STORYMIRROR

Partha Pratim Guha Neogy

Abstract Horror Others

3  

Partha Pratim Guha Neogy

Abstract Horror Others

লাশের চিঠি

লাশের চিঠি

8 mins
177

স্যার, জঙ্গলের মাঝখানে একটা অর্ধেক গলে যাওয়া লাশ পড়ে আছে। ভাগ্যিস আপনাদের এখানে পেয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি আসুন আমার সাথে।


লোকটার কথা শোনে চমকে উঠলাম। জঙ্গলের ভিতরে লাশ, তাও আবার অর্ধগলিত!


আমি এখানকার থানার একজন এস আই। একটা বিশেষ অভিযানের জন্য জঙ্গলের মধ্যে এই পাহাড়ী রাস্তায় চেকপোস্ট বসিয়েছি। আমার সাথে আরো তিনজন কনস্টেবল এখানে রয়েছে। চেকপোস্টে ওদের তিনজনকে রেখে আমি লাশটা দেখার জন্য লোকটার সাথে যেতে লাগলাম।


চাঁদনী রাত কিন্তু জঙ্গলের ভিতর অব্দি চাঁদের আলো পৌঁছায় না। তাই এখানে বরাবরের মতো সুনশান অন্ধকার। লাইটারের নিভু নিভু আলোতে ঝোপঝাড় ভেঙে হাঁটতে আমাকে বেশ দুর্ভোগ সইতে হচ্ছে। কখনো কখনো লতাপাতায় দুই পা আটকে যাচ্ছে।


আমার সামনেই লোকটা অনায়াসে হেঁটে যাচ্ছে কোনো আলো ছাড়া। জঙ্গলের ভিতর ওর এভাবে হাঁটা দেখে বুঝতে পারছি এই জঙ্গলটা ওর বেশ পরিচিত। তা না হলে অন্ধকারে এই ঝোপঝাড়ের মধ্যে সে কীভাবে অনায়াসে হাঁটতে পারে!


আমার পা বার বার ঝোপঝাড়ে লতাপাতায় আটকে যাওয়ার কারণে আমি ওর থেকে কিছু পিছনে পড়ে গেছি। যত ভিতরে যাচ্ছি তত ঝিঁঝিঁপোকার তীব্র আওয়াজ বাড়তে লাগলো। মাঝে মধ্যে আচমকা শিয়ালও ডেকে উঠছে। সব মিলিয়ে পরিবেশটা আমার কাছে এখন কিছুটা অন্যরকম মনে হচ্ছে।


লোকটাও কোনো কথা না বলে একনাগাড়ে হেঁটেই চলেছে। যত যাচ্ছি তত সে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে।


হাইওয়ে থেকে প্রায় ২৫ মিনিটের রাস্তা হেঁটে এখন অনেকটা গভীর জঙ্গলে চলে এসেছি। রাতের বেলা এই বন্য পরিবেশ কতোটা ভয়ংকর দেখায় তা জানতাম না। এরকম আগে আন্দাজ করতে পারলে আমি কখনোই এভাবে লোকটার সাথে আসতাম না। অনেকটা ক্লান্ত স্বরে লোকটার উদ্দেশ্যে বললাম,


– ও দাদা,একটু ধীরে চলুন। আপনার সাথে তাল মিলিয়ে আর হাঁটতে পারছি না।


– এখানে ধীরে চলতে নেই স্যার! জঙ্গলের নিয়মগুলো বড় অদ্ভুত। কখনো শান্ত, কখনো হিংস্র।


– কী বলছেন আপনি! বুঝিয়ে বলুন।


– বুঝার আগেই এ জঙ্গল না আমাদের বুঝিয়ে দেয় তার আসল রূপ, সেই কামনা করেন স্যার।


– তুমি তো রীতিমতো আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছো।


– পুলিশ মানুষ হয়ে ভয় পাচ্ছেন স্যার! ভয় পেতে নেই। ভয় পেলে ভয় পিছু ছাড়বে না।


– আচ্ছা আর কত দূর?


– দূর তো অনেক। তবে ভয় না পেলে কয়েক মিনিটের রাস্তা।


– আচ্ছা চলো।


লোকটা কেমন অদ্ভুতভাবে সব কথার জবাব দিচ্ছে। ওর জবাবের মানেগুলো আমি এখন বুঝতে চাই না। শুধু এটাই চাই, ক্রাইম স্পটে গিয়ে সবকিছু পরখ করে আবার যেন দ্রুত ফিরে আসি। এই অদ্ভুত লোকটার সাথে আমি এখানে বেশিক্ষণ থাকতে চাই না। কিছু সময়ের জন্য থেমে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরিয়ে নিলাম।


সিগারেট ধরানোর পর মাথা তুলে সামনে তাকিয়ে লোকটাকে দেখতে পেলাম না। চারদিকে ভালো করে দেখে নিলাম। যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে লোকটার কোনো সাড়াশব্দও নেই। হয়ত দ্রুত হেঁটে আমার থেকে অনেকটা এগিয়ে গেছে!


আমিও দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। কিন্তু লোকটাকে কিছুতেই দেখতে পেলাম না। মনের মধ্যে এতোক্ষণ যে নিরবতা বিরাজমান ছিল সেটা এখন ভয়ে পরিণত হয়েছে।


আমি হাঁটার গতি কমিয়ে নিয়ে এক’পা দু’পা করে হাঁটছি। ঝিঁঝিঁপোকার তীব্র আওয়াজও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। চারপাশের পরিবেশ এতোটা নীরব হয়ে এসেছে যে গাছ থেকে একটা পাতাও পড়লে সে শব্দ ভালোভাবেই শোনা যাচ্ছে।


হাতে থাকা সিগারেট কখন যে নিবে গেছে বুঝতে পারিনি। হঠাৎ পিছন থেকে কারো পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি সাথে সাথে হাঁটা বন্ধ করে থমকে গেলাম। আবারও সেই নীরবতা, কোনো শব্দ নেই। নাক বেয়ে কপালের ঘাম ফোঁটা ফোঁটা হয়ে পড়ছে। পিছনে ঘুরে তাকানোর শেষ সাহসটুকু এতক্ষণে হারিয়ে ফেলেছি। আমি জানি না আমার সাথে কী হতে চলছে!


আমি আবারও ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলাম। আমার পেছন থেকে আবার পায়ের শব্দ ধেয়ে আসলো। আমি এবার হাঁটা থামাই নি। ভালোভাবেই বুঝতে পারছিলাম আমার পিছনে কেউ না কেউ তো আছে যে আমাকে অনুসরণ করছে। মাথার মধ্যে নানান আজেবাজে চিন্তা আসতে লাগলো। আসবেই না বা কেন! পৃথিবীতে এ ধরণের জঙ্গল নিয়ে অদ্ভুত যত জল্পনা কল্পনার শেষ নেই।


আমি কিছুটা দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। হঠাৎ পেছন থেকে কিছুর আওয়াজ শুনে বুকটা ধুকধুক করতে লাগলো। কারো গলার আওয়াজ। এবার ভালোভাবে শোনা গেল, “কী স্যার! এখন তো দেখি ভালোই হাঁটতে পারছেন” সাথে সাথে পিছনে তাকিয়ে দেখলাম সেই লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছে করছে রিভলবার বের করে এক রাউন্ড গুলি ওর মাথায় চালিয়ে দিই।


– এই যে, আপনি কোথায় মিলিয়ে গিয়েছিলেন?


 – এইতো স্যার একটু দুই নাম্বার ধরেছিল। কাজ সারতে সারতে আপনি আমাকে পেছনে ফেলে চলে আসেন। ভয় পেয়েছেন?


 – আরে নাহ। রাখো এসব। একটা জিনিস বলো তো, এতো রাতে তুমি এই জঙ্গলে কী করতে এসেছিলে?


– আমি জঙ্গলে আসি না স্যার, জঙ্গল’ই আমার কাছে চলে আসে।


– কী বলতে চাও?


– মানে স্যার, এই জঙ্গলের এক কোণে আমার ঘর। তাই রাত বে’রাত এই জঙ্গলেই আমার চলাচল।


– এখানে একা থাকো?


– জঙ্গলে কেউ একা থাকে না স্যার। চাইলেও পারবেন না এখানে একা থাকতে। প্রকৃতি আপনাকে ঘিরে রাখবে। আপনাকে নিয়ে খেলায় মত্ত হবে এই নিষ্ঠুর প্রকৃতি।


লোকটা কী না কী বলেই চলেছে! ওর সব কথার মানে বোঝার সময় আমার হাতে নেই। তাই ওর সাথে আর কথাও বাড়াতে চাই না। কোনোভাবে লাশটা দেখে এখান থেকে বের হতে পারলেই হলো।


পুলিশ হলেও সব কিছুর পরে আমিও একজন মানুষ। আর ভয় হচ্ছে এমন একটা জিনিস যার কাছে সাহসিকতা অতি তুচ্ছ হয়ে ওঠে মাঝেমাঝে।


আমি ওকে ইশারা দিয়ে আমার সামনে যেতে বললাম। লোকটা যতই অদ্ভুত হোকনা কেন, ওকে আবার সাথে পেয়ে ভয় কিছুটা হালকা হয়েছে। আবারও ঝিঁঝিঁপোকার ডাক তীব্রভাবে শোনা যাচ্ছে। শিয়ালগুলো যখন আচমকা ডেকে উঠে তখন কয়েক সেকেন্ডের জন্য গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। ফোর্স সাথে নিয়ে আমি জঙ্গলে আরো কয়েক বার এসেছি। কিন্তু এই অনুভূতিটা ভিন্ন।


জঙ্গলে আসার বেশিক্ষণ না হলেও মনে হচ্ছে কয়েক ঘন্টা থেকে আমি হেঁটেই চলেছি। লোকটাকে অনুসরণ করে ওর সাথে যাচ্ছি আর যাচ্ছি। জানি পথটা বেশিদূর না, কিন্তু আমার কাছে সেটা অনেক দূরের রাস্তা। লোকটার কথার মর্ম আমি এখন বুঝতে পারছি। এখানে ভয় পেয়ে গেলে কয়েক মিনিটের রাস্তা অনেক দূরের মনে হয়।


হঠাৎ অদ্ভুতভাবে পরিবেশটা আবারও নীরব হয়ে এলো। মনে হচ্ছে জঙ্গলের সব ঝিঁঝিঁপোকা আর শিয়াল একসাথে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমাদের দু’জনের হাঁটার শব্দই শুধু শোনা যাচ্ছে। প্রকৃতি যেন এক নিমিষেই আবার থমকে গেলো। গাছের পাতা পর্যন্ত নড়ছে না। সবকিছুই যেন অদ্ভুতভাবে হচ্ছে। কখনো বাতাস, ঝিঁঝিঁপোকা আর শিয়াল জঙ্গলটাকে মাতিয়ে রাখছে। আবার কখনো নিমিষেই নেমে আসছে নীরবতা।

 

হঠাৎ এইরকম একটা সুনশান নিরবতা কীসের ঈঙ্গিত বহন করে আমি জানি না। আবারও নীরবতা ভাঙলো। তবে প্রকৃতি এখনও নিরব হয়ে আছে। লোকটা করুণ সুরে একটা পাহাড়ি গান ধরলো। চারদিকের নীরবতা ওর গানের প্রতিধ্বনি এমনভাবে ফুটিয়ে তুলছিল যেন মনে হচ্ছে ওর সাথে আরো অনেকজন গান করছে। আমি ভাবতেই পারি না, লোকটা কীভাবে এতো নরমাল থাকতে পারে! এরকম একটা পরিবেশ তার উপর আমরা এখানে একটা লাশের খোঁজ পেয়ে এসেছি আর সে গান গাইছে।


লোকটা গান থামিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলো। আমিও ওর পিছনে দাঁড়িয়ে আছি। কিছু একটার পচা গন্ধ নাকে আসছে। মনে হচ্ছে দুর্গন্ধটা কাছেই কোথা থেকে আসছে। লোকটা ধীরে ধীরে আমার দিকে ঘুরতে লাগলো। ওর অঙ্গভঙ্গি কেমন অস্বাভাবিক লাগছে আমার কাছে।


যখন সে পুরোপুরি আমার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো আমার তখন জ্ঞান হারানোর অবস্থা। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। এরকম একটা দৃশ্য দেখার পর আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে এতোক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতো। লোকটার গলা থেকে অজস্র রক্ত বেয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি কেউ ছুরি দিয়ে ওর গলার শিরা কেটে দিয়েছে।


ওর পরনে থাকা সাদা শার্ট রক্তে ভিজে পুরো লাল হয়ে গিয়েছে। ভয়ের পাশাপাশি অনেকটা অবাক হচ্ছি আমি, রক্তে লোকটা একাকার হয়ে যাচ্ছে তবুও ওর মুখে মৃদু হাসি। লোকটা ওর রক্তে ভেজা শার্টের পকেটে বার বার হাত ঢুকিয়ে আমাকে যেন কিছু বুঝাতে চাইছিল। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। সে এবার ওর আঙুল দিয়ে ইশারা করে আমাকে আমার ঠিক ডানদিকে যেতে বললো।


আমি বুঝতে পারছি না এখন আমার কী করা দরকার! হঠাৎ লোকটার এ অবস্থা কীভাবে হতে পারে সেটা ভেবে পাচ্ছি না! সে আমাকে আমার ডান দিকে যাওয়ার জন্য ইশারা করেই চলেছে। আমি শেষ বার ওর দিকে তাকিয়ে ওদিকে যেতে লাগলাম। লোকটার মুখে তখনও সেই মৃদু হাসি। আমি যত সেদিকে যেতে লাগলাম ততই দুর্গন্ধ বাড়তে লাগলো। হঠাৎ আমার পা কিছুতে আটকে গেলো।


নিচে তাকিয়ে যা দেখলাম তা আমার হৃদ স্পন্দন আগের থেকে দ্বিগুণ করে দিল। একটা লাশ পড়ে আছে। আর সেটা থেকেই এতোক্ষণ দুর্গন্ধ আসছিল। লাশের মুখ নিচের দিকে করা ছিল। আমি লাশটাকে উপর দিকে করার চেষ্টা করলাম। দেখেই বুঝা যাচ্ছে খুনটা করার কিছুদিন চলে গেছে। বডিটাতে পচন ধরে গেছে। তাই সহজে উপর দিকে করা যাচ্ছিল না। কোনোভাবে সেটাকে উপর দিকে করলাম। পকেট থেকে লাইটার বের করে জ্বালিয়ে বডিটার মুখের দিকে মারতেই যা দেখলাম তাতে আমি সঙ্গে সঙ্গে লাশ থেকে কয়েক পা পেছনে সরে এলাম।এতোটা অবাক আমি আর কোনদিন হইনি। ওকে গলা কেটে খুন করা হয়েছে।


এটা সেই লোক যার সাথে আমি এই গভীর জঙ্গল অব্দি এসেছি। লোকটা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে গিয়ে আর ওকে খুঁজে পেলাম না। সবকিছু মাথায় কেমন ঘুলিয়ে যাচ্ছে। ঠিক তখন মনে হলো সে ওর পকেটে হাত দিয়ে আমাকে কিছু বুঝাতে চাচ্ছিল। আমি আবার লাশটার কাছে গেলাম। ওর পকেটে হাত ঢুকিয়ে কিছু একটা পেলাম।


একটা কাগজ। সাদা শার্ট আর সাদা না রইলেও কাগজটা এখনো ধবধবে। কাগজটা খোলার পর বুঝতে পারলাম এটা একটা চিঠি। লাইটারের আলোয় যা লিখা ছিল পড়ে নিলাম। হ্যাঁ, চিঠি ঐ লোকটা তার পরিবারের জন্য লিখেছিল। চিঠিটিতে একটা ব্যাংকের নাম আর কয়েকটা লকারের নাম্বারও লিখা ছিল। বুঝতে বাকি রইলো না লোকটা আমাকে দিয়ে কী করিয়ে নিতে চায়।

কি অদ্ভুত জীবন, তাই না। এত কষ্ট করে নিজের জীবন বাজি রেখে অর্থ উপার্জন করলো, কিন্তু সেটাও নিজের লোকেদের হাত অবধি পৌছতে পারলো না। বাধ্যতামূলক ভাবে আত্মারও মুক্তি হল না। অশরীরী আত্মা হয়ে সম্পদের হাত বদলের লোক খুঁজে বেড়াতে হচ্ছে, সত্যিই দুঃখজনক।


 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract