ললন্তিকা ধারাবাহিক
ললন্তিকা ধারাবাহিক
পর্ব বিয়াল্লিশ
সুখচরের বাড়ি থেকে পালিয়ে অরবিন্দ সরখেল প্রথমে রাতের ট্রাকে চেপে চলে এল বর্ধমানে। ট্রাক চালক জানিয়ে দিয়েছিল ওর গন্তব্য বর্ধমান। সুতরাং বলার কিছু নেই । বর্ধমানে নেমে চলে এল স্টেশনে । তারপর লোকাল ট্রেনে চেপে আসানশোল ।
আসানশোল স্টেশনে নেমে হেঁটে হেঁটে চলে এল কল্যাণপুর হাউজিং এস্টেটে । ওখানে ললন্তিকার স্কুলের বান্ধবী শর্মিষ্ঠার বাড়িতে উঠল । শর্মিষ্ঠা অরবিন্দকে দেখে প্রথমে চমকে গেলেও ঠিক চিনতে পারল এই হচ্ছে তার বাল্যবন্ধুর বর ।
ললন্তিকা বিয়ে করে সর্বপ্রথম ওকেই খবর দিয়েছিল ।
- মামাতো ভাই ! কিন্তু প্রেম কি ও সব দেখে । দুজনেই রাজী অতএব করে নিলাম বিয়ে ।
- বেশ করেছিস । আরে আমি তো তোর মত সুন্দরী নই; প্রেমট্রেমও করতে জানি না । তাই অনূঢ়াই থেকে গেলাম। মা তো নেই। অনেক আগেই গত হয়েছেন। ওই রয়েছি, বুড়ো বাবার দেখভাল করছি - ব্যস ।
- একদিন যাব আমরা। খুব মজা করব ।
শর্মিষ্ঠা মনে করল ললন্তিকাও এসেছে । তাই অরবিন্দের পিছন দিকে উঁকি মেরে দেখে নিল ।
অরবিন্দ বলল - যাকে খুঁজছেন সে আসেনি । আর আমিই কি ছাই আসতাম নাকি ! বাধ্য হয়ে এসেছি। একটা জরুরী কাজ আছে আসানশোলে । ভেবে দেখলাম হোটেলে থাকার মত টাকা কড়ি নেই । রাতটা আপনাদের এখানে কাটিয়ে সকাল বেলায় চলে যাব ।
- ও মা সেকি কথা ! ও বাবা শুনছ ?
ষাট বাষট্টি বছরের প্রৌঢ় এসে বললেন - তা কি হয় বাবা ! এসেই যখন পড়েছ কয়েকটা দিন থেকে যাও ।
- না আঙ্কেল ! কাজের চাপে মাথা খারাপ হয়ে গেল । এই দেখুন না ভোর বেলাতেই প্ল্যান্টে যেতে হবে । কি একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে । প্ল্যান্ট বসে গেছে । রাতে আর গেলাম না । ভোর বেলায়ই চলে যাব ।
রাত কাটিয়ে ভোরবেলায় বেরিয়ে পড়ল অরবিন্দ । জি টি রোড ধরে আসানশোল শহরের মূল বাসস্ট্যাণ্ডে এসে দাঁড়াল। পর পর কয়েকটা মিনিবাস দাঁড়িয়ে। কেউ ডাকছে নিয়ামতপুর, কুলটি, বরাকর । কেউ বলছে বার্ণপুর । কেউ বলছে রাণীগঞ্জ বাজার ।
রাণীগঞ্জের নাম শুনে সেই বাসটার দিকে চলল । হাসপাতালে আরণ্যক বধ করতে গিয়ে রাণীগঞ্জ নামটা অনেকবার শুনেছে । তা-ছাড়া কয়লা খনির দেশ রাণীগঞ্জ অনেকটাই তার পক্ষে নিরাপদ হতে পারে ভেবে মিনিবাসে উঠল । বাস ছুটল রাণীগঞ্জের উদ্দেশ্যে ।
বাস ভর্তি যাত্রী । টেপাটেপি করে সবার পিছনের লম্বা সীটে একটুকু বসার মত জায়গা করে নিল ।
কিছু যাত্রী যাচ্ছে মথুরাচণ্ডী মায়ের বিশেষ পূজা উপলক্ষ্যে; কিছু স্রেফ মেলা দেখতে বেরিয়েছে।
খুব মন দিয়ে ওদের কথাবার্তা শুনছিল অরবিন্দ। মথুরা চণ্ডী থেকে কয়েক গজ দূরে গীতা আশ্রম । আশ্রমের কথা শুনে তার একটু ভাবান্তর হল । বোষ্টম সাজার সখ হল ।
রাণীগঞ্জ স্টেশন বাস টার্মিনাসে নেমে হাঁটতে লাগল । গজ দশেক যেতেই টোটোর চালকেরা ছেঁকে ধরল। কোথায় যাবেন ?
- মথুরাচণ্ডী।
- দশটাকা ।
চেপে বসল টোটোতে । নতুন ধুতি তো পরে আছে। একটা ফতুয়া আর তুলসীর মালি কিনে চলে গেল মথুরাচণ্ডী মন্দিরে । সেখানকার পুরোহিতের কাছে সাদা চন্দনে তিলক কেটে নিল । তারপর গীতা আশ্রমে এসে উপস্থিত হল ।
আশ্রমটি বড়ই মনোরম । রকমারি ফুলে গাছগুলো খুব সুন্দর দেখাচ্ছে । আশ্রমে বিজলী বাতি আছে। তবে তার আলো অনুজ্বল । স্বভাবগত ভাবে অরবিন্দ নম্র এবং বিনয়ী বলে সেই রাতেই অনেকের সঙ্গে বেশ আলিপ জমিয়ে নিল ।
রাধাকৃষ্ণের সন্ধ্যারতি শুরু হয়েছে । অরবিন্দ যোগ দিল । তারপর হঠাৎ গেয়ে উঠল ' ভজ কৃষ্ণ গোবিন্দ শ্রীমধুসূদন রাম নারায়ণ হরে ' । হারমোনিয়াম , একতারা, আর ডুগি তবলা যারা বাজাচ্ছিল তারা তার গানে সঙ্গত দিয়ে এক মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি করল । মোহান্ত এসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ।
- আহাহা ! কি মধুর সঙ্গীতই না শোনালে বোষ্টম । দেশ কোথায় গা তোমার ?
খুব বিনয়ের সঙ্গে অরবিন্দ বলল - বীরভূম গো । জয়দেব কেন্দুলি থেকে এলাম গো । অনেকদিনের সাধ ছিল এই আশ্রমে একটু জায়গা পাই । তা' ঠাকুর মিটিয়ে দিলেন গা ।
বলে সাষ্টাঙ্গে রাধামাধবকে প্রণাম করল ।
মোহান্ত বললেন - জয় রাধে
সমস্বরে সকলে বলল - জয় রাধে ।
মোহান্ত বললেন - জয় শ্রীকৃষ্ণ।
সকলে বলল - জয় শ্রীকৃষ্ণ ।
হয়ে গেল থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত । মোহান্ত মহাশয় অরবিন্দকে বললেন - বোষ্টমের শুভ নাম ?
অরবিন্দ বলল - জগদানন্দ ।
মোহান্ত বললেন - সকাল সন্ধ্যা মঙ্গলারতির পর তোমার মধুর কন্ঠের ধ্বণি দু'বেলা যেন শুনতে পাই বোষ্টমঠাকুর ।
বিগলিত হয়ে অরবিন্দ বলল - আমার সৌভাগ্য ।
সন্ধ্যের পর যখন প্রসাদ বিতরণ হচ্ছে অরবিন্দ মোহান্তকে বলল- এই প্রসাদ বিতরণের দায়িত্ব আমাকে দিলে কৃতার্থ হব ।
মোহান্ত খুশি হয়ে পেতলের গামলাটি তার হাতে তুলে দিলেন।
সারিবদ্ধ হয়ে সকলে প্রসাদ নিচ্ছে। দারুন উৎসাহের সঙ্গে অরবিন্দ প্রসাদ বিলোচ্ছে ।
একজন সুপুরুষ হাত বাড়িয়ে দিতেই চোখাচোখি হল অরবিন্দের সঙ্গে । প্রথমে ঘাবড়ে গিয়েছিল সে । কিন্তু স্বাভাবিক হতে মুহুর্তও লাগল না । এক এক করে প্রসাদ দিতে দিতে যখন মন্দিরে ঢুকল অরবিন্দ মনে করার চেষ্টা করল ভদ্রলোকটিকে যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে । কোথায় যে তাকে দেখেছে তখন কিছুতেই মনে করতে পারল না । কিন্তু সে সিওর লোকটির সঙ্গে দেখা হয়েছে।
রাত্রিকালীন আহারের পর অরবিন্দ যখন শোবার তোড়জোড় করছে তখনই ঘটে গেল এক বিস্ময়কর ঘটনা ।
দেখে আরণ্যক বসুরায়সহ সেই চেনা লোকটি আশ্রম পরিদর্শণ করে ফিরতি পথে চলে যাচ্ছে।
আরণ্যককে তো চিনে ফেলল । কিন্তু তার সঙ্গিটিকে কোথায় দেখেছে মনে পড়ছে না ।
অরবিন্দের কেমন একটা সন্দেহ হল । আরণ্যক বসুরায় নিশ্চয় এর কোন আত্মীয় হবে ।
সারা রাতে চোখে ঘুম এল না । ভোরবেলায় মোহান্ত এসে
ঘুম ভাঙিয়ে বললেন - প্রাত:কৃত্য স্নান সেরে চলে এস বোষ্টম ঠাকুর । ঠিক সময়ে যেন সঙ্গীত শুরু হয় ।
অরবিন্দ উঠে রেডি হয়ে মন্দিরে চলে গেল ।
মোহান্তের সম্মতি নিয়ে বাউল গান ধরল - ' গুরু না ভজি মুই সন্ধ্যা সকালে , মন প্রাণ দিয়া রে ,
আর না হবে মোর মানব জনম এই না ভবের মাঝারে,
প্রাণের বান্ধব রে । দাও দেখা দয়া করে !
আহা আহা করে বাহবা দিতে লাগল সকলে । মোহান্ত কেঁদে ভাসালেন । আর অরবিন্দ মনে মনে হাসতে লাগল।
আরণ্যক বাড়িতে ফিরে এসে অভয়ঙ্কর বাবুকে বললেন - বেয়াই মশাই কালও একবার গীতা আশ্রমে যাব । বড় ভালো লেগেছে ওই বোষ্টম ঠাকুরের গান । কি গলা ! তেমনি সুর ।
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - বেশ তো ! ভোরবেলাতেও হয়। চলুন তবে ভোরের বেলায় । প্রাতর্ভ্রমণও হবে, গান শোনাও হবে ।
আরণ্যক বসুরায় বললেন - আমার কিন্তু ভোরবেলায় ঘুম ভাঙে না । উঠিয়ে দেবেন কিন্তু !
অভয়ঙ্কর বাবু বললেন - একদম । অবশ্যই উঠিয়ে দেব। আমি তো ভোর চারটেয় উঠি। আপনাকেও উঠিয়ে দেব।
পরদিন ভোরবেলায় ওঁরা যখন গীতা আশ্রমে পৌঁছালেন তখন মাইকে শুনতে পেলেন গান হচ্ছে - গুরু না ভজি মুই ।
মিঃ আরণ্যক বসুরায় বললেন - বোষ্টমের সাথে আলাপ করলে হয় ।
অভয়ঙ্করবাবু বললেন - এ আর এমন কি ! চলুন দেখা করে আসি ।
তারপর তাঁদের পাশ দিয়ে যাওয়া লোকটিকে অভয়ঙ্করবাবু বললেন - এই যে বোষ্টম ! যে বোষ্টম গান করছিলেন তাঁকে কোথায় পাব ?
- আমিই সেই বোষ্টম । আমিই তো গান গাইছিলাম ।
আরণ্যক বললেন - ঠাকুর কিছু কথা ছিল । আমার জানতে বড় ইচ্ছে করছে আপনি কোথায় এমন সাধনা করেছেন । এমন সুন্দর গান ।
অরবিন্দ বলল - সে অনেক কথা মহাশয় । এখন বলতে বসলে বেলা বয়ে যাবে । আপনারা সন্ধ্যের দিকে আসুন। সব বলব ।
অরবিন্দ তো এমন সুযোগই চেয়েছিল । রাধামাধব তাও আয়োজন করে দিলেন ।
( ক্রমশ )
