ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব চল্লিশ
টাকি ঘাট থেকে বনগাঁ সীমান্ত আসতে চার পাঁচ ঘন্টা লেগে গেল । এনামুল, এনায়েত ও ললন্তিকা পথ ভেঙে ভেঙে সাবধানে আসছে ।
পুলিশি চেকিং এড়াতে এই উপায়ে ওরা প্রায় দশটা নাগাদ বিধ্বস্ত অবস্থায এনায়েতের বাড়িতে এল । ললন্তিকাকে দেখে মনে হল ভীষণ পর্যুদস্ত । তাকে একটা খাটে কাঁথা বিছিয়ে শুইয়ে দেওয়া হল । ললন্তিকা একেবারে কথা বলার অবস্থায় নেই । শুইয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়ল ।
কামাল ভাই আগেই লক্ষ্য করেছিল ললন্তিকা ঠিক মত চলতে পারছে না । পায়ে জুতো নেই। পাথরে কাঁটায় পা ক্ষতবিক্ষত । স্থানে স্থানে রক্তপাতও হচ্ছে ।
নিকটের মাঠ থেকে বুনো পাতা এনে রস করে পায়ে মলম দেওয়া হল । গা বেশ গরম । মনে হয় জ্বর এসেছে।
শরতের সকালে আবহাওয়া তেমন মনোরম নয়। একটু হাঁটাচলা করলেও ঘাম হয় । অথচ দেখা গেল ললন্তিকা জ্বরে কাঁপছে। কাছাকাছি কোন ডাক্তার বৈদ্য নেই ।
নিজেরাও তো কিছু জানে না । পাশের বাড়ির আফরিণ বলে বনগাঁ হাসপাতালের এক নার্স এসে দেখে গেল । মনে হচ্ছে ম্যালেরিয়া ।
কামাল শুনে আতঙ্কিত হল । বলল - সিস্টার হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে নাকি ?
- খুবই ভালো হয় । আফরিণ বলল । আমি কি এম্বুলেন্স ডেকে দেব ?
কামাল বলল - বেশ তাই ডাকুন।
এনামুল বলল - ধূত্তোর ! কিছু করার দরকার হবেনি । আমি যাচ্ছি প্যারাসিটামল নিয়ে আসি, খাইয়ে দিলে জ্বর ছেড়ে যাবে ।
আফরিণ চলে গেল । এনায়েত বলল - আর এখানে ওকে রাখা ঠিক হবে না । গোরুর গাড়িতে ওকে অন্য কোথাও নিয়ে যাই ।
কামালের মনে পড়ে গেল সাগরের কথা । জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতালের কম্পাউণ্ডার ছিল সে । এই তো নিকটেই পাশের গাঁয়ে থাকে ।
ফোনে সাগরকে ধরল কামাল। পুরানো বন্ধুকে পেয়ে সাগর খুশি হয়ে বলল - চলে আয় । আমি দেখব তারপর সেইমত ওষুধ দেব । আপাতত একটা প্যারাসিটামল খাইয়ে দে ।
ওকে নিয়ে সাগরের বাড়িতে গেল কামাল, এনায়েত ও এনামুল।
সাগর রোগী দেখে বলল - এমনই জ্বর । ছেড়ে যাবে'খন। কিন্তু মেয়েটিকে খুব চেনা মনে হচ্ছে ! কি কামাল ভাই ! ঠিক না ?
কামাল বলল - শালা , এত ঢঙ করিস কেন ? অরবিন্দের স্ত্রী ললন্তিকা !
- তাই ভাবছি রে জামাইবাবু ।
এনামুল, এনায়েত হেসে ফেলল । কামাল বলল - এখন ক'টা দিন একে তোর কাছে রেখে যাচ্ছি । কোন আপত্তি নেই তো ?
সাগর বলল - বউ বাচ্চা নিয়ে থাকি রে। রাখা মানে তো খুব রিস্কি হয়ে যাবে ভাই। বরং তোরা বিকেলে অন্য কোথাও নিয়ে যা !
জ্বর নেই দেখে সাগরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার এনায়েতের বাড়িতে ললন্তিকাকে আনা হল ।
রাত দশটা । এনামুল উসখুস করছে । তা' দেখে কামালের কেমন যেন সন্দেহ হল । এনামুল উঠছে বসছে, ললন্তিকার শরীরটা দেখছে, আবার বিছানায় এসে বসছে ।
কামাল বলল - খুব ইচ্ছে করছে না রে !
এনামুল হাসল শুধু ।
কামাল বলল - খবরদার ! নজর দিবি না । ও আমার সোনার ডিম পাড়া রাজহাঁস । একটু বেচাল হলে এতদিনের কষ্ট জলে যাবে ।
এনামুল বলল - তোর জন্যই কিছু করি না । নইলে সুযোগ তো অনেকবারই এসেছে !
- প্রাণে মেরে দেব শালা ! খুব সাবধান ! অমন জিনিস হাতে পেয়েও আমি কিন্তু লোভ সামলে আছি !
এনামুল ভয় পেয়ে গেল। কামালকে সে হাড়ে হাড়ে চেনে। হারুকে শেষ পর্য্যন্ত বাঁচতেও দেয়নি।
ওদিকে আরণ্যক বসুরায় নিশ্চিন্ত হয়ে গেছেন অরবিন্দের খেল খতম হয়ে গেছে । পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্য যখন কথা দিয়েছে তখন ফেক এনকাউন্টারে ---
আরণ্যক পুনরায় অফিসে বসছেন । অনেকটাই ভরসা নিয়ে নতুন উদ্যোগে কনকলতা প্রকাশনীর দরজা খুলেছে। পুরানো কর্মচারীদের কাউকে ছাঁটাই করেননি । বরং যে কয়টা মাস বন্ধ ছিল ওদের সবেতন ছুটি দিয়েছিলেন। ওরাও খুব খুশি। আবার সংস্থা খুলেছে বলেই নয় ; তাদের মতে দেবতুল্য লোকের জীবন হানি ঘটেনি পঙ্গুত্ব সত্বেও - এটাও কম পাওনা নয় ।
প্যারোলে জামিন পাওয়া অরবিন্দ আদ্যশ্রাদ্ধ শেষ করে বিশ্রাম নিচ্ছে । পরমেশ্বরের নিযুক্ত ছয় পুলিশ কর্মী ছাড়াও নিকটবর্তী থানার আরও ছয় জন পুলিশ ওকে চব্বিশ ঘন্টা পাহারা দিচ্ছে ।
গ্রাম্য পরিবেশে বাড়ি বলে টয়লেটটা উঠোনের এক প্রান্তে । অরবিন্দ টয়লেট যাবার নামে সেখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে ফের এসে বসল পুলিশ দলের মাঝে।
এল-৭২৭ রাইফেলধারী পুলিশ নবকেতন কর্মকারকে নির্দেশ পাঠিয়েছেন পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্য । যে কোন উপায় বের করে অরবিন্দকে মারতে হবে ।
এল-৭২৭ অরবিন্দের সুরক্ষা বাহিনীর প্রধান । রাইফেল দিয়েছিলেন পরমেশ্বর নিজে। একে-৪৭ । তখনই বলেছিলেন কথাগুলো একান্তে নিয়ে গিয়ে । অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন এই এল-৭২৭ । পরমেশ্বরও নিশ্চিত হয়ে গেছেন কাজ সফল হবেই ।
অরবিন্দ শ্মশানঘাটে মায়ের মুখাগ্নি করে ছাই বিসর্জন দিয়ে রাতে বাড়ি ফিরেছে । পাড়ার বিশ্বেশ্বর তার বন্ধু। ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ছদ্মবেশ নিয়ে সেই রাতেই অরবিন্দ পালাতে সক্ষম হয়েছে । এল-৭২৭ ভেবেছে বিশ্বেশ্বরই অরবিন্দ ।
কাছে গিয়ে কানে কানে বলল - পালাতে চাস ?
অরবিন্দ রূপী বিশ্বেশ্বর বলল - তা আর হচ্ছে কোথায় ?
- যদি সুযোগ করে দি ?
- সত্যি ?
এল-৭২৭ বলল - হ্যাঁ রে । তোর কেসটা জানি তো ! সবকিছুতেই তোকে ফাঁসানো হয়েছে।
- ঠিক আছে ! মায়ের শ্রাদ্ধের দিন একটা সুযোগ দেবেন । এখন পারলৌকিক কাজটুকু শেষ করে নি । নইলে মায়ের প্রেতাত্মা কাউকে রেহাই দেবে না ।
এল-৭২৭ বলল - আজই তো শ্রাদ্ধ ! তাহলে আজ রাতেই তোর মুক্তি । কিন্তু আমার পাওনাটা মিটিয়ে দিয়ে তবে !
অরবিন্দ ভাল মত জানত পুলিশকে ঘুষ দিয়ে বশ করা যায় । বিশ হাজার টাকা বিশ্বেশ্বরকে দিয়েছিল কোন পুলিশকে হাত করে কেস ঘুরিয়ে দিতে । এডভেঞ্চার হিসেবে অরবিন্দের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছিল বিশ্বেশ্বর ।
ভেবেছিল বন্ধুর প্রতি বন্ধুর কর্তব্য ।
পুলিশ নিজে থেকে টাকা চাইতেই খুব আনন্দ হল ওর। বলল - কত দিতে হবে ?
এল-৭২৭ বলেছিল - তোর কেসটা ভড় জটিল । পয়সাওয়ালা হলে লাখখানেকের কমে ছাড়তাম না। তোদের যা অবস্থা দশ হাজার দিবি !
খুশি মনে দশ হাজার দিয়েছিল বিশ্বেশ্বর । উপরি পাওনা হিসেবে বাকি দশ হাজার কোথায় খাটাবে সেই কথায় আনন্দে ফেটে পড়েছিল ।
রাত এগারোটা । এল-৭২৭ বলল - এখন এদিককার পুলিশদের ফাঁকা করে দিয়েছি । এই পথ ধরে পালিয়ে যা । তোর তো সব রাস্তাই চেনা । যা চলে যা ।
বিশ্বেশ্বর এক পা একপা করে পিছিয়ে পিছিয়ে একটু দূরে যেতেই এল-৭২৭ হুইসেল বাজিয়ে দিল । পুলিশের দল পজিশন নিয়ে ফেলল তখনই । এল-৭২৭ একে-৪৭ তাক করেই রেখেছিল । এক রাউণ্ড ঝাঁ ঝাঁ করে বেরিয়ে গেল আর নিমেষে ঝাঁঝরা হয়ে গেল বিশ্বেশ্বরের দেহ ।
খবর পাঠানো হল পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্যকে ।
- স্যার অরবিন্দ পালাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে।
পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্য মনে মনে খুশি হলেও সবার সামনে গর্জে উঠলেন - সে কি ? তোমরা এতজন পুলিশ থাকতেও সে পালাবার সুযোগ পেল কি ভাবে ? সব ক'টার চাকরি নট করে দেব। স্টুপিড কোথাকার !
এল-৭২৭ ও জানে এটা ধমক নয়; প্রোৎসাহ।
( ক্রমশ )
