই না?", আমি তোমার গায়ে হাত বোলালাম -- "ঠিক আছে, কোনো চিন্তা করো না", আমি আসতে আসতে বললাম কথাটা (মনে আছে, যেমন ভাবে আমি দীপের কথাটা প্রথমবার বলেছিলাম?) -- "আমি এখানে খুব শিগগিরই আরেকজনকে পাঠাচ্ছি। তোমাদের দেখাশোনা করার জন্য।"

হাসলাম আমি। যেন নিজেই নিজের প্রশ্নটাকে করার জন্য খোঁচালাম -- "বলো তো, কে?"

AC'র হওয়াটা যেন বেড়ে গেলো, তাই না?

আমি হাসলাম -- যেন ওদের না করা পাল্টা প্রশ্নটাই শুনতে পাচ্ছি -- "আরে বাবা, আর কে হতে পারে? তোমরা আর কাকে বিশ্বাস করো, তোমাদের ‘টুসু’ ছাড়া? কোনো চিন্তা করো না -- ও রাজিও হয়েছে। মোটা মাইনের চাকরি, খাওয়া-পড়া সব included -- এরকম তো যে কেউ শুনলে লুফে নেবে, তাই না?”

উঠে দাঁড়ালাম -- "যদি ও আমি এখনো ওকে বলিনি -- কাজটা ঠিক কি।", আবার ফিক করে হাসলাম আমি – “জানলে কখনই রাজি ও হতো না, তাই না, বাবা?”


"এতো বড় একটা খবর আর দেখো, কাগজের আট নম্বর পাতার নিচের এক কোণের কলামে দয়া করে চাপিয়েছে", কাঁপা কাঁপা হাতে বইটা নামিয়ে রেখে আমার দিকে চেয়ে হাসলো ব্যোমকেশ -- "খবরের কাগজের বাবুদের idiosyncrasy বোঝা ভার।"

"কোন খবরটা বলছ বলো তো?"

"কোনটা আবার -- কৃষ্ণকান্ত-বাবুর কথাটা পড়োনি?"

"প্রফেসার কৃষ্ণকান্ত রায়?", উঠে বসলাম আমি। আজকাল হাঁটুর ব্যাথাটা বেশ বেড়েছে -- "তাঁর আবার কি হলো?"

"হে ভগবান! এতো বড় একটা ব্যাপার হয়ে গেলো আর তুমি খবরই রাখোনি কোনো?", ব্যোমকেশ উঠে বইটা পাশের টেবিলে নামিয়ে রাখলো -- "অবশ্য দোষ দিয়ে লাভ নেই। যা ছোটো করে ব্যাপারটা লিখেছে, চোখে না পড়ারই কথা।"

"হুম...বেশ শুনি কি খবর।", পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢোকালাম। বহুদিন হয়ে গেছে নেশাটা ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু আজ ও অভ্যাস বশতঃ পকেটে হাত চলে যায়।  

"মাস দুয়েক আগে, বিশাল এক গেট -টুগেদার হলো। ভদ্রলোক তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের ডেকে খাওয়ালেন। সাথে বাদ যাননি কলেজের সতীর্থরা। পাড়া-পড়শিরা। সে এক এলাহী ব্যাপার, বুঝলে ভায়া। ডানলপের, ওনার বাড়ির কাছেই, একটা বিশাল বড় বকেট হাউস। আমাদের তো আর আজকাল কেউ ডাকে না। এইসব কথা কাগজে-কলমে পড়েই পেট ভরাই আর কি....", ব্যোমকেশের ক্ষেদোক্তি -- "আর তার ঠিক এক হপ্তা পর....গেলো মাসের ১৩ তারিখ, বুধবার। একটা চিঠি। ভারী অদ্ভুত চিঠিটি..."

"চিঠি?"

"থুড়ি...ওই যে আজকাল কি একটা বেশ হয়েছে না....কি যেন ফিমেল না শীমেল..."

"ইমেইল?"

"হ্যাঁ, হ্যাঁ। ইমেইল। ভদ্রলোক একটা মেল্ করেছেন -- নিমন্ত্রীত সকল অতিথিদের। 'এবার বিদায় নেবার পালা। এবার যেতে হবে। ভালো থেকো। দেখা হবে, আবার অন্য গানের ভোরে।' ব্যাস, এইটুকু শুধু তাতে লেখা।"  

"তারপর?"

"পরের দিন থেকে ভদ্রলোক সস্ত্রীক বেপাত্তা।"

"মানে?"

"ওটা যেন একটা farewell message ছিল। তাড়াহুড়ো করে লেখা একটা half-baked বিদায়-বার্তা। যেন ওই গেট-টুগেদার-টা একটা শেষ বারের মতন সবাইকে দেখে নেওয়া। প্রিয় মানুষ জনদের।"

ব্যোমকেশের দিকে খানিক্ষণ তাকালাম -- "ভদ্রলোকের কোনো সন্তানাদি?"

"একটি মেয়ে আছে। অনন্যা। অনন্যা রায়। কলেজে পড়ায়।"

হ্যাঁ, হ্যাঁ, নামটা শোনা শোনা লাগছে। আগে কোথাও শুনেছি, তাই না?, চোখ পিটপিট করে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে মনে করার চেষ্টা করলাম। 

"হ্যাঁ...ঠিকই। বেশ দু-তিনটে বই ও লিখেছেন , মাঝে মাঝে কাগজে লেখা লেখি ও করেন। ওই আর কি....আমেচার কলামনিস্ট।", ব্যোমকেশ মনে করিয়ে দিলো। 

"তো, মেয়ে কি বলছে এই ব্যাপারে?"

"তেমন কিছু না। বাবা নাকি বেশ কয়েকবার আগেও বলেছে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার কথা। এটা নাকি প্রত্যাশিত ছিল।"

বেশ ঘাবড়ে গিয়ে তাকিয়ে থাকলাম প্রিয় বন্ধুর দিকে। আশ্চর্য তো। এরকম করে একজন বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো, আর বলে কিনা প্রত্যাশিত ছিল?

"পুলিশে মিসিং ডায়েরি -- "

"মেয়ে না, ওনার এক প্রাক্তন ছাত্রী ঈশিতা – সে-ই করেছে। জানা গেলো যে উনি নিখোঁজ। নইলে মেয়ে উদাসীন হয়ে বাড়িতে বসেই ছিল।"

না...না....ঠিক যেন কেমন একটা...    

চায়ের জন্য অনেকক্ষণ ধরেই উসখুস করছিলো মনটা। পুঁটিরাম নেই -- লকডাউনের সময় সেই যে সে 'দেশে' গেলো আর ফেরার নাম নেই। বিশেষ করে বিকেল হলে আরও বেশি করেই মনে করি দেয়, ফেলে আসা সেই সময়ের কথা। 

আমি, ব্যোমকেশ, সত্যবতী। আর খোকা। 

নাহঃ, সত্যবতী আর নেই। আর খোকাবাবু এখন বড় হয়ে বেঙ্গালুরু থাকে, সস্ত্রীক। ব্যোমকেশকে অনেকবার যেতে বলেছে, বন্ধু আমার চিরকালই অবাধ্য।

"একটা জিনিস দেখবে? একটা জিনিস দেখবে?", ব্যোমকেশ খুব ব্যস্ত হয়েই বলল। 

"কি?"

"অনন্যার লেখা আর্টিকেল গুলো -- এই দেখো", পুরোনো বইয়ের শেলফে গোঁজা বেশ কিছু ম্যাগাজিন, ধুলো আর বুকমার্কে দধীচি'র পাঁজরের মতন যেন দেখে হাসলো আমায় -- "আমি পেন দিয়ে দাগ মেরে রেখেছি, সূচিপত্রে। দেখো..."

কাঁপা কাঁপা হাতে ম্যাগাজিন গুলো হাতে নিলাম। এক ডজন গ্রন্থকীট পুরোনো বইয়ের গর্ভ-গৃহ ছেড়ে লাইন দিয়ে স্বভাবতঃই বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো। আমি ঝেড়ে ঝেড়ে ফেলে দিলাম। 

'দূরের বলাকা'। কলেজ স্ট্রিটের পুরোনো পাবলিসিং দোকান। প্রিন্টার, পাবলিশার, ডিস্ট্রিবিউটর। সেখানে বন্ধু আমার একটা জায়গায় গোল করে লিন কালী দিয়ে দাগ মেরে রেখেছে। 

একটা আর্টিকেল। 

'মরণের পাড়ে'।  

বেশ। উঠিয়ে নিয়ে চোখের কাছে নিয়ে এলাম।আজকাল চশমা পড়েও পড়তে বেশ কষ্ঠ হয়। পাওয়ারটা বেড়েছে বোধহয়।  

নাহ, অভেদানন্দ নয়। 

Consciousness নিয়ে লেখা। চেতনা। মৃত্যুর পরও নাকি চেতনা থেকে যায়। তার ভুরি ভুরি প্রমান আছে জগৎ জুড়ে। Near death experience -- মরণের খুব কাছে গিয়েও ফিরে আসা র সেই মুহূর্তের কিছু ফিকে স্মৃতি। এক লম্বা টানেল, একটা অদ্ভুত আলো, অদ্ভুত এক উপস্তিতি। যেন ওপারে দাঁড়িয়ে আছে আরেক reality -- আরেক রূপের দন্ডপাত অস্তিস্ত্ব। এক কুয়াশাচ্ছন্ন নদীর ওপারে, হাতছানি তাকিয়ে আছে অনেক অনেক চোখ। 

তোমার ফেলে আসা আগের জীবনের কথা। 

কর্ম, প্রারব্ধ, পুনর্জন্ম। 

"পড়লে?", ব্যোমকেশ এগিয়ে দিলো আরেকটা ম্যাগাজিন -- "এটা দেখো।"

হ্যাঁ, দেখলাম। এটার টপিক -- কঠোপনিষদ। নচিকেতা আর যমের উপাখ্যান। মৃত্যুর ওপারে গিয়ে নচিকতার জীৱদ্ধশায় লাভ করা এক অনির্বচনীয় জগতের উপাখ্যান। 

Life after death। 

তারপর আরেকটা ম্যাগাজিন নিলাম। এটা গেলো বছর পুজো-সংখ্যায় বেরোনো। Quantum consciousness নিয়ে লেখা। মৃত্যুর পর চেতনা নাকি অন্য আরেক জগতে 'migrated' হয়। লেখাটিতে টানা হয়েছে নানান মুনির নানান মত। নানান বিজ্ঞান, নানান যুক্তি 

অবলম্বন করে। কখনো মহামতি গনিতবিদ রজার পেনরোস ও ডক্টর হেমারহফ-এর ভাষায়। কখনো গাণিতিক হিংটিংছট হিসাবে, কখনো বা পরীক্ষিত, উপলুব্ধ উদাহরণ হিসাবে।

"এটাও দেখ", ব্যোমকেশ আরেকটা ম্যাগাজিন এগিয়ে দিলো। এটা বেশ পুরোনো -- "পাঁচ বছর আগে। ডিসেম্বরে লেখা। যীশু-পুজোর ঠিক আগে বেরোনো।"

হু, পড়লাম। মিশরের বহু প্রচলিত মৃত্যু-তত্ত্ব। মারা যাবার সময়, প্রিয় এবং প্রয়োজনীয় মানুষকে (অথবা পোষা কুকুর-বেড়ালকে) জোড় জবরদস্তি সহমরণে পাঠানো। 

কেন?

মৃত ব্যক্তি ঘুম থেকে উঠে যেন কখনোই নিজেকে এক না বোধ করে। তাই সঙ্গে পাঠানো হয়েছে প্রিয় চাকর, প্রিয় দাস-দাসী, এমনকি প্রিয় 'রাখেল' কে ও। 

ওপারে গিয়ে শারীরিক ক্ষুণিবৃত্তির কথাও তো ভাবতে হবে, তাই না?

"কি?", ব্যোমকেশ হাসলো -- "কি বুঝলে ভায়া?"

মাথা নাড়লাম -- "it’s all about death, again and again...কি ব্যাপার বলো তো?"

"ওই যে....", ব্যোমকেশ জানলার কপাটটা বন্ধ করল। সন্ধ্যা হচ্ছে, মশা ঢুকবে - "কথায় বলে না....বাঙালিরা মৃত্যুকে ভালোবাসে। দেখো না, সব জায়গায়ই মৃত্যু লাগিয়ে বসে আছে। রবি ঠাকুর তো কথায় কথা টানতো, তাঁর দেখাদেখি জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণ, মহাস্বেতা দেবী...মায় আজকের নীল- লোহিত, শীর্ষেন্দু, সত্যজিৎ....উফফ, ভাই বুঝে পাইনা ব্যাপারটা নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি করার কি আছে, হে?"

আমি আবার তাকালাম ব্যোমকেশের দিকে -- "একটা কথা বলো তো?"

"বলো?"

"তুমি হঠাৎ এই ভদ্র-মহিলার লেখা নিয়ে পড়লে কেন?"

ব্যোমকেশ মিচকে মিচকে হাসছে। 

"দাঁড়াও দাঁড়াও...", হঠাৎ মনে পড়লো -- "একটু আগে বেরিয়েছিলাম আমি, ফিরে দেখি ইন্সপেক্টর মিত্তিরকে -- বাড়ির বাইরে পুলিশের জিপ। কি ব্যাপার বলো তো?"

ব্যোমকেশ আবার ফিরে এসে ওর হাই-ব্যাকেড চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো -- "অনন্যা'র মায়ের একটা ব্যাঙ্ক একাউন্ট আছে বরোদা ব্যাংকে। সেকালের লোক, বোধহয় তাই এটিএম কার্ড, নেট-ব্যাঙ্কিং, ই-ব্যাঙ্কিং এগুলোর খুব একটা পরিপন্থি ছিলেন না। আজীবন কাল ব্যাংকে গিয়ে পাস-বই আপডেট করিয়ে এসেছেন। সেকালের মানুষ -- টিপসই দিয়েই সাইন করতেন। আজ ও তাই করে এসেছেন। ইদানিং শরীর খারাপ বলে, মেয়ে চিঠি করিয়ে বাড়ির থেকে মায়ের টিপ্ সই দিয়ে পাস্ বই আপডেট করতেন। ও টাকা তুলতেন। "

"হুম, তো?"

"আশ্চর্য কি জানো? মা আর বাবা নিরুদ্দেশ হবার পর-ও regularly পাস-বই তা আপডেট হচ্ছে কি করে গো? মা তো বাড়ি নেই, তাই না?"

আকাশ থেকে পড়লাম -- "মানে?"

"গত কিছু মাস ধরেই আকাশ ছোঁয়া বাড়ির ইলেক্ট্রিক বিল আসছে। বাড়িতে আট-আট খানা এসি'র অনুমোদন করানো আছে। অথচ, বাড়ি ঢুকলে দেখবে, একটাও এসি নেই বাড়িতে। জিজ্ঞেস করায় বললো -- বাবা নাকি বহু আগে এসি'র অনুমোদন করে রেখে গেছিলেন। সেগুলো আর cancel করা হয়নি। বাড়িতে একটাও এসি নেই, তাহলে এতো বিল আসছে কি করে?"

আমি clueless....একদম নিরুত্তর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। 

"খটকাটা কোথায় লাগলো জানো ভাই অজিত", ব্যোমকেশ আড়মোড়া ভাঙলো বিশ্রী ভাবে -- "ওদের বাড়ির এক বহু পুরনো চাকর ছিল। দিপু দা। সেও নিখোঁজ। ওঁর দেশের বাড়ির লোকেরা এসে খবর নিচ্ছে -- অনন্যা দেবী বললেন দীপুদা তো কাজ ছেড়ে চলে গেছেন, এক মাস হলো। ওনার একাউন্ট-এ যা বাকি টাকা ছিল সবই দিয়ে দেওয়া হয়েছে।"

"মা...মানে?"

"একটু ভাবো বুঝতে পারবে", ব্যোমকেশ উঠে বসলো -- "খুব যদি না ভুল করে থাকি, মিত্তির পুলিশ এতোক্ষনে রায় বাড়িতে রেড করছে।"


ইন্সপেক্টর ইন্দ্রদেব মিত্র চুপচাপ এক কোণে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন পুরো ব্যাপারটা। 

গা গোলাচ্ছে। দু মাসের তিনটে পচা গলা দেহের গন্ধ পেলে যেকনো মানুষেরই গা গুলিয়ে উঠবে, মিত্তির পুলিশ তো কোন ছাড়। 

মানুষ না পিশাচ এরা?

ইন্দ্র তাকালেন অনন্যাদেবীর দিকে। এখনো চেঁচাচ্ছেনা মহিলা। "মা আর বাবা বেঁচে আছে..মৃত্যু বলে কিছু হতে পারে না....এটা এক ধরণের ঘুম। দিপু-দাকে ও পাঠিয়েছি ওদের কাছে। কিছু মধ্যেই ঘুম ভাঙবে মা আর বাবার, তখন দীপুদাকে ওদের লাগবে। আপনারা কেন বুঝছেন না?"

মাথাটা ঘুরছে এখনো। 

ব্যোমকেশ বাবুর অসাধরণ ক্যালকুলেশন। বাড়িটার চারপাশে এক লম্বা চওড়া পাঁচিল। Balustrade। বাড়িটা ছাড়াও বেশ খানিকটা জমি ছাড়া আছে বাগান আর গাড়ি বারান্দার জন্য। সেখানে একটা ছোট মতন খিলান। শ্যাওলা আর ঝোপঝাড়ে টের-ই পাওয়া যায় না একটা ছোট হাতল আছে বলে। একটু চাপ দিতেই দরজাটা খুললো, নিচে নেমে গেছে...অনেক নিচে। অনেক গুলো সিঁড়ি। 

সিঁড়ির নিচে আছে অনন্যার মা আর বাবা। 

আর তার থেকে একটু দূরে একটা ছোট গার্নিতে....দীপুদা। 

গনগন করে এসি চলছে।  

পচা মাংসের গন্ধে ভুরভুর করছে ঝুলে থাকা,আটকা পড়া বাতাস। 

সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন ডক্টর মুন্সি। গোটা কয়েক পুলিশ আর প্যারামেডিক এখনো ওনাকে প্রশ্ন করে চলেছেন। ডক্টর মুন্সি অনন্ন্যাদের পারিবারিক ডাক্তার।

"কৃষ্ণকান্ত-বাবু অনেকদিন ধরেই ক্যান্সারে ভুগছিলেন", ডক্টর মুন্সি আবার বললেন -- "মেয়েটা বাবাকে খুব ভালোবাসতো। বাবার কষ্ট আর দেখতে পাচ্ছিলো না। তাই বালিশ চাপা দিয়েই.... "

"আর ওনার মা?"

মাথা নাড়লেন মুন্সিবাবু -- "মা-কে ও বালিশ চাপা দিয়ে মেরেছে। সহমরণ।"

"আর ওই ইমেল-টা?"

দীর্ঘস্বাস ছাড়লেন মুন্সিবাবু -- "ওটাও অনন্যারই করা....সংসারকে জানাতে চায়নি বাবার মৃত্যুর কথা",মুন্সিবাবুর চোখে জল -- "বাবা তো ফিরেই আসবে একদিন, মৃত্যু বলে কি কিছু হয় নাকি....."


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics