অবিচ্ছিন্ন
অবিচ্ছিন্ন


বিষয়বস্তু : - মৃত্যু এমন ই এক বিচিত্র অজানা অনুভূতি যাতে মিশে রয়েছে অপার বিস্ময় , অদ্ভুত ভয় ,আশ্চর্য শীতলতা। মৃত্যু মানে ঠিক কতটা বিচ্ছিন্নতা সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে পারেন এমন কোনো মানুষ কে আমি চিনিনা। তবে প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রেমন্ড মুডি -র লেখা "লাইফ আফটার লাইফ" বইটি এক্ষত্রে আমাকে অত্যন্ত প্রভাবিত করে। সেই ধারণা থেকেই এই গল্প।তবে এটিকে কতটা গল্প বলা যায় তা পাঠকরাই বিচার করবেন।
বেশ জোরেই সাড়া দিয়ে বলেছি, "আসছি।" একবার নয়। অন্তত বার চার এক তো হবেই। তারপরেও যখন পঞ্চমবারের জন্য দরজায় টোকা পড়লো বেশ অবাকই হলাম।সমর যথেষ্ট ঠান্ডা স্বভাবের ছেলে। গলা তুলে কথা বলা , জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দেওয়া এসব তার সাথে মেলানোই যায়না। এর আগেও বহুবার এমন হয়েছে , আমি হয়তো স্নানের ঘরে রয়েছি বা রান্নার কাজে ব্যস্ত।সমর দরজায় জানান দিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছে। তাড়াহুড়ো থাকা সত্ত্বেও শান্ত হয়ে অপেক্ষা করেছে। আজ কি এমন হলো কে জানে !
আজ একটা বিশেষ দিন। আজ আমার তৈরী হতে সময় লাগবে।বাইরে প্রায় জনা পঞ্চাশ চেনা আধচেনা মানুষের জটলা।একরকম সবাই আমার জন্যই অপেক্ষা করে আছে। যে সে ভাবে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠেনা। একথা সমরের অজানা নয়। এই একমাস ধরে যাকিছু ঘটে চলেছে তার চেয়ে ভালো আর কে ই বা জানে ! এক নার্সিং হোম থেকে অন্য নার্সিং হোম , এক ডাক্তার থেকে অন্য ডাক্তার।শুধু তাই নয় সেই সব তাবড় ডাক্তার দের এপয়েন্টমেন্ট পাবার জন্য যে কতরকম লোকের সাথে আলাপ করতে হয়েছে , যোগাযোগ রেখে চলতে হয়েছে। দিন নেই রাত নেই যখন যে যেখানে ডেকেছে সেখানে হাজির থাকতে হয়েছে নাওয়া খাওয়া ভুলে। শেষের হপ্তা খানেক তো সমরের সাথে দেখা করারই সময় হয়নি।সেই সমস্ত দৌড়ঝাঁপ ছুটোছুটি আজ এই অন্তিম পর্যায়ে এসে যেন থমকে দাঁড়িয়েছে। তবে এখন এই অস্থিরতার কারণ কী ?
চুলটা পুরোপুরি আঁচড়ানো গেলোনা।মোটামুটি যা হোক খানিক চিরুনি টা বুলিয়ে নিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ালাম। সমর নয়। কাউকেই কাছাকাছির মধ্যে চোখে পড়লোনা।অল্প খানিক দূরে জনা তিন চারেক বয়স্ক মানুষ চাপা গলায় কি যেন বলাবলি করছে আমার দরজার দিকে নির্দেশ করে। ভাবগতিক দেখে মনে হলো আমি যে দরজা খুলে এসে দাঁড়িয়েছি তা তারা লক্ষ্যই করেনি। দরজায় দাঁড়িয়েই শোনবার চেষ্টা করলাম তাদের কথা।
জীবনের কোনোই স্থিরতা নেই মশাই।এতো একটিভ ,সভ্য ভদ্র ,ব্রাইট ছেলে এইভাবে হঠাৎ।...........প্যানক্রিয়াস এ কি যেন ইনফেকশন।ভালো তো জানাও গেলোনা।কম ছোটাছুটি তো করেনি।ভাবলে অবাক লাগে মশাই , এই মেডিকেল সাইন্স এর এতো উন্নতি অথচ জলজ্যান্ত ইয়ং ছেলে , কোনো ভাইস নেই কোনোরকম ডায়াগনসিস ই করা গেলোনা।শেষে কিনা সেপ্টিসেমিয়া ! কার ওপর আস্থা রাখা যায় বলুন তো আজকাল? সবই বরাত। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত সমরের ব্যাপারটা।এরকম কাকতালীয় ব্যাপার।......আমি তো মশাই বা বিশ্বাসই করতে পারছিনা। এ ভাবে একই দিনে একই সময়ে !!! অপূর্বর ব্যাপারটা নাহয় ভীষণ প্যাথেটিক। মানতে কষ্ট হলেও মেনে নিতে হয় কিন্তু সমর ?
কথাটা কানে যেতেই বুকের ভেতর টা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। সমর ? কি হয়েছে সমরের? লোকগুলো হঠাৎই কেমন যেন ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলো।চলো তবে এগোনো যাক। আর দেরি করা ঠিক হবেনা। জটলা ভেঙে তারা একে একে সরে দাঁড়াতেই আড়াল থেকে চোখে পড়লো ধূপের ধোঁয়ায় প্রায় ঢাকা পড়ে যাওয়া সমরের ঘুমন্ত শরীর টা। ঘুমন্ত।কোনোদিন না ভাঙার মতো শান্তির ঘুম। একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে আছি। এমন সময় পিঠে কে যেন আলতো করে হাত রাখলো। চেয়ে দেখি সমর। শান্ত ভাবে বললো, "সরে আয়। দরজার মুখ টা ছেড়ে দাঁড়া। ওদেরকে ওদের কাজ করতে দে"। দুজনে দালানের এক কোনায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে শেষ অবধি দেখলাম নিজেদেরই চলে যাওয়া। শেষটায় সব ফাঁকা হয়ে যাবার পর সমর বললো, "কাল রাতে নার্সিং হোম থেকে তোকে শেষবার দেখে ফেরার সময়ই ডাঃ ভার্মা জানিয়ে দিয়েছিলেন তোর হাতে আর সময় নেই। হয়তো রাত টাও কাটবেনা। এর আগে প্রতিটা রাত তোর কেবিন এর বাইরে চেয়ার এ বসেই একপ্রকার কাটিয়ে দিয়েছি। কাল কেন যেন আর থাকতে ইচ্ছে হলোনা। পৃথিবীর সবটুকু ঘুম যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছিলো আমাকে। ফিরে এসে শুয়ে পড়লুম। তারপর ঘুমের মাঝেই কখন........সকালে নিমুদাই সাড়া না পেয়ে ডাক্তার কে খবর দিলো। ইট ওয়াস টুউউ সিভিয়ার। দ্যাট সুইট লিট্ল স্ট্রোক। তবে দুজনের সময় টাও অবিকল এক সেটা জেনে সত্যিই অবাক হয়েছি।তুই ব্যাটা শেষ অবধি আমাকে মুক্তি দিলিনা। "
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললো সমর , " যাই হোক। বাদ দে। চল একটু ঘাটের দিকে গিয়ে বসি। খুব মিষ্টি হাওয়া দিচ্ছে। "
আমি বললাম ," জিনিস পত্র গুলো? সব তো পড়ে রইলো !"
সমর হেসে বললো, "ওগুলো আর আমাদের নয়। ওসবের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। "
দুজনে বট তলার ঘাটের দিকে পা বাড়ালাম।