Sucharita Das

Tragedy Inspirational

3  

Sucharita Das

Tragedy Inspirational

মেহুলি

মেহুলি

4 mins
12.1K


"এ মেয়ে যে কোথায় এতো তাড়াতাড়ি চাকরি পেলো কে জানে? এত অল্প পড়াশোনায় কি চাকরি করে ? তার ওপর আবার অসুস্থ বাবাকে ফেলে রেখে কতো রাত করে বাড়ি ফেরে দেখো না।" মেহুলিকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলছিল ওদেরই পাশের বাড়ির এক কাকিমা ,আর এক বৌদিকে।মেহুলি তখন অফিসের গাড়ি থেকে নেমে বাড়িতে ঢুকছিল। আজকাল আর এসব কথায় মেহুলি কিছু মনে করে না। আগে করতো, খুব কষ্ট হতো ওর আগে। বাবা, মায়ের একমাত্র আদরের সন্তান মেহুলি। বাবা আদর করে নাম রেখেছিল মেহুলি, অর্থাৎ পেঁজা তুলোর মতো ছোট ছোট মেঘ। অনেকে বলে বাদল মেঘের বাতাস। যে বাতাস বৃষ্টি নিয়ে আসে। সত্যি মেহুলির জীবনটাও ছোট ছোট আশার মেঘে ভরা ছিল। কতো স্বপ্ন,কতো আশা ছিলো মেহুলিকে নিয়ে মা, বাবার। মেয়ে বড়ো হয়ে ডাক্তার হবে দাদুর মতো। বাবা,মা, বংশের নাম উজ্জ্বল করবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় আর এক। উচ্চ মাধ্যমিকের পর মেডিকেলের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো মেহুলি। আর ঠিক সেই সময়েই হার্ট অ্যাটাকে মা মারা গেল ওর। জীবনে এতবড় ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই বাবার ক্যানসার ধরা পড়লো। বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে গেল মানুষটা কয়েক মাসের মধ্যেই। জমানো টাকা পয়সা যা ছিল সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। দিশাহারা মেহুলি অসুস্থ বাবাকে নিয়ে কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছিলো না। আত্মীয়স্বজনরা সবাই প্রথম প্রথম খবরাখবর নিলেও, শেষে যখন দেখেছিল টাকাপয়সা কিছুই আর অবশিষ্ট নেই এদের কাছে। তখন সাহায্য করতে হবে, এই ভয়ে পালিয়ে বেঁচেছিল। ফোন করলেও আর ফোন ওঠাতো না কেউই। একা,অসহায় মেহুলি তখন মারণরোগে আক্রান্ত বাবাকে নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছে জীবনযুদ্ধে। বাবার চিকিৎসার খরচ, ওষুধপত্র, খাওয়া-দাওয়া কি করে এইসব চালাবে মেহুলি। এতো বড়ো দায়িত্ব সে কিভাবে পালন করবে? 


কি করবে আর কি করবে না ,এইসব ভাবনায় যখন মেহুলি দিশাহারা, ঠিক তখনই একদিন ওদের বাড়িতে এসেছিল ,ওর বাবাকে দেখতে পাড়ার শিউলি কাকিমা। শিউলি কাকিমাও অল্প বয়সে স্বামীহারা হয়েছিল ছোট দুটো দুধের শিশুকে নিয়ে। শেষপর্যন্ত ওর স্বামীর কোম্পানিতেই কাজ পেয়ে এখন কাকিমার রীতিমতো ভালোভাবে সংসার চলে যায়। এটা মেহুলি মায়ের কাছে শুনেছিল। আর তাই আজ শিউলি কাকিমা যখন ওর বাবাকে দেখতে এসেছিল, মেহুলি মনে মনে ভেবেছিল, একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি। ও শিউলি কাকিমাকে বলেছিল ওর জন্য একটা কাজ দেখে দিতে। শিউলি কাকিমা ওকে বলে গিয়েছিল নিশ্চয়ই দেখবে। এরপর শিউলি কাকিমার সঙ্গে মেহুলি গিয়েছিল ওদের কোম্পানিতে। চেনাজানা সূত্রে মেহুলির একটা কাজের জোগাড়ও হয়ে গিয়েছিল। মাইনেপত্তর খুব বেশি না হলেও, অভাবের সংসারে এটাই অনেক। ওরা অবশ্য বলেছিল, মাঝে মাঝেই ওভারটাইম দেবে, তাতে উপরি কিছু পয়সাও আসবে। সব মিলিয়ে মেহুলি আজ অনেকটাই নিশ্চিন্ত। ঘরে ফিরে বাবাকে সুখবরটা দিয়েছিল মেহুলি। সেদিন বাবার সে কি কান্না মেহুলির হাতদুটো জড়িয়ে ধরে। কি অসহায়তা যে সেই কান্নায় ছিলো তা মেহুলির আজও মনে আছে। 




তারপর থেকে মেহুলি ধীরে ধীরে শিউলি কাকিমার কাছ থেকে এইসব প্রাইভেট চাকরিতে কি করে টিকে থাকতে হয়, তার সমস্ত কলাকৌশলই রপ্ত করে ফেলেছিল। যে কোনো মূল্যেই যে এই কাজটায় ওকে টিকে থাকতে হবে। বাবাকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে যে অনেক টাকার দরকার ওর। রাতদিন এক করে কাজ করতো মেহুলি। বাবাকে দেখাশোনা করবার জন্য একটা সর্বক্ষণের কাজের লোকও রেখে দিয়েছিল। অফিস থেকে ফিরে সোজা বাবার কাছে এসে কিছুক্ষণ বসে থাকতো মেহুলি।গলায় ক্যানসার বলে ধীরে ধীরে বাবার কথা বলার ক্ষমতাটা চলে যাচ্ছিলো। কিন্তু মেহুলি যখন ওর বাবার কাছে এসে বসতো,বাবা ওর হাত দুটো জড়িয়ে কতো কি বলতে চাইতো যেন। বাবার দুচোখ বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পড়তো বালিশে। মেহুলি শত কষ্ট হলেও বাবার সামনে কাঁদত না। বাবাকে এটা বুঝতে দিতো না যে ওর ও কষ্ট হয়। বাবার অপারেশনটা করতে অনেক টাকার দরকার। মেহুলি কে অনেক পরিশ্রম করতে হবে বাবাকে সুস্থ করে তোলার জন্য। এই পৃথিবীতে তার আপনজন বলতে শুধুই বাবা আছে, তার একমাত্র বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা।সেই বাবাকে সুস্থ করতে মেহুলি সব করতে পারে।




 আর তাই সেদিন যখন ওর অফিসের বস বলেছিল বিদেশি ক্লায়েন্টদের সঙ্গে এই মিটিংটা যদি মেহুলি ঠিকভাবে ম্যানেজ করতে পারে, তাহলে মেহুলির প্রমোশন অনিবার্য।আর তাতে যে মেহুলির বেতনও এক ধাক্কায় বেশ অনেকটাই বেড়ে যাবে ,তার আভাসও দিয়েছিল বস মেহুলিকে। মেহুলি দিনরাত এক করে খেটেছিল প্রোজেক্টটাতে। শেষপর্যন্ত মেহুলির ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ক্লায়েন্টরা খুশি হয়েছিল।কোম্পানির তরফ থেকে মেহুলির প্রমোশন ও হয়েছিল। এর ঠিক তিনমাস পর মেহুলি বাবার অপারেশনের জন্য সবকিছু ঠিক করে নিয়েছিল।বাবাকে যে কোনো মূল্যে ও বাঁচাবেই। অপারেশনের দু দিন আগে বাবা মেহুলিকে হাতের ইশারায় নিজের কাছে ডেকে ওর হাত দুটো জড়িয়ে ধরে একটা খাতা পেন এনে দিতে বলেছিল। মেহুলি খাতাপেন বাবাকে দিয়ে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল বাবার অপারেশনের জন্য যে সমস্ত কাগজপত্র লাগবে সেগুলো দেখতে। পরদিন অপারেশন টেবিলেই বাবা মারা গিয়েছিল। মেহুলি কে দ্বিতীয় বারের মতো অনাথ করে দিয়ে বাবা চলে গিয়েছিল।শোকে পাথর হয়ে গিয়েছিল মেহুলি।




বাবার অন্তিম ক্রিয়ায় আত্মীয়স্বজনরা কিছু এসেছিল। শিউলি কাকিমা সবসময় মেহুলির সঙ্গেই ছিল।ঘরে ফিরে মেহুলি বাবা যে বিছানায় শুতো, সেখানে গিয়ে বিছানায় হাত বোলাতে লাগলো। তারপর বাবার বালিশটা তুলে নিজের কোলে নিতে গিয়ে,ওর নজরে পড়লো বাবাকে দেওয়া খাতাটার ওপর।

যেটাতে বাবা লিখেছিল,


 আমার মেহুলি,


ছোটবেলায় তোকে ঠিক যেভাবে আদর দিতাম, আজ আমার মৃত্যু শয্যায় তুই আমাকে ঠিক সেই ভাবে আদরে, যত্নে রেখেছিলিস। আমি যখন অফিস থেকে ফিরতাম, রোজ তোর জন্য কিছু না কিছু খাবার নিয়ে আসতাম, আজ আমার শেষ সময়ে তুই ঠিক সেইভাবেই আমার জন্য রোজ অফিস থেকে ফেরার সময় কিছু না কিছু নিয়ে আসতিস। জানিস মা ,আমিও তোর মতো রোজ অপেক্ষা করে থাকতাম যে, আজ তুই কি আনবি আমার জন্য। কবে যে তুই এতো বড়ো হয়ে গেলি বুঝতেই পারিনি। তোর প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারলাম না আমি, কিন্তু তুই এইটুকু বয়সে আমার প্রতি সব দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে এটা বুঝিয়ে দিয়েছিস যে তুই আমার মা। যদি মরেও যাই পরের জন্মে আবার তোর বাবা হয়েই জন্মাতে চাই, এ জন্মের পিতৃঋণ শোধ করবার জন্য। ভালো থাকিস মা। 

                          বাবা


 চিঠিটা পড়ে মেহুলির এতক্ষণ ধরে জমে থাকা সব কষ্ট কান্না হয়ে ঝরে পড়ে দু গাল বেয়ে।


             সমাপ্ত


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy