ললন্তিকা ১০৭ পর্ব
ললন্তিকা ১০৭ পর্ব
পর্ব একশত সাত
অপারেশন পরবর্তী সময়ে অভয়ঙ্কর বাবু, গোপালকৃষ্ণ বাবু এবং সজ্জন সিং - এরা সকলেই যে যার গৃহে ফিরে গেলেন ।
সকলেই যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। আরণ্যক বসুরায় মৃত । রেডিও টেলিভিশনে সেই ছবি এবং বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে। টিভিতে তো প্রতি মিনিটের ব্রেকিং নিউজ এটাই ।
পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন স্বস্তিতে । পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্য স্বস্তি পেলেও শান্তিতে নেই । তিনি শুনেছেন অরবিন্দ সরখেল মৃত । তবে ছেলেটাকে বিশ্বাস নেই । সাংঘাতিক স্বভাবের ডাকাবুকো শয়তান একটা । হয়তো শুনব মরার ভান করে পড়েছিল; পুলিশ খেয়াল করেনি আর সুযোগ পেয়ে সে আবার গা ঢাকা দিয়েছে।
সময় হলে বেরিয়ে আসতে পারে। তার যত রাগ তো পরমেশ্বরের উপর ।
কথাটা মিথ্যে নয় । মাস ছয়েক পর জানা গেল নয়ডার সজ্জন সিংএর বাড়িতে আবার হামলা হয়েছে । এবার আর টাকাকড়ি গয়না নয় খোদ সজ্জন সিং এর স্ত্রীকে নিয়ে কেউ পালিয়ে গেছে ।
সজ্জনের মেয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে পড়ে আছে । তাকে নিয়ে নাকি যমে মানুষে টানাটানি চলছে ।
কোন সুত্র পেয়ে নয়ডা পুলিশ পশ্চিমবঙ্গ পুলিশকে সতর্ক করে দিয়েছে । রেল স্টেশন, এয়ার পোর্ট এবং দেশের সব বাসস্ট্যাণ্ডে চলছে চিরুণী তল্লাশি । হোটেল রেস্টুরেন্টগুলোও ছাড় পাচ্ছে না ।
পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্য অতিরিক্ত সতর্কতা জারি করতে গিয়ে নিজেই বিপদ ডেকে আনলেন । কৃষ্ণপুরের বাড়িতে হানা দিতেই ললন্তিকাকে পাওয়া গেল ।
রুদ্র তখন রাণীগঞ্জে শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গেছে। কৃষ্ণপুরের বাড়িতে বৃদ্ধ গোপালকৃষ্ণ চাকলাদার এবং তাঁর
পত্নী বনলতা দেবী দু'জনই রয়েছেন । হঠাৎ ললন্তিকার আগমনে তাঁরা যারপরনাই বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করতে যাবেন ললন্তিকা বলল - ভীষণ বিপদে পড়ে আছি মেসোমশাই।
বনলতা দেবী বললেন - তোমার স্বামী এবং মেয়েও এসেছে বুঝি ?
- না মাসীমা ! ওদের নিয়েই তো বিপদে পড়েছি । মেয়ে এখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে । আর সজ্জনকে কে বা কারা অপহরণ করে নিয়ে গেছে ।একলা ঘরে থাকতে পারছিলাম না । তাই চলে এলাম। মেয়ে তো পুলিশি পাহারায় রয়েছে। তাই আমাকে থাকতে দেয়নি ।
গোপালকৃষ্ণ বাবু একরকম অবাকই হলেন । মেয়ের কাছে মাকে থাকতে দেবে না - সে কেমন হাসপাতাল আর সেখানকার প্রশাসনইবা কেমন !
সজ্জন সিং অপহৃত । মেয়ে অসুস্থ সবই মেনে নেওয়া গেল । কিন্তু ললন্তিকার এমন অকস্মাৎ সব ছেড়ে চলে আসা - তাও আবার অল্প পরিচিতের ঘরে ----
নাহ্ ব্যাপারটা ভালো মনে হচ্ছে না । গোপালবাবু আইনজীবী। অনেক কিছু প্রশ্ন করতেই পারতেন । কিন্তু তা না করে বনলতা দেবীকে বললেন - তুমি ওর থাকার জায়গাটা করে দাও । আমি একটু বাজার করে আনি । অত দূর থেকে মেয়েটা এসেছে । না জানি পেটে কিছু পড়েছে কি না ।
গোপাল বাবু একটা থলে হাতে বাজারে বেরিয়ে গেলেন ।
কিছু পথ পেরিয়ে এসে থানায় ফোন করলেন । পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্য ফোন ধরে বললেন - কে বলছেন ?
গোপাল বাবু পরিচয় দিয়ে বললেন - আরণ্যক বসুরায়ের আত্মীয় ।
পরমেশ্বর বললেন - জানি জানি। আপনি আইনজীবী গোপালকৃষ্ণ চাকলাদার তো !
গোপাল বাবু এরপর ললন্তিকার ঘটনা সব বলে দিলেন।
পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্য সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। সঙ্গে চারজন মহিলা কনস্টেবল।
দরজায় ধাক্কা দিতেই বনলতা দেবী দরজা খুলে দিলেন ।
পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্য কোন রাখঢাক না করে ডাকলেন - মিসেস ললন্তিকা সিং গুজ্জর ! বেরিয়ে আসুন । আমরা থানা থেকে আসছি ।
ললন্তিকা সব শুনেছে। ফ্রেশ হতে জাস্ট টয়লেটে ঢুকেছিল । আগের অবস্থাতেই বাইরে বেরিয়ে এল । পুলিশ দেখে অবাক হয়ে গেল । বলল - কি ব্যাপার ! আসতে না আসতেই আপনারা যে ! ব্যাপার জানতে পারি কি ?
পরমেশ্বর ভট্টাচার্য্য বললেন - মোটেও না । অত্যন্ত গোপনীয় ব্যাপার । আপনাকে আমাদের সঙ্গে এখনই থানায় যেতে হবে ।
- কিন্তু এটা তো বলবেন কোন অপরাধে আমায় থানায় যেতে হবে ?
- সে থানায় গেলেই বুঝতে পারবেন । নাউ হারি আপ ।
- কিন্তু ...
- কোন কিন্তু টিন্তু নয় । যা বলছি করুন । এই যে মিস রশ্মি ! ওনাকে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুলুন ।
তারপর বনলতা দেবীকে বললেন - আপনাদের মস্ত বড় ফাঁড়া কেটে গেল । এবার দরজা বন্ধ করে দিন । চলি ।
বনলতা দেবী হাঁ হয়ে দেখলেন শুধু। কিছু বলার মত ভাষা খুঁজে পেলেন না । শুধু এক অজানা আশঙ্কায় স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষা করতে লাগলেন।
পুলিশ ললন্তিকাকে নিয়ে চলে যাবার পর গোপালকৃষ্ণ বাবু ঘরে ঢুকলেন ।
স্ত্রীকে বললেন - জানতাম এমনটাই হবে । আজ সকাল থেকে আমার বাঁ চোখ নাচছিল । যাক বাবা বেঁচে গেছি ।
বনলতা দেবী অবাক হয়ে বললেন - শুধু শুধু মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গেল ।
- শুধু শুধু পুলিশ কাউকে ধরে নিয়ে যায় ? নিশ্চয় কোন কারণ আছে । কিন্তু ভাবছি --
- কি ?
- পুলিশকে খবর দিল কে ! তুমি তো দাওনি নিশ্চয় ।
- আমি? না তো! পুলিশকে খামোকা কেন খবর দিতে যাব ?
- তা'হলে ? কে দিল ? ললন্তিকা তো পাড়ায় ঢাকঢোল পিটিয়ে আসেনি । লুকিয়ে চুরিয়ে এসেছিল ।
- তাই তো ! ও তো চোরের মতই এসেছিল । তবে কে পুলিশকে জানাল ?
- বাড়িতে আমরা এখন দু'টি প্রাণী। তুমি আর আমি । আর তুমি বলছ খবর তুমি দাওনি । তবে তো বাকি রইলাম আমি।
- মানে ? তুমি পুলিশ ডেকেছ ?
- ডাকব না ? স্বামী সন্তান ফেলে রেখে কোন মেয়ে দূর দেশে যাত্রা করে ? আমার মনে হল কোন একটা গণ্ডগোল তো করেই এসেছে । আর আসবি আয়, আমারই ঘরে ?
তাই আমি পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছি । আর পুলিশের তৎপরতা দেখে তো আমি নিজেই অবাক হয়ে গেছি । মাত্র কয়েক মিনিটেই একশন ! মনে হয় ওখানকার পুলিশ আগে ভাগে এখানকার থানাকে সতর্ক করে দিয়েছে ।
বনলতা দেবী নতুন চিন্তায় পড়লেন । আর যাই হোক ললন্তিকার সঙ্গে আরণ্যকের যে ঘনিষ্ঠতা ছিল তা'তে তার মনেও যে দুর্বৃত্তায়ন হয়নি এ কথা স্পষ্ট করে বলা যায় না ।
হয়তো পুলিশ ও আইনের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য ললন্তিকা বাধ্য হয়ে বা নিরুপায় হয়ে এখানে এসেছে।
যাক বাবা ! যা হয়েছে ভালই হয়েছে। নইলে আজ এখানে কাল রাণীগঞ্জে পরশু দেবেন্দ্রের ওখানে ----
দেবেন্দ্র ভৌমিকের কথা মনে হতেই বনলতা দেবী গোপাল বাবুকে বললেন - হ্যাঁ গো ! ঘটনাটা একবার দেবেনকে জানালে হত না ? তেল, ঝাল, মশলা সবেতেই তো ওকে জড়ানো হয় । তাছাড়া ক্রাইম সম্বন্ধে ওর আনুপূর্বিক ধারণা আছে। আর ধারণাই বা বলি কেন ও তো এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ!
গোপাল বাবু ক্ষণিক চিন্তা করলেন । বললেন - ঠিক কথাই বলেছ ! দেখি রাতের দিকে কথা বলব । তার আগে রুদ্র ও তার শ্বশুর বাড়িতে খবরটা দেওয়া দরকার।
খবর কিন্তু রুদ্রর কাকাশ্বশুর অভয়ঙ্কর বাবু অলরেডি পেয়ে গেছেন।
শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তি বলে অভয়ঙ্কর বাবুর মাঝে মাঝেই থানায় ডাক পড়ে । খনি অঞ্চলের থানা । ক্রাইমের স্বর্গোদ্যান । সেখানে রামা, শ্যামা, যদু ,মধুদের বিনা দোষে পুলিশ ধরে নিয়ে আসে । তাদের হয়ে কথা বলতে যান তিনি। আর নিরপরাধীরা তখন থানা থেকে ছাড়া পায় ।
সুতরাং গোপাল বাবু খবর দেবার আগেই অভয়ঙ্কর বাবু বলেন - বেয়াই মশাই আপনারা নিরাপদেই আছেন তো ?
ভাববেন না আমরা কালই আপনাদের ওখানে যাচ্ছি ।
( ক্রমশ )
