#মরণের পরে
#মরণের পরে
ছোটগল্প
কলমে: বুলা বিশ্বাস
শিরোনাম:
#মরণের পরে
সিমলাপালের মণ্ডলকুলী গ্রামে, জমিজরিপের কাজে নিযুক্ত সীতেশ থাকে ঐ গ্রামেই, গ্রাম পঞ্চায়েতের একটা মাটির দোতলা বাড়িতে। চাকরী পাওয়ার পর থেকে এখানেই তিনি ভাড়ায় আছেন, প্রায় তিনবছর। নীরুপমার সাথে, পাঁচ মাস হলো ওর বিয়ে হয়েছে।
দক্ষিণ কোলকাতার টালিগঞ্জের মেয়ে নীরুপমার মা বাবা সেমন্তী সেন ও পলাশ সেন দুজনেই বৈজ্ঞানিক। নীরু ওদের একমাত্র আদরের সন্তান। যদিও নীরুর বড় দিদি ছিল। ওর যখন বাইশ বছর বয়স, এক অজানা কালাজ্বরে মাত্র দশদিনে রোগের সাথে ভীষণ যুদ্ধ করে সবার স্নেহমায়াকে ছিন্ন করে, পরপারে পাড়ি দেয়, চারু।
নীরুর তখন চব্বিশ বছর বয়স। দিদি চারুলতার অকাল প্রয়াণকে,ও মেনে নিতে পারে নি, কারন ওরা দুজন, দিদি বোনের সম্পর্কের থেকেও ভালো বন্ধু ছিলো। দিদির পিঠে পিঠ না ঠেকিয়ে নীরু ঘুমোতে পারতো না। দিদি ওকে সারাক্ষণ আগলে রাখতো। সব কথা, নানা গল্প ওরা একে অপরকে না বললে, যেনো ওদের পেটের ভাত হজমই হতো না। বলাই বাহুল্য দিদি বোনের এই মধুর সম্পর্ক চিরায়ত। এক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় হয় নি। দিদিকে ভুলতে পারে না , বলা যায় আজও ভুলতে পারেনি।
দিদি ওকে এতটাই ভালোবাসতো, যে কখনো নীরু কোনো অন্যায় করলে, ওর দোষটা পর্যন্ত নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে, অক্লেশে মায়ের কাছে বকা খেয়ে হজম করতো। নীরু মায়ের বকার হাত থেকে রেহাই পেলেও ওর জন্য দিদিকে মিথ্যে বকা খাওয়াটাতে ও কষ্ট পেয়েছে বহুবার। বহুদিন দিদিকে ও খুঁজে বেরিয়েছে। কোথাও পায়নি। ওর অবুঝ মন খালি ভাবে, দিদি হারিয়ে যায় নি, হারিয়ে যেতে পারে না। অহেতুক কান্নাকাটি করে ফেলে, জিনিষপত্র ভাঙচুর করে, বেডরুম ছেড়ে বেরোতে চায় না। এমনকি ও ভাবে দিদি ওর সাথে সাথেই আছে। আর আছে এই বেডরুমেই। এই বেডরুমটাই যে কিছুদিন আগেও ছিলো ওর আর ওর দিদির স্বর্গ।
নীরুর মা বাবাকে প্রতিদিনই বেরোতে হয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ এর কাজে তাঁরা ব্যস্ত। নীরু কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা নিয়ে সাতাশি সতাঙ্শ নাম্বার পেয়ে পোষ্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি সম্পূর্ণ করেছে। এরপর ও ডক্টরেট, পোষ্ট ডক্টরেট করে, ও ওর মা বাবার মতোই গবেষণা করবে, এরকমই তো কথা ছিলো।
কিন্তু দিদির চলে যাবার পর, ওই ডানপিটে মেয়েটা, কেমন ভীতু হয়ে গেল। অবসাদগ্রস্ত এক রোগীতে পরিণত হলো।
ওর অস্বাভাবিকতা প্রথম চোখে পড়ে, মালতীদির। মালতীদি, খুব ছোটবেলায় ওর মায়ের সাথে, এ বাড়িতে এসেছে। ওর জন্মের পর ওর বাবা ওদের ছেড়ে দিয়ে, অন্য মেয়ের সাথে বাসা বেঁধেছে। আর সহায়সম্বলহীনা মানুষদুটোর তখন থেকেই নীরুদের বাড়িতে স্থায়ী জায়গা হয়ে গেছে।
মালতীর মা কাজকর্ম করতো, আর মালতী, নীরু চারুর সাথে খেলা করতো। ও ওদের থেকে বয়সে একটু বড়ো ছিলো। মায়ের থেকে শোনা কতো গল্প শোনাতো ওদের! রাজকন্যার, দুয়োরাণী সূয়োরাণীর, ভূতের, শাকচুন্নীর নানা গল্প। আর ওর ভূতের গল্প শুনলে, ওদের খুব হাসি পেতো। ওদের মা যে বলেছে, ভূত বলে কিছু নেই। তাই ওরাও মালতীদিকে বলতো, ভূত বলে কিছু নেই। ওদের দেখা যায় না, তাই ওরা ভূতে বিশ্বাস করে না। মালতীদি বলতো, 'ওরকম কতা বলতে নেই, ভূত দেকোনি, এটা বললে কিন্তু ওরা তোমাদের দেকা দেবেই দেবে।' ওরা তো হেসেই খুন। মালতীদি, ওদের বলতো,' জানো মানুষ মরলেই ভূত হয়ে যায়।'
