Sanghamitra Roychowdhury

Tragedy Crime Inspirational

4  

Sanghamitra Roychowdhury

Tragedy Crime Inspirational

মুখবন্ধ খামে

মুখবন্ধ খামে

6 mins
23.2K



আমার আদরের বাবুইসোনা,


সোনা, সোনা, সোনা... কেমন আছিস বাবুই, আমার আদরের ধন? কতকাল তোকে ছুঁয়ে দেখিনি। হয়তো দু'যুগ হবে। কত দূরে চলে গেছিস আমার থেকে। আজ মনটা বড়ো খারাপ করলো রে... ইচ্ছে হলো দু'লাইন লিখি তোকে।




যখন আমার শরীরে প্রথম তোর উপস্থিতি টের পেলাম... সে কী আহ্লাদ আমাদের! মানে তোর বাবার আর আমার। রোজই তোর বাবা তোর বৃদ্ধি অনুভব করতে চাইতো আমার তলপেট ছুঁয়ে। কী ভালো যে আমার লাগতো তখন! জীবনবৃত্ত সম্পূর্ণ হবার সুখে তখন আমি বাঁধভাঙা জোছনা হয়ে গলে গলে পড়ছি তোর বাবার সোহাগ নদীর বুকে। উচ্ছল তরঙ্গ যেমন দুলিয়ে দেয় নদীর স্রোতে ভেসে চলা নৌকাখানাকে... আমার জীবনে মাতৃত্বের নব্য অনুভূতি তখন তেমনই কম্পমান। কখনো ভয়ের সুখে, কখনো দুঃখের আশঙ্কায়, কখনো আবার নিছক পূর্ণতা পাবার গৌরবে।




একটি একটি করে দিন পার হচ্ছে... আর প্রাপ্তিসুখের দোদুল্যমানতায় আমি তখন দিন গুনছি তোর আসার। জানিস বাবুই, তোর বাবা এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে বললো যে তোর নাম হবে ঋদ্ধি। আমি বললাম যে সেতো পোশাকি নাম... একটা যে ঘরোয়া নামও চাই। ভাবতে বসলাম দুজনে মিলে। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো, রাত ফুরিয়ে সকাল হলো, তখনো তোর ঘরোয়া নামটি অমিল। মুখটি ব্যাজার করে তোর বাবা অফিসে রওনা হবার সময়ে কী খুশি... কী খুশি... আঙুল তুলে দেখালো আমাকে দূরের পুকুরপাড়ের মাঠের ধারে একপায়ে খাড়া দাঁড়ানো তালগাছের পাতার ফাঁকে ঝুলে থাকা কতকগুলো বাবুই পাখির বাসার দিকে। সাইকেলে চেপে বসে ফিসফিস করে বললো পাঁচজনের কান বাঁচিয়ে... ওর ঘরোয়া নাম হবে বাবুই। খুব খুশি হলাম আমি। নিজের ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সবে সবে ফুলে উঠতে শুরু করা তলপেটের উপরে হাত রেখে বললাম... বাবুই, দুষ্টুমি কোরো না কিন্তু। বাবা তোমার জন্য অনেক খেলনা - দোলনা কতকিছু আনবে। তুমি তো আমার বাবুই সোনা... আমার সোনা বাবুই।




তারপরে শুরু হলো সেকেণ্ড, মিনিট, ঘন্টা, দিন, মাস গোনা। সেতো যেন আর ফুরোতেই চায় না। ডাক্তার, ওষুধ, পরীক্ষা নিরীক্ষা কতকিছুই না চললো! আমি তো তখন বুঁদ হয়ে আছি তোর গায়ের গন্ধ শোঁকার অধীর আগ্রহে। কী জানি কেন জানি না... হঠাৎ একদিন দেখলাম তোর বাবার মুখটা বড়ো বিষন্ন, কপালে দুশ্চিন্তার স্পষ্ট ভাঁজ। তোর ঠাকুমা দাদু আসেন মাঝেমধ্যে আমার ঘরে। তাদেরও চোখমুখ ঘিরে রেখেছে দুশ্চিন্তার কালো ছায়া। আমি তাদের স্বান্ত্বনা দিই... বাবুই তো খুব ভালো আছে। মাঝে মাঝেই আমার পেটে লাথি মারে। বলতে গিয়ে লজ্জায় আবেগে আমার মুখটা যে টকটকে লাল হয়েছিলো... তা আমি আয়না না দেখেও নিশ্চিত করেই বলতে পারি।




তারপর আরো কটা দিন পার হলো টানাপোড়েনে। তোর বাবা একদিন আমাকে নিয়ে আবার ডাক্তার দেখাতে নিয়ে চললো। আমি বললাম তোর বাবাকে... আমার তো কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। শুধু শুধু বারবার ডাক্তার দেখিয়ে মিছিমিছি এতো খরচার কি দরকার? তোর বাবা রিক্সায় বসে আমার মাথাটা শুধু নিজের কাঁধে রেখে বললো, পাগলি একটা। আমি আবার বললাম... দেখো না, বাবুইও তো ভালোই আছে। তোর বাবার ডানহাতখানা টেনে নিয়ে তলপেটে ছুঁইয়ে তোর নড়নচড়ন দেখালাম রিক্সার চিকের পেছনে বসে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছিলো তখন। ছাটে উড়ে গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টি তোর বাবার টোপর হয়ে ফুলে থাকা চুলের ওপরে আটকে ছিলো... আর আমার গালে মুখে ছিটে ছিটে বৃষ্টি ফোঁটা... তোর বাবা যত্ন করে মুছিয়ে দিলো, নিজের পকেট থেকে বার করে আমারই হাতে সেলাই করা ফুলতোলা রুমালে। ডাক্তারখানায় পৌঁছে গেছি... তখনো ভারি সংশয়, আর ভালোলাগায় মেশামেশি আমি। তোর বাবা সত্যিই বৌ-বাচ্চার কত খেয়াল রাখে... কত অকারণ খরচা করে!




খানিকক্ষণ বসে রইলাম। বেশ বড়সড় ডাক্তারখানা। আমার মতোই বয়সী সব নব্য মায়ের লাইন সেখানে। তোর বাবা আমাকে নিয়ে একটা কোণের দিকে বসে ছিলো। একসময় আমাদের... মানে আমার ডাক পড়লো ভেতরের ঘরে। উঠে যাবার সময় তোর বাবা আমার হাতে হাত ছুঁইয়ে একটু চাপ দিলো। সেই প্রথম আমার কেমন যেন গা শিরশির করা শিরদাঁড়া কাঁপানো একটা বরফঠাণ্ডা ভয় করে উঠলো। ভেতরে আবার নাম ধাম জানা... আর দুটো ইঞ্জেকশনের পরে আমার শাড়িটা খুলিয়ে আলখাল্লার মতো এক পোশাক পরিয়ে একটা অল্পবয়সী মেয়ে আমাকে আরো ভেতরের একটা ঘরে নিয়ে গেলো। ঘরটা আধো অন্ধকার। ওষুধের ঝিমধরানো গন্ধে দমবন্ধ করা। জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আমি ভাবলাম... এ আবার কেমন ডাক্তারখানা? ছুটে বেরিয়ে গিয়ে তোর বাবার বুকে মুখ গুঁজে বলতে ইচ্ছে হয়েছিলো... ফিরে চলো, এই ডাক্তারখানা ভালো না।




ভাবনা রইলো ভাবনা হয়েই মনের ঘরে, আর আমি রইলাম শুয়ে সেই আধো অন্ধকারময় ওষুধগন্ধী ঘরে। ছোট্ট সরু এক টেবিলে। ততক্ষণে শুইয়ে দিয়েছিলো তাতে আমায়। তার দুপাশ থেকে বেরিয়ে এলো দুখানা ফোল্ডিং হাত। তাতে বাঁধা হলো আমার হাত দুখানা শক্ত করে। ওপর থেকে ঝোলানো কটা জোরালো আলো জ্বলে উঠলো টপাটপ। আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো। বুজে ফেললাম আতঙ্কে। তার মধ্যেই টের পেলাম কোমরের দুধারে প্যাঁটপ্যাঁট করে আবার দুই ইঞ্জেকশন। কোমর থেকে পা কেমন অবশ হয়ে যাচ্ছে... যেন আমার শরীরের অংশ নয় ওগুলো। তবে তারমধ্যেই বেশ বুঝতে পারলাম ঐ অল্পবয়সী মেয়েটা আরেকজনকে সঙ্গে নিয়ে আমার পা দুটোকে দুদিকে ছড়িয়ে টেনে নিয়ে তুলে দিলো আমি শুয়ে আছি যে সরু টেবিলটায়... তার দুধারে দুটো উঁচু উঁচু পায়ায়। পায়াগুলো ঠিক যেন টিভিতে দেখা সন্ন্যাসী মহারাজের হাত রাখার জায়গার মতো আধা গোলাকার আঙটা দেওয়া। আমার আর নড়াচড়া করার শক্তিও নেই। চোখ ফেটে, বুক ভেঙে কান্নার সমুদ্র এসে পৌঁছলো আমার দুচোখে। অবোধ অভিমানের অসহায় বন্যায় ভেসে যাচ্ছি আমি। ওহ্, সে কী যন্ত্রণা! অমানুষিক! আমাদের পাশের বাড়ির কালি গাইয়ের মতো চেঁচালাম আমি চোখ বুজেই। সেই বীভৎস চিৎকারে চাপা পড়লো ভ্রূণকর্তনের কড়কড় আওয়াজ আর অজাত শিশুর নিষ্ফল ক্রন্দন। মনে হলো আমি মরেই যাই না কেন? ঐ মেয়েগুলো আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। কতক্ষণ ধরে চললো যান্ত্রিক ছুরির ফলায় ফালাফালা করা আমার জরায়ুর এপাশ থেকে ওপাশ। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলি রে বাবুই... তুই আমার শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলি। তোর সহায়সম্বলহীন অপদার্থ মা তোকে বাঁচাতে পারলো না। খণ্ডবিখণ্ড হয়ে তুই হারিয়ে গেলি ডাক্তারখানার বর্জ্যপদার্থের সাথে শহরের কোনো নর্দমায়। অচৈতন্য হয়ে পড়লাম আমি। এক কন্যাভ্রূণের মা হওয়ার অপরাধে গর্ভমোচন হয়েই গেলো আমার। তোর বাবাকে অবিশ্বাস করতে শিখলাম। তোর ঠাকুমা দাদুর আশা পূরণ করে বংশরক্ষার জন্য পুত্রসন্তান আনার কাজে আর আমি কিছুতেই সামিল হলাম না। কে জানে আবার যদি বাবুই তুইই আসিস কন্যা হয়েই... আর আবার তোকে আমি বাঁচাতে না পারি। পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা আমি আর পেতে চাইনি বাবুই। তোর কাছে যখন যাবো আমি... তখন তাহলে তোর কাছে মুখ দেখাবো কি করে বলতো সোনা আমার? তুই তো তখন বলবি... মা, তুমি এতো স্বার্থপর? তোর সেই কৈফিয়তের কি জবাব দেবো আমি বল? তাই যতদিন শরীর থেকে রক্তধারা নির্গত হলো... ততদিন নার্সদিদির কাছ থেকে লুকিয়ে নিয়ে গর্ভনিরোধক বড়ি খেয়ে গেলাম লাগাতার। নিজের অসহায় অনাগত সন্তানকে হত্যা করার চেয়ে বাঁজা বদনাম অনেক সুখের। আমাকে তুই কোনোদিনও ক্ষমা করিস নারে বাবুই... তাহলে আমার প্রায়শ্চিত্ত অসম্পূর্ণ থেকে যাবে রে বাবুই সোনা।




আজ তোকে এই চিঠিটা লিখে হালকা হতে চাইছিলাম। আচ্ছা বাবুই বলতে পারিস, যেদিন তোকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো সেদিন কেন এখনকার মতো এমন লকডাউন ছিলো না? তবে তো তুই বাঁচতি, আমি বাঁচতাম, আমার মাতৃত্ব বাঁচতো। থাক, যা হয়নি তাই নিয়ে আর আক্ষেপ করে কীইবা হবে? তবে জানিস বাবুই, তোকে চুপিচুপি বলে রাখি... আমি চাই, এই লকডাউন আর কখনো না উঠুক... ঐ গর্ভপাতের ক্লিনিকগুলো আর কখনো না খুলুক... যেখানে আইনতঃ বন্ধ থাকার নিয়মের ফাঁক গলে ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ হয় অবৈধভাবে অবাধে পয়সার জোরে, আর তোর মতো আরো কতশত বাবুইকে চিরকালের মতো তার মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন করে নর্দমার কাদাপাঁকের অন্ধকারের মধ্যে তলিয়ে দেওয়া হয় আবর্জনার মতো... শুধুমাত্র কন্যাভ্রূণ হওয়ার অপরাধে। কোটি কোটি ধিক্কার আমার এই পোড়া সমাজসংসারের এই অসভ্য নগ্ন রাক্ষসবৃত্তিকে




মুখবন্ধ খামে রাখলাম আমি এই চিঠি। জানি কখনো তোর কাছে পৌঁছবে না এই চিঠি। কারণ অসম্ভব কি কখনো সম্ভব হয় রে সোনা? তবুও তোর মায়ের আকুলতার আর্তিটুকু কালির আঁচড়ে লেখা থাক। যে রক্তাক্ত কালিটা গলিত উত্তপ্ত লাভার মতো আমাকে আজীবনের জন্য পুড়িয়ে বেরিয়ে এসেছিলো... আমার আর তোর সংযোগের অর্ধগঠিত নাভিরজ্জুটার ছেদনকালে।




বাবুইয়ের হতভাগ্য মা পৃথিবীর সব কন্যাসন্তানের চিরায়ু কামনা করে। একদিন ঠিক দেখা হবে আমার সোনা বাবুইয়ের সাথে বাবুইয়ের মায়ের। প্রতীক্ষায় রয়েছি...


ইতি,

আশীর্বাদিকা আমার বাবুই সোনার মা।





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy