কঠিন বাস্তবকে জয়
কঠিন বাস্তবকে জয়


সকাবেলা ঘুম চোখে বিছানা ছেড়ে যখন ই মাটিতে পা'টা রাখতে যাবে তৃসা শুনতে পেল বৌদি মাকে বলছে-
"শুনুন মা, আমরাও তো মানিয়ে গুছিয়ে সংসার করছি নাকি, তৃসার অত তেজ কিসের শুনি? আর ও তো আর একা নেই, পেটের টার কথা চিন্তা করেও তো নিজের শ্বশুরবাড়ি থাকতে পারতো;"
কথাগুলো তৃসার কানে আসতেই ওর বুকটা যেন কষ্টে হা হুঁতাশ করে ওঠে।
দুবছর আগে তৃসা ভালোবেসে বিয়ে করেছিল অভিষেককে। বিয়ের বছর খানিক যেতে না যেতেই ওর মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষ্য করে তৃসা। অনেক খোঁজখবর নিয়ে ও জানতে পারে, অভিষেক অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে যুক্ত হয়েছে। অভিষেকের বাড়ির লোকও সব সময় ছেলের প্রশংশায় পঞ্চমুখ। বৌমার ভালো মন্দে তাদের কিছু এসে যায় না। তাও তৃসা দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করে শ্বশুরবাড়িতেই পড়ে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু সমস্যাটা হল সেদিন, যেদিন তৃসা মা হতে চলেছে এই খবরটা সবার সামনে আসে। অভিষেক কিছুতেই এই সন্তান চায় না। ও বারংবার তৃসাকে এই সন্তান নষ্ট করে দেওয়ার কথা বলে। একদিন তো তৃসার গায়ে হাতও তোলে এর জন্য। ব্যস্!আর চুপ করে থাকতে পারেনি তৃসা। সোজা ব্যাগপত্র গুটিয়ে বাপেরবাড়ি চলে এসেছে। বিয়ের আগে যে চাকরিটা ও করতো, সেটা আবার ফিরে পাওয়ার জন্য নানা জায়গায় ফোন করে চেষ্টা চালাতে থাকে। ও ভাবে বাচ্চাটা হয়ে গেলেই মা'র কাছে ওকে রেখে সেখানেই চাকরিটা আবার করবে। কিন্তু যত সহজে সব কিছু ভাবা যায়, তত সহজে কি আর সব হাতের মুঠোয় পাওয়া যায়! সে পথ যে অনেক কঠিন। এখন ওর প্রায় ছয় মাস চলছে। উঠতে,চলতে,বসতে একটা কষ্ট শুরু হয়েছে ওর। পেটের নীচটাও বেশ ভারী হয়ে উঠছে। ও ভেবেছিল বিয়ের আগে যেরকম আদুরিপনায় বাপেরবাড়িতে বড় হয়েছিল, এখনো বাপেরবাড়িতে সেরকম আদরেই থাকবে। কিন্তু কয়েকদিন একটানা থাকার সাথেই সাথেই ও বুজতে পারে, বাপের বাড়িতে নিজের লোকগুলোর সাথে কেরকম একটা সম্পর্কের দূরত্ব তৈরি হয়েছে, এমনকি সেটা নিজের মা-বাবার সাথেও বিদ্যমান। যে বৌদি কিনা ননদ অন্ত প্রাণ ছিল একসময়, সেও কানা ঘেঁষায় ওর নামে কথা বলতে শুরু করেছে।
তৃসা বৌদির কথাগুলো এড়িয়েই সামনে আসতে সবাই চুপ করে যায়। মা তৃসার সাথে দুটো ভালো কথা না বলেই চা-জলখাবারটা দিয়ে রান্নাঘরের কাজে লেগে পড়ে। বেচারি, তৃসা। বড্ড অসহায় লাগছে ওর। সবার ব্যবহারে ওর আর বুঝতে বাকি নেই যে, ও সকলের কাছে বিশাল বড় বোঝা হয়ে উঠেছে। বারংবার ওর মনে হতে থাকে-' হায়রে নারী! কি তোর কপাল!'
শীতের দুপুরে খাবার খেয়ে সকলে যখন ঘরে বিশ্রাম নিতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই তৃসা ওর মা-বাবার ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দেখে ওঁরা ঘুমচ্ছে। কেউ ঘুমালে যে তাকে প্রণাম করতে নেই! তাই দূর থেকেই ও মা-বাবাকে প্রণাম জানায়। বৌদির ঘরে গিয়ে দেখে, বৌদি আর তাতানটাও ঘুমাচ্ছে। ভাইপো তাতানটাকে যে বড় ভালোবাসে ও। মনটা বড় কাঁদছে ওর জন্য। দাদা তো অফিসে, তাই আর তৃসার দেখা হল না ওর সাথে। কাউকে কিচ্ছু না বলে তৃসা চুপিসারে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়ে। এ জীবন আর ও রাখবে না, ঠিকই করে ফেলেছে। কিন্তু মৃত্যুর কোন পথটা সহজ হবে তা ওর জানা নেই। ছোটবেলা থেকে একটু ব্যাথা পেলেই ওকে নিয়ে সকলের কষ্টের সীমা থাকতো না। কিন্তু আজ ওর জীবন যন্ত্রনার দাম কেউ দিল না।
সাত পাঁচ ভেবে ও বাড়ির কাছের স্টেশনটাতে গিয়েই দাঁড়ালো। এই স্টেশনটাতে ভিড় খুব একটা ভিড় থাকে না। তাও ও স্টেশনটার একদম ফাঁকা জায়গা দেখেই দাঁড়ালো। যদি কেউ সন্দেহ করলেও ওকে বাঁচাতে না পারে। পর পর দুটো ট্রেন লাইন ধরে চলে গেল। তখন ও ও ওর স্মৃতির পাতাগুলো একবার করে উল্টে দেখে নিচ্ছে। তবে এবার আর অপেক্ষা না। সন্ধ্যে হয়ে এলো। বাড়ির লোকও হয়ত এরমধ্যে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে। ঐ তো আরেকটা ট্রেনের হুঁইশল শোনা যাচ্ছে। ও পা'টা বাড়াতে যাবে, ঠিক তখনই পেটের মধ্যে কোলজে মোচড়ানো লাথি। ও নিজের পা দুটো আবার ধীরে ধীরে পেছনে ফেলে স্টেশনের চেয়ার'টায় বসে পড়ল। এক্সপ্রেস ট্রেনটাও ততক্ষণে স্টেশন ছাড়িয়ে চলে গেল। তৃসার আর লাইনে ঝাঁপ দেওয়া হল না। তৃসা বুঝতে পারে, এই জীবনকে ও অত সহজে শেষ করে দিতে পারেনা। গর্ভের সন্তানটা প্রথমবার এইভাবে লাথি মেরে তৃসাকে আজ বুঝিয়ে দিল যে ও এই পৃথিবীতে আসতে চায়। তৃসা দেখে স্টেশনে কতগুলো গরীব বাচ্চা একসাথে খেলছে। তারা, তাদের বাবা-মায়েরা শত কষ্টের মধ্যে বেঁচে আছে। কৈ;তারা তো মরে যাওয়ার কথা ভাবছে না। তাহলে ও কেন? তবে তৃসা ঠিক করে নেয়, ও আর শ্বশুরবাড়িতে ফিরে যাবে না। এমনকি বাপেরবাড়ি থেকেও যখন একবার বেড়িয়ে এসেছে সেখানেও আর ফেরৎ যাবে না। ওর কলেজের পাশে যে নারী সংগঠনটার কথা ওর বান্ধবী বলেছিল, সেখানেই যোগাযোগ করবে। ওরা তো মেয়েদের অল্প স্বল্প কিছু কাজ দিয়ে থাকারও ব্যবস্থা করে দেয়। আজ রাত্রিটা নয় এই স্টেশনেই কোনরকমে কাটিয়ে নেবে। সাথে তো হাতের সোনার বালাটা আছেই। তবে তৃসার কাছে কাজটা খুব কঠিন। তবে ও পারবে। নারীরা যে কঠিনকে সহজ করতে জানে। ঐ তো আকাশে একটা নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। মাতা মেরি'ও তো একদিন এই উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখে নিশ্চিত হয়েছিল যে, যীশু আসছে। আজ তৃসাও নিশ্চিত। কঠিন বাস্তবও যে অনেক সময় সহজভাবে ধরা দেয়।