এহেন ডানপিটে মেয়েটা, দিদিকে হারিয়ে, কেমন যেনো পাগলপারা হয়ে যাচ্ছে। মা মারা যাবার পর মালতী এ বাড়ির সব কাজ করে, মামা মামী কাজে বেরিয়ে যাবার পর ওদের দেখভাল করা, সব, সঅঅঅব।
চারুর মৃত্যুর পর বাড়িটা যেনো খা খা করে। মালতীও কেমন যেন মনমরা হয়ে পড়েছে। ও বোঝে, নীরুকে সামলাবার জন্য এমত মুহুর্তে ও ছাড়া কেউ নেই। নীরুর মা বাবার মালতীর উপর অগাধ বিশ্বাস। তাই তো কাজে বেরোবার আগে, সেমন্তী, মালতীকে বলে যায়,' নীরুকে চোখে চোখে রাখিস, কোনো অসুবিধে হলে আমাকে ফোন করিস যেনো।'
নীরুর সারাদিন, বেডরুমে কাটানো, পাশবালিশটাকে দিদি মনে করে, চাদরে মুড়ি দিয়ে ও আর দিদিস্বরূপ পাশবালিশকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকা, গল্প করা, হাসাহাসি করা, এ সবই মালতী নীরুর ঘরে ঘুমাতে এসে লক্ষ্য করে।
মালতীর কাছে শোনা ছোটবেলার ওই গল্পের ভাবনা, যেমন অসময়ে মানুষের মৃত্যু হলে, তার আত্মার মুক্তি হয় না, তার চেনা পরিচিত জায়গায় ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। দিদির চলে যাওয়ার পর, এই ভাবনাটাকেই নীরু মনে মনে প্রশ্রয় দিতে শুরু করেছে।
মালতীকে জিগ্যেস করে, নীরু স্থির সিদ্ধান্তে আসতে চায় যে তার দিদি তার কাছেই আছে। শূন্যে বিলীন হয়ে যায় নি। মালতীও কিন্তু নীরুর কথাকে সায় দেয়। মালতী বলে, সন্ধ্যাবেলায়, তিনতলায় চিলেকোঠা সংলগ্ন ঠাকুরঘরে, ও যখন সন্ধ্যা দেখাতে যায়, ওর কিরকম গা ছমছম করে।
এই তো, গত মঙ্গলবার, রাত তখন আটটা, মালতী ছাদ থেকে কাপড় জামা তুলে ছাদের দরজার কাছে এসে দেখে, খোলা দরজা কিভাবে ভিতর থেকে বন্ধ হয়ে গেছে। দরজা খুলে তো ও ছাদে এসেছে। বাড়িতে মামা মামীর ফিরতে, প্রায় রাত ন'টা বেজে যায়। ঘরে একা নীরু। দোতলার বেডরুমে চুপ করে শুইয়ে থাকে। ও ছাদে বড় একটা আসে না। বাড়িতে ও আর নীরু ছাড়া কেউ নেই। তবে কে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করলো! মালতী ভীষণ ভয় পেয়ে গেল। ওর গা ভারী হয়ে আসছে। হঠাৎ ছাদের ঈশাণ কোণে চোখ পড়তেই, এ কি, ও কাকে দেখতে পাচ্ছে? এ তো চারু! ওইতো ওর প্রিয় লাল রঙের লঙ্ ড্রেসটা পড়ে, একঢাল এলোচুল এলিয়ে পিছন করে দাঁড়িয়ে আছে। সংজ্ঞাহারা হয়ে পড়ে ও। যখন ওর জ্ঞান ফেরে, ও দেখে, ও ওর খাটের উপর শুয়ে আছে। ডাক্তার ওকে দেখছেন। মামা মামী সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ডাক্তারবাবু, মামাকে বলেন, 'ওর প্রেসারটা খুব লো। ও কিছুদিন বিশ্রামে থাকুক , সব ঠিক হয়ে যাবে।' কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে উনি চলে গেলেন।
মামী ওকে অনেকবার জিগ্যেস করেছেন, কেনো ও ওরকম অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল? ও কি করে মামা মামীকে সত্যিটা বলবে? ওরা তো ওসব বিশ্বাস করে না, বরং বলে' মালতী, নীরুকে চারু সম্পর্কে কোনো আজগুবি গল্প শোনাবি না।' রাতের বেলায় নীরুর ঘরে শুতে এসে, ওর সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা ও নীরুকে বলেছিলো। নীরুও মালতীকে বলেছে, ওর দিদি ওর কাছে আসে, ওরা দুজনে সারাক্ষণ মজা করে।
দিনের পর দিন মালতী, নীরুর এরকম অস্বাভাবিক ব্যবহারের মানেটা বুঝতে পারলেও নীরুর এহেন আচরণের কথা, নিজে নিজে বেশিক্ষণ হজম করতে পারে না। তাই, একদিন ও মামা মামীকে সব জানিয়ে দেয়।
ওরা নীরুর সাথে কথা বলেছে, অনেক বুঝিয়েছে, কিন্তু নীরু সবসময়ই বলে, ওর দিদি ওর কাছেই আছে, ওর কাছে আসে, কখনো কখনো লুকিয়ে পড়ে। ও দিদির কথা শুনতে পায়, দিদির গান শুনে ও নাচলে, দিদি ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করে, দিদির সাথে ও ঘুমায়, এরকম নানাবিধ অস্বাভাবিক কথাবার্তা নীরু বলতে থাকে।
অনন্যোপায় হয়ে, নীরুর মা বাবা কোলকাতা শহরের একজন বড় সায়ক্রিয়াটিস্টের সাথে অ্যাপয়েণ্টমেণ্ট করেন। উনি নীরুকে কাউন্সিলিং করেন, ওষুধ দেন। বলেন, দিদির অনুপস্থিতিকে ও কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। ভীষণভাব আঘাত পেয়েছে, বাস্তবের মাটিতে নেমে আসতে ওর কিছুটা সময় লাগবে। তবে উপযুক্ত পরিবেশ, ভালোবাসা, কাউন্সিলিং, ওষুধপত্র এগুলোর ঠিকঠিক মতো প্রয়োগে ও সুস্থ হয়ে উঠবে।
প্রায় ছ'মাস ডাক্তারবাবুর অকুণ্ঠ সহযোগিতায়, মালতীদির যত্ন, নীরুর মা বাবার পরিচর্যায় নীরু অনেকটাই সুস্থ। ওর ডাক্তার বলেছেন, ওকে কাজের মধ্যে রাখতে। চুপচাপ থাকলেই, রোগটা আবার ফিরতে পারে।
নীরুর মায়ের বান্ধবীর একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে, নীরু পদার্থবিদ্যার শিক্ষিকা পদে নিযুক্ত হয়। বেশ অল্পদিনেই ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে, নীরুপমা ম্যাম অনেকটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে ফেলেছে।
এরপরেই, নীরুর মা বাবা নীরুর জন্য পাত্র খুঁজতে শুরু করেন। মনোনীত পাত্রও পেয়ে যান। সরকারী অফিসে জমিজরিপের বড়ো পদে কর্মরত পাত্র সীতেশ, খুব বড়ো মনের ছেলে।
নীরুর মা বাবা ঠিকই করেছিলেন, যার সাথে নীরুর বিয়ে হবে, তাকে ও তার বাড়ির লোকদের নীরু সম্পর্কে সব জানিয়ে বিয়ে দেবেন। এর ফলে বহু ভালো সম্পর্ক ওদের হাতছাড়া হয়। কারণ, শুধু সুন্দরী আর মেধাবী হলেই, বিয়ের বাজারে ছাড়পত্র পেতে পারে না, ওরকম পাগল মেয়ে, যদিও এখন সুস্থ, কিন্তু পরে তো আবার হতে পারে, এই ভয়ে অনেকেই এই বিয়েতে পিছিয়ে গেছে।
এ সম্বন্ধতে সীতেশের পরিবারের আপত্তি থাকলেও, সীতেশ কিন্তু, একদেখাতেই, নীরুকে পছন্দ করে, আর প্রায় গোঁ ধরেই এই বিয়েটা করে। নীরুর মা বাবাকে কথা দেয়, ও নীরুকে ভালোবাসার আবডালে রেখে, নীরুর মধ্যে বিশ্বাস জুগিয়ে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে রাখবে, কোনো অবস্থাতে ওকে ও অসহায় হতে দেবে না। সীতেশ হয়ত ওর দিদির জায়গাটা নিতে পারবেনা, কিন্তু ওর নিখাদ ভালোবাসা দিয়ে, নীরুকে ওর দিদি হারানোর দুঃখটাকে ঘোচাবে।
নীরুকে বিয়ে করে, সীতেশ সদ্য সদ্য নীরুকে ও ওর কাজের জায়গায় নিয়ে যেতে চায় না, কারণ, সীতেশ যেখানে থাকে, সেটা একেবারেই অজ পাড়া গাঁ। মাঝে মাঝেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। নীরু এতো বিলাসিতায় মানুষ, ওর হয়তো এরকম পরিবেশ ভালো লাগবে না।
কিন্তু সীতেশের আদর, ভালোবাসার কাঙালিনী নীরু, সীতেশকে ছেড়ে বেশিদিন থাকতে পারছে না, বারেবারেই ও সীতেশকে ফোন করে, ওর কাছে নিয়ে যাবার জন্য কাকুতি মিনতি করতে থাকে। কিন্তু সীতেশের এখানে কাজের অনেক চাপ। একেবারেই ছুটি পাচ্ছে না ও। সীতেশ অনন্যোপায় হয়ে , নীরুকে ওর কাছে পৌঁছে দেবার জন্য শ্বশুরমশায়কে অনুরোধ করে।
কিন্তু এরই মধ্যে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল।
যেদিন নীরুকে নিয়ে ওর মা বাবা সীতেশের কাছে নীরুকে পৌঁছতে যাবে, তার আগের দিন রাতে, সেমন্তী ও পলাশ নীরুকে নিয়ে অনেকক্ষণ গল্প করেছে। ঘুমোতে একটু রাতই হয়ে গেছে ওদের।
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ওরা। হঠাৎ সেমন্তীর পায়ে, দুটো ঠাণ্ডা হাতের ছোঁয়ায় সেমন্তীর ঘুম ভেঙে গেল।
ঘর অন্ধকার। জানলা দিয়ে রাস্তার সামান্য আলো, ঘরের ভিতর ঢুকে একটা আবছা আলোআঁধারির সৃষ্টি করছে। চোখ খুলে সেমন্তী ওর পায়ের কাছে ও যা দেখতে পেলো, তাতে ওর জিভ শুকিয়ে গেছে, বুকের ভিতর নিজের হৃদস্পন্দন নিজেই শুনতে পাচ্ছে যেনো। স্থির হয়ে গেছে ও, কাঠ হয়ে শুয়ে আছে। ও দেখছে, ওর বড় মেয়ে চারু আকুলভাবে কাঁদছে, ইশারায় যেনো বলতে চাইছে, ওর বোন নীরুকে যেনো এখান থেকে ওরা না নিয়ে যায়, কিন্তু কেন? এটা জানবার জন্য মুখ খুলতে গিয়ে, সেমন্তীর গলা রুদ্ধ হয়ে গেছে। এক ঝটকায় মশারি খুলে বেরোতে গিয়ে, পলাশের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ও।
পলাশের ঘুম ভেঙে যায়। রাত তখন দুটো। তাড়াতাড়ি ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে, পলাশ সেমন্তীর কাছ থেকে সব শুনে, ওরা সারা ঘর, বাথরুম, ব্যালকনি, এমনকি মেন গেট খুলে, চারিদিক তন্নতন্ন করেও চারুকে কোথাও খুঁজে পেলো না।
ড্রয়িঙরুমে বসে স্বামী স্ত্রীর সেকি আকুল কান্না! এতদিন তো ওরা জানতো, মৃত্যুর পর আত্মার কোনো অস্তিত্ব থাকে না, তবে এ কি ঘটনা ঘটলো, যেখানে ওদের বৈজ্ঞানিক যুক্তি, হার মানতে চলেছে।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলো। ওরা নিজেরা নিজেদের শান্ত করে, চোখে, মুখে, ঘাড়ে জল দিয়ে আবার শুয়ে পড়লো। জানলা দিয়ে সুন্দর ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে। ওরা ঘুমিয়ে পড়লো।
আধ ঘণ্টাও হয়নি, পলাশ চিৎকার করে,সেমন্তীকে ধাক্কা মেরে জাগিয়ে দিয়ে বললো, 'তাড়াতাড়ি ওঠো, আমাদের চারু এসেছে। ওই,ওই তো ও ড্রয়িঙরুম থেকে বেরিয়ে নীরুর ঘরের দিকে যাচ্ছে।' তাড়াতাড়ি ওরা বিছানা থেকে উঠে, আলো জ্বালিয়ে, খাট থেকে নেমে ড্রয়িঙরুমের দিকে দৌড়ে, নীরুর ঘরের দিকে গিয়েও ওরা কোথ্থাও চারুকে দেখতে পেলোনা।
কিন্তু আশ্চর্য, এটা কী করে সম্ভব! যে পারফিউমটা চারু ব্যবহার করতো, চারু চলে যাবার পর, যেটাকে সযতনে সেমন্তী ড্রেসিঙ্ টেবিলের ভিতর দিকে রেখে দিয়েছিলো। ড্রেসিঙ টেবিল থেকে, সেই পারফিউমের শিশিটা মেঝেতে ভেঙে পড়ে আছে, বাড়িময় তার গন্ধে ভেসে যাচ্ছে। আর এতে যেন চারুর উপস্থিতি বেশি করে প্রতিভাত হচ্ছে। শিশিটা কে ফেললো???
নিমেষে ওদের চোখ থেকে ঘুম উধাও। কোনো অঙ্ক দিয়েই, দুই বৈজ্ঞানিক এই উদ্ভট সমস্যার সমাধান করতে পারলো না।
সারা রাত ভালো করে ঘুম হয়নি বলে, সেমন্তীর মাথাটা ধরে আছে। এ এমন ঘটনা যা ব্যাখ্যাতীত। গত রাতে সেটা ওদের উপর দিয়ে ঘটে যাবার জন্য, সেমন্তী তার রহস্য উন্মোচনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ওর মনে হয়, তবে কি সেদিন মালতীও এরকম ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলো? তবে কি নীরু ওর দিদি সম্পর্কে যা বলে, একেবারেই ঠিক? সেমন্তী, কেনো কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছে না, ও নিজেই বুঝতে পারছে না। গুম্ হয়ে বসে আছে ও।
মালতী কোন সকালে চা দিয়ে গেছে, সেমন্তীর কোনো খেয়ালই নেই। চায়ের কাপ নিতে এসে মালতী দেখে, মামীর চা ঠাণ্ডা জল হয়ে গেছে। মামী আজ কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে চুপচাপ বসে আছে, মাঝে মাঝেই চোখ মুছছে।
এতদিন ও এ বাড়িতে এসেছে। মামীকে এরকমভাবে, এত আনমনা হয়ে বসে থাকতে কোনোদিনও ও দেখেনি। মালতী খুব সাহস করেই মামীকে বলে,' মামী, আর এক কাপ গরম চা এনে দেবো? মামী, নীরু আজ চলে যাবে বলে তোমার মন খারাপ?'
সেমন্তী শান্ত গলায়, মালতীকে বললো, 'তুই এককাপ গরম চা নিয়ে, এখুনি একবার আমার ঘরে আয়তো, কথা আছে।' মামীর এরকম জরুরী তলবে, মালতীর মনে একটু খটকাই লাগলো।
তাড়াতাড়ি এক কাপ গরম চা নিয়ে এসে, মামীর মুখের সামনে দিয়ে, মামী কি বলবে, তা শোনার অপেক্ষায় মালতী দাঁড়িয়ে থাকে।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে, সেমন্তী মালতীর কাছ থেকে, সেই সন্ধ্যা বেলার ঘটনাটা জানতে চায়। মালতী আমতা আমতা করতে থাকে। সেমন্তী ওকে গতকাল রাতে, ওর আর নীরুর বাবার সাথে যে ঘটনা ঘটে গেছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে, মালতীকে আশ্বস্ত করে। মালতী বলে,'মামী, তাহলে তোমরাও চারুকে দেখেছ? নীরু তো এখনো চারুর সাথে কথা বলে।' এই বলে মালতী ওর সাথে ঘটে যাওয়ার পুরো বৃত্তান্ত মামীকে খুলে বলে। এরপর সেমন্তীর আর বুঝতে বাকী থাকে না যে, পৃথিবীতে এখনো এমন কিছু রহস্য আছে, যাকে বিজ্ঞান, বুদ্ধি, যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। তবে কি এই ঘটনাটাও তারই মধ্যে পরে????
সেমন্তীর অবচেতন মনে, মনে হয়, চারুর শারীরিক মৃত্যু ঘটে গেলেও আত্মার মৃত্যু হয়নি। চারুর অতৃপ্ত আত্মা এখনো ওদের কাছেই ঘুরঘুর করছে।
তাতে ও দুঃখ পায় না, বরং খুশিই হয়, যেভাবেই হোক না কেনো, চারুতো একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায় নি। মনে মনে ভাবে, থাকনা ও ওদের কাছে, এভাবেই। ও একটুও ভয় পায় না, ওদের হারানো মেয়ে, যে রূপেই ওদের কাছে আসুক না কেনো, ওরা ওকে গ্রহণ করবে। তাই তাড়াতাড়ি সেমন্তী পলাশের কাছে গিয়ে চুপিচুপি বলে,এভাবেই যদি চারু, প্রতিরাতে ওদের কাছে আসে, তাতে মন্দ কি? নাই বা পারলো, ওরা চারুকে ছুঁতে। চারুর অশরীরি আত্মার সাথেই না হয় ওরা মিলিত হবে। চারুর সাথে কথা না বলতে পারলেও, ওর আকুতি, ওর গতিবিধি দেখেই না হয় ওরা খুশি থাকবে। নেই মামার চেয়ে তো কানা মামা ভালো!
পলাশ ডুকরে কেঁদে ওঠে। সেমন্তীও শেষ কালে কি পাগল হয়ে গেলো? এও কি সম্ভব?
সেমন্তী জাপ্টে ধরে ওর স্বামীকে বলে, 'কালকে রাতের ঘটনাটাকে তুমি কি অস্বীকার করতে পারো?'
এক মুহুর্তে চুপ করে যায় পলাশ। সত্যি তো, কালকে, ওর নিজের চোখে দেখা ওর আদরের বড়ো মেয়েকে ও অস্বীকার করে কোন সাহসে?
তাই আর দেরি করে না ওরা। নীরুকে ওর স্বামীর কাছে তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিয়ে, ওই গাড়িতেই বাড়ী ফিরে আসবে। কথা ছিলো গ্রাম্য পরিবেশ। ওরা ওখানে দু-চারদিন থেকে, নীরু, জামাইয়ের সাথে দু তিনদিন সময় কাটিয়ে, বাড়ী ফিরে এসে নিজেদের কাজে মন দেবে।
কিন্তু, এখন তো এটা সম্ভব নয়, পরিস্থিতি পুরোই পাল্টে গেছে। এখানে চারু যে একা। মা, বাবাকে না দেখতে পেলে যে চারুর কষ্ট হবে!
বেলা থাকতে থাকতে নীরুকে নিয়ে সেমন্তী, পলাশ সাথে মালতীও ওদের সাথে বেরিয়ে পড়ে। মণ্ডলকুলীতে পৌঁছতে রাত প্রায় দশটা বেজে যায়।
সে রাতে ওদের আর বাড়ি ফেরা হলো না। সীতেশ আরো কিছুদিন ওদের থাকতে বললেও শ্বশুরমশাই জানিয়ে দেয়, সেটা সম্ভব নয়। কারণটাও ওরা সীতেশের কাছে লুকায় না।
সীতেশ ওদের কাছে শুধুমাত্র জামাই ই নয়, নিজের ছেলের থেকেও বেশি। যেভাবে নীরুকে আগলে রেখেছে, যেভাবে শ্বশুর, শাশুড়ির মনোবল যোগায়, তাতে এমত মুহুর্তে, ওদের কাছে সীতেশের থেকে আর কেউ আপনজন হয় না।
সীতেশকে সব বুঝিয়ে দিয়ে, নীরুকে যেন ও চোখে চোখে রাখে, এসব বলে, পরের দিনই সেমন্তী, পলাশ আর মালতী বাড়ি ফিরে আসে।
সীতেশের তখন অন্য ভাবনা। এখন ওকে একটু অন্য কিছু ভাবতে হবে। কারণ ওর বৈজ্ঞানিক শ্বশুর শাশুড়ি, যদি অলৌকিক মায়াজালে পড়ে যায়, তাহলে ওই বা সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে নেবে কি করে?
