মিছিমিছি
মিছিমিছি


বিষয়বস্তু :- বর্তমান অস্থির সময়ে কমবেশি দুশ্চিন্তা আমাদের সকলের নিত্যসঙ্গী।ফুরফুরে দিন কাটানো প্রায় অসম্ভব।তবে তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, সাময়িক এমন অনেক দুশ্চিন্তা আছে ,অস্থিরতা আছে যাদের মনে স্থান দেবার জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী।এমন অনেক বিষয়ই আছে যেগুলো নিয়ে না ভাবলেও দিব্যি বেঁচে থাকা যায়। তবু একরকম অকারণেই সেগুলোকে আমরা আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে মেনে নিয়ে থাকি। এরকমই একটা উদাহরণ হলো আমার এই গপ্পো, যার কেন্দ্রে রয়েছেন দিল্লীনিবাসী নিপাট ,নিরীহ মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক মুখার্জী বাবু।আসুন দেখি বাড়ি থেকে অফিস যাবেন বলে বেরিয়ে ঠিক কি ব্যাপারে তিনি অস্থির ও জেরবার হয়ে উঠলেন।
হুড়মুড় করে মেট্রোতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই লোকটার ওপর চোখ পড়লো মুখার্জী বাবুর। চেনা তো বটেই।হ্যাঁ ,সেই গোঁফ ,সেই মাথার ডান দিকে সিঁথি, সেই নাকের বাঁ পাশে আঁচিল। কোনো ভুল নেই। জোরবাগ কি? নাকি গ্রীনপার্ক ? কোথায় যেন নামে লোকটা? আবার মনে এই ভয় ও হচ্ছে যাকে ভাবছেন এই লোক আদৌ যদি সে না হয় তাহলে? হয়তো ওই দুই স্টেশন এর কোনোটাতেই নয়, আরো দূরে কোথাও গিয়ে নামবে লোকটা। অসুবিধে নেই। অভি দুধ কা দুধ , rum কা rum হো যায়েগা। ছোট্ট পকেট নোটবুক টা দেখে নিলেই সব ফর্সা হয়ে যাবে। কিন্তু পকেট হাতড়াতেই খেয়াল হলো আজ দিনটাই সবিশেষ খারাপ। প্যান্ট টা বদল করার সময় নোটবুক টা বের করে নেওয়া হয়নি। এবার? ওই লোকটার দুপাশে যে দুজন তাদের একজন অফিস এর ব্যাগ আর টিফিন এর বাক্স কোলে করে ঘুমে কাদা।এইধরণের নমুনা ভীষণ টিপিকাল।সিকান্দরপুর বা এম.জি.রোড এর আগে নামার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা।অন্যপাশের জন অবিশ্যি ছোকরা। এক মনে কিছু মুখ ঢাকা আততায়ী দের উদ্দেশ্যে তেড়ে গুলি ছুঁড়ে চলেছে মোবাইল এ। জগৎসংসার যাক শালা জাহান্নামে।এইধরণের মূর্তি আজকাল খুব দেখা যাচ্ছে।আগে থেকে কিছুই বোঝার উপায় নেই। হঠাৎই এরা সদ্য জলোচ্যুত মাছের মতো খাবি খেয়ে ওঠে এবং ধাক্কাধাক্কি সহযোগে ছোটোখাটো একটা অশান্তি সৃষ্টি করে বেশ কিছু মানুষ কে বিব্রত করে পা ফা মাড়িয়ে পড়ি কি মরি করে স্টেশন এর উদ্দেশ্যে হওয়া হয়ে যায়। কাজেই ভরসা করে কার সামনের জায়গাটা বেছে নেবেন কিছুতেই স্থির করে উঠতে পারলেন না তিনি।এখন উপায়? একটা কিছু যে করতেই হবে। এটা সেটা ভেবে ফোন টা বের করে স্ত্রীর নম্বর টা ডায়াল করলেন। ওপাশ থেকে মিসেস মুখার্জীর চিরতা মাখা গলা টা ভেসে উঠলো। "আজ আবার কি ভুলেছো?" মুখার্জী বাবু চাপা গলায় বললেন ,"মন দিয়ে শোনো। গতকাল যে ধূলো ধূলো রঙের প্যান্ট টা পরে অফিস এসেছিলাম সেটা কি এখনো বাইরের ঘরের দরজার পেছনে ঝুলছে নাকি মেশিন এ পুরে ঘুরিয়ে দিয়েছো?" সর্বনাশ এখনো হয়নি সেটা জেনে নিয়ে ফের বললেন ,"শিগগিরি সেটার ডান পকেট এ দেখো আমার নোটবুক টা পাবে। আমি হোল্ড করে আছি , এখুনি ওটা হাতে নিয়ে কন্ফার্ম করো। " এর উত্তরে অবিশ্যি মিসেস মুখার্জী ওপাশ থেকে যে সব কথা বললেন তা কানে ঢোকানোর কোনো চেষ্টাই করলেন না মুখার্জী বাবু। বৈবাহিক হাজার্ডস। বৌ থাকলে বাজে বকুনিও থাকবে। উত্তেজনায় অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলেন। মিনিট তিনেকের মধ্যে আবার গন্ডগোল। ছেলে রাজীব কাল অনেক রাত অবধি কাজ কম্মো করে আর দোতলায় নিজের ঘরে না গিয়ে নিচের ওই বাইরের ঘরেই শুয়ে পড়েছে।দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। এমনি অকাতরে ঘুমোচ্ছে যে মিসেস মুখার্জীর টোকা মারা সত্ত্বেও তার তরফে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছেনা।উফফ ! ডিসগাস্টিং। এই ছেলে বুড়ো বয়সে লাইফ হেল করে ছেড়ে দেবে।রোজ রাত করে ফিরবে।বেশিরভাগ দিন খাবে কি খাবেনা কোনো ঠিক নেই। খেলেও রুটি তরকারি আর ল্যাপটপ একসাথে নিয়ে মাখামাখি করবে। খাওয়াদাওয়ার সাথে সাথে কাজ আজকের ব্যস্ত যুগে অনেককেই করতে হয়। কিন্তু এ হারামজাদা কাজের ফাঁকে ফাঁকে খায়। যেমন খাওয়াদাওয়ার কোনো ছিরিছাঁদ নেই তেমনি নেই ঘুমের।কোনোদিন সোফায় কোনোদিন এখানে তো কোনোদিন সেখানে। মাঝে মাঝে মুখার্জী বাবু ভাবেন ছেলের ঘরটা ভাড়াই দিয়ে দেবেন।একটা কোনো কাজে তো আসবে। উপরি কিছু আমদানিও হবে। এদিকে সময় চলে যাচ্ছে। আর কিছু না ভেবে ফোন টা কেটে এবার লাগালেন রাজীবের নম্বর।সে বেচারা ঘুম এর মধ্যেই কোনোরকমে বাপের আদেশ মতো উঠে দরজা খুলে দিলো। মিসেস মুখার্জী গজগজ করতে করতে ঘরে ঢুকে নোটবুক এর নাগাল পেলেন। ওপাশ থেকে proceed করার সম্মতি পেয়ে মুখার্জীবাবু বললেন ,"এবার শেষের দিক থেকে দু তিন পাতা আগে দেখো বাইফোকাল চশমা,নাকের বাঁ দিকে আঁচিল ,ডান দিকে সিঁথি ,হিটলার গোঁফ। পাচ্ছো ?" যে গতিতে প্রশ্ন করা হয়েছিল তার দ্বিগুন গতিতে উত্তর ফিরে এলো,.."না"....."না ??? না মানে ? ওয়ার্থলেস !! আঁচিল ,গোফঁ ,বাইফোকাল কিছু পাচ্ছনা ? দু একটা পাতা এদিক ওদিক করে দেখো।"
"এদিক না ওদিক ঠিক করে বোলো।মেলা কাজ পড়ে আছে। এসব বোকাবোকা ব্যাপারের জন্য সাতসকালে আমার হাতে সময় নেই। "
এই কিনা সংসারে আপনার জন। এত্তবড় একটা সমস্যা আর তার নাকি সময় নেই। বিট্রেয়ার।
এসবের মাঝে হঠাৎই মুখার্জীবাবু খেয়াল করলেন জোরবাগ, গ্রিনপার্ক দুটো স্টেশন ই কখন যেন পার হয়ে গেছে। এতক্ষন চাপা উত্তেজনায় চারপাশের কিছু খেয়াল ই করেননি তিনি। হঠাৎ করে খেলায় ফিরে অবাক হয়ে দেখলেন ট্রেন ভূগর্ভস্থ টানেল থেকে বেরিয়ে ঝলমলে দিনের আলো চিরে ছুটে চলেছে। এবং তারচেয়েও বড় বিস্ময় যে লোকটিকে নিয়ে এতক্ষন স্বর্গ মর্ত্য পাতাল এক করলেন কোন ফাঁকে সেও নেমে গেছে।এবং তার জায়গায় অন্য অচেনা মুখের একটি ছেলে বসে বসে মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছে। মনটা একরাশ রাগ ও বিরক্তিতে ভোরে উঠলো। ঠিক কতটা খারাপ লেগেছে সেটা বুঝে উঠতে উঠতে শেষটায় মুখার্জী বাবুর নামার সময় উপস্থিত হলো।
এতক্ষন যে গপ্পোটা শুনছিলাম আমরা সেটা মিস্টার আলোকময় মুখার্জীর। এক বেসরকারি বীমা কোম্পানির মধ্যপদস্থ কেরানি। নিবাস পূর্ব দিল্লির পাণ্ডবনগর। দিল্লি মেট্রোর ব্যস্ততম ইয়েলো লাইন এ সকাল সকাল অফিস মুখী যে ভিড় লোকজনকে স্টেশন এ নামতে না দিয়েই ধাক্কাধাক্কি মারপিট করে ট্রেন এর ভিতর নিজেদের ছুঁড়ে দেয় একটা বসবার জায়গা হাতিয়ে নেবার আশায় আলোকময় বাবু সেই ভিড়েরই একজন। বসে বসে অফিস যাওয়া তার জীবনে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে বাতিকগ্রস্ত আলোকময় বাবু বারবার কোনো মানুষকে রুট এ দেখলে তার চেহারার বিশেষ বর্ণনা সহযোগে কোন স্টেশন এ সে নামছে সেসব নোট করে রাখেন।সেই নোট আর রোজরোজ সেই গতিবিধি চাক্ষুষ করতে করতে সেটা মুখস্থ করে নেন। ট্রেন এ উঠে সেরকম কোনো চেহারা কমন পড়ে গেলেই কেল্লাফতে। এমন ভাবে সেই সিট এর সামনে গুছিয়ে দাঁড়ান যাতে করে সেই মানুষ উঠলেই সঙ্গেসঙ্গে তিনি বসে পড়তে পারেন এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো আর অন্য কেউ যেন তার আগে বসতে না পারে।সবই শুধুমাত্র একটা সিট এর লোভে।একটা সিট এর জন্য আজ তিনি সক্কাল সক্কাল স্ত্রীর বিরক্তির কারণ হয়েছেন, পরিশ্রমী ছেলে রাজীবের কাঁচা ঘুম ভাঙিয়েছেন, সর্বোপরি শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে অনেক আগেই বসবার জায়গা পেয়ে যেতেন ,,সেই সুযোগও হারিয়েছেন।
আমাদের জীবনে এমন অনেক পরিস্থিতি আসে যেগুলোকে আপাত ভাবে সমস্যা বলে মনে হয়। কিন্তু ভেবে দেখা দরকার তাদের মধ্যে কতগুলো প্রকৃতপক্ষে সমস্যা। ছোটছোট এমন অনেক বিষয়ই আছে যাতে মাথা না দিলে হয়তো সেই অর্থে কোনো ক্ষতিই হয়না আমাদের। তাই মিছিমিছি সেইসব ব্যাপার মনে স্থান না দিয়ে যতটা সম্ভব নিজেকে প্রাণবন্ত ও মুক্ত রাখা যায় সে চেষ্টা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। নচেৎ , বলা তো যায়না প্রকৃত সমস্যায় পড়ে অকারণ-অতিপরিশ্রমে ক্লান্ত মগজ যদি হঠাৎই ছুটি চেয়ে বসে !!!!