মিকি
মিকি
ঘরের কোণে রাখা একটা টেবিল ফ্যানের সামনে গিয়ে চোখদুটো বন্ধ করে প্রাণ ভরে একবার শ্বাস নিল সৌমিক। এরপর চার চারটে ঘন্টা ভারী পোশাকের তলায় গরমে ঘর্মাক্ত হয়ে কাটাতে হবে। কি আর করা যাবে! উপায় নেই। তাও তো একটু রোজগার হয়। কিছুদিন আগে শোভনদা হঠাৎ করেই বলল “সৌমিক! সন্ধ্যেবেলাটা তো বাড়িতেই থাকিস। বাচ্ছাদের জন্মদিনে, অন্নপ্রাশনে মিকি মাউস সাজবি?” না করেনি সৌমিক। সপ্তাহ দুয়েক আগে একটা বাচ্চার জন্মদিনের দিন প্রথম হাতেখড়ি হয়েছিল মিকি মাউস সাজার। ভালোই প্রশংসা কুড়িয়েছিল সেদিন। তারপর আজ দ্বিতীয় দিন।
পোশাকটা পরে নিয়ে মিকি মাউসের মুখটা হাতে নিল সৌমিক। এরপর মাথায় গলিয়ে নিলেই পুরো মিকি মাউস! বাচ্ছাদের সাথে ছবি তোলার হিড়িক পরবে। সেলফি নিতে, হাত মেলাতে কত লোক ছুটে আসবে। আবার ঘন্টা চারেক পর সব লোকজন যে যার ঘরে ফিরে গেলে সে হয়ে উঠবে মিকি মাউস থেকে অত্যন্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সৌমিক পোদ্দার। মিকি মাউসের মুখটা নিয়ে নিজের মাথায় পরে নিল সৌমিক।
- ওই দ্যাখ, মিকি! যা যা দাঁড়া ওর পাশে! ছবি তুলে দেই।
একজন মহিলা তার ছেলেকে কথাটা বলতেই বাচ্চাটা ছুটে মিকি মাউসের পাশে দাঁড়িয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসল। ব্যাস! তারপর থেকে একের পর এক! মিকিকে ঘিরে বাচ্ছাদের ভিড় বাড়তেই থাকল। শৈশবের নিষ্পাপ হাসিমাখা মুখগুলোর ভিড়ে মিকিও তখন ছবি তোলার জন্য পোস দিতে ব্যস্ত। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠছে বারংবার।
চন্দনদা না? ভিড়ের মধ্যে হঠাৎ চন্দনদাকে দেখে একটু অবাক হল সৌমিক। সেই চন্দনদা। ছোট্টবেলার চন্দনদা। একবার ভাবলো “চন্দনদা” বলে জোড়ে ডাকবে। কিন্তু না না, এখন তো সৌমিক মিকির ভূমিকায় অভিনয় করছে। প্রায় দশ দশটা বছর পর চন্দনদাকে দেখে মিকির মুখোশের আড়ালে চোখে জল চলে এল সৌমিকের। কিন্তু আজ ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। কত লোক এসে সৌমিককে জড়িয়ে ধরে ফটো তুলছে। চন্দনদাও একবার আসুক না! একবার এসে কাঁধে হাত রেখে ফটো তুলুক। সৌমিকও জড়িয়ে ধরবে চন্দনদাকে।
চন্দনদা ছিল মোহনবাগানের সমর্থক, আর সৌমিক ইস্টবেঙ্গলের। দুজনের মধ্যে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানকে নিয়ে দ্বন্দ্ববিবাদ লেগেই থাকত। প্রত্যেকবারই “যত বার ডার্বি, তত বার হারবি” থেকে শুরু করে “চুরি করে, রেফারিকে ঘুষ খাইয়ে জিতেছিস তো! বেশি কথা বলবি না একদম” এ গিয়ে হত তাদের ঝগড়ার যবনিকাপাত। ঝগড়ার সময় কেউ কাউকে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়ত না। কিন্তু পাড়ার অগ্রদূত ক্লাবের হয়ে যখন খেলত তখন ওদের মধ্যে অদ্ভুত বোঝাপড়া কাজ করত। সৌমিক, চন্দনদার জুটি অনায়াসে গোলের পর গোল করে জিতিয়ে চলত দলকে।
বিপক্ষের লেফট ব্যাককে কাটিয়ে নিয়ে বল নিয়ে এগোচ্ছে দশ বছর আগের সৌমিক। সামনে গোলরক্ষক ছুটে আসছে। একজন সেন্ট্রাল ডিফেন্ডারকে ডজ করে ডান দিকে পাস বাড়াল সৌমিক। বল পায়ে পেয়েই চন্দনদার জোড়ালো শট বিপক্ষের গোলের জালে ততক্ষনে আটকে গেছে। উল্লাস! চন্দনদা এসে জড়িয়ে ধরেছে সৌমিককে। সেদিন ফাইনালে উঠে মাঠ ছেড়েছিল সৌমিক, চন্দনদারা।
আরো উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে পরের দিন শুরু হল ফাইনাল ম্যাচ। প্রতিপক্ষ বেশ শক্তিশালী, প্রথমেই এক গোলে এগিয়ে গেছিল। তবুও সমান তালে চোখে চোখ রেখে লড়াই করছিল অগ্রদূত ক্লাব। খেলা শেষ হবার মিনিট দুয়েক বাকি তখন। হঠাৎই বিপক্ষের ডিফেন্ডারের ভুলে পায়ে বল পেয়ে গেল সৌমিক। সামনে শুধু গোলরক্ষক পজিশন নিচ্ছে। “বলটা দে সৌমিক”। চন্দনদার সামনে পুরো ফাঁকা। পাস দিতে গিয়ে এক মুহূর্ত থামলো সৌমিক।
গোলরক্ষকের চোখে চোখ পড়ল সৌমিকের। গোলরক্ষক চন্দনদাকে কড়া নজরে রেখেছে। সাতপাঁচ না ভেবে নিজেই শট নিল সৌমিক। গোলের অনেক দূর দিয়ে বলটা উড়ে গেল। ম্যাচটা হেরে গেছিল অগ্রদূত ক্লাব।
- তোর ম্যান অফ দ্য ম্যাচ বা টপ স্কোরারের প্রাইজগুলো নেবার ইচ্ছে ছিল তো বলতে পারতিস! ইচ্ছে করে পাস না দিয়ে হারালি কেন?
উত্তেজিত হয়ে সৌমিককে প্রশ্ন করেছিল চন্দনদা।
- না না। ইচ্ছে করে নয় গো।
- শোন! এমন সেলফিস হলে জীবনে বড় প্লেয়ার হতে পারবি না রে! যদি টিমের জন্য খেলিস তবেই কাল থেকে তোর সাথে খেলবো। নচেৎ নয়। কথাটা মনে থাকে যেন!
- তুমি কোন সে পেলে মারাদোনা হে, যে গোল করতে পারতেই। কত সোজা সোজা শট তো মিস কর!
- সৌমিক! মুখে মুখে তর্ক করবি না।
- চুপ করো তো! ফালতু প্লেয়ার একটা। আবার বড় বড় বাতেলা।
আর কোনো কথা না বাড়িয়ে চন্দনদা ওখান থেকে চলে গিয়েছিল সেদিন। কাকতলীয় ভাবে বাবার চাকরির বদলিতে এক সপ্তাহের মধ্যে শহরে চলে আসতে হয়েছিল সৌমিককে। ওই এক সপ্তাহের মধ্যেই দু-একবার ক্লাবে চন্দনদার সাথে ব্যাপারটা নিয়ে সৌমিক মিটমাট করতে গেলেও দুঃখ, অভিমানে চন্দনদা ক্লাবে আসেনি। চন্দনদা যখন আবার ক্লাবে এলো সব অভিমান ভুলে, তখন সৌমিক শহরে চলে গেছে। দুজনের আর দেখা হয়নি কখনো।
- দাদা, ওখানটায় যাবেন একবার? ওখানে কেক কাটা হচ্ছে তো। বাচ্ছারা আনন্দ পাবে।
নেমন্তন্ন বাড়ির কর্তার কথায় হুঁশ ফিরল সৌমিকের।
- হুমম যাচ্ছি।
স্মৃতিচারণ করার সময়টুকুও নেই। হঠাৎ করেই লক্ষ্য করল সৌমিক ওর পাশে সেই বাচ্ছাদের ভিড় তো নেই। একটু দূরে বাচ্ছাদের কেক কাটার ওখানে একজন চ্যাপলিন সেজে, আরেকজন বাটুল দ্য গ্রেট সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবাই এখন মিকিকে ভুলে ওদের সাথে ফটো তুলছে। এই না, না, এরম করলে হবে না। শোভনদা বারবার করে বলে দিয়েছে আরো অনেক বিভিন্ন চরিত্র থাকবে, তাদেরকে কিন্তু অভিনয়ের দক্ষতায় টেক্কা দিতে হবে। কম্পিটিশনের যুগে না হলে টিকে থাকা বেশ কঠিন।
যতই প্রফেশনাল হয়ে অভিনয় চেষ্টা করুক না কেন, বারবার এখানে সেখানে, খাবারের টেবিলে সৌমিকের চোখ চন্দনদাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কোথায় ভ্যানিশ হয়ে গেল চন্দনদা! নাকি ভুল দেখল সৌমিক! ইস! একটিবারের জন্য যদি তখন ‘চন্দনদা’ বলে চেঁচাত! বড্ড আফসোস হচ্ছে। চন্দনদা সৌমিকের পিঠ চাপড়ে বলত “সৌমিক, তুই কি বল তো! আমি যেখানেই থাকি না কেন! ঠিক তোর পাস আমার পায়ে এসেই আটকায়”। সেই চন্দনদাকে চিনতে ভুল হল সৌমিকের! মনটা বড্ড খচখচ করছে। ইচ্ছে হচ্ছে মিকি মাউসের পোশাক ছিড়ে ফেলে বেরিয়ে এসে চিৎকার করতে “চন্দনদা, তুমি কোথায়! আমি তোমাকে দেখেছি। সামনে এস।“ অভাবের সংসারে তাপ্পি মারতে মারতে কত অমূল্য সম্পর্ক এইভাবেই হারিয়ে যায় হয়তো।
ঘড়ির কাঁটা ঘুরে চলে। আটটা বাজল, নটা বাজল, দশটা বাজল। সৌমিক আর খুঁজে পেল না চন্দনদাকে। যদি এসেও থাকে তবে এতক্ষণে চলেও গিয়েছে নিশ্চই। মন-খারাপ দানা বাঁধে সৌমিকের মনের অন্তরে। ক্রমশ ফাঁকা হচ্ছে জন্মদিন বাড়ি। দেখতে দেখতে সাড়ে এগারোটাও বেজে গেল। কর্তা বাবু এসে মিকি মাউসের হাত ধরে বলল
- থ্যাংক ইউ। বাচ্ছারা খুব এনজয় করেছে আপনাকে পেয়ে। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ! এবার আস্তে আস্তে আপনি আসতে পারেন।
মিকি মাউসের মুখটা খুলে রুমাল বার করে মুখের ঘাম মুছল সৌমিক। দিনের শেষে মালিকপক্ষ যে খুশি হয়েছে সেটাই সৌমিকের প্রাপ্তি। নাই বা দেখা হল চন্দনদার সাথে, পরের দিন হাতে কাজটা তো থাকবে। হয়তো অন্য কোনো অনুষ্ঠানে আবার সুযোগ আসবে চন্দনদার সাথে সাক্ষাৎ করার। এইটুকুই হয়তো মনখারাপের ক্ষতের প্রলেপ। তাও শেষ বারের মত সৌমিক ভাবল কর্তা বাবুকে যদি একবার চন্দনদার কথা জিজ্ঞেস করা যায়। উনি জানতে পারেন। না, জিজ্ঞেস করতে উনিও বললেন চেনেন না।
আর কথা বাড়াল না সৌমিক। পোশাক খুলে যত্ন করে নিজের ব্যাগে সেই পোশাক ঢুকিয়ে নিল। গতবার ঠিক এমন সময়েই একজন এসে বলেছিলেন “খেয়ে নেবেন চলুন”। মন ভরে, পেট ভরে চিকেন বিরিয়ানি খেয়েছিল সৌমিক। কই! এবার কেউ খেতে বলল না তো সৌমিককে। খুব খিদেও পাচ্ছে। অনেকক্ষন না খেয়ে আছে। শেষ ট্রেনও তো বেরিয়ে গেছে এতক্ষণে। সেই আবার ভোর চারটেয় ট্রেন। আগে বুঝলে কিছু বিস্কুট অন্তত সঙ্গে রাখত। সৌমিক ইতস্তত করছে দেখে কর্তা বাবু এসে জিজ্ঞেস করলেন
- কিছু প্রবলেম? মিস্টার শোভনকে তো সব এডভান্স দেওয়া আছে।
- না, না। স্যার বলছি রাতের খাবারের ব্যবস্থা কোথায় পাব এখন?
- দ্যাখো, মিস্টার শোভনের সাথে তো এমন কোনো কথা হয়নি তো যে তোমার ডিনার এরেঞ্জ করতে হবে। বাট, আজ আমার ছেলের বার্থ ডে। এই নাও, পঞ্চাশটা টাকা নাও, খেয়ে নিও।
- না স্যার, আমি সেটা বলিনি। বাইরে কোথায় পাব সেটা যদি…
- সেটা একটু খুঁজে নাও তুমি।
রাত বারোটায় তখন সব ঝুপড়ি বন্ধ হয়ে গেছে। কি অদ্ভুত ব্যাপার! খিদের জ্বালায় তখন চন্দনদা সৌমিকের মন থেকে বেমালুম বেপাত্তা। না! কোনো দোকান খোলা নেই। স্টেশনের দিকে হাঁটা লাগালো সৌমিক।
- দাঁড়া সৌমিক
পেছন ফিরে তাকালো সৌমিক। একি! চন্দনদা তো।
- তুমি চন্দনদা!
- পরে কথা হবে। খিদে পেয়েছে তো। চল খেয়ে নেই আগে।
পাশে একটা খোলা মাঠে গিয়ে সৌমিককে বসালো চন্দনদা।
- তোমাকে আমি দেখলাম একবার জানো তো। তারপর আর খুঁজে পেলাম না।
- মিস্টার মিকি, তোর পাশে বাটুল দ্য গ্রেট সেজে তোর চন্দনদাই ঘুরে বেড়াচ্ছিল এতক্ষণ।
পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় চন্দনদার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে সৌমিক। ব্যাগ থেকে টিফিন ক্যারিয়ার বার করল চন্দনদা।
- নে, খাবি তো?
- কিন্তু এটা তো বৌদি তোমার জন্য পাঠিয়েছে।
- উমম! তোর বৌদি কিন্তু খুব রাগী। যদি জানে দেওরকে না খাইয়ে নিজের বর সব খেয়ে নিয়েছে তবে আর আমার রক্ষে থাকবে না।
চন্দনদাকে জড়িয়ে ধরল সৌমিক, যেমন প্রত্যেকবার গোল করার পর জড়িয়ে ধরত, ঠিক তেমনিভাবে।
- চন্দনদা, তুমি সত্যিই আমার দাদা। তোমাকে এ মুহূর্তে দেবার মত তো কিছু নেই। তবে আমি প্রে করছি এবার যেন ট্রফিটা মোহনবাগানই পায়।
হাসে চন্দনদা।
- ধুর! পাগল কোথাকার! এখন আমরা জীবনযুদ্ধে ব্যস্ত রে সৌমিক। কখনো মিকি সেজে, কখনো বাটুল সেজে, আবার কখনো বা জোকার সেজে।