ডাক্তার নীরুকে স্রিজোফেনিয়ার রোগী বললেও, ওর শ্বশুর শাশুড়ি কিংবা মালতী তো রোগী নয়।ওরা নিশ্চয়ই কিছু প্রত্যক্ষ করেছে, তবেই বলছে।
যাই হোক ওর চিন্তা কিন্তু এখন অন্যখাতে বইছে। শ্বশুর শাশুড়ি চারুকে কাছে পাবে বলে,তড়িঘড়ি কোলকাতায় রওনা দিলেও, সীতেশ নিশ্চিত, চারু তার একান্ত প্রিয়জনের সাথেই থাকবে। যদি সত্যিই চারুর আত্মা থেকে থাকে তো, নির্ঘাত ও নীরুকে ছাড়বে না।
বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। কয়েকদিন ধরে সীতেশের একটু জ্বরজ্বর ভাব, ঠাণ্ডা লেগেছে, ও বাড়ি বসেই কাজ করছে। নীরু এসে গেছে। ওর ভালোই লাগছে। নীরুকে কাজে ব্যাস্ত রাখতে হবে। তাই সীতেশ ওর রান্নার দিদিকে বলে রেখেছিলো যে নীরুকে ও সব জোগাড় করে দেবে, নীরু রান্না করবে। হাসি গল্পে খুনসুটি করে, নীরু সীতেশের ভালোই সময় কাটছিলো।
সীতেশ কিন্তু সবসময়েই সজাগ থাকতো, এবার ওই হয়তো, কোনো অস্বাভাবিক কিছু প্রত্যক্ষ করতে চলেছে। সীতেশের মন তৈরী। আর নীরুই যে এর মূল আধার, সেটা ভেবে নিতে, সীতেশের একটুও অসুবিধে হলো না।
নীরুরা আসার আগে থেকেই, ছোটোখাটো কিছু ঘটনা ঘটেই চলেছে। যদিও সীতেশ সেগুলোকে কোনো পাত্তাই দেয়নি। যেমন, নীরুকে যেদিন ওর বাড়ির লোকেরা দিতে এসেছিলো, ওরা আসার ঠিক আধঘণ্টা আগে, সীতেশের দরজায়, বেশ জোরে জোরে কড়া নাড়ার আওয়াজ হয়। সীতেশ ভাবে, নীরুরা এসে গেছে। এক ছুট্টে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে ও বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখে, কেউ কোথাও নেই। পাশের বাড়ি থেকে, গড়াই বাবু পর্যন্ত সেই আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলেন, তিনি জানতেন, সেদিন সীতেশের বৌ, শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আসছে। আওয়াজ শুনে ভেবেছিলেন ওরাই হয়তো এসে পড়েছে। তাই সীতেশের দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে, গড়াইবাবুও জানতে চেয়েছিলেন, ওরা এসে গেছে কিনা।
কিংবা যখন যখনই নীরুর কথা ভেবে ও আনন্দে আত্মহারা হয়েছে, সুখস্মৃতিতে মনটা উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেছে, ঠিক সেইসময় রান্নাঘর থেকে, ঝনঝন করে কিছু পড়ে যাবার আওয়াজ পেয়ে ছুট্টে গিয়ে দেখে, কোথাথেকে একটা কালো বিড়াল রান্নাঘরে ঢুকে ওর সাধের ইলিশভাপে খেয়ে,পালাতে গিয়ে, ভাতের সরঞ্জামসুদ্ধ সব ফেলে, জানলা দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।ওর সুখস্মৃতিতে ভাটা পড়ে যায়। রান্নার দিদি চলে গেছে, ফলে নিজের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ও। কখনোবা ওর ভাবনা চিন্তায় জল ঢেলে দেবার জন্য এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঝোড়ো হাওয়া, ওর ঘরে ঢুকে, ওর অগোছালো সংসার কে আরো তছনছ করে দিয়ে গেলো। জিনিসপত্র ঠিকঠাক জায়গায় রাখতে গিয়ে, ওর রোম্যান্টিসিজম উধাও।
সীতেশ এখন এগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। সীতেশ দেখছে, নীরুকে নিয়ে সুখস্মৃতিতে ভাসতে গেলেই, কিন্তু যত বিপত্তি বাঁধছে। এই তো সেদিন সীতেশ ওর বিয়ের অ্যালবামটা নেড়েচেড়ে দেখছে, নীরুর সাথে কিছু ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের ছবিগুলো সন্তর্পনে দেখছে। রান্নার দিদি রান্না করছে, একফাঁকে এসে সীতেশকে এক কাপ কফি দিয়ে, আবার নিজের কাজে চলে গেছে। এরই মাঝে, সীতেশের একটা পার্শেল এসেছে, সীতেশ উঠে বাইরে অপেক্ষমান পিয়নের কাছ থেকে সই করে পার্শেলটা নিয়ে ফিরে এসে দেখে, ওর অ্যালবামের উপর, ওর অর্ধসমাপ্ত চায়ের কাপ উল্টে পড়ে, কিছু ভালো ফটো চায়ে ভিজে যা তা অবস্থা হয়ে গেছে। চিৎকার করে রান্নার দিদিকে বকাবকি করতে, রান্নার দিদি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জানিয়ে দিলো, ও দাদাবাবুর ঘরে কফি দিয়ে যাবার পর ঢোকেইনি। সীতেশ স্তম্ভিত হয়ে যায়। বিরাট একটা জিজ্ঞাসা চিহ্ণ ওর মাথার মধ্যে সৃষ্টি হয়। এ সব ঘটনা কি নিছকই ঘটে যাওয়া ঘটনা, নাকি এই ঘটনাসমূহ কোনো না কোনো অশুভ আভাসের ইংগিত???
ওর এখন মনে হচ্ছে, তবে কি চারুর বিদেহী আত্মা চায় না, নীরুকে নিয়ে সীতেশের সুখের সংসার গড়ে উঠুক! নীরু কি শুধুই ওর একার? নীরুকে কি ও কারো হতে দিতে চাইছে না? ভয়ে বুক কেঁপে ওঠে সীতেশের।
পরেরদিন, দুপুরের খাবার খেয়ে, সীতেশের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা চলে যায়। নীরুর মা বাবার জন্য মন খারাপ হয়ে গেলেও, সীতেশকে কাছে পেয়ে খুব খুশি। বিকেল বেলায়, সীতেশ নীরুকে নিয়ে, বাড়ির পিছনদিকে, বেশ কয়েকবিঘা জুড়ে মহীরুহ থেকে ছোটো বড়ো মাঝারি মাপের গাছগাছালিতে ভরা জঙ্গলটাতে ঘুরে বেড়ালো। নানান ফুলের গাছ, ফলের গাছ, শাল শিমুল, জংলী অনেক অনেক গাছ দেখে নীরু খুব খুশি। একটা কাঠচাপা ফুলের গাছ দেখেতো নীরু আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লো। সীতেশকে জড়িয়ে ধরে বললো,'জানো, আমাদের বাড়ির উঠোনে এরকম একটা কাঠচাপা ফুলের গাছ ছিলো। দিদির ভীষণ পছন্দের গাছ ছিলো। বাজ পড়ে গাছটা মরে গেছে।'
এইরে বেশ তো ছিলো, আবার দিদির কথা কেনো, মনে মনে ভেবে, সীতেশ প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে, নীরুকে নিয়ে, তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে এলো।
শীতের সন্ধ্যা ঝুপ্ করে নেমে আসার আগেই, নীরুকে নিয়ে, সীতেশ বাড়ি ঢুকে পড়লো।
একে শীতের রাত, এখানে ভোল্টেজ আপডাউন করতেই থাকে। কখন আলো চলে যায়, তাই রাত নটাতেই, ওরা রাতের খাবার খেয়ে নেয়। পরিপাটি বিছানা। সীতেশ নীরুকে বলে, 'তুমি শুয়ে পড়ো, আমি চারিদিকে দরজা বন্ধ করে, তালাচাবিটা দিয়ে আসছি, ঘুমিয়ে পড়ো না যেনো, আজ অনেক গল্প করবো,' বলে সীতেশ ওর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ওদিকে নীরু কম্বলের তলায় ঢুকে ,একটা গল্পের বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লো। সীতেশ সমস্ত বাড়িটাকে নিশ্ছিদ্র করার মতো করে, তালাচাবি দিয়ে আটকে, ঘরে এসে দেখে, নীরু ঘুমিয়ে কাদা। যেনো মনে হচ্ছে, পরম আশ্রয়ে নিবিড়ভাবে ও ওর বিছানায় নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। এটাই তো ওর নিজের ঘর।
সীতেশ ওকে জাগায় না। সারাদিনের ক্লান্তিতে সীতেশও ঘুমিয়ে পড়লো ঘুম ভাঙ্গলো, রাত তখন পৌনে দু'টো।
ও মেঝেতে পড়ে আছে। সীতেশ বুঝে পেলো না, ও কেন মেঝেতে পড়ে আছে! খাটের উপর চোখ পড়তেই ও দেখে নীরু বিছানায় নেই। ভাবলো ওয়াশ রুমে গেছে হয়তো, চলে আসবে।
কিন্তু প্রায় আধ ঘণ্টা হয়ে গেছে। নীরু ঘরে আসে নি। ও আর অপেক্ষা করতে পারে না। ' নীরু, তুমি কি ওয়াশরুমে? শরীর ঠিক আছে তো? বেরোতে এত দেরী হচ্ছে কেন, কি হলো তোমার?' কোনো সাড়া নেই। বাথরুম থেকে জল পড়ার আওয়াজ হচ্ছে। সীতেশের আর ধৈর্য্য থাকেনা। বাথরুমের কড়া নাড়তে গিয়ে দেখে, ক্যাএএএএচ করে দরজাটা খুলে যায়। ভিতরে ঢুকে দেখে নীরু নেই। সদর দরজার দিকে তাকিয়ে ওর বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে। যে দরজায় ও দু দুটো গোডরেজের তালা লাগিয়ে দরজা বন্ধ করে শুতে গেছিলো, সেই দরজা কে খুললো? চাবি তো ওর বালিশের তলাতেই আছে! তবে, তবে কি নীরু বাইরে বেরিয়ে গেছে? সারা বাড়িতে সীতেশ তন্ন তন্ন করে নীরুকে খুঁজে বেড়ালো, কিন্তু নীরু কোথাও নেই। কি করবে ও ? এত রাতে একা একা কোথায় ও নীরুকে খুঁজতে যাবে? সীতেশ একবার ভাবলো, ও ওর বাড়িওয়ালা, গড়াইবাবুকে ডাকবে, তার সাহায্য নেবে, পরক্ষণেই ওর খুব লজ্জা লাগলো, কি ভাববে সবাই!
সাহস করে খুব জোরালো আলোর একটা টর্চ লাইট জ্বালিয়ে, ও বাড়ি পিছনের জংগলের মধ্যে হাঁটা শুরু করলো। ও কেমন একটা অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করতে লাগলো। কিছুটা ভিতরে ঢুকতেই, ওর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। যা ভেবেছিল তাই, সেই কাঠচাপা গাছ, তার তলায় দাঁড়িয়ে নীরু কার সাথে খুব কথা বলছে, খিলখিল করে হাসছে। সীতেশ আজ ব্যাপারটা নিজে চোখে দেখতে চায়। টর্চ নিভিয়ে দেয়, ধীরে ধীরে এগিয়ে, নীরুর সাথে কোনো এক ছায়ামূর্তি যেন ও দেখতে পায়।
আর তো দেরি করা যায় না, নীরুকে এ বিপদ থেকে এখুনি উদ্ধার করতেই হবে। 'নীরু নীরু' বলে, এক দৌড়ে নীরুর কাছে যেতে গেলে, পায়ের কাছে, কিছু একটা বেঁধে সীতেশ হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়, পা কেটে দরদর করে রক্ত ঝরছে। কোনোমতে উঠতে উঠতে দেখে, নীরু খিলখিল করে হাসতে হাসতে,আরো গভীর জঙ্গলে ঢুকতে শুরু করেছে। সীতেশও দমবার পাত্র নয়, নীরুর পিছন পিছন ও ছুটছে, কিছুতেই ও নীরুকে নাগালের মধ্যে পাচ্ছে না।
সীতেশ অনুভব করতে থাকে, কে যেন ওর গলার শ্বাস নালীকে চেপে ধরছে। ঘন অন্ধকার, হাত থেকে টর্চটা কখন যেন,কোথায় পড়ে গেছে, ও নিজেও জানে না। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট অনুভব করতে থাকে। কিন্তু চলা থামায় না। একটা বিরাট গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা খেয়ে, আর ও নিজেকে সামলাতে পারে না, ছিটকে, একটা খালের ধারে পড়ে,নিমেষে জ্ঞান হারায়।
সকাল দশটা। সীতেশ চোখ খুলে দেখে, ও বাঁকুড়া সরকারি হসপিটালের বেডে, হাতে স্যালাইন, নাকে অক্সিজেন, মাথা হাত পায়ে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। ওর সামনে, গড়াই বাবু, ওর অফিসের এক কলিগ, দুজন ডাক্তারবাবু, নার্স ও একজন পুলিস অফিসার। আগের রাতের সব কথা ওর সামনে ছবির মতো ভেসে উঠছে। ও কথা বলতে পারছে না। শুধু একবার বললো,'আমার নীরু?'
ডাক্তাররা ওকে কথা বলতে বারণ করলেন। সিস্টার ইনজেকশন দিতে কিছুক্ষণ বাদে ও ঘুমিয়েও
পড়লো।
সেদিন সকাল সাতটায় গড়াইবাবু প্রাতঃভ্রমণে বেড়িয়ে, জংগলের ভিতর বেশ কিছু ছোটো ছোটো ছেলেদের দেখতে পেয়েছিলেন। গরীব ঘরের বাচ্ছারা খাল থেকে মাছ ধরতে আসে। গড়াইবাবুকে দেখে, ছুটতে ছুটতে এসে খবর দেয়, জমিবাবু( সীতেশ) খালের ধরে পড়ে আছে।
গড়াইবাবু, ওদের সাথে সাথে গিয়ে দেখে, সত্যিতো, এ যে সীতেশ। বাড়ি ফিরে দেখেন, সীতেশের দরজা হাটখোলা করে খোলা।, ঘরে কেউ নেই।
উনি তাড়াতাড়ি, থানায় ফোন করেন। নিমেষে, তিনজন হাবিলদার ও পুলিশ অফিসার এসে উপস্থিত। ওনারা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন, সীতেশের তখনো প্রাণ আছে, ওরা ওকে অচৈতন্য অবস্থায় গাড়ি করে হসপিটালে পাঠান।
সীতেশের স্ত্রীর খোঁজ করতে করতে, একটা কাঠচাপা গাছের তলায়, ওরা নীরুকে মৃত অবস্থায় দেখতে পায়, ওর মুখের কষ বেয়ে, রক্ত গড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু ততক্ষণে তা জমে, কালো হয়েগেছে।
নীরুর বডি পোষ্টমর্টেমে পাঠানো হয়েছে।
ছ'মাস হয়ে গেলো। সীতেশ কোলকাতায় পোষ্টিং নিয়েছে। ও ভালো নেই, নীরুকে ও ভুলতে পারে না। সারাদিন কাজের মধ্যেই ডুবে থাকে। বিশেষ কোনো বন্ধু নেই। ও একা বড়োই একা!!!!!
-------------
কলমে: বুলা বিশ্বাস
ফোন নাম্বার: 7980205916
মেল আইডি:
bulabiswas60@gmail.com
