মিলন হবে কতদিনে ?
মিলন হবে কতদিনে ?
( রবি ঠাকুরের অভিসার কাব্য অবলম্বনে । কবিগুরুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে শুরু করছি । )
চৈতন্য হতেই বিন্দি চোখের সামনে একগাল হাসি নিয়ে লোকটাকে দেখতে পায় । আঁতকে ওঠে ।
" একি কোথায় আমি ? স্টেশনে কে ... আ: কি ব্যথা ! " উঠতে পারে না বিন্দি ।
আশেপাশের সব লোক জমায়েত এবার ধীরে ধীরে ভাঙ্গে । ডাউন ডায়মন্ড লোকাল ছাড়বে । ডায়মন্ডহারবার রোজকার মতই লোকে লোকারণ্য ।
প্রসন্ন মুখে বিন্দিকে শুতে বলেন লোকটা । " শোও মা , তুমি সুস্থ হলে তোমায় গাড়িতে তুলে দেবো । বাপ - মা পরিজন কারোর সাথে যোগাযোগ করতে হলে আমায় বলো ওই বুথ থেকে ... " কথা পুরো করতে পারলো না ।
ধীরকন্ঠে বিন্দি বললো , " ফকিরবাবা , কেউ নেই আমার । আসলে হঠাৎ এভাবে নিজেকে চৈতন্যে পাওয়ায় নিজেই চমকে গেছি । "
লালনের " মানব জনম " গানটা ধরেছিলেন ফকিরবাবা । বিন্দি রোজের মতোই যাচ্ছিলো কোলকাতার বারে নৃত্য পরিবেশন করতে । প্রতিদিনই গান ফকিরবাবা কিন্তু আজ যেন মর্ম স্পর্শ করলো । স্টেশনে ঢোকার মুখেই বিন্দি তাঁর গান শুনলো । গান শুনে অন্যমনস্ক হয়ে চলতে চলতে বুঝতে পারেনি ফকিরবাবা তার চলার পথেই বসে । গায়ে তো পা লাগলোই উফরন্তু তাঁর সব সঞ্চিত অর্থ ছড়িয়ে ছত্রাকার ।
খুব সংকুচিত হয়ে বিন্দি ফকিরবাবার সব পয়সা তুলতে তুলতে বললো , " আমার অপরাধ নেবেন না বাবা । আমায় আপনার একটা উপকারের সুযোগ দেবেন ? "
ফকিরবাবা বললেন , " কী উপকার করবে তুমি ? আমার তো কিছু দরকার নেই । ভুল তো মানুষ মাত্রই হয় আর তুমি তো তার শোধনও করে নিলে ! "
বিন্দি বললো , " আপনি এত সুন্দর গান , চলুন আমার সাথে কোলকাতা একবার । এক মিউজিক ডিরেক্টর প্রায়ই আসেন বারে । আজকাল সিনেমায় লোকগীতিও ভালোই ব্যবহার হয় । আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে ... "
এই কথা শুনে সে কি অট্টহাসি ফকিরবাবার । যেন কি ভীষণ বোকার মতো কথা বলে ফেলেছে বিন্দি । বললেন , " ভগবানের দরবারে কীসের সিনেমা চলে জানো ? জীবনের । ওই সিনেমায় তো আমি সদা সর্বদা গাইছি । তোমার যাত্রাপথ আলাদা মেয়ে । তবে সময় একদিন হবে , সেদিন এক হব । "
বিন্দি ফকিরবাবার উপর কিছু বলতে পারে না । প্রতিদিনের মতো একশোটা টাকা বাটিতে রেখে চলে আসে ।
বারের ডিউটি
সন্ধ্যে ৭ টা থেকে রাত ২টো অবধি । দুকুলে কেউ নেই বিন্দির । অনেক ছোট বয়সে বাবা মাকে হারায় । পরিবারের সকলে তাকে দুচ্ছাই করে বের করে দেয় । এক মাসি তাকে মানুষ করে । তিনিও মারা যেতে জীবনধারণের পথ খুঁজতে খুঁজতে বার ড্যান্সারের চাকরি নেয় বিন্দি । অনেকবারই মদ্যপ পুরুষের দুই বাহুতে তার অঙ্গ লুটোতেই হয় । নিজে যে মেসে থাকে সেখানে আরও কজন মেয়ে একসাথেই ওই বারে আসে । তারা সহজেই নাচের সাথে শরীর বিকিয়ে পয়সা অর্জন করে । তবে ওই দিকে বিন্দির ভীষণ ভয় । ব্যস পানের আসরে যেটুকু লাস্য না দেখালে চলে না সেটুকুই ।
সেদিন বাকিদিনের মতো ডিউটি শেষ করে স্টেশনের জন্য উবের বুক করতে যাবে হঠাৎ দুটো মদ্যপ ইনিয়ে বিনিয়ে তার শরীরে হাত দিয়ে তাকে কুপ্রস্তাব দেয় । সে জোরের সাথে বেরিয়ে উবেরে শিয়ালদহ চলে আসে ।
আশ্চর্য ছেলেগুলো স্টেশনেও উপস্থিত ! তবু সে গা করে না । সারারাতই ডায়মন্ডের ট্রেন থাকে । ট্রেন আসতে সে উঠে পড়ে । কামড়া বেশ ফাঁকা । ইতস্ততঃ লোক এদিক ওদিক । ছেলে দুটো ওই কামড়াতেই উঠলো ।
গড়িয়ায় ট্রেন ফাঁকা হতে ছেলেগুলো তার পাশে এসে বসলো । এরপর বিন্দির সাথে ছেলেদুটি দুর্ব্যবহার ও শারীরিক অত্যাচার করতে উদ্যত হলো । দুটো স্টেশন আগে ছেলে দুটি নেমে যায় ।
ফকিরবাবা জানতেন কোন ট্রেনে বিন্দি ফেরে । ট্রেন থেকে বিন্দিকে নামতে না দেখে জেগে বসা ফকিরবাবা উঠে দাঁড়ালেন । ট্রেনে একের পর এক কামড়া তন্ন তন্ন করে খোঁজার পর শেষে পেলেন বিন্দিকে । নিজেই কোলে তুলে অজ্ঞান বিন্দিকে তুলে আনলেন ।
বিন্দি জ্ঞানের পর ফকিরবাবাকে বললো তার কেউ নেই । ফকিরবাবা বললো , " তোমার বন্ধুদের তো বলতে পারো ! "
বিন্দি বললো , " কেউ নয় বন্ধু , তুমি এক আপনজন আমার । তুমি বলেছিলে একদিন আমার সাথে মিলবে তুমি , সেটা এখন থেকেই হোক । "
ফকিরবাবা প্রাণ জুড়োনোর মতো হাসলেন ও তারপর , " দাঁড়া তোর জন্য ডাক্তারের ব্যবস্থা করি । " বলে পাশের বুথে যান ।
বিন্দি বোঝে ফকিরবাবা তুই বলে তাকে মেয়ে বলে মেনেছেন , মিলন সম্পূর্ণ হয়েছে । জীবনচক্র পূর্ণ হয়েছে । ফকিরবাবা না থাকলে বিন্দির জীবন শেষ হত অকালে । বিন্দি হয়তো রংচঙে জীবনে ফিরতে আর পারবে না কিন্তু এ যেন তার নবজন্ম হলো ।