Partha Pratim Guha Neogy

Comedy Romance

3  

Partha Pratim Guha Neogy

Comedy Romance

মফস্বলের একদিন

মফস্বলের একদিন

10 mins
558


মফস্বল শহরগুলোতে এই এক সমস্যা। বৃষ্টি নামলেই ইলেকট্রিসিটি চলে যায়। মোবাইল ফোনের আলো জ্বালিয়ে খুব সাবধানে রাস্তায় বিছিয়ে দেয়া ইটে পা রেখে শেফালীর পেছন পেছন হাঁটছে সুজিত । শেফালীকে থমকে দাঁড়াতে দেখে সুজিত বলল, ‘কী হলো, থামলি কেন?’

শেফালী সুজিতের কথার জবাব না দিয়ে জুতো খুলে হাতে নিয়ে পাশের গলিতে ঢুকল। এ গলিতে ইট বিছানো নেই। হাঁটুর কাছ অবধি জল - কাদা । সুজিত হেসে বলল, ‘এতদূর অবধি এসে শেষমেষ কাদাতেই নামতে হলো।’ কথার জবাব দেয়া তো দূরের কথা শেফালী ফিরেও তাকাল না। সুজিত বুঝতে পারল শেফালী এখনো হয়তো তার ওপর রেগে আছে। আসার সময় একটা কথাও বলেনি তার সাথে। বাস থেকে নামার পরে শেফালীর ছাতার নিচে দাঁড়াতেই শেফালী তীক্ষ্ণ স্বরে বলেছে, ‘গা ঘেষছিস কেন? দূরে যা।’ 

.

সুজিতের মনে হলো যে মেয়েটা তার সাথে কথাই বলছে না, তার সাথে তার বাসায় সে কেন যাচ্ছে। এ সময় তো তার এখানে থাকার কথা না। ছাত্রের বাসায় চেয়ারে হেলান দিয়ে চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খাবার কথা। তাহলে সে এখানে কেন? নিজেকে প্রশ্ন করল সুজিত । কিন্তু প্রশ্নের কোনো জবাব খুঁজে পেল না।

.

অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পরে একজন এসে দরজা খুলে দিলো। শেফালীর পেছন পেছন সুজিত বাসায় ঢুকল। বারো তেরো বছরের এক মেয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। শেফালী পরিচয় করিয়ে দিলো, ‘আমার ছোট বোন সাধনা ।’

শেফালী ছাতা বন্ধ করতে করতে সাধনার কাছে জানতে চাইলো, ‘বাসার সবাই কোথায়?’

সাধনা বোনের হাত থেকে ছাতাটা নিয়ে সুজিতের দিকে একবার তাকাল, তারপর কিছুটা ফিসফিস করে বলল, ‘বাবাকে খুঁজতে গেছে।’

‘কখন গেছে?’

‘অনেকক্ষণ হলো।’

সাধনার কথা শুনে শেফালীর কপালে পড়া চিন্তার ভাঁজ সুজিতের দৃষ্টি এড়াল না। শেফালী সুজিতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই একটু বোস। আমি আসছি। সাধনা চেয়ার আর গামছাটা এনে দে।’

কথাটা বলে শেফালী এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। 


শার্টটার অনেকখানি অংশ ভিজে গেছে। ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। সুজিতের ফোনটা বাজছে। সুজিত পকেট থেকে ফোন বের করে দেখল সোমার কল। সুজিত ফোনটা সাইলেন্ট করে পকেটে রেখে দিলো। নিশ্চয়ই আজকের ঘটনা নিয়ে কথা বলার জন্য কল করেছে । কী বাজে একটা ঘটনা ঘটে গেল আজ ক্যাম্পাসে। পরীক্ষা শেষে বের হচ্ছিল তারা। হুট করে এক মহিলা এসে তাদের পথ আগলে দাঁড়াল। মহিলাকে দেখে শেফালী কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু শেফালী কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মহিলা রাগে ফেটে পড়ল, ‘এ্যাই মেয়ে তোমাকে বলেছিলাম না জীবনের থেকে দূরে থাকবে । কেমন বেহায়া মেয়ে তুমি? হ্যাঁ। ভালোয় ভালোয় টাকাটা বের করে দাও।’

শেফালী একবার চেষ্টা করল মহিলাকে সাইডে নিয়ে গিয়ে কথা বলার, কিন্তু তাতে লাভ হলো না। মহিলা শেফালীর হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নিলো। 

মহিলা ব্যাগে যা খুঁজছিল তা না পেয়ে ব্যাগটা শেফালীর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘টাকা আমার ফেরত চাই। কালকেই টাকা ফেরত দেবে। ভেবেছ কী, আমি কিছুই জানব না?’

মহিলা যেভাবে ঝড়ের বেগে এসেছিল ঠিক সেভাবেই ঝড়ের বেগে চলে গেল। ব্যাগ থেকে পড়ে যাওয়া ছোট্ট আয়নাটা তুলে নেয়ার সময় আড়চোখে আশাপাশ দেখে নিলো শেফালী । সোমা জিজ্ঞাসা করল, ‘কিরে ঘটনা কী?’

সোমার কথার জবাবে ‘কিছু না’ বলে শেফালী দ্রুতপায়ে চলে গেল। সুজিত পেছন থেকে শেফালীকে কয়েকবার ডাকল, শেফালী দাঁড়াল না। সোমা কিছুটা ব্যঙ্গ করে বলল, ‘চোরের দশদিন গেরস্তের একদিন।’

সোমার কথার অর্থ বুঝতে না পেরে সুজিত বলল, ‘মানে কী? তুই কিছু জানিস নাকি?’

‘কেন তুই জানিস না?’

‘নাতো। ঘটনা কী?’

‘মহিলাটা শেফালীর কলিগের স্ত্রী। ওই লোকের সাথে নাকি শেফালীর মাখোমাখো সম্পর্ক।’

‘কী যা-তা বলছিস।’

‘এটা আমি বলছি না। ওই মহিলাই একদিন মেসে এসে শেফালীকে শাসিয়ে গিয়েছিল। শেফালী নাকি লোকটার কাছে টাকা পয়সা নেয়। অফিসের আরেক কলিগ জানিয়েছে মহিলাকে।’

.

শেফালীর নামে এর ওর কাছ থেকে টাকা নেয়ার অভিযোগ এর আগেও শুনেছে সুজিত। কিন্তু গায়ে লাগায়নি। ভেবেছে রূপবতী মেয়েদের নিয়ে কুৎসা রটাতে মানুষ একটু বেশিই পছন্দ করে। আর ক্লাসের মেয়েরা যে শেফালীকে একটু ঈর্ষার চোখে দেখে সেটা অস্বীকার করা যাবে না। রুমমেট অতীশ ভাই বলেছিলেন, ‘ওই মেয়ে তোকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে কিন্তু ভালোবাসা দেবে না।’ 

অতীশ ভাইয়ের কথা শুনে সুজিত ভেবেছিল আর শেফালীর ধারে কাছেও যাবে না। কিন্তু পরক্ষণেই শেফালীর ফোনকল পেয়ে নোটস নিয়ে শেফালীর মেসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। শেফালী প্রেমের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার পরেও সুজিতের মনে হতো এই মেয়ে তাকে পছন্দ করে। একদিন ঠিক তারা হাত ধরে ক্যাম্পাসে পাশাপাশি হাঁটবে। 

সুজিত ঘরে একা একা বসে আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে ভাবছিল ঠিক সেসময় ঘরে একজন প্রবেশ করল। মুখ ভর্তি খোঁচাখোঁচা কাঁচা-পাকা দাড়ি। গায়ে ঢোলা সাদা হাফ শার্ট। সুজিত চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে নমস্কার করলো । বুড়ো লোকটা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চাইলো, ‘কে তুমি?’

কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে সুজিত বলল, ‘ আমি সুজিত । শেফালীর বন্ধু।’

‘আচ্ছা।’ লোকটা গাল চুলকে সুজিতের কাছে এসে নিচু স্বরে বলল, ‘তোমার কাছে পঞ্চাশ টাকা হবে? রিকশা ভাড়া দেব।’

লোকটার কথা শুনে সুজিত বেশ অবাক হলো। অপরিচিত একজনের কাছে কোনো সঙ্কোচ ছাড়া কী সহজেই টাকা চাইলো লোকটা। সুজিত মানিব্যাগ থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে দিলো। লোকটা টাকাটা নিয়েই বাসা থেকে বের হয়ে গেল। লোকটা চলে যাবার সময় সাধনা পাশের ঘর থেকে বের হয়ে ‘বাবা, বাবা’ বলে ডাকতে ডাকতে লোকটার পেছন পেছন গেল। 

.

সুজিত কী করবে বুঝতে না পেরে আবার চেয়ারটায় বসে পড়ল। অনেকক্ষণ হলো সে একা একা বসে আছে। শেফালী যে তাকে বসিয়ে রেখে গেল আর ফেরার নাম নেই। তার তো আবার ঢাকায় ফিরতে হবে। দেরি হলে বাস পাওয়া যাবে কী-না কে জানে। সুজিতকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। শেফালীর কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। সুজিত ঘরে বসেই তাদের কথোপকথন শুনতে পাচ্ছে। সাধনার কণ্ঠ, ‘বাবা এসেছিল। আবার চলে গেছে।’

‘বাবাকে বলিসনি আমি এসেছি?’ শেফালীর কণ্ঠ।

‘কোনদিকে গেছে?’ অপরিচিত কণ্ঠ।

‘থাক খুঁজতে যেতে হবে না। একবার যখন এসেছে রাতে ঠিক ফিরবে। মা যাও তুমি ভেজা কাপড়টা পাল্টে নাও।’ শেফালীর কণ্ঠ।

.

শেফালী ঘরে ঢুকেই সুজিতের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখেছিস অবস্থা। বৃষ্টি সেই কখন থেমেছে, অথচ ইলেকট্রিসিটি এখনো নেই।’

শেফালী সুজিতের সামনের টুলটায় বসে দরজা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ডাকল, ‘রাখী , অঞ্জনা এদিকে একটু আয় তো।’ 

সুজিতের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, ‘চা জলখাবার কিছু দিয়েছে?’

দুটো মেয়ে এসে ঘরে ঢুকল। একজন আরেকজনের জেরক্স কপি। শেফালী চুল বাঁধতে বাঁধতে চোখের ইশারায় দেখিয়ে দিলো, ‘ও হলো রাখী , ও বড়। আর ও অঞ্জনা । দুজনে ইন্টার পরীক্ষা দেবে এবার। রাখী যা চা-জলখাবার কিছু নিয়ে আয়।’

সুজিত লক্ষ্য করল শেফালী তার সাথে একদম স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলছে। চেহারায় বা কণ্ঠে কিছুক্ষণ আগেকার রাগের লেশমাত্র নেই। অথচ আজ শেফালীকে অনেক কথা শুনিয়েছিল সুজিত। বলেছিল, ‘তোকে আমি কখনো এমন ভাবিনি। শেষমেষ এক বিবাহিত লোকের সাথে। ছিঃ’!

শেফালী চোখ মুখ কঠিন করে বলেছিল, ‘আরেকবার ছিঃ বললে থাপ্পর খাবি। কী করেছি আমি? আমি কী ওই লোকের সাথে প্রেম করছি? কলিগের কাছে ধার নিলে এতে খারাপ কী?’

‘ধার যে নিচ্ছিস ফেরত কী দিস?’

‘ও আচ্ছা, তুই টাকার কথা শোনাচ্ছিস? প্রতিটা পয়সার হিসেব তারিখ সহ লিখে রেখেছি। ভয় পাস না তোদের টাকা খেয়ে বাঁচবো না।’ কথাটা বলেই ব্যাগ থেকে ডায়েরি বের করে সুজিতের হাতে দিয়েছিল শেফালী । ডায়েরিটা দেয়ার সময় ডায়েরির ভেতর থেকে শুকনো গোলাপটা মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। সুজিত দেখে খুব অবাক হয়েছে যে শেফালী গোলাপটা এখনো নিজের কাছে রেখেছে। অথচ যেদিন সুজিত গোলাপ হাতে শেফালীকে ভালোবাসি বলেছিল সেদিন শেফালী হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘ইদানিং কী নাটক বেশি দেখছিস। আর বন্ধুদের সাথে কী মানুষ প্রেম ট্রেম করে? ওসব ভূত মাথা থেকে নামা।’

সেদিন শেফালীর কথায় সুজিত যতটা না কষ্ট পেয়েছিল তারচেয়ে বেশি লজ্জা পেয়েছিল। এরপর থেকে কাপল দেখলেই শেফালী টিটকারি করে বলত, ‘কিরে হাত ধরতে ইচ্ছে করছে নাকি?’ বলেই খিলখিল করে হাসত। 

.

আজ ঝগড়ার এক পর্যায়ে শেফালী বলেছিল, ‘তুই এত react করছিস কেন? ওই মহিলা তোকে তো কিছু বলেনি। তাছাড়া তুই আমার বয়ফ্রেন্ড বা স্বামী কোনটাই না। হয় বিষয়টা এড়িয়ে যা, নয়তো অন্য সবার মতো বিষয়টা নিয়ে হাসাহাসি কর।’

‘আমি এতো react কেন করছি তুই জানিস না?’

‘দেখ সুজিত আমি চাই না তুই আর কিছু বল। বিষয়টা এখানেই শেষ কর। মেসের সামনে এভাবে চেঁচামেচি করিস না। আমি বাসায় যাচ্ছি। ফিরে এসে না হয় এ নিয়ে কথা হবে।’

‘যা কথা বলার এখুনি বল। কেন তুই সবসময় এড়িয়ে যাস। তুই ভালো করেই জানিস আমি তোকে ভালোবাসি।’ 

‘ভালোবাসিস তো কী করব? তোর সাথে প্রেম করব?’

‘হ্যাঁ করবি।’

‘তারপর?’

‘তারপর কী?’

‘বিয়ে করবি আমাকে?’

‘হ্যাঁ করব।’

‘তোর কথা শুনে না হেসে পারলাম না। আমাকে যে বিয়ে করতে চাচ্ছিস আমার সম্পর্কে জানিস কতটুকু?’

‘আমার অতো জানার প্রয়োজন নেই।’

‘প্রয়োজন আছে। আচ্ছা চল আমার সাথে। আমার বাসা থেকে ঘুরে আয়। তারপর নাহয় এ বিষয়ে কথা বলব।’

সুজিত এক কথাতেই শেফালীর সাথে আসার জন্য রাজি হয়েছে। শেফালী নিজেও হয়তো ভাবেনি সুজিত তার সাথে আসতে রাজি হয়ে যাবে। 

.

রাখী অথবা অঞ্জনা সুজিত ঠিক চিনতে পারল না। দুজনের মধ্যে একজন এসে বলল, ‘বাসায় চা পাতা নেই।’

শেফালী ব্যাগ থেকে টাকা বের করতে করতে সুজিতকে বলল, ‘তুই বোস আমি দোকান থেকে আসছি।’

‘থাক চা করতে হবে না।’ সুজিত বলল।

‘তোর খেতে ইচ্ছা না করলে খাবি না। আমি খাব। আমার মাথা ব্যথা করছে।’

‘দাঁড়া তাহলে আমিও যাব তোর সাথে।’

শেফালী হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় একটা দোতলা বাড়ি দেখিয়ে বলল, ‘এই বাড়ীর মেজো ছেলের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। ছেলে পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। এখন অবশ্য স্ত্রী সহ নরওয়ে থাকে। 

কিছুক্ষণ চুপ থেকে সুজিত বলল, ‘বিয়ে ভেঙেছিল কেন?’

‘সে অনেক কথা, পরে বলছি। চল দেরি হচ্ছে।’ 


দোকানের কাছাকাছি আসতেই সুজিত শেফালীর বাবাকে দেখতে পেল। লোকটা অকথ্য ভাষায় কাকে যেন গালাগালি করছে। বাবাকে দেখে শেফালী দ্রুতপায়ে এগিয়ে গেল। সুজিতের মনে হলো লোকটা নিশ্চয়ই মাতাল। মদ খেয়ে মাতলামি করছে। সুজিত লোকটার কাছে যেতেই দেখতে পেল লোকটার মাথা বেয়ে লাল জল বেয়ে বেয়ে পড়ছে। সাদা চুলগুলো লাল হয়ে গেছে। শেফালী ওড়না দিয়ে বাবার মাথা মুছে দিচ্ছে। 

বৃদ্ধ দোকানদার দোকান থেকে বেড়িয়ে এসে বলল, ‘পাড়ার ছেলেপিলে সব বেয়াদব হয়ে গেছে। নাহলে কেউ এভাবে বয়স্ক লোকের মাথায় রঙ ঢেলে দেয়?’

শেফালী বাবার হাত ধরে টেনে বাসায় নিয়ে আসছে। শেফালীর বাবা এখনো গালাগালি করছেন। বৃদ্ধ দোকানদার শিউলির বাবার কাছে এসে বললেন, ‘মুকুলদা বাসায় যান।’

শক্তি দিয়ে শেফালী বাবার সাথে পারছে না দেখে সুজিতকে বলল, ‘একটু ধর তো।’

সুজিত এগিয়ে এসে শেফালীর বাবার হাত ধরল। মুকুল বাবু সুজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি কে?’

সুজিত বলল, ‘আমি সুজিত । শেফালীর বন্ধু।’

.

বাসায় ফিরে শেফালীর মা স্বামীকে কলপাড় নিয়ে গেলেন। রাখী হারিকেন নিয়ে তাদের পেছন পেছন গেল। শেফালী আর সুজিত এসে ঘরে বসল। কারো মুখে কোনো কথা নেই। অঞ্জনা এসে চা দিয়ে গেল। সঙ্গে দুটো বিস্কুট আর দু’গ্লাস জল । সুজিত হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ তুলে নিয়ে বলল, ‘আঙ্কেলের অবস্থা কবে থেকে এমন?’

শেফালী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘দু’বছর যাবৎ।’

‘ডাক্তার দেখিয়েছিস?’

‘হুম দেখিয়েছি। অষুধ খেলে কিছুদিন শান্ত থাকে। ঘুমিয়ে অথবা বারান্দায় বসে দিন পার করে। মাঝে মাঝে বাসা থেকে বেড়িয়ে যান। তখন খুঁজে আনতে হয়। তুই একটু আগে জানতে চাইলি না বিয়ে কেন ভেঙেছে। এই কারণেই। মা কী বলেন জানিস? ছেলের মা নাকি বিয়েতে রাজি ছিলেন না তাই বাবাকে তাবিজ করেছে। ভালো ভদ্র ঘরের পরিবার তো আর পাগলের মেয়েকে ঘরে তুলবে না।’

‘তোরও কী তাই মনে হয়?’

‘আরে না ধূর। মা ওসব বলেন কারণ তার যখন মন খারাপ হয় তখন ওই মহিলাকে একা একা দোষারোপ করে, গালিগালাজ করে নিজের মন হালকা করেন। কী হলো খাচ্ছিস না কেন?’ শেফালী বিস্কুট তুলে সুজিতের দিকে এগিয়ে দিল। 


খাওয়া শেষে সবার কাছে বিদায় নিলো সুজিত । শেফালীর মা বললেন, ‘রাতে খেয়ে যেতে পারতে বাবা।’ সুজিতের হয়ে শেফালীই বলল, ‘দেরি হয়ে যাবে মা। পরে বাস পাবে না।’

শিউলি রাস্তা পর্যন্ত সুজিতকে এগিয়ে দিলো। চলে আসার আগে বলল, ‘রাখী আর অঞ্জনার ফর্ম ফিলাপের লাস্ট ডেট ছিল। বেতন হতে এখনো অনেক দেরি ছিল তাই বাধ্য হয়ে জীবন ভাইয়ের কাছে টাকা ধার নিয়েছিলাম। তাছাড়া পার্টটাইম চাকরী থেকে ক’টাকাই বা বেতন পাই বল।’

সুজিত বোবার মতো দাঁড়িয়ে থাকল। একটা কথাও তার মুখ দিয়ে বের হলো না। শেফালীকে কথা শোনানোর কারণে খুব বেশি অনুশোচনায় পুড়তে লাগল। বাসে বসে সুজিত পকেটে হাত দিয়ে কাগজটা বের করল। না এটা কোনো চিরকুট না। পুরোনো পঞ্চাশ টাকার একটা নোট। সবার থেকে বিদায় নেয়ার সময় সাধনা সবার চোখ এড়িয়ে টাকাটা সুজিতের হাতে গুঁজে দিয়েছিল। বারো তেরো বছরের মেয়েটাও হয়তো চায় না তার বাবা কারো কাছে ঋণী হয়ে থাকুক। 

.

ফেরার সময় তার বারবার মনে হচ্ছিল শেফালী ফিরে এসে যদি জানতে চায় ‘কী এখনো আমাকে বিয়ে করতে চাস?’ তাহলে সে কী জবাব দেবে। শেফালীর বাবাকে নিয়ে তার কোনো আপত্তি নেই কিন্তু তার পরিবার তো মেনে নেবে না। তার বাবাকে বড্ড ভয় পায় সে। শুধু সে না, তার বড় দুই ভাই ও অসম্ভব ভয় পায় বাবাকে। স্কুল শিক্ষক বাবা ছেলেদের মনে পিতৃভয় ছোটবেলা থেকেই সূক্ষ্ণভাবে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। তিন ছেলের একজন ও চোখ তুলে তাকিয়ে কথা বলার সাহস পায় না। 

বাবাকে রাজি করানো তো বহুদূরের ব্যাপার তাকে জানানোর সাহসটুকুও সুজিতের নেই। 

.

অফিস থেকে বের হয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটছে শেফালী । আকাশে মেঘ দেখে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলো শেফালী । ভুলে ছাতাটা সে বাসায় রেখে এসেছে। নতুন ছাতা একটা কিনতে হবে। বাড়তি খরচা। নিজের ওপর রাগ হলো শেফালীর । টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হঠাৎ পেছন থেকে এসে শেফালীর মাথার ওপর ছাতা ধরল সুজিত । সুজিতকে দেখে শিউলি বলল, ‘তুই এখানে?’

‘এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে মেসে ফিরলে পুরো রাস্তা লোকজন তোর দিকে তাকিয়ে থাকবে। আমার একটা দায়িত্ব আছে না।’

শেফালী সুজিতের হাত থেকে ছাতাটা নিয়ে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘গা ঘেষছিস কেন।’ সুজিত একটু দূরে সরে দাঁড়াল। 

শেফালী বলল, ‘তোকে কী অতটাও দূরে যেতে বলেছি? সুজিত হাসল। একটু এগিয়ে এসে বলল, ‘তোর হাত ধরতে ইচ্ছে করছে।’

‘তোর বাবা জানলে তোকে আস্ত রাখবে?’

সুজিত শেফালীর হাতটা ধরে বলল, ‘দু’জন মিলে সবকিছু সামলে নেব।’

এই যে দুজন বৃষ্টির মধ্যে হেঁটে যাচ্ছে। তাদের দু’জনের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছে। সুজিত বলছে তাকে যেন শেফালী এখন থেকে তুমি বলে ডাকে। শেফালী ভ্রু কুঁচকে বলেছে সে পারবে না। তুমি বলতে গেলে তার নাকি হাসি পাচ্ছে। টং দোকানের বুড়ো ক্যাসেটে পুরোনো গান বাজাচ্ছে … এই পথ যদি না শেষ হয়।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy