লক্ষ্য
লক্ষ্য


"তোমার মেয়ের কত বয়স হলো গো পরমা দি?" বিয়ে বাড়ীতে তার মামাতো বোন মিতার প্রশ্ন পরমাকে। এই নিয়ে দশজন জিজ্ঞেস করলো পরমাকে তার মেয়ে টিয়ার বয়স নিয়ে। যেন পরমার মনেই নেই তার মেয়ের কতো বয়স হয়েছে, এরা বলবে তবে জানবে পরমা। সত্যি এইসমস্ত আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে পেরে ওঠা খুবই মুশকিল। পরমা এসেছে তার ভাইয়ের মেয়ের বিয়েতে।যে কিনা তার মেয়ে টিয়ার থেকে তিন বছরের ছোট।আর এটাই হলো একদল আত্মীয় স্বজনদের কাছে বিরাট প্রশ্ন। যাইহোক পরমা যখন বলেছিল ওর মেয়ের বয়স বত্রিশ বছর , তখন মিতার মুখে বিস্ময়ের শেষ ছিল না। "এ বাবা কি বলছো গো পরমা দি, বত্রিশ বছর? এরপর তো চেহারায় জৌলুসও থাকবে না গো। বয়সের ছাপ পড়ে যাবে। তখন বিয়ে থা দেবে কি করে? মেয়েদের বিয়ের একটা বয়স হয় বুঝলে। সেটা পেরিয়ে গেলে খুব মুশকিল হয় বিয়ে দিতে। আমি তো আমার মেয়ের তেইশ বছরেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। কম বয়স ছিলো, দেখতে শুনতেও ভালো ছিল , এক দেখায় পছন্দ হয়ে গিয়েছিল পাত্রপক্ষের।" পরমা চুপ করে শুনছিল এতক্ষণ। তার মেয়ে টিয়া এই বছর দুয়েক হলো ব্যাংকে চাকরি পেয়েছে। পরমা মেয়েকে ছোট থেকেই শিখিয়েছিল, জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়ানো কতটা দরকারি। আজকালকার দিনে ছেলেদের পাশাপাশি একটা মেয়েরও চাকরি করা কতটা প্রয়োজনীয় তার নিজের স্বার্থে এবং সংসারের স্বার্থে, সর্বোপরি নিজের ভবিষ্যতের স্বার্থে। পরমার মেয়ে টিয়াও ছোট থেকে তাই এটাই জেনেছে যে তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে । তার জীবনের প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য ই হবে এটা। বিয়ে , সংসার এসব তো পরে।
টিয়াকেও বিয়ে বাড়িতে অনেকেই তার থেকে ছোট বোনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে বলে আভাসে ইঙ্গিতে কথা শুনিয়েছে। কিছু মানুষের মানসিকতা কখনও বদলায় না, এরা অনেকটা সেরকমই। এদের মনে বদ্ধমূল হয়ে আছে, মেয়ে মানেই বিয়ের বয়স হলেই একটা ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দাও। তাতে তার পড়াশোনা , কেরিয়ার সব গোল্লায় গেলেও অসুবিধা নেই। এতদিন বাবার পয়সায় জীবন কাটিয়েছো, এবার যাও স্বামীর পয়সায় জীবন কাটাও। তাহলেই বাবা মায়ের সব কর্তব্য পালন শেষ। এই যুগে বসবাস করেও বেশীরভাগ বাবা, মায়েরাই এখনও পর্যন্ত এরকম ধারণা পোষণ করে যে, একটা মেয়ের জীবনে বিয়েটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রত্যেক বাবা মায়ের তার মেয়েকে ছোট থেকেই এটা শেখানো উচিত যে ,তাকে পড়াশোনা শিখে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে জীবনে, তার নিজের ভবিষ্যতের স্বার্থে। যাতে বিয়ের পর যদি কোনো কারণে মেয়েটির শ্বশুরবাড়িতে বনিবনা না হয়, তাহলে কোনো মেয়ের বাবা মাকে এটা বলতে না হয় যে, অ্যাডজাস্ট করে পড়ে থাক ওখানেই।
পরমার এক দুজন জ্যেঠিমা তো বলেই ফেলল,"পরমার এই মেয়েটার পরমা বিয়ে থা দেবে না নাকি? চাকরি করছে বলে ঘরেই বসিয়ে রেখে দেবে নাকি গো? এ আবার কি মানসিকতা পরমার? একটা ভালো পাত্রের হাতে পাত্রস্থ করে, কন্যাদান করলে তবে তো বাবা, মায়ের সব কর্তব্য পালন শেষ হবে।" পরমা এতক্ষণ চুপ করেই ছিল। এবার বললো, "বিয়ে তো দেব ই জ্যেঠিমা মেয়ের, কিন্তু আমরা ভেবে নিয়েছি, মেয়ের কন্যাদান করবো না। আমার মেয়ে কোনো বস্তু নাকি যে তাকে দান করতে হবে। মেয়ে আমার ঘর আলো করে এতদিন ছিলো, এবার বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি আলো করবে, এইটুকুই। আমাদের ঘরে, আমাদের হৃদয়ে আমার মেয়ে ঠিক সেইভাবেই থাকবে, যেভাবে এতদিন ছিলো।" বলাই বাহুল্য, প্রাচীন ধ্যানধারা সম্পন্ন পরমার জ্যেঠিমারা যে পরমার এই চিন্তাধারায় খুশি হয়নি, সেটা তাদের মুখ দেখেই পরমা বুঝতে পারছিল। কিন্তু তাতে পরমার কিছু যায় আসে না। মেয়ে তার, আর তাই তার অতীত, বর্তমান, আর ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা করা পরমার কর্তব্য। কে কি ভাবলো, তাতে পরমার কোনো মাথাব্যথা নেই। টিয়া এতক্ষণ তার মায়ের সব কথা শুনছিল। সে ধীরে ধীরে মায়ের কাছে গিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললো, "তোমাদের মতো মা, বাবা যেন আমি প্রত্যেক জন্মে পাই। যারা সমাজের সঙ্গে লড়াই করে, নিজের মেয়েকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্য, তার ভবিষ্যতকে সুরক্ষিত করবার জন্য আর সর্বোপরি তাকে তার জীবনের সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য।
সমাপ্ত