ললন্তিকা ১১১ পর্ব
ললন্তিকা ১১১ পর্ব
একশত এগারো পর্ব
সিজার লিস্ট মোতাবেক দু'হাজার টাকার নোটে দশ দশটি বাণ্ডিল অর্থাৎ কুড়ি শক্ষ টাকা ট্রলিতে আছে ।অনন্ত মোহন দশ লক্ষ টাকার কথা ডায়েরীতে লিখেছেন। তা' হলে বাকি দশ লক্ষ ?
হিসাব তো বসে বসে মিলবে না । এর যথোপযুক্ত জবাব ললন্তিকাই দিতে পারে ; কিন্তু সে তো এখন দিল্লীতে পুলিশ লক আপে !
অনন্ত মোহনকে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন আছে । পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্য ডায়েরীর পাতা থেকে অনন্ত মোহনের ফোন নং বের করে তাঁকে ফোন করলেন ।
এত রাতে কে আবার ফোন করল ভেবে ফোন তুলতেই অনন্ত মোহন সরখেল শুনতে পেলেন মিঃ ভট্টাচার্য্যের কন্ঠস্বর ।
- শুনুন মিঃ সরখেল ! আপনার করা ডায়েরী মত আপনার টাকা ললন্তিকা নামের জনৈকা মহিলার ব্যাগ থেকে উদ্ধার করা গেছে । উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ নিয়ে আগামীকাল সকাল দশটায় এসে কলেজ স্ট্রীট থানায় যোগাযোগ করবেন ।অন্যথায় বাজেয়াপ্ত অর্থ কোর্টে জমা পড়ে যাবে ।
অনন্ত মোহন খুশীর খবর শুনলেন ; কিন্তু তাঁর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল । তা'হলে কি ললন্তিকা বামাল ধরা পড়ে গেছে !
দ্বিতীয় প্রশ্ন হল তিনি তো এখন দিল্লীতে অজ্ঞাতবাসে আছেন । ললন্তিকার মেয়েকে খুন করার অপরাধ তদন্তে নয়ডা এবং দিল্লী পুলিশ নিশ্চয় হন্যে হয়ে আছে । এখন তাঁর পক্ষে কলকাতা যাওয়া - তাও আবার সকাল দশটার মধ্যে থানায় হাজিরা দেওয়া কার্য্যত অসম্ভব ।
থানার অফিসার তো ফোনে জানিয়ে দিয়েই খালাস। এখন তিনি কি করবেন সেই চিন্তায় তাঁর বাকি ঘুমটুকু উড়ে গেল । টাকা যায় যাক; আগে তো প্রাণ বাঁচাই !
আগেই বলেছি মিঃ পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্য পোড় খাওয়া ধুরন্ধর পুলিশ অফিসার ।
তাঁর মনে হল কাল সকাল পর্য্যন্ত অপেক্ষা কেন ; রাতেই অনন্ত মোহনকে থানায় আনা আবশ্যক । দশ লক্ষের হিসেবটা যে বড় গোলমেলে । তিনি ডায়েরী খুলে ঠিকানাটা লিখে নিলেন ।
চারজন পুলিশ এবং ড্রাইভারকে বললেন - এখনই বেরোব। তোমরা পাঁচ মিনিটের মধ্যে তৈরী হয়ে নাও ।
সাহেবের এমন অনেক খেয়াল ওঁরা জানেন । তাই বললেন - আমরা রেডি স্যার । চলুন কোথায় যেতে হবে !
পরমেশ্বর ফোন নং আর এঅবার দেখতে গিয়েই আঁতকে উঠলেন । ট্রু কলারে দেখা যাচ্ছে তিনি ফোন করেছিলেন দিল্লীর পাহাড়গঞ্জ এলাকায় ।
- এই যা ! সব মাটি হয়ে গেল !
স্বগতোক্তি করলেন পরমেশ্বর স্যার । এ যে দেখি দিল্লীর অবস্থান ডিটেক্ট করছে ! তবে কি অনন্ত মোহন এখন কলকাতায় নেই ?
আবার কল করলেন তিনি । ফোন উঠিয়ে অনন্ত মোহন বললেন - আবার কি হল স্যার ! বলেছি তো আগামীকাল ঠিক দশটায় হাজিরা দেব ।
পরমেশ্বর এবারও দেখলেন লোকেশন পাহাড়গঞ্জ এরিয়া নিউ দিল্লী । বললেন - মিঃ সরখেল আপনি বাড়িতেই আছেন তো ?
- আজ্ঞে হ্যাঁ! বাড়িতে থাকব না তো কি মাঠের হাওয়া খাব? কি যে বলেন স্যার !
- আপনার ঠিকানা বলুন তো ! আমরা এখনই আপনার টাকা পৌঁছে দিয়ে আসি । এটা আমাদের কর্তব্য ।
অনন্ত মোহনের যেন বোবার গুড় খাওয়ার দশা হল । কি বলবেন ভেবে পেলেন না ।
বললেন - অত ব্যস্ত হবেন না স্যার । টাকা যখন আপনার হাতে এসে গেছে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে গেছি তা' সুরক্ষিত আছে । এখন এত রাতে কষ্ট করে আসতে হবে না ।
মিঃ ভট্টাচার্য্য বললেন - কত টাকা আপনার ছিনতাই হয়েছিল ?
- আজ্ঞে গুনে তো দেখার সময় পাইনি । তবে দশ লাখ তো হবেই ।
- কিন্তু ললন্তিকার ব্যাগে তো কুড়ি লক্ষ টাকা রয়েছে । আপনি ভুল করছেন না তো ?
- কুড়ি লক্ষ ? তাও হতে পারে । বললাম না আমি গুনে দেখিনি। সজ্জন জামাই ব্যাগটা হাতে দিয়ে বলল এখানে আপনার যাবতীয় পাওনা আছে । আপনি নির্দ্বিধায় আসুন ।
- হুমম্ তবে তো আপনাকে ডায়েরীর বয়ান বদলাতে হবে। কারণ এখানে তো আপনি দশ লাখ লিখেছেন। ওটা চেঞ্জ করে বিশ লাখ করতে হবে যে ! নইলে আপনিই ফলস কেসে পড়ে যাবেন ।
অনন্ত মোহন সরখেলের মাথা বনবন করে ঘুরছে। এ তো দেখি বেশ ঝামেলায় পড়া গেল ।
মিঃ ভট্টাচার্য্য বললেন - আমরা বেরোচ্ছি এখন। আধ ঘন্টা কি পৌনে ঘন্টায় পৌঁছে যাব ।
ফোন কেটে দিলেন অফিসার । ড্রাইভার এবং চারজন পুলিশ তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে। বললেন - প্রোগ্রাম ক্যানসেলড ।
পরমেশ্বর দিল্লীর পাহাড়গঞ্জ পুলিশ স্টেশনে ফোন করলেন । অনন্ত মোহনের ফোন নং দিয়ে বললেন - প্লীজ এখনই এই ব্যক্তির খোঁজ করুন । ও এখনও পাহাড়গঞ্জের কোন এলাকায় আছে ।
অনন্ত মোহন একজন ভিখারীর ছদ্মবেশে এত রাতেও বেরিয়ে পড়লেন । এ জায়গা তাঁর পক্ষে মোটেও নিরাপদ নয় । মোবাইল সুইচ অফ রেখে নিকটবর্তী বাস স্ট্যাণ্ডে গিয়ে দাঁড়ালেন। একটা দূরপাল্লার বাস ছাড়ছে দেখে তাতে চড়ে বসলেন ।
কণ্ডাক্টর টিকিট চাইলে তাকে টাকা দিয়ে বললেন - টার্মিনাল স্টেশন ।
কণ্ডাক্টর অবাক হল । টার্মিনাল কথাটা একজন ভিখারীর মুখ থেকে শুনে অবাক হবারই কথা । কেউ এ ভাবে গন্তব্যের নাম বলে না ।
বলল - দুটো টার্মিনাল আছে । কোনটায় যাবেন ?
- ওই প্রথমেরটায় । কি যেন নাম ? ভুলে গেছি।
কণ্ডাক্টরের সন্দেহ হল । তিনশ দশ টাকার টিকিট হাতে ধরিয়ে চলে গেল । ড্রাইভারকে ফিসফিস করে কি সব বলল । অনন্ত মোহনের সজাগ দৃষ্টিতে তা এড়াল না ।
টুকটুক করে সীট ছেড়ে বাসের পাদানিতে নেমে এসে বললেন - এহি রুকিয়ে । ম্যায় ইয়াহা উতরুঙ্গা ।
কণ্ডাক্টর ভাবল লোকটা পাগল । গাড়ি থামিয়ে মাঝ পথে নামিয়ে দিল ।
রাতের রাজধানী । ঝাঁ চকচকে পথ, নিয়ন বাতির আলোয় চালশে পড়া চোখেও ছুঁচে সুতো পরানো যাবে ।
অনন্ত মোহন বাস থেকে নেমে উল্টো পথে হাঁটা দিলেন । পথের ধারে ঝুপড়িতে ঢুকে পড়লেন ।
সাঁই সাঁই করে গাড়িগুলো নিরবচ্ছিন্ন ভাবে দ্রুতগতিতে বেরিয়ে যাচ্ছে । দু'চারটে পুলিশের গাড়িও দেখা গেল ।
ভাগ্যক্রমে ঝুপড়িটা ফাঁকা পড়েছিল । হয়তো ঝুপড়ির মালিক রাতের কাজে বেরিয়েছে । অনন্ত মোহন অন্ধকার ঝুপড়িতে ঘাপটি মেরে বসে থাকলেন ।
নতুন সূর্য্য তাঁকে কোথায় নিয়ে যায় এখন তারই প্রতীক্ষা ।
এভাবেই কিছুটা সময় কেটে গেল । অনন্ত মোহন ভাবছেন ভোরের বেলায় এখান থেকে পালাতেই হবে । নেহাৎ গভীর রাত ; উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি করলে পুলিশের খপ্পরে পড়ার সম্ভাবনা ।
কিন্তু পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বেশীক্ষণ থাকা গেল না । মোবাইলের সুইচ সত্যি সত্যিই অফ করেছেন কি না দেখতে গিয়েই ঘটে গেল বিপত্তি । মোবাইল খুলতেই রিং বাজতে শুরু করল । তিনি তড়িঘড়ি সুইচ অফ করে দিলেন ঠিকই কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হল না ।
পুলিশ মোবাইল টাওয়ারের হদিশ পেয়েই নিকটবর্তী মোবাইল ভ্যানে জানিয়ে দিল অবস্থান ।
মিনিট কয়েকের ব্যবধানে পুলিশ বস্তিতে চলে এল। এসেই
বস্তিবাসীদের জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড করতে লাগল ।
অনন্ত মোহন আওয়াজ শুনে ভীত হয়ে পড়লেন । তিনি বস্তি থেকে বেরিয়ে একটা অন্ধকার জায়গায় মাটিতেই শুয়ে পড়লেন ।
সার্চ লাইটের আলো তার শরীরে এসে লাগল । তাতেও হয়তো তাঁকে দেখা যেত না । মুশকিল করল সারমেয়র দল। নাগাড়ে চিৎকার, লম্ফঝম্প করে পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করল । একদল পুলিশ এসে এক ভিখারীকে তুলে নিল গাড়িতে ।
সারা দেহ চেক করে বের করে ফেলল মোবাইল। তারপর সুইচ অন করে ওই নাম্বারে ফোন করতেই তা বাজতে শুরু করল ।
পুলিশ গ্রেপ্তার করল অনন্ত মোহন সরখেলকে ।
( ক্রমশ )
